এখন সিআইএ ও লাতিন রাষ্ট্রগুলোর টার্গেট ব্যক্তি কারা কিংবা কাদের গুম/খুন/অপহরণ করা হবে, এই বিষয়টি খোলাসা করা যাক। অপারেশন কোন্ডোর হাতে নেয়ার পেছনে আমেরিকার মূলত কারণ ছিল লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সশস্ত্র গেরিলা হিসেবে থাকা বামপন্থী বিপ্লবীদের একেবারে সমূলে উৎপাটন করা, যাতে তারা সরকার উৎখাতের কোনো ষড়যন্ত্র করতে না পারে।
গেরিলা বাহিনীগুলো সোভিয়েত অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে– আমেরিকার ধারণা ছিল এরকম। অপরদিকে লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসকদেরও প্রধান শত্রু ছিল সশস্ত্র গেরিলা বিপ্লবীরা, কারণ এরাই তখন স্বৈরাচারী শাসক কিংবা সামরিক জান্তাদের উৎখাতের সংগ্রাম জারি রেখেছিল। অর্থাৎ বিষয়টি হলো, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যে সশস্ত্র বিপ্লবীরা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তারা আমেরিকার চোখে ছিল ‘পুঁজিবাদের শত্রু’ আর স্বৈরশাসক ও সামরিক জান্তাদের চোখে ছিল ‘রাষ্ট্রের শত্রু’। আমেরিকা এদের নির্মূল করতে চেয়েছিল মতাদর্শিক কারণে, আর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিরা এদের নির্মূল করতে চেয়েছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করার জন্য।
পরিকল্পনা অনুমোদন থেকে শুরু করে ডেথ স্কোয়াড গঠন কিংবা টার্গেট চিহ্নিতকরণ– সবকিছু হয়েছিল একেবারে গোপনে। এজন্য অপারেশন কোন্ডোর সম্পর্কে সেই সময়ে ভেতরের খবরাখবর কিছুই পাওয়া যায়নি। ডেথ স্কোয়াড গঠন, অপহরণকারী কিংবা হত্যাকারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া, সশস্ত্র বিপ্লবী নেতাদের উপর নজরদারি– সবকিছুই গোপনে করা হচ্ছিল। সেসময়ের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, প্রায় প্রতিটি লাতিন রাষ্ট্রই নিজেদের মধ্যে সব ধরনের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে একে অপরকে তথ্য দিয়ে বা কারিগরি সহায়তা দিয়ে এগিয়ে এসেছিল। দেখা গিয়েছে, আর্জেন্টিনার নিরাপত্তা বাহিনীর হাত থেকে কোনো বিপ্লবী হয়তো চিলিতে পালিয়েছে। সেক্ষেত্রে চিলির নিরাপত্তা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে আর্জেন্টিনার নিরাপত্তা বাহিনীর ডেথ স্কোয়াডকে খবর পাঠাত। এরপর আর্জেন্টিনা থেকে ডেথ স্কোয়াড চিলিতে এসে পরিকল্পনামাফিক বাকি কাজ সেরে ফেলত। লাতিন আমেরিকার সেই আটটি দেশের শত্রু ছিল অভিন্ন– কমিউনিস্ট ও গেরিলা সশস্ত্র যোদ্ধারা, যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
অপারেশন কীভাবে চালানো হয়েছিল– এই নিয়ে সরকারি কোনো ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট পাওয়া যায়নি। কারণ পুরো অপারেশনের সকল তথ্য গোপন রাখা হয়েছিল। তবে প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা সেসময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের বরাতে অপারেশন সম্পর্কে কিছু বিষয় জানা যায়। যেমন- সেসময়ে কমিউনিস্ট পার্টির অসংখ্য কর্মীদের অপহরণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে অপহরণের পর বেঁচে যাওয়া মানুষেরা সেই ভয়াল সময়ের স্মৃতিচারণ করেছিলেন। তাদের দেয়া তথ্যমতে, সেই আটটি লাতিন আমেরিকান দেশে গোপনে অনেক টর্চার সেল গঠন করা হয়েছিল। অপহরণ করা ব্যক্তিদের সেসব টর্চার সেলে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। জিজ্ঞাসাবাদে সহায়তা না করলে নির্মম অত্যাচারের ঘটনা তো ছিলই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিক্টিমদের গুম করে ফেলা হতো। শুধু অপহরণের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে আলাদা করে সুপ্রশিক্ষিত নিয়ে বিশেষ ইউনিট খোলা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ‘ডেথ স্কোয়াড’ নামে বিশেষ ইউনিট গঠন করে, যে ইউনিটের সদস্যদের প্রধান কাজ ছিল টার্গেট করা ব্যক্তিকে যেকোনোভাবে হত্যা করা।
একজন ভুক্তভোগী সম্পর্কে জানা যাক, যিনি এই ঘৃণ্য অপারেশনের কারণে তার বাবা-মাকে হারিয়েছেন। তাহলে এই অপারেশনের নির্মমতা সম্পর্কে একটু আঁচ পাওয়া যাবে। আনাতোলে লারাবেইতি নামের সেই মানুষটির বাবা-মাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তিনি মাত্র চার বছর বয়সী। তার বাবা ১৯৭৩ সালে উরুগুয়ে থেকে সপরিবারে পালিয়ে আর্জেন্টিনায় চলে আসেন এবং পরবর্তীতে তিনি আর্জেন্টিনার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৭৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল লারাবেইতির জন্মদিন। তার একদিন পরেই তাদের বুয়েন্স আয়ার্সের বাড়িতে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা হানা দেয়। হঠাৎ আলোর ঝলকানি তার চোখে এসে লাগে এবং তিনি বুলেটের শব্দ শুনতে পান। কিছুক্ষণ পর শহরতলীতে অবস্থিত সেই বাড়ির বাইরে তার বাবার মৃতদেহ দেখতে পান তিনি এবং মৃতদেহের পাশে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। বাবার পাশাপাশি তার মাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সেই দিন সম্পর্কে লারাবেইতির এটুকুই মনে আছে।
পরে লারাবেইতি ও তার আঠারো মাস বয়সী বোন ভিক্টোরিয়া ইভাকে সশস্ত্র পুলিশ এসে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। প্রথমে বুয়েন্স আয়ার্স শহরেরই একটি গাড়ি মেরামত করার গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের ভাই-বোনকে। এই গাড়ি মেরামত করার গ্যারেজকে গোপন টর্চার সেলে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এরপর তাদের পিতৃভূমি উরুগুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে আবার চিলিতে। পরবর্তীতে চিলির একটি জায়গায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। মাত্র চার বছর বয়সী একটি ছেলে তার আঠারো মাসবয়সী ছোট বোনসহ কয়েক মাসের ব্যবধানে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে তিনটি আলাদা দেশে স্থানান্তরিত হলো– ঘটনাটি স্বাভাবিক কিছু ছিল না। তারপরও তাদের ভাগ্য ভালো বলতে হয়, অন্তত প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল তারা। গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে লাতিন আমেরিকায় এরকম হাজারো শিশু এই অপারেশনের কারণে তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছে। অনেককে টর্চার সেলে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল, জীবনের বাকি সময়ে সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা।
অপারেশন কোন্ডোরের পেছনে আমেরিকার ভূমিকা ইতোমধ্যে অনেকখানি জানা হয়ে গেছে। অপারেশন চলার সময়ে কী ভূমিকা পালন করেছিল, সেই সম্পর্কে জানা যাক। ধারণা করা হয়, আমেরিকার সিআইএ লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে গোপন তথ্য দিয়ে প্রচুর সাহায্য করেছিল। এছাড়া ডেথ স্কোয়াডের সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছিল আমেরিকা– এমনটাও শোনা যায়। লাতিন দেশগুলোর নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘ডেথ ফ্লাইট’ নামে নতুন একটি পন্থা অবলম্বন করার নির্দেশও দিয়েছিল সিআইএ। এই পদ্ধতিতে অপহরণের শিকার ব্যক্তির উপর বিভিন্ন মাদক ব্যবহার করে তাকে অচেতন করে ফেলা হতো। এরপর বিমান ব্যবহার করে তাকে সাগর কিংবা খরস্রোতা নদীতে ফেলে দেয়া হতো। এতে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সবচেয়ে বড় যে সুবিধাটি হতো তা হচ্ছে– ব্যক্তির মৃতদেহ কখনও পাওয়া যেত না। গুমের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির লাশ যাতে কোনোভাবেই পাওয়া না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে বেশ বেগ পেতে হতো। এই পদ্ধতিতে লাশ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এই অপারেশনে লাতিন আমেরিকায় ষাট হাজার থেকে আশি হাজার মানুষকে গুম করা হয়, যাদের কোনো নাম-নিশানা পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রায় চার লাখ মানুষকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়। সবচেয়ে বেশি মানুষ গুমের ঘটনা ঘটে আর্জেন্টিনায়, মোট গুমের প্রায় অর্ধেক সেখানেই ঘটেছে। ইতিহাসের অনেক যুদ্ধেও এত মানুষকে হত্যা করা হয়নি, যতটা না এই অপারেশনে করা হয়। এই অপারেশনের মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার সশস্ত্র বিপ্লবী দলগুলোর কবর রচনা করা হয়। গুম কিংবা জেলে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের প্রায় সবাই ছিল বামপন্থী কিংবা সরকারের সমালোচক। লাতিন আমেরিকার পুরো একটি প্রজন্ম চোখের সামনে মানুষের মৃত্যু, গুম কিংবা অপহরণ দেখতে দেখতে বড় হয়।
বিশ্বব্যপী গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দলগুলোর সহাবস্থান কিংবা মানবাধিকার নিয়ে কথা বললেও রাজনৈতিক কিংবা মতাদর্শিক দিক থেকে শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এসবের বালাই থাকে না– অপারেশন কোন্ডোরের মাধ্যমেই তা বোঝা যায়। সশস্ত্র বিপ্লবীদের দমন করতে লাতিন রাষ্ট্রগুলোকে যেভাবে সহায়তা করেছে আমেরিকা, সেটি এই দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার অন্ধকার দিকটিকেই তুলে ধরে। পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে ধ্রুপদী উদাহরণের জন্য অপারেশন কোন্ডোরই যথেষ্ট। রাষ্ট্র যখন দানব হয়ে ওঠে, তখন তাকে আটকানোর মতো কেউ থাকে না। স্বৈরাচারী শাসক কিংবা সামরিক জান্তারা যে জনগণের রক্তের উপর পা রেখেও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে দ্বিতীয়বার ভাবে না, অপারেশন কোন্ডোরের মাধ্যমে এই সত্যট আমাদের সামনে আবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইতিহাস আজকে ঘৃণাভরে অপারেশনের পেছনের ব্যক্তিদের গল্প লিখে রেখেছে, বর্তমান প্রজন্ম সেসব স্বৈরাচারী ব্যক্তিদের স্মরণ করে।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্ব
১) অপারেশন কোন্ডোর: লাতিন আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের নির্মম আখ্যান (পর্ব-০১)