মিশরের ফারাও ৩য় তুথমোসিসের শাসনামলের এক পর্যায়ে হঠাৎ লেভান্টের রাজারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কাদেশের রাজা ছিলেন এই বিদ্রোহের মূল ইন্ধনদাতা। মেগিডোর রাজাও তার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন।
অগত্যা এই বিদ্রোহ দমনের জন্য তুথমোসিস তার মিশরীয় আর্মি নিয়ে রওয়ানা দিলেন। পথে তার প্রথম লক্ষ্য মেগিডোর রাজাকে পরাস্ত করা। এই সংবাদ পেয়ে কাদেশের রাজা মিশরীয় আর্মিকে ঠেকাতে তার যৌথবাহিনী নিয়ে মেগিডোতে জড়ো হলেন। আর্মি নিয়ে মেগিডোতে যাবার পথ ছিল তিনটি। উত্তর আর দক্ষিণের পথের চেয়ে মধ্যবর্তী পথ এত বেশি দুর্গম ছিল যে সৈন্যদের এক লাইনে এগোনো ছাড়া উপায় ছিল না। তুথমোসিসের জেনারেলরা এই পথ ছেড়ে অন্য দুই পথের যেকোনো পথে এগোবার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তুথমোসিস ভাবলেন, যেহেতু তার জেনারেলরা এই পথে যাবার কথা ভাবছেন না, সেক্ষেত্রে শত্রুও এই পথে তাকে অতটা প্রত্যাশা করছে না। তাই তিনি এই অপ্রত্যাশিত পথই বেছে নিলেন।
মেগিডো শহর ছিল উপত্যকার মাঝে একটি টিলার ওপর। শত্রু আর্মি যখন উত্তর আর দক্ষিণের পথ আগলে বসে আছে, এই ফাঁকে তুথমোসিসের আর্মি সেই বন্ধুর পথ পেরিয়ে উপত্যকায় ক্যাম্প করল। অবস্থা বেগতিক দেখে কাদেশের রাজা অরক্ষিত মেগিডো বাঁচাতে রাতের ভেতর তার আর্মি ফিরিয়ে এনে সকালেই তুথমোসিসের আর্মির ওপর তড়িঘড়ি করে আক্রমণ করে বসলেন। তুথমোসিস রাতেই তার আর্মিকে এমন ক্রিসেন্ট প্যাটার্নে (অর্ধচন্দ্রাকৃতি) সাজিয়ে রেখেছিলেন যে বিদ্রোহী যৌথবাহিনী আক্রমণ করতে এসেই তাদের দুই ফ্ল্যাঙ্ক থেকে একযোগে আক্রান্ত হলো। মিশরীয় সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বিদ্রোহীরা দ্রুত পিছু হটে শহরের ভেতরে ঢুকে মূল ফটক আটকে দিল। শুরু হলো অবরোধ। সাত মাস পর মেগিডোর পতন হয়। খ্রিস্টের জন্মের ১,৪৫৭ বছর আগের এই মেগিডোর যুদ্ধ সমর ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ হিসেবে পরিগণিত।
কিছু মানুষ আছে যারা অন্য দেশের সাথে যেকোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো কিছুই ভাবতে পারেন না। ইংরেজিতে এ ধরনের লোকদের বলে ‘হক’ (Hawk)। দু’পক্ষের মতের অমিল একটি সংকট, আর এই সংকট সাধারণত কূটনৈতিকভাবে সমাধা করার কথা। কিন্তু কখনো কখনো কূটনীতিকরা ব্যর্থ হন অথবা রাজনীতিবিদেরা তাদের ব্যর্থ হতে বাধ্য করেন। আর তখনই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। যুদ্ধ মানেই কিন্তু বল প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে আপনার শর্তাবলী মেনে নিতে বাধ্য করা। মনে রাখার বিষয় হলো, যুদ্ধ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং যেকোনো যুদ্ধের নেপথ্যে কূটনৈতিক ব্যর্থতা একটি বড় কারণ। সানজুর তের অধ্যায়ের প্রথম এই অধ্যায়কে ইংরেজিতে বলে ‘প্রাইমারি ক্যালকুলেশন’ বা ‘এস্টিমেশন’ অথবা ‘লেইং প্ল্যানস।’ সহজ কথায়, যুদ্ধে জড়ানোটা আদৌ ঠিক হবে কিনা অথবা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে হয়, এই অধ্যায়ে সেই বিষয়েই সানজু আলোকপাত করেছেন।
যুদ্ধ কিন্তু শুধুই সেনাপতিদের বিষয় না, বরং যুদ্ধ হলো রাষ্ট্রের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র্র বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে অথবা নিজ স্বার্থে অন্য রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। সানজু বলেন,
যুদ্ধ একটি রাষ্ট্রের পরম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কেননা এ হলো জীবন অথবা মৃত্যুর প্রশ্ন; এ পথ বেঁচে থাকবার অথবা সর্বনাশের। তাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যুদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন অত্যাবশ্যক।
চাইলেই আপনি যুদ্ধ শুরু করে দিতে পারেন না। যুদ্ধের প্রস্তুতি আর পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যুদ্ধের কারণে সাধারণ জনগণের জীবন আর সম্পদের ক্ষতিও অপূরণীয়। সর্বোপরি ভুল প্রতিপক্ষের সাথে লেগে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় যুদ্ধ করতে গিয়ে পরাজিত হবার পরিণাম আরো ভয়াবহ।
১ম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধে পরাজিত বিধ্বস্ত জার্মানির ওপর ১৩২ বিলিয়ন মার্ক ক্ষতিপূরণের বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলাফল ছিল বিশ বছরের মাথায় আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ, যা ছিল আগেরটির চাইতেও ভয়াবহ। তাই যুদ্ধে অপারেশনাল ট্যাক্টিকসের চাইতে স্ট্র্যাটেজি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যুদ্ধজয়ের জন্য স্ট্র্যাটেজি আর ট্যাকটিক্সের সুষম সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি, কেননা কথায় আছে, ট্যাকটিক্স ছাড়া স্ট্র্যাটেজি হলো বিজয়ের সবচেয়ে অনিশ্চিত রাস্তা, আর স্ট্র্যাটেজি ছাড়া ট্যাকটিক্স হলো নিশ্চিত পরাজয়ের আগে অনর্থক শোরগোল মাত্র।
ধ্রুব পাঁচ
পরিস্থিতি যুদ্ধের জন্য কতটা অনুকুল তা আপনি পাঁচটি মৌলিক ফ্যাক্টরের আলোকে যাচাই করবেন।
প্রথম ফ্যাক্টরটি হলো ‘মোরাল ইনফ্লুয়েন্স’ বা নৈতিক প্রভাব। যদি উপযুক্ত একটা কারণ সামনে থাকে আর আপনার চেইন অব কমান্ড যদি নৈতিকভাবে প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়, তবে সৈন্যরা ভয়কে জয় করে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাবে। যুদ্ধে ‘রাইচাস্নেজ অব কজ’ বা সন্তোষজনক কারণ সেনাদলের ওপর নৈতিক প্রভাব বিস্তারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ৭১-এ পাকবাহিনী যুদ্ধ শুরু করেছিল এই ব্রিফিং পেয়ে যে, পূর্ব-পাকিস্তানে সব বিধর্মী আর বেঈমানদের বসবাস, অতএব ওদের নির্বিচারে হত্যা করতে হবে। কিন্তু কিছুদিন পরই সাধারণ সৈন্যরা টের পেয়ে গেল যে, আদতে তারা বিধর্মী নয়, বরং মুসলমানদেরই মারছে। ব্যাস, দ্বিধা ঢুকে গেল, নেতৃত্বের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাস জন্ম নিল। পাক সেনাবাহিনী যথেষ্ট প্রশিক্ষিত আর উপযুক্ত হয়েও, যুদ্ধ করার মতো সন্তোষজনক কোনো কারণ না থাকায়, দ্রুত তাদের সৈনিকসুলভ স্পিরিট হারিয়ে ফেলল; এবং পরাজিত হল।
অথচ গ্রিক রাজা লিওনিডাস মাত্র ৩০০ স্পার্টান যোদ্ধা নিয়ে থার্মোপেলি গিরিপথে পার্শিয়ানদের ঘাম ছুটিয়ে ইতিহাসে নাম করে নিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকটা ইসলামিক যুদ্ধে খলিফা আর সেনাপতিদের নৈতিক প্রভাবের কারণে মুসলমান সেনাবাহিনী সংখ্যায় শত্রুর চেয়ে দুর্বল হয়েও বিজয়ী হয়েছে।
দ্বিতীয় ফ্যাক্টর হলো ‘আবহাওয়া’। প্রথমে নেপোলিয়ন, পরে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে হেরেছে। আদতে হেরেছে রাশিয়ান ঠান্ডার কাছে। রাশিয়ার মাটিতে রাশিয়ান শীতে রাশিয়ানদের হারানোর মতো ট্রেনিং অথবা লজিস্টিক কোনোটাই না থাকায় হিটলারের অপারেশন বার্বারোসা হয়ে গেল ইতিহাসের অন্যতম ভুল আর মর্মান্তিক সামরিক অভিযান। এই অভিযানে জার্মানরা আট লাখেরও বেশি সৈন্য হারায়।
আপনার আর্মি যেখানে যুদ্ধ করবে, সেখানকার আবহাওয়ার সাথে কত দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারবে, কতদিন টিকে থাকতে পারবে আর আপনি কতদিন রসদ যুগিয়ে যেতে পারবেন, তার উপর জয়-পরাজয় অনেকটাই নির্ভরশীল। রাশিয়ার যেমন আছে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির শীত, আমাদেরও তেমনি আছে আষাঢ়-শ্রাবণ। বর্ষাকালে এই দেশে ঢুকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে হারিয়ে যাবার মতো আর্মি এখনও তৈরি হয়নি।
‘টেরেইন‘ আরেকটি বিশাল ফ্যাক্টর। ইংরেজি টেরেইন শব্দের প্রাসঙ্গিক মানে হলো একটি যুদ্ধক্ষেত্র সংলগ্ন গাছপালা, পাহাড়-উপত্যকা, নদ-নদী, বসতি ইত্যাদি। দুটি নদী পার হয়ে যদি আপনাকে আক্রমণ করতে হয়, আপনার হিসেব থাকতে হবে দুটি সামরিক ব্রিজ বানানোর সামর্থ্য আপনার আছে কিনা, কেননা যুদ্ধের সময় শত্রু ব্রিজ ভেঙে দিয়ে পিছু হটতে পারে।
আপনি যেখানে আসল যুদ্ধটা করতে চাচ্ছেন, সেখানে আপনার ফোর্স কন্সেন্ট্রেট করতে হবে, যেন মূল আক্রমণের সময় আপনার বেলিজারেন্ট রেশিও শত্রুর চেয়ে ভাল থাকে। তো সেই মোক্ষম সময়ে কন্সেন্ট্রেশন অর্জন করতে, কোন পথে কোথা থেকে কোন ফোর্স আনাবেন, সেটা ঠিক করতেও আপনাকে টেরেইন সম্পর্কে জানতে হবে। টেরেইন সম্পর্কে জানতে হবে কোথায় গিয়ে বিশ্রাম নেবেন, কোথায় শত্রুকে কোণঠাসা করবেন অথবা কোন পথে পিছু হটবেন, তা ঠিক করতেও।
চতুর্থ ফ্যাক্টর হলো সেনাপতিদের মান বা কোয়ালিটি। বিচক্ষণ কমান্ডারেরা পরিবর্তিত পরিস্থিতি দ্রুত অনুধাবন করে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, আর সুযোগ কাজে লাগাতে জানেন। নেপোলিয়ন নাকি আগে ভাগেই শত্রুর চাল ধরে ফেলতে পারতেন, জার্মান জেনারেল রোমেলও নাকি পারতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউএস জেনারেল প্যাটন যেবার পেঞ্জার ডিভিশনকে হারিয়েছিলেন সে যুদ্ধে ‘ডেজার্ট ফক্স’ রোমেল ছুটিতে ছিলেন। বৃটিশ জেনারেল অচিনলেক যখন প্রথম এল-আলামিনের যুদ্ধে রোমেলের বিরুদ্ধে তিস্টাতে পারছিলেন না, চার্চিল তার বদলে পাঠালেন ফিল্ডমার্শাল মন্টগোমারিকে, মন্টগোমারি কিন্তু ঠিকই রোমেলকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন। সেনাপতিদের নামে এবং উপস্থিতিতে যুদ্ধক্ষেত্র প্রভাবিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।
পঞ্চম ফ্যাক্টর হলো ডক্ট্রিন। যে সেনাবাহিনীর ইউনিট, র্যাঙ্ক স্ট্রাকচার, চেইন অব কমান্ড আর লজিস্টিক সিস্টেম যত উন্নত, সেই সেনাবাহিনীর জয়ের সম্ভাবনা তত বেশি। যুদ্ধক্ষেত্রে পিছু হটা মানেই হেরে যাওয়া না। তাই সুশৃঙ্খল আর সুপ্রশিক্ষিত সেনাদল একবার পশ্চাদাপসরণ করে আবার আক্রমণ করতে ফিরে আসে, দুর্বল সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।
সানজু দাবী করেন,
এমন কোনো জেনারেল পাওয়া যাবে না যিনি এই পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জানেন না। কিন্তু যারা এই পাঁচ বিষয় ভালভাবে আত্মস্থ করতে পারেন, তারাই বিজয়ী হন, আর যারা পারেন না, তারাই হেরে যান।
সাত বিবেচ্য
যুদ্ধের পরিকল্পনার সময় যদি আপনি বলতে পারেন-
- কোন পক্ষের নেতৃত্বে নৈতিক প্রভাব বেশি,
- কার সেনাপতি বেশি সক্ষম,
- কারা আবহাওয়া আর টেরেইনের সুবিধা বেশি আদায় করে নিতে জানে,
- কাদের ডক্ট্রিন অধিক পরীক্ষিত আর ফলপ্রসু,
- কাদের সেনারা বেশি উজ্জীবিত,
- কাদের অফিসার আর সৈন্যরা বেশি প্রশিক্ষিত এবং
- কাদের প্রশাসনে পুরস্কার আর তিরস্কার/শাস্তি সমুচিতভাবে নিশ্চিত করা হয়
তাহলে আপনিও ভবিষ্যৎবাণী করতে পারবেন, কে জিতবে আর কে হারবে।
সদুপদেশ
সানজুর শিক্ষাকে জানুন, বুঝুন এবং কার্যত প্রয়োগ করতে শিখুন। অচল, সহজ অথবা জটিল ভেবে একে উড়িয়ে দেবেন না, বরং এমন মনে হলে আপনি আপনার নিজের উপলব্ধিকে প্রশ্ন করুন। কেননা সানজুর দাবী, জেনে-শুনে যে সেনাপতি তার এই শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করে, তাকে অনতিবিলম্বে অবসরে পাঠানো হোক, কারণ তিনি যে ইতোমধ্যেই একজন পরাজিত জেনারেল, তা যুদ্ধে হেরে প্রমাণের কোনো দরকার নেই। আর ভাল জেনারেলরা তার এই শিক্ষাকে বিবেচনায় রেখে উদ্ভুত পরিস্থিতি সামলে ঠিকই বিজয় ছিনিয়ে আনবে।
অবশ্য সানজু এটাও বলেছেন যে, শুধুমাত্র তার সদুপদেশের ভিত্তিতেই সব পরিস্থিতি সামালানো সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই প্রত্যেকে যেন তার এ শিক্ষার বাইরেও জ্ঞানের অনুসন্ধান করেন, আর অজানা পরিস্থিতিতে এই জ্ঞানলব্ধ স্বকীয়তার ভিত্তিতে নিজ উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেন।
ধোঁকা
ইংরেজি ‘ডিসেপসন’ শব্দের অর্থ ধোঁকা, প্রতারণা অথবা ছলনা। বাইজান্টাইন রোমানদের বিরুদ্ধে ইয়ারমুকের যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ ইয়ারমুক প্রান্তরে পশ্চিম দিকে মুখ করে পজিশন নিয়েছিলেন। একে বলে ‘পজিশনাল এডভান্টেজ’ বা অবস্থানগত সুবিধা। এর ফলে সকাল থেকে দুপুর অবধি প্রতিপক্ষ বাইজান্টাইনদের চোখে সূর্য পড়ত, ফলে দূর থেকে তারা মুসলিম আর্মির সঠিক সংখ্যা ঠাহর করতে পারতো না। উপরন্তু খলিফা ওমর নির্দেশ দিলেন যেন প্রতিদিন সকালের দিকে মুসলিম সেনারা ছোট ছোট দলে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে খালিদের আর্মিতে যোগ দেয়। ফলে বাইজান্টাইনরা ভাবতে লাগল যে প্রতিদিনই মুসলিম শিবিরে না জানি কতশত নতুন সেনা যোগ দিচ্ছে। ব্যাপারটা সামান্য হলেও এর প্রভাব অনেক বড়, কেননা বাইজান্টাইন ভাবনা বাইজান্টাইনদেরই ক্রমশ হতাশ করে তুলছিল। এই জাতীয় ট্রিক বা কূটচালকেই বলে ডিসেপসন।
আর সানজু বলেন, সব যুদ্ধই ডিসেপসন নির্ভর। তাই যখন আপনি শত্রুকে হরিয়ে দিতে প্রস্তুত, ভান করুন যেন যুদ্ধ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। তেমনি এমন কিছু করুন যেন শত্রু তটস্থ থাকে এই ভেবে যে আপনি বোধহয় আশেপাশেই ঘাপটি মেরে পড়ে আছেন, অথচ বাস্তবে আপনি তখনো বেশ দূরেই আছেন। আর যখন শত্রুর ওপর হামলে পড়বেন, তখন শেষমুহূর্ত পর্যন্ত যেন শত্রু টের না পায় যে আপনি তার এতটা কাছে চলে এসেছেন। অন্যথায় শত্রুকে প্রলুব্ধ করুন আপনার ফাঁদে পা দিতে, তারপর তাকে ধ্বংস করুন।
শত্রু যখন আপনাকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, আপনিও তাকে ঠেকাবার প্রস্তুতি নিন। শত্রুর শক্তি অথবা বিশেষ সামর্থ্যকে চিহ্নিত করুন এবং পারতপক্ষে তা এড়িয়ে চলুন। তার জেনারেলদের রাগিয়ে দিন আর বিভ্রান্ত রাখুন। ক্ষিপ্ত আর বিভ্রান্ত মানুষ ভুল করে বেশি। কিছু রাজা-বাদশা-প্রসিডেন্ট আছেন যারা গায়ে পড়ে আশেপাশের শান্তিপ্রিয় দেশের সাথে লাগার ধান্দায় থাকেন।
ইস্টার্ন হু এর রাজা ছিলেন তেমনই একজন। তিনি একদিন প্রতিবেশি দেশ শিংনু এর রাজা মোতুং এর কাছে একহাজার ঘোড়া দাবি করে বসলেন। দাবি শুনে মোতুং এর সভাসদেরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালো। কিন্তু রাজা মোতুং বললেন ঘোড়ার চেয়ে প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বেশি জরুরি। তাই পাঠানো হলো এক হাজার ঘোড়া।
কিছুদিন পর ইস্টার্ন হু-এর রাজা ফের আব্দার করলেন। এবার তার একজন রাজকুমারী চাই। সভাসদেরা রাগে ফেটে পড়ল, যুদ্ধ ছাড়া কোন ছাড় নেই এবার। কিন্তু রাজা মোতুং বললেন, এক রাজকুমারীর চেয়ে প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বেশি জরুরি। তাই ঘটা করে এক রাজকুমারীর বিয়ে দেয়া হলো।
কিছুদিন পর ফের আরেক বায়না। এবার একহাজার লি জমি দিতে হবে। রাজা মোতুং সভাসদদের মতামত চাইলেন। সভাসদদের কেউ বলল ‘কক্ষনো না’, আবার কেউ বলল ‘কিছু জমির চেয়ে প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বেশি জরুরি।’ আর যায় কোথায়, রাজা মোতুং রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, “মাটি হলো রাষ্ট্রের ভিত্তি, এক কণা মাটি ছাড়ার কথাও যে যে ভেবেছে, তাদের সব কয়টার কল্লা কাটো। আর এক্ষুনি প্রস্তুত হও ইস্টার্ন হু আক্রমণের জন্য। আমি রওনা দেবার পর যাকেই আমার পেছনে পাওয়া যাবে, তাদেরও কল্লা যাবে।” ইস্টার্ন হু এই প্রতিক্রিয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে রাজা মোতুং এক ঝটিকা আক্রমণে সহজেই তাদের পরাস্ত করেছিলেন।
আর সানজু বললেন, “মোক্ষম সময়ের আগপর্যন্ত দুর্বল সাজার ভান কর, আর প্রতিপক্ষকে উস্কে দিতে থাক!”
শত্রুকে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখতে হয়, যখন সে দু’দন্ড শান্তি খোঁজে, তখনই তাকে জ্বালাতে হবে। যখন সে একতাবদ্ধ থাকার চেষ্টা করবে, আপনি তখন ফন্দি খুঁজবেন কিভাবে তার ভেতর বিভাজন তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে শত্রুর নিজেদের ভেতর কোন্দল লাগিয়ে দিন, তার মিত্রদের সাথে প্যাঁচ লাগান, মোটকথা তাকে দৌড়ের উপর রাখুন।
গালফ ওয়ারে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের পর কুয়েতের মাটিতে খুব শক্তিশালী ডিফেন্স ( প্রতিরক্ষা বুহ্য) নিয়েছিলেন। শোয়ার্জকফের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনীও সেই ডিফেন্স বরাবর সৌদি আরবের মাটিতে অবস্থান নিল। তারপর এমন একটা অবস্থা তৈরি করল যে সাদ্দাম বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন যে, আক্রমণ যদি হয়ই, তাহলে তা হবে পার্সিয়ান গালফ দিয়ে। তাই তিনি ঐ এম্ফিবিয়াস এসল্ট থামাতে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু ধূর্ত শোয়ার্জকফ কিন্তু কুয়েত থেকেও অনেক পশ্চিমে, পার্সিয়ান গালফের সম্পূর্ণ উল্টোদিক দিয়ে ইরাকের ভেতর ঢুকে আক্রমণ করে সাদ্দামকে চমকে দিয়েছিল। এই যুদ্ধে রিপাবলিকান গার্ড সহ সাদ্দাম হোসেন ১০০ ঘণ্টার ভেতর পরাস্ত হন।
এই ব্যাপারে সানজু আগেই বলেছিলেন, শত্রু প্রস্তুত হবার আগেই আক্রমণ করুন, আর আক্রমণ করুন সেই দিক দিয়ে যেদিক দিয়ে শত্রু কস্মিকালেও আক্রান্ত হবে বলে ভাবেনি।
পরিকল্পনা
সমুচিত পরিকল্পনাই একজন স্ট্র্যাটেজিস্টের যুদ্ধজয়ের চাবিকাঠি। যদিও যুদ্ধ একবার শুরু হয়ে গেলে বদলে যাওয়া পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন কর্মপন্থা ঠিক করতে হয়। তারপরও যুদ্ধ শুরুর আগেই পরিকল্পিত হিসেবনিকেশ আপনাকে বাতলে দেবে যুদ্ধ জেতার সম্ভাবনা কতখানি। যথাযথ প্রস্তুতি আর বিস্তারিত পরিকল্পনা যুদ্ধজয়ের মূলমন্ত্র। পরিকল্পনার সময় যত বেশি কন্টিজেন্সি নিয়ে আপনি ভাববেন, যুদ্ধের সময় আপনি তত বেশি সুযোগ করায়ত্ত করতে পারবেন, আর শত্রু তত কম আপনাকে চমকে দেবার সুযোগ পাবে।
পরিকল্পনার সময় শত্রুর উদ্দেশ্য, সামর্থ্য আর তার অবস্থান সম্পর্কে আপনার জ্ঞান আপনাকে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নে সাহায্য করে। আধুনিক সামরিক বাহিনীতে এপ্রেসিয়েশন, ইন্টেলিজেন্স প্রিপারেশন অব দ্য ব্যাটেলফিল্ড, ওয়ার গেমিং এর মাধ্যমে সেনাপতিরা তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকেন। ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে, অথচ যুদ্ধ লাগলে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জার্মান মোতায়েন কেমন হবে, সেই পরিকল্পনা করা হয় ১৯০৫ সালে, পরিকল্পনাটির নাম ‘স্লিফেন প্ল্যান’। কথিত আছে, ১৯৯০ সালের গালফ ওয়ারের পরিকল্পনাও নাকি ইউএস আর্মির সেন্ট্রাল কমান্ড আগেই ওয়ার গেমিং করে রেখেছিল!
আইজেনহাওয়ার বলেন, ‘প্ল্যান’ নয় বরং ‘প্ল্যানিং’ ই সব। কেননা, যুদ্ধে প্রথম বুলেটটা বেরিয়ে যাবার সাথে সাথেই সব প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে যায়। স্বভাবতই যুদ্ধ শুরুর পর আপনার কল্পনা অনুযায়ী শত্রু প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। তাই এমন অবস্থায় যে যত বেশি কন্টিজেন্সি নিয়ে প্রস্তুতি থাকে, সে তত বেশি উদ্যোগী হয়ে লড়তে পারে।
তাই সব পরিকল্পনা হয়ত বাস্তবায়নের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু শান্তিকালীন সময়ে ক্রমাগত পরিকল্পনা প্রণয়নে অভ্যস্ত সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী হন। তাই তো সানজু বলেন, যে যত বেশি হিসেব কষে পরিকল্পনা করে, সে তত বেশি যুদ্ধ জেতে।
এতক্ষণ তো জানা গেল আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সানজুর আর্ট অফ ওয়্যার এর ১ম অধ্যায় কেমন হতে পারে সেই সম্পর্কে। সানজুর কথাগুলো এতক্ষণ লেখক আমাদেরকে আমাদের পরিচিত নানা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। কেমন হয় যদি সানজুর মূল বক্তব্যগুলো কেমন ছিল সেটা জানা যায়? মেজর ডেল এইচ খান রোর বাংলার পাঠকদের জন্য নিয়ে হাজির হয়েছেন সানজুর মূল লেখা নিয়েই, যা এখন থেকে আমাদের পরিচিত উদাহরণ ব্যাখ্যার পরই থাকবে। উল্লেখ্য, সানজুর মূল বক্তব্যের এই অংশটুকু আগে কোনো মাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি ডেল এইচ খানের পক্ষ থেকে। ফলে রোর বাংলার পাঠকগণ এক আলাদা স্বাদই পেতে যাচ্ছেন আজকের লেখার পরবর্তী অংশ থেকে। – সম্পাদকীয়
অধ্যায় ১: যুদ্ধের সম্ভাব্যতা যাচাই
সানজুর দ্য আর্ট অব ওয়ার এর প্রথম অধ্যায়টির চৈনিক নামের সরল বাংলা হতে পারে ‘পরিকল্পনা প্রণয়ন’ অথবা ‘বিবেচনা’ কিংবা ‘যাচাই’।
এ অধ্যায়টিকে লিওনেল গিলেস ‘পরিকল্পনা প্রণয়ন’ (Laying Plans), আর এল উইং ‘বিবেচনা’ (The Calculations), রালফ ডি সয়্যার ‘প্রাথমিক অনুমান’ (Initial Estimations), স্যামুয়েল বি গ্রিফিথ ‘প্রাক্কালন’ (Estimates) এবং চাও-হউ উই ‘বিস্তারিত মূল্যায়ন এবং পরিকল্পনা’ (Detail Assessment and Planning) হিসেবে নামকরণ করেছেন। পাঁচটি মৌলিক হেতু (Factor) আর সাতটি উপাদান/বিবেচ্য (Element/Consideration) পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে কীভাবে আসন্ন যুদ্ধের ফলাফল যাচাই করা যায়, এ অধ্যায়ে তা-ই আলোচনা করা হয়েছে।
যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার আগে যুদ্ধের গুরুত্ব আর আসন্ন যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে সানজু বলেন,
যুদ্ধ মানেই বাঁচা-মরার খেলা; কেউ টিকে থাকে, আর কেউ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়াটা যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক প্রসঙ্গ; এবং এমন সিদ্ধান্ত নেবার আগে যথাযথভাবে যুদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন, আর আসন্ন যুদ্ধের পূর্বাপর নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করাটা সবচেয়ে জরুরি।
পাঁচটি মৌলিক হেতুর প্রেক্ষিতে আসন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনা যাচাই সম্পর্কে সানজু বলেন,
যেকোনো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেবার আগে পাঁচটি হেতু আর সাতটি উপাদান/বিবেচ্যর প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি যাচাই করতে হয়।
প্রথম হেতু হল নৈতিক প্রভাব, দ্বিতীয়ত আবহাওয়া, তৃতীয়ত ভূমি, চতুর্থত নেতৃত্ব এবং পঞ্চমত ব্যবস্থাপনা।
১) ‘নৈতিক প্রভাব’ হলো যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য এমন উপযুক্ত কারণ যার জন্য দেশের জনগণ তাদের দেশের নেতৃত্বের সাথে একাত্মতা বোধ করে আর আমৃত্যু লড়ে যাবার অনুপ্রেরণা পায়।
২) ‘আবহাওয়া’র হেতু মানে সামরিক অভিযান পরিকল্পনা আর পরিচালনায় শীত, গ্রীষ্ম আর বর্ষা ঋতুর সুবিধা অসুবিধার প্রভাব।
৩) ‘ভূমি’র হেতু বলতে বোঝায় সামরিক অভিযান পরিকল্পনা আর পরিচালনায় নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের দূরত্ব; যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছাবার রাস্তার অবস্থা; আর যুদ্ধক্ষেত্রের প্রকৃতি (খোলা ময়দান, নাকি সংকীর্ন এলাকা) ইত্যাদির প্রভাব।
৪) নেতৃত্বের হেতু বলতে বোঝায় সামরিক অভিযান পরিকল্পনা আর পরিচালনায় সেনাপতিদের প্রজ্ঞা, ঋজুতা, মানবিকতা, সাহস আর দৃঢ়তার উৎকর্ষের প্রভাব।
৫) ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় সামরিক অভিযান পরিকল্পনা আর পরিচালনায় বাহিনীর বিদ্যমান সাংগঠনিক বিন্যাস, যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, উপযুক্ত সেনাপতিদের নিয়োগ, রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং যুদ্ধের জন্য জরুরি সরঞ্জামাদির প্রস্তুতিজনিত প্রভাব।
এমন কোনো সেনাপতি নেই যিনি এই পাঁচ হেতুর কথা জানেন না; যারা যথাযথভাবে এই পাঁচ হেতু আত্মস্থ করতে পারেন, তারাই যুদ্ধে জেতেন; আর যারা পারেন না, তারা হারেন।
যুদ্ধ পরিকল্পনা করার আগের সাতটি উপাদান/বিবেচ্য সম্পর্কে সানজু বলেন,
যুদ্ধের পরিকল্পনা করার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে নিচের সাত বিবেচ্যগুলোর একটির সাথে আরেকটির যাচাই করতে হয়।
আপনি যদি বলতে পারেন যে দুই প্রতিপক্ষ শাসকের মধ্যে জনগণের ওপর কার নৈতিক প্রভাব বেশি, কার সেনাপতি বেশি যোগ্য, কার সেনাবাহিনী প্রকৃতি আর ভূমির ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত, কার সেনাবাহিনীতে আদেশ নির্দেশ ঠিকঠাক প্রতিপালিত হয়, কার সৈন্যরা বেশি করিৎকর্মা, কার অফিসার আর সৈন্যরা উন্নততর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং কার প্রশাসনে যথাযথভাবে পুরস্কার আর শাস্তি নিশ্চিত করা হয়- তাহলে আমি বলে দিতে পারি, যুদ্ধে কে জিতবে আর কে হারবে!
আর্ট অব ওয়ার অনুশীলনের ব্যাপারে সানজুর সদুপদেশ,
যে সেনাপতি আমার কলা-কৌশল রপ্ত করে, তার জয় নিশ্চিত। এমন সেনাপতিকে নিশ্চিন্তে নিয়োগ দিন! আর আমার কলা-কৌশলকে অবজ্ঞাকারী সেনাপতিকে নিয়োগ দিলে তার পরাজয় নিশ্চিত, তাই তাকে অবিলম্বে ইস্তফা দিন। আমার পরামর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রত্যেক সেনাপতির উচিত উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনা করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া।
যুদ্ধে ধোঁকার সার্থক প্রয়োগ সম্পর্কে সানজু বলেন,
সব লড়াই-ই ধোঁকা নির্ভর। তাই যখন আপনি আসলে যথেষ্টই শক্তিশালী, তখন প্রতিপক্ষের সামনে নিজেকে দুর্বল হিসেবে উপস্থাপন করুন, আর যখন কিছু করবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলবেন, তখন এমন ভাব করুন যেন প্রতিপক্ষ ভাবতে থাকে যে আপনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
যখন শত্রুর খুব কাছে পৌঁছে গেছেন, তখনও ভান করুন যেন এখনও অনেকটা পথ দূরেই আছেন; আর যখন দূরে আছেন তখন শত্রুকে এমনভাবে হুমকি-ধামকি দিতে থাকুন যেন সে এই ভেবে তটস্থ থাকে যে আপনি হয়ত আশেপাশেই ঘাপটি মেরে বসে আছেন এবং যেকোনো সময় হামলে পড়বেন।
শত্রুকে প্রলুব্ধ করতে টোপ ফেলুন; শত্রুকে ভাবতে দিন যে আপনি তার চাপে এলোমেলো হয়ে গেছেন, আর তারপরই অতর্কিতে শত্রুর উপর হামলে পড়ুন। যখন শত্রু জমায়েত হবার চেষ্টা করে, তখন তাকে এলোমেলো করে দিতে বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। তার শক্তিকে এড়িয়ে চলুন।
শত্রুর সেনাপতিকে রাগিয়ে দিন, যেন সে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেবার অবকাশ না পায়, আর তাকে সারাক্ষণ বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করুন।দুর্বল সাজার ভান করুন আর শত্রুকে উদ্ধত হয়ে ভুল আর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করুন। শত্রু যখন বিশ্রাম নেবার কথা ভাবছে, তখনই তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলুন। যখন সে একতাবদ্ধ, তখন তাকে বিভক্ত করুন। যেখানে সে অপ্রস্তুত সেখানেই হামলা করুন; আর যেখানে সে আপনাকে প্রত্যাশাই করছে না, ঠিক সেখান দিয়েই হামলা করুন।
এই হলো একজন সমরবিদের বিজয়ের মূলমন্ত্র, যা মোক্ষম সময়ের আগে প্রকাশ করতে নেই।
এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ
১) কেন পড়বেন সানজু’র ‘দ্য আর্ট অফ ওয়্যার’?
২) সানজু: এক রহস্যময় চীনা সমরবিদ এবং দুর্ধর্ষ সেনাপতি
ফিচার ইমেজ: The Imaginative Conservative