ঘুমানো যাবে না। ম্যাকবেথ ঘুমকে হত্যা করেছেন।
– শেক্সপিয়ার, ম্যাকবেথ
ঘুম শুধু মানুষের শারীরিক ক্লান্তিই দূর করে না। এটি স্বপ্নের মাধ্যমে তাকে মানসিকভাবেও চাঙ্গা করে তোলে। বাস্তব জীবনের বহু অপ্রাপ্তি মানুষ সুখ-স্বপ্নগুলোর মাধ্যমে পূরণ করে। কথাটি হাস্যকর শোনালেও মনোবিজ্ঞানীরা তেমনটাই দাবি করেন। এটি মানুষের মানসিক জগতে ভারসাম্য নিয়ে আসে। তবে কেমন হয় যদি বাস্তবের ভয়াবহ পরিস্থিতি মানুষের স্বপ্নের মধ্যেও ঢুকে পড়ে? যদি স্বপ্নের জগতেও মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে? এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন নাৎসি জার্মানিতে বসবাসরত বহু মানুষ। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা মানুষকে তাদের স্বপ্নের জগতেও রেহাই দেন না। ম্যাকবেথের মতো তারা মানুষের ঘুমকেও হত্যা করেন।
গত শতকের ত্রিশের দশকের নাৎসি জার্মানিতে মানুষেরা কেমন স্বপ্ন দেখত? এমন অদ্ভূত বিষয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন সে সময়ের একজন ইহুদী সাংবাদিক শার্লট বেরাডট। তিনি বাস করতেন বার্লিনের একটি ইহুদী অধ্যুষিত উপশহর শার্লটেনবার্গে। গোপনে গোপনে তিনি পাড়া-পড়শী, বন্ধু-বান্ধব, দর্জি, দুধ বিক্রেতা ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রায় তিনশো স্বপ্নের বর্ণনা সংগ্রহ করেন। তার একজন ডাক্তার বন্ধু তাকে এই কাজে সাহায্য করেন। সংগৃহীত স্বপ্নগুলো দেখা হয়েছিল ১৯৩৩-৩৯ এই ছয় বছরের মধ্যে। হিটলারের ক্ষমতা দখলের সময়কাল থেকে শুরু করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগপর্যন্ত।
১৯৬৬ সালে জার্মান ভাষায় এই সংকলন বই আকারে বের হয়। এর দু’বছর পর ‘দ্য থার্ড রাইখ অব ড্রিমস্’ শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে দার্শনিক হান্নাহ আরেন্ডট, বিখ্যাত লেখক ফ্রানৎস কাফকা, বার্টোল্ট ব্রেখট এবং হিমলার এপিগ্রাফ লিখেছেন। শেষদিকে মনোবিজ্ঞানী ব্রুনো বেটেলহেইম একটি প্রবন্ধে স্বপ্নগুলোকে মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ব্যাখা করেছেন।
১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। পুরো রাষ্ট্র এবং সমাজকে তিনি তার কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপের আওতায় নিয়ে আসেন। নজিরবিহীন দমন-পীড়ন চালান ইহুদী ও কম্যুনিস্টদের উপর। ইতিহাসজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকের চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে হাজির হন তিনি। পুরো দেশের মানুষের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম এমনকি চিন্তা-ভাবনাতেও তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। তারই ছাপ পড়ে সে সময়ের সাধারণ মানুষের মনোজগতে। সেটিই তাদের রাতের বেলায় দেখা স্বপ্নের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। এমন কিছু স্বপ্নের গল্প শোনা যাক।
হিটলারের ক্ষমতা দখলের তিন দিন পরের ঘটনা। জনৈক হার এস. নামক একজন কারখানা-মালিক রাতের বেলায় একটি স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নের বিবরণ তিনি দেন এভাবে:
আমি ঘুমের মধ্যে দেখি গোয়েবলস আমার কারখানা পরিদর্শনে এসেছেন। তিনি শ্রমিকদেরকে মুখোমুখি দুটি সারিতে দাঁড় করান। আমাকে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাকে নাৎসি কায়দায় স্যালুট দিতে হবে। আধা ঘন্টা ধরে খুব চেষ্টা করে আমি নিজের হাত উপরে তুলতে সক্ষম হলাম। এই পরিশ্রম করতে গিয়ে আমার মেরুদন্ড ভেঙে গেল। গোয়েবলস এই কান্ড দেখে খুশি না বেজার হলেন বোঝা গেল না। যেন তিনি কোনো একটা মজার খেলা দেখছিলেন। তাকে স্যালুট দেওয়ার পর তিনি মাত্র কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করে বললেন: ‘তোমার স্যালুটের আমার কোনো প্রয়োজন নেই।’ তারপর তিনি দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। তার নষ্ট পায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি নিজের পতন ঠেকালাম। তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যেতে দেখলাম। ঘুম ভাঙার আগ পর্যন্ত আমি নিজের কারখানায় দু’দশকের পরিচিত সহকর্মীদের সামনে হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
এই ধরনের স্বপ্ন দেখার কারণ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেন। তারা বলেন, এটি হলো কোনো ব্যক্তি মানুষের উপর একটি সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার প্রকৃতি ও ফলাফল উভয়ই। শার্লট বেরাডটের মতে, একটি সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা এভাবে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধ্বংস করে দেয়। মানুষের সামনে তাকে অপদস্ত করার মাধ্যমে বা তার ভীতি তৈরি করে তার বহুদিনের অর্জিত আত্মবিশ্বাসকে নষ্ট করে ফেলে।
১৯৩৩ সালের শুরুর দিকে ত্রিশ বছর বয়সী এক নারী তার দেখা একটি স্বপ্নের বিবরণ দেন এভাবে,
আমি একটি অপেরা থিয়েটারে বসে ছিলাম। আমার গায়ে ছিল একটি নতুন গাউন। চুল সুন্দর পরিপাটি করে বাঁধা ছিল আমার। এটি ছিল এক বিশাল অপেরা হাউজ। প্রচুর পরিমাণে দর্শকসারি ছিল সেখানে। আমার প্রতি বহু মানুষের প্রশংসা আমি উপভোগ করছিলাম। আমার প্রিয় অপেরা ‘দ্য ম্যাজিক ফ্লুট’ দেখানো হচ্ছিল সেখানে। অপেরা চলাকালীন মঞ্চে একটি বাক্য উচ্চারিত হলো: ‘নিশ্চয় এ-ই সেই শয়তান’। সেই মুহূর্তে পুলিশের একটি স্কোয়াড থিয়েটারের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারা সরাসরি আমার কাছে চলে আসলো। আমাকে জানানো হলো, মঞ্চে ‘শয়তান’ উচ্চারণ শুনে আমি হিটলারের কথা ভেবেছিলাম। একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র আমার সে ভাবনা ধরে ফেলেছে। আমি সে সময় উৎসবমুখর দর্শকদের কাছে মিনতিভরা চোখে সাহায্যের জন্য তাকালাম। দেখলাম তারা সবাই নীরবে নির্লিপ্তভাবে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ এমনকি করুণা করেও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমার পাশের আসনের এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে একটু সদয় ও ব্যতিক্রম বলে মনে হলো। তার দিকে তাকিয়ে সাহায্যের নিবেদন করতে যাব অমনি তিনিও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।
চিন্তা নিয়ন্ত্রণের এই যন্ত্রটির বিবরণ ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা শুধু মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করেই ক্ষান্ত হন না। তারা মানুষের চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এমনকি একুশ শতকের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পৃথিবীতে এমন দুঃস্বপ্ন আক্ষরিকভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যেও ফেলে দিয়েছে। এর পনেরো বছর পর জর্জ অরওয়েল তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘১৯৮৪’ রচনা করেন। সেখানে তিনি একজন চরম ক্ষমতাধর ‘বিগ ব্রাদার’ এর গল্প শোনান। উপন্যাসের ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’– উক্তিটি সর্বাত্মক নজরদারিমূলক একটি ব্যবস্থার কথা বলে।
সে নারীই আবার পরবর্তী সময়ে আরেকটি স্বপ্নের গল্প শোনান। কোনো একটি থিয়েটারে দার্শনিক ফ্রিডরিখ শিলার রচিত ডন কার্লোস নামক একটি নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল। নাটকের মধ্যে ‘দয়া করে আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা দিন’- উক্তির সাথে সাথে থিয়েটারে তালির রোল পড়ে যায়। এই জাতীয় স্বপ্ন সে সময়ের মানুষের চূড়ান্ত পরাধীনতার রূপক হিসেবে হাজির হয়।
চিন্তার নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারি সংক্রান্ত আরো বেশ কিছু স্বপ্নের উল্লেখ পাওয়া যায়। একই সাথে একই ধরনের অনেকগুলো স্বপ্ন একাধিক ব্যক্তি দেখছেন, এমন নজিরও পাওয়া যায়। তাতেই বোঝা যায়, একই রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সকল মানুষের মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফলে তারা প্রায় কাছাকাছি ধরনের স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন একই সাথে দেখেছিলেন।
১৯৩৪ সালের ঘটনা। একজন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী ডাক্তার তার নিজের দেখা একটি স্বপ্নের বিবরণ দেন,
রাত নয়টা বাজে তখন। আমার কাজ সেদিনের মতো শেষ হয়েছে। আমি ম্যাথিয়াস গ্রুনেওয়াল্ডের লেখা একটি বই নিয়ে সোফার উপরে আরাম করে বসলাম। হঠাৎ করেই দেখি প্রথমে আমার ঘরের এবং পরে পুরো অ্যাপার্টমেন্টের দেয়ালগুলো একে একে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমি চারপাশে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে আবিষ্কার করলাম, যত দূর চোখ যায়, কোনো অ্যাপার্টমেন্টেই কোনো দেয়াল আর অবশিষ্ট নেই। তারপর আমি লাউডস্পিকারে একটি ঘোষণা শুনতে পেলাম: “এই মাসের ১৭তম আদেশ অনুযায়ী কোনো ভবনেই কোনো দেয়াল রাখতে দেওয়া হবে না।”
এই স্বপ্নটি দেখে ডাক্তার ভদ্রলোক বিচলিত হয়ে পড়েন। পরের দিন সকালে তিনি তার ডায়েরিতে এটি লিখে রাখেন। পরে তা নিয়েও স্বপ্ন দেখেন। দেখেন যে, তিনি স্বপ্ন লিখে রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন।
স্বৈরশাসকেরা মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করে তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন চালিয়ে যায়। ডাক্তারের এই স্বপ্নটি দারুণ প্রতীকীভাবে এই পরিস্থিতিকে তুলে ধরে।
হিটলারের জার্মানিতে মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপ এবং কথাবার্তার উপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল। এর তীব্রতা বোঝা যায় এক নারীর দেখা স্বপ্ন থেকে। ১৯৩৩ সালের গ্রীষ্মকালে তিনি স্বপ্নে দেখেন, নিরাপত্তার খাতিরে তিনি ঘুমের মধ্যে রাশিয়ান ভাষায় কথা বলছেন। কারণ নাৎসিরা তো সে ভাষা বোঝেই না, তিনি নিজেও রাশিয়ান বোঝেন না। এমনকি তার ঘুমের মধ্যে কথা বলার কোনো অভ্যাসও নেই। তবু যদি ঘুমের ঘোরে সরকারবিরোধী কিছু বলে ফেলেন, সে ভয়ে তার অবচেতন মন তটস্থ থাকতে থাকতেই তিনি এই স্বপ্ন দেখেন।
একই সময়ে একজন তরুণ স্বপ্নে আয়তক্ষেত্র, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ এবং অষ্টভুজের বিচিত্র সব আকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। সেগুলো তার কাছে ক্রিসমাসের বিস্কুটের মতো মনে হয়েছিল। অন্য কোনো স্বপ্ন দেখতে গিয়ে যদি সরকারবিরোধী কিছু দেখে ফেলেন! তাই স্বপ্নে এসব বিমূর্ত আকার দেখাকেই নিরাপদ বলে ভেবেছিল তার অবচেতন মন।
ব্যাপক আতঙ্ক এবং ভয়ের পরিবেশের মধ্যে মানুষ এমনকি নিজের আপনজনের প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতিও হারিয়ে ফেলে। যদিও ঘটনাটি ঘটেছিল স্বপ্নে, তবে আমরা আগেই জেনেছি এ জাতীয় স্বপ্নের পেছনে একটি বাস্তব পরিস্থিতি হাজির থাকে।
১৯৩৬ সালের শীতকালের ঘটনা। সে বছরে নাৎসি সরকার কর্তৃক জাতি সংক্রান্ত আইন জারি করা হয়েছিল। তাতে জার্মানিতে বসবাসরত ইহুদীদের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গড়িয়েছিল। জনৈক ডাক্তারের একজন অফিস সহকারী মহিলা তার ইহুদী মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তার বাবা ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। বাবার মৃত্যুর পর তিনি মায়ের সাথে বসবাস করছিলেন। সে সময় তিনি স্বপ্নে দেখেন, তিনি তার মাকে নিয়ে পাগলের মতো দৌড়ে কোথাও পালাচ্ছেন। দৌড়াতে দৌড়াতে তার মা হাঁপিয়ে গেলে তাকে পিঠে নিয়ে তিনি আবারো দৌড়াতে থাকেন। একপর্যায়ে তার খেয়াল হয়, তিনি তার মায়ের লাশ পিঠে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। তখন তার মনে হয়, তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
১৯৩৫ সালে একজন ইহুদী আইনজীবী স্বপ্নে দেখেন, তিনি তুষার ঢাকা পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পৃথিবীর সর্বশেষ দেশটিকে খুঁজছেন, যেখানে ইহুদীরা শান্তিতে বসবাস করতে পারে। তিনি একসময় তেমন একটি দেশ খুঁজেও পেলেন। কিন্তু সে দেশের শুল্ক বিভাগের দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা তার পাসপোর্ট বরফের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তার সব আশা মাটি হয়ে গেল। বিষণ্ণ মনে তিনি দেখলেন, তার সেই প্রতিশ্রুত দেশ সূর্যের আলোয় চকচকে সবুজ রঙ ধারণ করেছে। এই স্বপ্ন দেখার ছয় বছর পর জার্মানি থেকে ইহুদীদের গণ নির্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
শহুরে জার্মান নারীরা হিটলারকে নিয়ে বেশ উদ্ভট ধরনের কিছু স্বপ্ন দেখেন। কেউ দেখেন কারফুরস্টেনডামে সন্ধ্যার পোশাক পরে ফুয়েরার সাহেব এক হাতে এক মহিলাকে ধরে চুমু খাচ্ছেন, আরেক হাতে নাৎসি প্রচারপত্র বিলি করছেন। আরেকজন দেখেন, গোরিঙ সিনেমার মধ্যে কোনো এক সেলসগার্লকে অন্ধের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
জাতি সংক্রান্ত আইন জারি করার পর এক নারী স্বপ্নে দেখেন, তিনি আইন অনুযায়ী এক পোয়া পরিমাণে ইহুদী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। তারপরেও তিনি দেখেন, হিটলারের সাথে তিনি একটি বিশাল সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছেন। বহু মানুষ তাদেরকে দেখছে। একটা ব্যান্ড পার্টিও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্বপ্নে তাকে দারুণ আনন্দিত ও গর্বিত দেখাচ্ছিল।
এই জাতীয় স্বপ্নগুলোকে হিটলার-ভক্ত নারীকুলের তার প্রতি প্রেমজ আকর্ষণের চিহ্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। হিটলার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জনসমর্থন নিয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর গণ-উন্মাদনা সৃষ্টি করে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা উপভোগ করেছিলেন। তার ক্ষমতার বলি ইহুদীরা হলেও ভক্তেরও কমতি ছিল না।
মানুষের ব্যক্তিগত সত্তাকে কাঠামোগতভাবে বিনষ্ট করে দিয়ে তাদেরকে বিবেকহীন এক অন্ধ পশুপালে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝা যায় এক ব্যক্তির দেখা একটি স্বপ্ন থেকে। তিনি দেখেন, তিনি কোনো একদল মানুষের সাথে সম্মিলিতভাবে কথা বলা ছাড়া একা একা আর কথা বলতে পারছেন না।
কিছু কিছু স্বপ্নের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে দর্শক স্বপ্নের মধ্যেই ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছোটখাট আকারের প্রতিবাদ করার দুঃসাহস দেখান। যেমন, এক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখেন, স্বপ্ন দেখাও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। তবুও তিনি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে স্বপ্ন দেখছেন।
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা এভাবে মানুষের সবচেয়ে গোপন এবং ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। স্বপ্নের মতো ব্যক্তিগত মূহুর্তগুলোও রাজনৈতিক হয়ে যায়। স্বপ্নের মধ্যে অদ্ভুত ধরনের অসংখ্য রূপকের ছড়াছড়ি দেখা যায়। এই দুর্দান্ত প্রতীকগুলো কোনো একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্মারক হয়ে দাঁড়ায়। অচেতন মনে জমা হওয়া নানা গোপন আশঙ্কা সাধারণ অবস্থায় হয়তো নিজের কাছেও ধরা পড়ে না। কিন্তু স্বপ্নের মাধ্যমে সেগুলো সচেতন মনে চলে আসে। হিটলারের শাসনামলের মতো চরম রাজনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের কালে মানুষের দেখা স্বপ্ন তাই পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।