জীবনের হতাশা, ক্লান্তি আর বেদনা যখন একাকার হয়ে যায়; যখন জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া কিংবা বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন নিজের প্রতি অথবা জীবনের প্রতি তৈরি হওয়া বিদ্বেষ থেকে মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহননের।
এ প্রবণতা থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্যে ধর্মীয় থেকে শুরু করে আইনগত ও সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই এটি বন্ধে বিভিন্নভাবে আইন, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে হতাশার সম্মুখীন হয়ে আত্মহননের কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু সে আত্মহনন যদি হয় একাধিক মানুষের একত্র হয়ে, তবে তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠাই যেন স্বাভাবিক। পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া গণ আত্মহননের কিছু ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের প্রতিবেদন।
১
পৃথিবীর প্রথম গণ আত্মহননের ঘটনাটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৭৩-৭৪ অব্দে। প্রায় ১২ বছর ৯০০ মানুষ যিহূদার মরুভূমির মাসাদা দুর্গে রোমানদের থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন। সম্রাট লুসিয়াস ফ্লেভিয়াস সিলিভাস তাদের বন্দি করার উদ্দেশ্যে একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে দুর্গের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সেই দুর্গে পৌঁছে তিনি হাজারো পোড়া দেহ এবং দুর্গের ধ্বংসাবশেষ পান।
২
গণ আত্মহননের দ্বিতীয় ঘটনাটি শোনা যায় ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ। ভারতের রাজস্থানে অবস্থিত চিতোরের রানী কর্ণাবতী ১৩০০০ নারীসহ জওহর ব্রত পালন করে আত্মহনন করেন। জওহর ব্রত ছিল একধরনের প্রথা, যেখানে শত্রুপক্ষের হাতে আসন্ন হার নিশ্চিত হলে রাজমহলের মহিলারা বিশাল অগ্নি জালিয়ে তাতে আত্মহনন করতেন। ১৫২৮ সালে শত্রুর হাতে চিতোরের রাজা রানা সাঙ্গা নিহত হলে মেওয়ার এবং চিতোরের দায়িত্বভার এসে পড়ে রানী কর্ণাবতীর হাতে। এ সময় গুজরাটের রাজা বাহাদুর শাহ চিতোর রাজ্য আক্রমণ করেন এবং প্রায় বিনা বাঁধায় চিতোর রাজ্যে প্রবেশ করেন। রাজমহলের রমণীরা সম্ভ্রম বাঁচাতে জওহর ব্রত পালন করে আত্মহনন করেন।
৩
১৯০৬ সালে বালির বাড়ুং শহর ডাচ আর্মিদের দ্বারা আক্রমণ হলে সেখানে বসবাসরত মানুষেরা মনে করে তারা কোনোভাবেই এখান থেকে রক্ষা পাবে না। তাই তারা নিজেরাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। পুরো শহর জুড়ে মানুষ নিজের হাতে পরিবারের সদস্যদের চাকু দিয়ে হত্যা করে এবং পরে নিজেরাও আত্মহত্যা করে। পুরো শহরে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। যখন ডাচ আর্মিরা সেখানে পৌঁছায় তারা মানুষের পচা মাংস ও শিশুদের বিচ্ছিন্ন শরীর দেখতে পায়। এ দৃশ্য এতটাই হৃদয় বিদারক ছিল যে সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
৪
১৯৪৪ সালে প্রায় ২২,০০০ মানুষ সাইপানের পর্বত থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন। আমেরিকান সেনাবাহিনী তাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছে জাপানের এমন প্রচারণা শুনে তারা এ কাজ করেন। বলা হয়ে থাকে, সবচেয়ে ছোট শিশুদের বড়রা, বড়দের মায়েরা ও মায়েদেরকে বাবারা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় এবং পরে তারা নিজেরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহনন করেন।
৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে সোভিয়েত রেড আর্মির ভয়ে প্রায় ১,০০০ জার্মান ডেমিম শহরে গণ আত্মহনন করেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মহিলা এবং শিশু। যুদ্ধের বিভীষিকায় ও আতংক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বন্দুক, ব্লেড এবং বিষের মাধ্যমে আত্মহনন করেন।
৬
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যুর ভয়াবহতাকে কাছ থেকে দেখেছে বিশাল সংখ্যক মানুষ। কিন্তু যুদ্ধে হারার পর খোদ জার্মানরা এতটা ভীত হয়ে পড়ে যে, ১৯৪৫ সালে জার্মানিতে অনেক স্থানে অসংখ্য মানুষ আত্মহনন করেন। যুদ্ধের শেষের দিকে হেরে যাওয়ার পরিস্থিতি অনেক জার্মানের জন্য এতটাই হতবিহবলকর ছিল যে, অনেকেই সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে আত্মহনন করেন।
৭
১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর আমেরিকার জোন্সটাউনে পিপলস টেম্পল নামে একটি ধর্মীয় সংগঠনে ৯১৮ জন সদস্য বিষপানের মাধ্যমে গণ আত্মহনন করেন। সেখানকার ধর্মীয় গুরুর প্ররোচনায় তারা এ কাজ করে। বলা হয়ে থাকে, প্রায় ৩০০ শিশুকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়।
৮
১৯৯৪ সালে ফ্রান্সে অবস্থিত একটি সোলার টেম্পলের সদস্যরা আধুনিক পৃথিবীর অত্যাচার ও নৃশংসতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গণ আত্মহনন করেন। তারা এটাও বলেছিল যে, রাতের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আধ্যাত্মিকভাবে তারা সৌরলোকে ভ্রমণ করবে।
৯
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত হ্যাভেন’স গেট নামে পরিচিত একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ৩৯ জন সদস্য ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ গণ আত্মহনন করেন। তারা এ মিথ্যা ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন যে, মৃত্যুর পর অতিজাগতিক কেউ এসে তাদের আকাশের বৈপ্লবিক রাজ্যে নিয়ে যাবে যেটা কি না তাদের আসল গন্তব্য। প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে মাথা জড়িয়ে নিজেদের শ্বাসরোধ করে তারা আত্মহনন করে। উদ্ধারকারী দল সেখানে যাওয়ার পর দেখতে পায় সকল মৃত ব্যক্তির মুখ বেগুনী রঙের কাপড় দিয়ে ঢাকা। তারা শ্বাসরোধের পূর্বে আনারসের শরবত ও ভদকা পান করেছিল।
১০
“দশ আদেশ পুনঃপ্রবর্তন আন্দোলন” নামে এই ধর্মানুষ্ঠান পদ্ধতিটি ছিল রোমান ক্যাথলিকদের একটি ধর্মীয় আন্দোলন যেখানে এর অনুসারীরা মনে করতো তারা এ পৃথিবীতে এসেছে দশটি আদেশ পালনের জন্যে এবং যিশুখ্রিস্টের ধর্মপ্রচারের জন্যে। এ দলের সদস্যদের নিজস্ব জীবনাচরণ ছিল। তারা শুক্রবার ও সোমবার একবেলা খাবার খেতো, সঙ্গম এবং সাবান ব্যবহার তাদের জন্যে নিষিদ্ধ ছিল। এ আন্দোলনের সাথে জড়িত প্রায় ৭৭৮ জন মানুষ ২০০০ সালের মার্চ মাসে উগান্ডায় গণ আত্মহনন করেন। মূলত ধর্মীয় নেতাদের প্ররোচনায় এ বিশাল সংখ্যক মানুষ নিজেদের জীবন দেন। তবে এটাও বলা হয়ে থাকে যে, এদের মাঝে অনেককেই হত্যা করা হয়েছিল।
জীবন স্রষ্টার দেয়া এক বিস্ময়কর উপহার। বলা হয়ে থাকে, এ পৃথিবীতে যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি মূল্যবান জীবন। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতি আর সময় কিছু মানুষকে এর ঊর্ধ্বে চিন্তা করতে বাধ্য করে। রোগব্যাধির সাথে নিয়ত যুদ্ধ করতে থাকা সুন্দর এ পৃথিবীতে যেখানে আর এক মুহূর্ত বেশি বেঁচে থাকার জন্য কিছু মানুষ স্রষ্টার কাছে নতজানু হয়, যেখানে কাউকে কাউকে জোরপূর্বক হত্যা করা হয়, সেখানে অনেকের স্বেচ্ছায় এ সুন্দর জীবনের ইতি টেনে রেখে যাওয়া মানুষকে ফেলে দেয় বিস্ময়ের মাঝে।