প্রাচীন পৃথিবীর অনেক কিছুই আজও রহস্যময় রয়ে গিয়েছে। মিশরের আশ্চর্য সব পিরামিড থেকে শুরু করে ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানসহ প্রাচীন বহু স্থাপত্যই এখনো মানুষের কাছে অপার রহস্যময় হয়ে রয়েছে। আলেক্সান্দ্রিয়ার বাতিঘর তেমনি এক রহস্যের নাম।
আলেক্সান্দ্রিয়ার বাতিঘর ছিল প্রযুক্তিগতভাবে বিশাল এক বিজয়। এর স্থাপত্যকলা এমনই ছিল যে একে তখনকার সময়ে মডেল মেনে অন্য সকল বাতিঘর তৈরি হতো। প্রাসাদতুল্য এই বাতিঘর এর স্থাপত্যকলার কৌশলের জন্য প্রাচীন সপ্তমাশ্চর্যের তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছিল। প্রাচীনত্বের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ছিল এটি।
বাতিঘরটি তৈরি করা হয়েছিল ফারোস দ্বীপে। দ্বীপটি অবস্থিত ছিল মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া বন্দরের কাছে। পানির ওপর দিয়ে নির্মিত এক উঁচু পথের মাধ্যমে দ্বীপটি মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলো। সমসাময়িক লেখক পসিডিপ্পসের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, বাতিঘরটি মূলত নাবিকদের পথপ্রদর্শন ও নিরাপত্তার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। বাতিঘরটি জিউস সোটার (Zeus Soter) এবং গ্রিক সমুদ্রের দেবতা প্রোটিয়াসকে উৎসর্গ করা হয়েছিলো। প্রোটিয়াসকে ‘সমুদ্রের বুড়ো’ (Old man of the Sea) বলেও উল্লেখ করা হতো।
বাতিঘরটি একসময় মিশরের পিরামিডের পর সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা ছিলো। আলেক্সান্দ্রিয়া শহরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট। মিশরের দীর্ঘতম নীল নদের পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় এবং শহরের ধারে প্রাকৃতিক বন্দর হওয়ার কারণে শহরটি দ্রুত বাণিজ্যিক বন্দরনগরী হিসেবে উন্নতি লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে তৎকালীন মিশরের রাজা সোটার (১ম টলেমি বলেও তাকে অভিহিত করা হয়। তার বংশের শাসনামল টলেমি রাজবংশের শাসন হিসেবে খ্যাত, যা প্রায় তিন শতাব্দী যাবত বজায় ছিলো।) তার ক্ষমতা ও মহিমা প্রদর্শনের স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন এবং আলেক্সান্দ্রিয়াতে চলাচলকারী জাহাজসমূহকে তাদের চলাচলের পথ সঠিকভাবে প্রদর্শন করার জন্য এক বিশাল বাতিঘর ভবন স্থাপন করার অনুমোদন দেন।
বাতিঘরটি তৈরি করা শেষ হয় এই প্রকল্প গ্রহণ করার প্রায় ২০ বছর পর, ২য় টলেমির রাজত্বকালে। বিভিন্ন প্রাচীন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, বাতিঘরটির স্থপতি ছিলেন সস্ট্র্যাটাস অফ নিডাস। ১ম টলেমি ও তার ছেলের সাথে সস্ট্র্যাটাসের খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিলো বিধায় তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিলেন। তথ্যসূত্রগুলো খুবই দুর্লভ এবং এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা না থাকায় স্থপতি সম্পর্কে জানা যায় খুব কম। কিছু তথ্যসূত্র আবার বলে, সস্ট্র্যাটাস শুধু এই প্রকল্পকে অর্থায়ন করেছিলেন। এটাও শোনা যায় যে, তার কাজে গর্বিত হয়ে তিনি এই স্থাপত্যটির গায়ে তার নাম খোদাই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২য় টলেমি এই স্থাপত্যের গায়ে কেবল তার নিজের নাম খোদাই করার ইচ্ছা থেকে সস্ট্র্যাটাসের নাম খোদাই করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। সস্ট্র্যাটাস খুবই চালাকি করে তার নিজের নাম এই বাতিঘরে খোদাইয়ের মাধ্যমে নিম্নোক্ত বর্ণনাটির মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করেন।
“SOSTRATUS SON OF DEXIPHANES OF KNIDOS ON BEHALF OF ALL MARINERS TO THE SAVIOR GODS”
এই লিপিটির ওপর প্লাস্টার করে সেই প্লাস্টারের ওপর টলেমির নাম খোদাই করা হয়। সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে প্লাস্টারটি পুরাতন হয়ে যেতে থাকে। সস্ট্র্যাটাস ও টলেমি দুজনই মারা যাবার পর একসময় প্লাস্টারটি পুরো ভেঙে গেলে সস্ট্র্যাটাসের কৃতিত্ব প্রকাশ পায়।
বাতিঘর সম্পর্কে কিছু কিছু বর্ণনা থেকে জানা যায়, বাতিঘরের শীর্ষে একটি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছিল। ভাস্কর্যটি সম্ভবত সূর্যদেবতা হিলিওসের রূপে ১ম টলেমি সোটার বা আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটকে চিত্রিত করেছিলো। যদিও বাতিঘরটি অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত ছিল, কিন্তু ৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এটি প্রাচীন আশ্চর্যসমূহের তালিকায় ঠাঁই পায়নি (পূর্ববর্তী তালিকায় বাতিঘরটির পরিবর্তে ব্যাবিলনের দেয়ালের কথা উল্লেখ করা ছিলো)। মধ্যযুগে সুলতান আহমেদ ইবন তৌলুন বাতিঘরটিকে একটি ছোট মসজিদ হিসেবে পরিণত করেন। দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাতিঘরটি সগর্বে তার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। ১৪৭৭ শতাব্দীতে মামলুক সূলতান কা’ইত বে এর ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি দুর্গ তৈরি করেন।
বাতিঘরটি উচ্চতায় ৩৫০ ফুটেরও (১১০ মিটার) বেশি ছিলো বলে এর বর্ণনাসমূহ থেকে জানা যায়। সে সময় মানুষ দ্বারা নির্মিত এর চেয়ে বেশি উচ্চতাবিশিষ্ট একমাত্র স্থাপনা ছিলো গিজার পিরামিড। উপকূলের ধারের এক চূনাপাথরের খনি থেকে প্রাপ্ত চুনাপাথর দ্বারা বাতিঘরটি তৈরি হয়েছিলো। বাতিঘরটির গঠনপ্রণালি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা যায় হারম্যান থিয়েরশের ১৯০৯ সালের একটি গবেষণা (Pharos, antike, Islam und Occident) থেকে। থিয়েরশের আলোচিত প্রাচীন তথ্যসূত্রসমূহ থেকে জানা যায় যে, বাতিঘরটিকে মোট তিনটি ধাপে বানানো হয়েছিলো, যার সবগুলোই কিছুটা ঢালু হয়ে বাতিঘরের অভ্যন্তরের দিকে চলে যায়। এর সবচেয়ে নিচু পর্যায় ছিলো বর্গের মতো, দ্বিতীয় পর্যায়কে তৈরি করা হয়েছিলো অষ্টকোণাকৃতির করে, এবং বাতিঘরটির তৃতীয় পর্যায় তৈরি হয়েছিলো নলাকৃতিতে। বাতিঘরটির চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য একটি চওড়া সর্পিল রাস্তা বানিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
এর চূড়ায় সারারাত ধরে আগুনের বাতি জ্বালিয়ে রাখা হতো। খুবই জোরালোভাবে এ আগুন দিন-রাত সবসময় সতর্কতা ও রক্ষণাবেক্ষণের সাথে জ্বালিয়ে রাখা হতো। এই আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে কাঠ সবসময় বাতিঘরের প্রথমতলায় মজুদ করা থাকতো। দিনের বেলায় আগুন থেকে বের হওয়া ধোঁয়া ও রাতের বেলায় আগুনের উজ্জ্বলতার মাধ্যমে নাবিকেরা বুঝতে পারতো বাতিঘরটা কোনদিকে অবস্থিত। আলেক্সান্দ্রিয়ার বাতিঘরের চারপাশে প্রায় ৫০ কিলোমিটার অঞ্চল পর্যন্ত দৃশ্যমান ছিল।
বাতিঘরটি ঐতিহাসিক নথি থেকে মুছে যায় আনুমানিক চতুর্দশ শতকের পরের দিকে, সম্ভবত ১৩৩০ সালের এক ভূমিকম্পে পানিতে ধ্বসে পড়ার পর। উল্লেখ্য, এর আগেও বাতিঘরটির আশেপাশে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছিল, যেগুলো বাতিঘরটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরবর্তীতে গবেষণার সময় নৌ প্রত্নতাত্ত্বিকরা বাতিঘর অঞ্চলে চল্লিশটিরও বেশি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন।
১৯৯৪ সালে আলেক্সান্দ্রিয়ান অধ্যয়ন কেন্দ্রের (Centre d’Etudes Alexandrines) প্রতিষ্ঠাতা প্রত্নতত্ত্ববিদ জন-ইভস এমপেরার ফারোস দ্বীপের তলায় কিছু চমকপ্রদ জিনিস খুঁজে পান। ওই অঞ্চলে একটি বাঁধ তৈরি করার আগে মিশরীয় সরকার সমুদ্রগর্ভে যদি প্রত্নতাত্ত্বিক তাৎপর্যপূর্ণ কিছু থেকে থাকে, তবে তা শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে তাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। তিনি কয়েকশ’ রাজমিস্ত্রির তৈরি গাঁথুনি খুঁজে পেয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, ত্রয়োদশ শতকে যখন বাতিঘরটি ধ্বংস হয়ে যায়, তখন এই গাঁথুনিগুলো সমুদ্রের পানিতে ডুবে গিয়েছিল।
এছাড়াও একটি ভাস্কর্য খুঁজে পাওয়া যায়, ২য় যাকে টলেমির চিত্রিত ভাস্কর্য বলে ধারণা করা হয়। ১৯৬০ সালে ওই এলাকা থেকে আইসিসের রূপকে চিত্রিত করা এক রানীর ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কারগুলোকে কেন্দ্র করে এবং এদের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝার পর মিশরের সরকার ওই অঞ্চলে বাঁধ তৈরির চিন্তা ত্যাগ করে। সে জায়গায় তারা এক আন্ডারওয়াটার পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করে, যেখান থেকে ডুবুরিরা এই প্রত্নতাত্ত্বিক ভাস্কর্যসমূহ, যেমন- স্টোন স্ফিংস (stone sphinxes) এবং বাতিঘরের অবশিষ্টাংশ দেখতে পারবে।