‘বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তি’ নিঃসন্দেহে একজন লেখকের জীবনে সবচেয়ে কষ্টকর অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি। লেখকের মেধা, শ্রম, সময় সবকিছুর চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার করে তৈরি করা একটি ব্রেইন চাইল্ড যখন অবলীলায় অন্য কেউ বিনা অনুমতিতে বা বিনা ক্রেডিটে নিজে নামে চালিয়ে দেয়, বিষয়টি তখন খুব ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই লেখাচুরির ব্যাপারটি এখন এতটাই ডাল-ভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এর ভয়াবহতা আমরা অনেকে বুঝতেই পারি না। শিক্ষার্থীরা হয়তো এ ধরনের কাজ করলে শিক্ষকের কাছে ধরা পড়ে ফেঁসে যায়, কিন্তু বিখ্যাত ব্যক্তিরাও যদি এমন কাজ করেন, তাহলে বিষয়টা কেমন হবে? ‘চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা’- কিন্তু সেই মহাবিদ্যায় ধরা পড়েছেন এমন পাঁচ বিখ্যাত ব্যক্তির অপকর্মের কাহিনী নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
ইসাবেলা বিটন
উনিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী এবং বেস্ট সেলিং একটি বই ‘মিসেস বিটন’স বুক অফ হাউজহোল্ড ম্যানেজমেন্ট’। শুধুমাত্র একটি রান্না বিষয়ক বই হওয়া সত্ত্বেও, পাঠকদের মধ্যে এটি এমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। কয়েক ডজন রেসিপি নিয়েই ইসাবেলা বিটন লিখে ফেলেছিলেন প্রায় ৯০০ পৃষ্ঠার একটি বই! বইয়ের শেষাংশে খুব ছোট করে মেডিকেল বিষয়াদির কৃতিত্ব এবং তথ্যসূত্র হিসেবে ‘একজন ভালো ডাক্তার’ এবং ‘উপদেষ্টার’ কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। ব্যস, উনবিংশ শতাব্দীতে ঝড় তোলার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল।
পরবর্তীতে সমালোচকরা আবিস্কার করেন দারুণ একটি তথ্য, ইসাবেলা বিটন তার বইয়ের প্রতিটি রেসিপি চুরি করেছেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, এলিজা অ্যাক্টনের মতো বিখ্যাত সব লেখকদের লেখা থেকে। চৌর্যবৃত্তির সময় তিনি এতটাই বেখেয়ালি ছিলেন যে, কোনো কোনো পুরুষ লেখকের লেখা চুরির পর তাদেরকে তিনি সম্বোধন করেছেন নারী লেখক ভেবে। পুরোপুরি লেখা চুরির দায় এড়াতে তিনি এমন অর্থহীন কিছু কথা ব্যবহার করেছেন, যা পাঠকের কাছে একেবারেই যুক্তিহীন মনে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি পাঠকদের ১০৫ মিনিট ধরে পাস্তা সেদ্ধ করতে বলেছেন!
মাত্র ২৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ইসাবেলা, কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে বিতর্কের ঝড় তখনো থামেনি। তার স্বামী স্যাম বিটন ইসাবেলার মৃত্যু সম্পর্কে পাঠকদের অন্ধকারেই রেখে দেন, আর নতুন করে বইটি পুনর্মুদ্রণ করতেই থাকেন। কখনো তাতে জুড়ে দেওয়া হয় নতুন কিছু তথ্যসূত্র, কখনো বা চলে রেসিপির কাঁটাছেঁড়া। পাঠকরাও মনে করতে থাকেন, ইসাবেলাই বইটি এখনো সম্পাদনা করে চলেছেন। ধীরে ধীরে এক সময় কমে যায় বইটির চাহিদা, আর বিরাট এক চৌর্যবৃত্তি ইতিহাসে বিলীন হয়ে যায় বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে।
জেসন ব্লেয়ার
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এর প্রতিবেদক জেসন ব্লেয়ারকে মোটামুটি অসাধারণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন লেখাচোর বলা যায়। তার কলেজ জীবন থেকে শুরু করে ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত প্রায় ৩৬টি আর্টিকেলে তথ্যসূত্রের উল্লেখ ব্যতীত লেখা কপি-পেস্টের নজির পাওয়া গেছে! প্রথমবারের মতো তিনি ধরা পড়েন সান অ্যান্টোনিও এক্সপ্রেস নিউজের সাংবাদিক ম্যাকার্না ফার্নান্দেজের কাছে। ব্লেয়ারের একটি লেখায় তিনি হুবুহু নিজের লাইন দেখে চমকে ওঠেন। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠিত হলে কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ভার্জিনিয়ার যে স্থানটি নিয়ে ব্লেয়ার প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন, আদৌ সেখানে তার পদধূলি পড়েনি!
জায়গাটি সম্পর্কে অন্য লেখকেরা কী লিখেছে তার উপর ভিত্তি করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই লাইনগুলোই তুলে দিয়ে নিজের মতো করে একটি প্রতিবেদন বানিয়ে ফেলেন তিনি। এর ফলে শুধু নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হননি ব্লেয়ার, তার কারণে চাকরিচ্যুত হন নিউ ইয়র্ক টাইমসের দুজন সম্পাদকও।
২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় ব্লেয়ারের আত্মজীবনী ‘বার্নিং ডাউন মাই মাস্টার’স হাউজ’। এখানে তিনি উল্লেখ করেন, এই মিথ্যা অপবাদ তাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করেছে। কোকেইনে আসক্তি তাকে এতটাই অসংলগ্ন করে ফেলে যে, একবার ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজনও বোধ করেননি ব্লেয়ার। প্রথম সপ্তাহে এই বইটি মাত্র ১,৪০০ কপি বিক্রি হলেও, কয়েক মাসের মধ্যে তা আড়াই লাখেরও বেশিবার ছাপানো হয়।
সাদ্দাম হোসেন ও তার পরিষদবর্গ
সাদ্দাম হোসেন এবং তার সরকার এত বেশি অপকর্মের সাথে লিপ্ত ছিল যে, তার তুলনায় লেখাচুরির বিষয়টিকে একেবারে নগণ্য অপরাধ বলে মনে হতে পারে। তবে ২০০৩ সালে সাদ্দাম সরকার এমন এক চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নেয় যে, নড়েচড়ে ওঠে গোটা বিশ্ব গণমাধ্যম।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইরাক সরকারকে দেশে মজুদকৃত অস্ত্রের বিবরণ সম্পর্কে লিখিত একটি প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়। এই নোটিশের বিপক্ষে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে প্রায় ১২,২০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পেশ করে ইরাক সরকার। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা কন্ডোলিৎসা রাইস নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, এই বিশাল প্রতিবেদনের বৃহদাংশ সরাসরি চুরি করা হয়েছে ইরাক সম্পর্কে জাতিসংঘের নিজস্ব প্রতিবেদন থেকেই।
সৌভাগ্যবশত, সাদ্দামের প্রেমের উপন্যাস ‘জাবিবা অ্যান্ড দ্য কিং’ এর বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কেউ চুরির অভিযোগ আনেনি।
রিচার্ড ওয়েন
খুব কম বৈজ্ঞানিকই রিচার্ড ওয়েনের মতো সহকর্মীদের চোখে এমন দারুণভাবে ছোট হয়ে যাওয়ার রেকর্ড রেখে গেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর এই জীববৈজ্ঞানিক ‘ডায়নোসর’ টার্মটি আবিস্কারের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি লন্ডনের ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম’ এর প্রতিষ্ঠাতা। চার্লস ডারউইনের শত্রু হিসেবেও খ্যাতি আছে রিচার্ড ওয়েনের।
ওয়েনের নামে বেশ কিছু স্থূল চুরির অভিযোগ আছে। তিনি প্রায়ই এমন সব ব্যক্তিদের লেখা চুরি করতেন, যারা তখনো বেঁচে ছিলেন আর প্রতিবাদ করার সামর্থ্যও রাখতেন। এই চৌর্যবৃত্তির মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মামলা ছিল ভূবিজ্ঞানী গিডিয়ন ম্যান্টেলের পক্ষ থেকে। ডায়নোসরের হাড় প্রথম আবিস্কার করেন ম্যান্টেল, কিন্তু অবলীলায় সেই লেখাগুলো চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেন ওয়েন। ওয়েন জর্জ কুভিয়ারের সাথে ইগুয়ানোডন আবিষ্কারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ভাগ করে নেন, কিন্তু প্রাণীটির প্রকৃত আবিস্কারক গিডিয়ন ম্যান্টেলের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। মূলত সহকর্মীদের ছোট করে দেখানোর প্রবণতা থেকেই এ ধরনের চুরিবিদ্যার আশ্রয় নিতেন তিনি।
অন্যের আবিস্কারকে নিজের বলে চালানোর কাজ অবশ্য ওয়েন এর আগে এবং পরে অনেকবার করেছিলেন। ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অফ নিয়ারলি এভরিথিং’ বইটিতে বিল ব্রাইসন এবং অন্যত্র বেশ কয়েকজন লেখকও বলেছেন যে, ওয়েন রয়্যাল সোসাইটিতে নিজের প্রভাব খাটিয়ে গিডিয়ন ম্যান্টেলের অনেক গবেষণাপত্রের প্রকাশ রুখে দিয়েছিলেন। অন্যের লেখা নিজের বলে চালানোর অভিযোগে শেষ পর্যন্ত তাকে রয়াল সোসাইটির প্রাণীবিদ্যা সংসদ থেকে বিতাড়িত হতে হয়। এ ব্যাপারে ম্যান্টেল বলেন, “এমন মেধাবী একজন লোক যে এত নীচ আর হিংসুক হতে পারে, এটা খুবই দুঃখজনক।”
জেমস এ. ম্যাকায়
আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত আত্মজীবনী সহ স্বনামে প্রায় একশোটিরও বেশি বই বের করেছেন জেমস ম্যাকায়। চুরিবিদ্যায় তিনি ছিলেন বিশেষভাবে পারদর্শী। ১৯৭২ সালে ব্রিটিশ জাদুঘরের পক্ষ থেকে ডাকটিকেটের প্রুফ চুরির দায়ে অভিযুক্ত হন ম্যাকায়। ৯০ এর দশকে লেখা চুরি নিয়ে রীতিমতো কলঙ্কিত অধ্যায়ের সৃষ্টি করার আগ পর্যন্ত এই মামলাটিকে অবশ্য খুব বেশি আমলে নেয়নি ব্রিটিশ সরকার।
১৯৯৭ সালে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী লেখক রবার্ট ব্রুস ম্যাকায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, তিনি আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের আত্মজীবনী ‘আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল: এ লাইফ’ বইটিতে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছেন। ম্যাকায় তার বইয়ে শতকরা ৯৫ ভাগ অন্যের লেখা ব্যবহার করেছেন বলে দাবি করেন তিনি। ব্রুস যেমন তার বইটিতে জাতীয় ভূগোল সংস্থাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ম্যাকায়ও তার বইতে সংস্থাটিকে ধন্যবাদ জানাতে ভুল করেনি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ম্যাকায় যখন বইটি লেখা শুরু করেন, তার আগ দিয়েই সংস্থাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়!
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘আই হ্যাভ নট ইয়েট বিগান টু ফাইট: এ লাইফ অফ জন পল জোনস’ বইটিতে তিনি উল্লেখযোগ্য হারে লেখা চুরি করেছেন। প্রকাশক আটলান্টিক প্রেস বাধ্য হয়ে বইটির প্রায় ৭,৫০০ কপি নষ্ট করে ফেলে। ম্যাকায় অবশ্য বারংবার দাবি করেছেন, একটি লেখাও তিনি সজ্ঞানে কপি-পেস্ট করেননি!