সেইন্ট পিটারের হাত ধরে ৩৩ খ্রিস্টাব্দে পোপদের যে শাসন তথা পাপাসি (Papacy) শুরু হয়েছিলো, বর্তমান পোপ ফ্রান্সিসের হাত ধরে তা আজও অব্যাহত রয়েছে। মাঝখানে চলে গেছে প্রায় ১,৯৮৪টি বছর, বিশ্ব দেখেছে সর্বমোট ২৬৬ জন পোপের যাওয়া-আসা। তবে তাদের সবাই যে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে পেরেছিলেন এমনটা ভুলেও ভাবা যাবে না। বিষ প্রয়োগ, পাথর ছুঁড়ে মারা, হাতুড়ি দিয়ে আঘাত, ক্রুশবিদ্ধকরণ, অনাহার ইত্যাদি নানাবিধ উপায়ে বিভিন্ন সময় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে ক্যাথলিক চার্চের এ নেতাদের।
আজকের এ লেখায় তেমনই কতজন পোপের নির্মম অন্তিম পরিণতির কথা উঠে এসেছে।
পোপ সেইন্ট পিটার
যিশু খ্রিস্ট তাঁর বাণী প্রচারের জন্য যে বারোজন শিষ্যকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের একজন ছিলেন সেইন্ট পিটার। তখন চলছিলো সম্রাট নিরোর সময়কাল। তিনি আবার খ্রিস্টানদের বেশ তুচ্ছজ্ঞান করতেন। এ অবজ্ঞা এতটাই গভীরে পৌঁছেছিলো যে ৬৪ খ্রিস্টাব্দে রোমে সংঘটিত ঐতিহাসিক অগ্নিকান্ড, যা গ্রেট ফায়ার অফ রোম নামেও পরিচিত, এর জন্য তিনি খ্রিস্টানদের দায়ী করেন।
জান বাঁচাতে পিটারও পালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কথিত আছে যে, তখন তিনি স্বপ্নে যিশু খ্রিস্টের দেখা পান, যিনি তাকে রোমে ফিরে গিয়ে শহীদ হবার নির্দেশ দেন। এ ঘটনার শতবর্ষ পরে রচিত বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায় যে, সেইন্ট পিটার ফিরে গিয়ে অনুরোধ করেছিলেন তাকে যেন ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, তবে উল্টো করে। তাহলে তিনি দীর্ঘসময় যন্ত্রণা সহ্য করে মারা যাবেন এবং এটা যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধকরণের মতো হবে না। এভাবে ক্রুশবিদ্ধকরণের মাধ্যমেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো প্রথম পোপ সেইন্ট পিটারের। বেশ কিছু ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন, ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা আসলে প্রথম পোপের সমাধিস্তম্ভের উপরই নির্মিত।
পোপ প্রথম সেইন্ট ক্লেমেন্ট
৮৮ থেকে ৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পোপের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রথম সেইন্ট ক্লেমেন্ট। তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি একটা তথ্য জানা যায় না।
কিংবদন্তী থেকে জানা যায় যে, রোম থেকে নির্বাসিত হবার পর তাকে একটি পাথরের খনিতে কাজ করতে পাঠানো হয়। সেখানে কাজ করতে করতে একদিন তিনি দেখতে পান তার সঙ্গী অন্যান্য বন্দীরা পানিশূন্যতায় ভুগছে। সাথে থাকা মানুষগুলোর এমন কষ্ট সহ্য করতে পারলেন না তিনি, হাঁটু গেড়ে বসে গেলেন স্রষ্টার কাছে একাগ্র প্রার্থনায়। কিছুক্ষণ পর দূরের এক পাহাড়ের উপর একটি ভেড়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি।
এরপর সাথে কুঠার নিয়ে তিনি হেঁটে চললেন পাহাড়টির দিকে। এরপর ভেড়াটি যেখানে দাঁড়িয়েছিলো, ঠিক সে জায়গাটিতেই মাটিতে সজোরে কুঠার দিয়ে আঘাত হানলেন তিনি। সেই আঘাতের পরপরই জায়গাটি ফেটে গেলো এবং প্রবল বেগে পানি বেরিয়ে আসা শুরু করলো। এমন অলৌকিক ঘটনা আগে কেউই দেখে নি। তাই স্থানীয় অনেক জনগণ এবং ক্লেমেন্টের সাথে থাকা বন্দীরা জায়গার মাঝেই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে।
কিন্তু পোপের এমন কাজে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সেখানকার প্রহরীরা। তারা তাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। এরপর গলায় একটি নোঙর বেঁধে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় কৃষ্ণ সাগরে। ফলে পানিতে ডুবেই মারা যান এ পোপ।
পোপ প্রথম সেইন্ট স্টিফেন
২৫৪ সালের ১২ মে রোমের বিশপের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন পোপ প্রথম সেইন্ট স্টিফেন। ২৫৭ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুর আগপর্যন্ত এ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
চার্চের ভেতরে এবং বাইরে দু’জায়গাতেই তাকে ঘিরে বিতর্ক জমে উঠছিলো। পথভ্রষ্ট ক্যাথলিক এবং তাদের মতো অন্যান্যদের পুনরায় দীক্ষা দান করা হবে কিনা এমন প্রশ্নে চার্চের সাথে বিরোধের সূত্রপাত ঘটে তার। ওদিকে তৎকালে রোমের সম্রাট ছিলেন ভ্যালেরিয়ান। প্রথমদিকে তিনি খ্রিস্টানদের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণই প্রদর্শন করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার এ মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। তখন চার্চের বিরুদ্ধে দুটি অধ্যাদেশ জারি করেন তিনি। এমনই এক সময়ে একদিন নিজের চেয়ারে বসেছিলেন পোপ। হঠাৎ করে তার রুমে ঢুকে পড়লো একদল সৈন্য। এরপর বলা নেই, কওয়া নেই, এক কোপে তারা পোপের মাথাটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো!
জানা যায়, পোপের রক্তমাখা সেই চেয়ার আঠারো শতাব্দী পর্যন্ত চার্চে সংরক্ষণ করে রাখা ছিলো।
পোপ দ্বিতীয় সেইন্ট সিক্সটাস
পোপ প্রথম সেইন্ট স্টিফেন নিহত হন ২৫৭ সালের ২ আগস্ট। একই মাসের ৩১ তারিখ পোপের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন দ্বিতীয় সেইন্ট সিক্সটাস।
এ সময় সম্রাট ভ্যালেরিয়ান আইন জারি করে দেন যে, রোমান দেবতাদের স্মরণে অনুষ্ঠিত সকল আচার-অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে তার রাজ্যে বসবাসরত সকল খ্রিস্টানকে। সরকারের সাথে বিরোধ এড়াতে খ্রিস্টান অধিবাসীরা সেটাই করতো। তবে পোপ চাইলে সেসব অনুষ্ঠানে না আসলেও পারতেন।
কিছুদিন পর ভ্যালেরিয়ানের মন আবার বদলে গেলো। এবার নতুন অধ্যাদেশ জারি করলেন তিনি, দোষী সাব্যস্ত করা হলো পোপ, বিশপ ও অন্যান্য উপপুরোহিতদের। এরপর এলো ২৫৮ সালের ৬ আগস্ট। সেদিন বেদীতে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় উপদেশ দিচ্ছিলেন পোপ। হঠাৎ করে আবারো অনুপ্রবেশ ঘটে রাজার সৈন্যদের। পোপকে বন্দী করে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। সেদিন তার সাথে আরো ছয়জন উপপুরোহিতের মৃত্যুদন্ডও কার্যকর করা হয়েছিলো।
পোপ সপ্তম জন
৭০৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকেই পোপ হিসেবে যাত্রা শুরু করেন সপ্তম জন। তার দাদা ছিলেন একজন সিনেটর, বাবাও ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ফলে বেশ সম্ভ্রান্ত এক বংশ থেকেই আগমন ঘটেছিলো তার।
‘বাইজান্টাইন পাপাসি’ (Byzantine Papacy) চলাকালে পোপ হয়েছিলেন সপ্তম জন। তখন নিয়োগপ্রাপ্ত সকল পোপকেই বাইজান্টাইন সম্রাটের অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হতো, যেন তাদের কোনো সিদ্ধান্ত সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপন্থী না হয়। ফলে মাঝে মাঝেই পোপদের সাথে রাজদরবারের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হতো।
তবে আগে উল্লিখিত দুজনের মতো পোপ সপ্তম জনের মৃত্যুর জন্য তার রাজ্যের সম্রাট দায়ী ছিলেন না। শোনা যায়, বিবাহিতা এক নারীর সাথে গোপন সম্পর্ক ছিলো পোপের। দুর্ভাগ্যবশত একবার মহিলার স্বামী পোপকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। এরপর রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেন তিনি।
পোপ অষ্টম জন
পোপ অষ্টম জনকে অনেকেই তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ পোপ বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। তিনি যখন এ গুরুদায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন, তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার ছিলো না।
এমন নাজুক অবস্থায় পোপ যেকোনো মুহূর্তে যে প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন, সেটা অনুমান করা যাচ্ছিলো সহজেই। অষ্টম জনের হত্যাকাণ্ডটি কি পরিকল্পিত কোনো হত্যা ছিলো নাকি কেবল চার্চের সম্পদের প্রতি লোভ থেকে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা কখনো নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তার দায়িত্ব গ্রহণের দশ বছর দুই দিন পরের কথা। এক সন্ধ্যায় পোপের এক আত্মীয় এসেছিলো তার সাথে দেখা করতে। পোপের অগোচরে সেই লোকটি পোপের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়। পোপ সেই খাবারটি খেয়েও নেন সরলমনে। কিন্তু বিষের কাজ শুরু হতে যেন খানিকটা দেরি হচ্ছিলো। এটা দেখে লোকটি আর অপেক্ষা না করেই সাথে থাকা হাতুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত করে বসে পোপের মাথায়। সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
পোপ ষষ্ঠ স্টিফেন
পোপ হিসেবে ষষ্ঠ স্টিফেনের যাত্রা শুরু হয় ৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে। ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন তার পূর্ববর্তী আরেক পোপ ফর্মোসাসের মৃতদেহের বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য।
পোপ ফর্মোসাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছিলো। সেগুলোর সবগুলোই একে একে প্রমাণিত হয়। তখন দায়িত্বরত পোপ ষষ্ঠ স্টিফেনের নির্দেশে সাবেক এই পোপের মৃতদেহ থেকে পুরোহিতের যাবতীয় পোষাক খুলে ফেলা হয়, ডান হাতের তিনটি আঙুল কেটে ফেলা হয় এবং সবশেষে তার মৃতদেহটিকে টাইবার নদীতে ছুঁড়ে ফেলা হয়। এছাড়া তিনি যেসব অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, তার সবই বাতিল ঘোষণা করা হয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে স্টিফেনের এমন বিচারকার্য জনতাকে মারাত্মক ক্ষেপিয়ে তোলে। তারা তাকে বন্দী করে। ৮৯৭ সালের আগস্ট মাসে বন্দী থাকা অবস্থাতেই গলা টিপে খুন করা হয় তাকে।
পোপ দ্বাদশ জন
মাত্র আঠারো বছর বয়সে ৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পোপ হয়েছিলেন দ্বাদশ জন। তবে বিশাল এ দায়িত্বের সাথে চলে আসা বিধিনিষেধ তিনি মানতে পারেন নি কখনোই। জুয়া খেলা, চুরি, গুপ্ত হত্যা ও ইনসেস্টের মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। ‘A History of the Popes: From Peter to the Present’ বইটির লেখক জন ডব্লিউ. ও’ম্যালি তার সম্পর্কে বলেছেন, “ভোগ-বিলাসের প্রতি নেশা ও লাম্পট্যের কারণে দ্বাদশ জন তার সময়ের রোমান সমাজকে কলঙ্কিত করেছেন।” তার প্রতিপক্ষের একটি বড় অভিযোগ ছিলো যে, তিনি পোপের প্রাসাদকে একটি পতিতালয় বানিয়ে ছেড়েছেন!
৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে ছিলো দিনটি। এক নারীর সাথে তখন শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন পোপ। এমন পরিস্থিতিতেই হঠাৎ করে মৃত্যু ঘটে তার। এ মৃত্যু নিয়ে দু’ধরনের মতামত পাওয়া যায়। একটি মত অনুযায়ী সঙ্গমরত অবস্থায় হৃদরোগে ভুগে মারা যান পোপ। অপর মতানুসারে সঙ্গমরত অবস্থায় মহিলার স্বামীর কাছে ধরা পড়ে যান পোপ। তখন লোকটি তাকে রাগের মাথায় পিটিয়ে মেরে ফেলে।
পোপ ষষ্ঠ বেনেডিক্ট
৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ জনের মৃত্যুর পর পোপের দাবিদার ছিলেন বেশ কয়েকজন। হলি রোমান এম্পারর প্রথম অটোর অনুমতিক্রমে এক বছর পর সেই পদটি লাভ করেন ষষ্ঠ বেনেডিক্ট। মাত্র কয়েক মাস পরেই প্রথম অটো মারা গেলে জার্মান-বিরোধী একটি অংশ রোমে বিদ্রোহ করে বসে।
তারা সেইন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গে পোপ বেনেডিক্টকে অবরুদ্ধ করে রাখে এবং এন্টিপোপ সপ্তম বোনাফিসকে ক্ষমতায় বসায়। বোনাফিসের নির্দেশেই ৯৭৪ সালের জুন মাসে এক পুরোহিত স্বাসরোধ করে খুন করেন বেনেডিক্টকে।
বোনাফিসের শেষ পরিণতিও সুখকর ছিলো না। রহস্যজনকভাবে ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু ঘটে তার। তাকে জনগণ এতটাই অপছন্দ করতো যে মৃত্যুর পর তার শরীর থেকে পুরোহিতের পোষাক খুলে ফেলা হয়, উলঙ্গ দেহটিকে রাস্তা দিয়ে টেনেহিচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সর্বশেষ সেই দেহটিকে পোপের প্রাসাদের সামনে রেখে দেয়া হয় যেখানে লোকে তার মৃতদেহটিকে কিছুদিন পা দিয়ে মাড়িয়েছে এবং বর্শা দিয়ে ক্রমাগত খুঁচিয়ে গেছে।
পোপ চতুর্দশ জন
পোপ ষষ্ঠ বেনেডিক্টের মৃত্যুর এক দশক পরের কথা। হলি রোমান এম্পারর দ্বিতীয় অটোর সমর্থনে পোপের পদটি অধিকার করেন চতুর্দশ জন। কিন্তু ম্যালেরিয়ার সংক্রমণে জনের কোলেই মারা যান সেই সম্রাট। এরপরে আবারো প্রেক্ষাপটে আসেন এন্টিপোপ সপ্তম বোনাফিস।
বোনাফিসের নির্দেশে জনকে পিটিয়ে বন্দী করে রাখা হয় সেইন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গে। মাসাধিককাল সেই দুর্গে থেকে, অনাহার-অর্ধাহার-অপুষ্টিতে ভুগে ৯৮৪ সালের ২৯ আগস্ট মারা যান পোপ চতুর্দশ জন।