২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের তুরস্কের গাজিয়ানটেপ (Gaziantep) শহরের কাছে ৭.৮ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। একই দিন দুপুরে আগের অবস্থান থেকে মাত্র ৯৫ কি.মি. দূরে ৭.৭ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। উভয় ভূমিকম্পের আঘাতে দুই দেশে ৫০,০০০ এরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, ভূমিকম্প ও এর পরবর্তী আফটার শকের কারণে কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন আরও অজস্র মানুষ।
যদিও এটি সাম্প্রতিককালের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প, কিন্তু এর থেকেও ভয়াবহ ভূমিকম্পের সাক্ষী হয়েছে পৃথিবীবাসী। আজ আমরা আলোচনা করব পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া এরকম ভয়াবহ পাঁচ ভূমিকম্প সম্পর্কে।
শানশি প্রদেশ, চীন, ২৩ জানুয়ারি, ১৫৫৬
বিগত ৪ হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ ভূমিকম্প নথিপত্র করে রাখছে। এর মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পটি ঘটে আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে ১৫৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি চীনের শানশি প্রদেশে, মিং রাজবংশের সময়ে। ১৯৩০ এর দশকে রিখটার স্কেল উন্নয়নের পর বিজ্ঞানীদের তত্ত্বীয় হিসেবমতে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৮-৮.৩ এর মধ্যে। যদিও সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প ছিল না, কিন্তু এর ফলে শানশি প্রদেশের পর্বতগুলো ধুলোয় মিশে যায়, নদীর গতিপথ পাল্টে যায়, ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়, এবং প্রায় ৮,৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে। প্রদেশটির কিছু কিছু কাউন্টিতে প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এত বেশি লোকের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ঘনবসতি আর দুর্বলভাবে তৈরি পাথরের ভবনকে দায়ী করা হয়।
তাংশান, চীন, ২৮ জুলাই, ১৯৭৬
ভৌগলিকভাবে ভারতীয় এবং প্যাসিফিক প্লেটের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় চীন বরাবরই অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা।হয়তো তাই পৃথিবীর ইতিহাসের দ্বিতীয় মারাত্মক ভূমিকম্পেরও সাক্ষী হতে হয়েছিল চীনবাসীকে।
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাত ৩টা ৪২ মিনিটে রাজধানী বেইজিংয়ের ৬৮ মাইল পূর্বে অবস্থিত শিল্পনগরী তাংশান ৭.৮ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। নগরবাসী এর আগের দিন বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়, যেমন- কুয়ার পানির স্তরের অস্বাভাবিক ওঠা-নামা, দিনেদুপুরে আতঙ্কগ্রস্ত ইঁদুরের দলবেধে ছোটাছুটি করা প্রভৃতি। কিন্তু এসব যে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ, তা নগরবাসী অনুমান করতে পারেনি। নগরীর ১০ লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে প্রায় ২,৪২,০০০ মানুষ এই ভূমিকম্পে মৃত্যুবরণ করে, এবং আহত হয় আরো প্রায় ১৬০,০০০ মানুষ। মাত্র ২৩ সেকেন্ডের ভূমিকম্পে নগরীর ৯০ শতাংশ দালান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
এত বেশি লোকের মৃত্যুর কারণ হিসেবে শহরের সাথে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বিদেশি সাহায্য না নেওয়াকে দায়ী করা হয়।
আলেপ্পো, সিরিয়া, ১১ অক্টোবর, ১১৩৮
২০১১ সালের গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার আলেপ্পো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ারও প্রায় ৯০০ বছর আগেও ভয়াবহ ভূমিকম্পে আরো একবার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ১১৩৮ সালের ১১ অক্টোবর ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্পে আলেপ্পো এবং এর আশেপাশের অঞ্চলে প্রায় ২,৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া, ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৪
একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পটি ঘটে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ থেকে ১৬০ মাইল পশ্চিমে ভারত মহাসাগরে, যেটি এ পর্যন্ত রেকর্ডে রাখা ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় শক্তিশালী এবং চতুর্থ মারাত্মক। এর ফলে ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী ৪টি দেশ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় আঘাত হানা ভূমিকম্পটির ফলে সৃষ্ট সুনামি ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে ডেকে আনে মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা। ১০ মিনিট স্থায়ী এই ভূমিকম্প ৮০-১০০ ফুট উচ্চতার সুনামি সৃষ্টি করে আচেহর উপকূলে আছড়ে পড়ে, যেটি প্রদেশের অধিকাংশ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এর ফলে শুধু ইন্দোনেশিয়ায় মারা যায় ১,৩০,০০০ মানুষ, যার অধিকাংশ ছিলেন আচেহ প্রদেশের বাসিন্দা। ভূমিকম্প হওয়ার দীর্ঘ ৯০ মিনিট পর সৃষ্ট সুনামি পৌঁছায় শ্রীলঙ্কায়, যেখানে সেটি কেড়ে নেয় আরো ৩৫ হাজার মানুষের প্রাণ। তাছাড়া ভূমিকম্পটির ফলে ভারত এবং থাইল্যান্ডে মারা যান আরো ২৩,০০০ মানুষ। এমনকি সুনামির ঢেউ উৎপত্তিস্থল থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আঘাত হানে, যেখানে মারা যান আরো দুজন।
পোর্ট-অ- প্রিন্স, হাইতি, ১২ জানুয়ারি, ২০১০
২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত দেশ হাইতি এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়। রাজধানী পোর্ট-অ- প্রিন্সের সোজা ভেতর দিয়ে যাওয়া উত্তর আমেরিকান প্লেট এবং ক্যারিবিয়ান প্লেটের কারণে দেশটি বরাবরই ভূমিকম্পপ্রবণ ছিল। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির উপকেন্দ্র ছিল রাজধানী থেকে মাত্র ১৬ মাইল দূরে, যে কারণে অনেক মানুষকে হতাহত হয়। প্রায় ২,২০,০০০ মানুষ এতে মৃত্যুবরণ করে, আরো ৩,০০,০০০ মানুষ আহত হয়, এবং ১০ লক্ষেরও বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়। দেশটির বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা উদ্ধার কার্যক্রমকে আরও জটিল করে তোলে।
পরিশেষে, যতদিন পর্যন্ত না ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের ভূমিকম্পের ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু পরিকল্পিত নগরায়ন, যথাযথ বিল্ডিং কোড অনুসরণ, প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মী, এবং ভূমিকম্প-পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে রাখতে পারি।