বর্ণবাদের মূলকথা হলো- সব মানুষ সমান হতে পারে না। গায়ের রং, জন্ম পরিচয়, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, আধিপত্যের ধরন- এসব নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে বর্ণবাদী আচরণ তৈরি হয়। মানুষের ভেতরের বিভেদকে এভাবে একরকম বৈধতা দেওয়া হয়। ফলে এক দল কর্তৃক আরেক দলকে নির্যাতনের সামাজিক পরিস্থিতির বীজ এভাবেই রোপিত হয়ে যায়।
বর্ণবাদের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, এটি শোষিত মানুষের ভেতর তীব্র হীনমন্যতা জন্ম দেয়। তবে সবসময় যে এতে একই ফল আসে, তা নয়। আবার যুগে যুগে এমন মানুষও জন্মান, যারা এধরনের প্রতিকূলতাকে তীব্র শক্তি ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে পরাজিত করেন। জেমস ম্যাককুন স্মিথ (১৮১৩-১৮৬৫) ছিলেন এমনই একজন মানুষ। প্রথম মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ চিকিৎসক, বর্ণবাদ বিরোধী এক্টিভিস্ট, লেখক, সমালোচক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি কঠোর বর্ণবাদের সময়েই নাম কুড়িয়েছিলেন।
মজার ঘটনা হচ্ছে, এই প্রতিভাবান মানুষটির নাম অবধি মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিলো। বিশ শতকের শেষের দিকে তাঁরই কোন এক বংশধর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পাঠের সূত্রে তাঁর নাম পরিবারের পুরনো বাইবেলের মধ্যে খুঁজে পায়। এভাবে মার্কিন ইতিহাসে তাঁর ভুলে যাওয়া নাম আবার ফিরে আসে। জেমস ম্যাককুন স্মিথ ১৮১৩ সালের ১৮ এপ্রিল নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীন মানুষ হিসেবে নয়, তিনি দাস হিসেবেই জন্মেছিলেন। তাঁর মা ল্যাভিনিয়া একজন কালো চামড়ার দাসী এবং বাবা স্যামুয়েল স্মিথ একজন সাদা চামড়ার দাস মালিক ছিলেন। কৌতূহলের বিষয় এটাই যে, ম্যাককুনের মা তাঁর বাবার দাসী ছিলেন! ১৮২৭ সালে নিউইয়র্কের ইমান্সিপেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৪ বছর বয়সে ম্যাককুন দাস থেকে স্বাধীন মানুষের পরিচিতি পান।
ম্যাককুনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় আফ্রিকান ফ্রি স্কুলে পাঠ গ্রহণের মাধ্যমে। সেখানে একজন শিশু ছাত্র হিসেবে তিনি অসাধারণ প্রতিভাবান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি বর্ণবাদ বিরোধী বা অ্যাবোলিশনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও জেনেভা মেডিকেল কলেজে ভর্তির কথা ভেবেছিলেন, তবে কালো মানুষ হবার কারণে বঞ্চনার শিকার হন। তাঁর স্কুলজীবনের শিক্ষক ও কৃষ্ণাঙ্গ এপিস্কোপাল অ্যাংলিক্যান পাদ্রী রেভারেন্ড পিটার উইলিয়ামস তাঁকে আটলান্টিকের ওপারে স্কটল্যান্ডে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরামর্শ দেন।
ইউরোপের পশ্চিম ভূখণ্ডে তখন বর্ণবাদের ছায়া কিছুটা হলেও কম ছিলো। ম্যাককুন তাই লিভারপুলে পা রেখে এক রকম মুক্তির হাওয়া পেয়েছিলেন। অ্যাবোলিশনিস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে ‘লন্ডন এজেন্সি অ্যান্টি স্লেভারি সোসাইটি’র সাথে যুক্ত হন। বাল্যকাল থেকে তাঁর শিক্ষকরা তাঁর যে মেধা ও বুদ্ধির পরিচয় পেয়েছিলেন, নতুন ভূখণ্ডে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়েও তার কোন ব্যতিক্রম হলো না। ১৮৩৫ সালে তিনি স্নাতক ও এর পরের বছর স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৮৩৭ সালে মেডিকেল ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি প্যারিসে তাঁর ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করেন।
শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি নিউইয়র্কে ফিরে আসেন। ১৮৪০ সালে তিনি ম্যালভিনা বার্নেট নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গ রমণীকে বিয়ে করেন। তাঁদের ১১ সন্তানের মধ্যে ৫ জন ছাড়া সবাই অকালে মারা গিয়েছিলো। সফল শিক্ষাজীবনের পর নিজ দেশে ফিরে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সম্মাননা পান। পুরো মার্কিন মুল্লুকে তিনিই ছিলেন মেডিকেল ডিগ্রী অর্জনকারী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি। আমেরিকার মেডিকেল জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশকারী হিসেবেও তিনি প্রথম কালো মানুষ!
নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে তিনি তাঁর ডাক্তারি প্র্যাকটিস শুরু করেন। বাল্যকালে কালো হবার কারণে বৈষম্যের শিকার হলেও তিনি রুগ্ন মানুষের সেবায় কোন বৈষম্যের আশ্রয় নেন নি। কালো ও সাদা নির্বিশেষে সকল রোগীদের তিনি সমানভাবে চিকিৎসাসেবা দিতেন। চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি শিশুদের জন্য সন্ধ্যাকালীন বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করেন। নিউইয়র্কে তিনি একটি ফার্মেসি চালু করেন, যা সমগ্র আমেরিকায় কালো মানুষের মালিকানার প্রথম ফার্মেসি ছিলো।
১৮৪৬ সালে তিনি নিউইয়র্কের ‘কালার্ড অরফান অ্যাসাইলাম’ নামের কৃষ্ণাঙ্গ অনাথ আশ্রমে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এখানে তিনি প্রায় ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, এই অনাথালয় ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। নিউইয়র্কে স্বাধীন কৃষ্ণাঙ্গদের বেকারত্ব বেশি থাকায় এখানে অনাথ শিশু ছাড়াও গরীব মা বাবার শিশু সন্তানদেরও রাখা হতো। এখানে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি সংক্রামক রোগের টিকা প্রদান করা হতো। ১৮৫২ সালের জুলাই মাসে ম্যাককুন তাঁর বন্ধু ও শ্বেতাঙ্গ আবোলিশনিস্ট গেরিট স্মিথের থেকে পাওয়া ৫ হাজার একর জমি হাসপাতালের ট্রাস্টি বোর্ডে দান করেন।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে থাকার সময়ই তিনি সেখানকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচিত হন। ছাত্র থাকাকালীন সেখানকার অ্যাবোলিশনিস্ট সংগঠন ‘গ্লাসগো ইমান্সিপেশন সোসাইটি’র সাথে যুক্ত হন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইংল্যান্ডে ১৮৩৩ সালে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে তিনি ‘আমেরিকান অ্যান্টি স্লেভারি সোসাইটি’তে যুক্ত হন। এই সংগঠন সমমনা হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ উভয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত ছিলো।
বর্ণবাদবিরোধী নিবন্ধ প্রকাশিত হবার কারণে ম্যাককুন ধীরে ধীরে জাতীয় দাস বিলোপ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর লেখা ‘ডেসটিনি অব দ্য পিপল অব কালার’, ‘ফ্রিডম অ্যান্ড স্লেভারি ফর আফ্রিকানস’, ‘এ লেকচার অন দ্য হাইতিয়ান রিভোল্যুশন’ দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। ‘কালার্ড পিপল’স এডুকেশনাল মুভমেন্ট’ আন্দোলনও তিনি পরিচালনা করতেন।
১৮৫০ সালে ‘ফ্যুজিটিভ স্লেভ ল’ নামে একটি নতুন আইন পাশ হয়। এ আইনে দক্ষিণাঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা দাসদের স্ব স্ব এলাকায় ফেরত যাবার বিধান রাখা হয়। এই আইনের বিরুদ্ধে অ্যাবোলিশনিস্ট মুভমেন্টে যুক্ত নেতৃবৃন্দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ম্যাককুন তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে দাসপ্রধান অঙ্গরাজ্য থেকে জীবন হাতে নিয়ে পালিয়ে আসা নিপীড়িত কালো মানুষদের নিরাপদ আশ্রয় ও সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখেন। এ বছরের মাঝামাঝি তিনি তাঁর অন্যান্য সহযোগীদের সাহায্যে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রথম জাতীয় সংগঠন ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর কালারড পিপল’ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। নিউইয়র্কের রচস্টারে তিন দিনব্যাপী এক সম্মেলনের মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। কারিগরি ও প্রায়োগিক শিক্ষার উপর তিনি বেশি গুরুত্ব দিলেও সাধারণ শিক্ষার গুরুত্ব তিনি অস্বীকার করেন নি। সভায় উপস্থিত সবাই ম্যাককুনের যৌক্তিক ও মানবিক বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সবচেয়ে অনুপ্রেরণা দানকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিবাদন জানান।
‘আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি’ নামে নিউজার্সি ভিত্তিক একটি ডানপন্থী সংগঠন স্বাধীন কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকা পাঠিয়ে দেবার জন্য প্রচারণা চালাতো। জেমস ম্যাককুন স্মিথ এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী কৃষ্ণাঙ্গদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দাবি করেন। এর জন্য তাঁকে আইনগত লড়াইয়ে অংশ নিতে হয়েছিলো। তিনি নিউইয়র্ক শহরে ‘লিগ্যাল রাইটস এসোসিয়েশন’ নামক সংগঠন গড়ে তোলেন। এর কাজ ছিলো সংখ্যালঘু ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
১৮৬৩ সালের জুলাই মাসে পুরো নিউইয়র্ক শহরে জ্বলে উঠলো ড্রাফট রায়টের আগুন। শ্বেতাঙ্গ, বিশেষ করে নতুন আইরিশ অভিবাসীদের বিশেষ রাগ ছিলো স্বাধীন কালো মানুষদের প্রতি। সেই রাগ থেকে এই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় আইরিশ সন্ত্রাসীরা কালার্ড অরফান অ্যাসাইলাম ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনাথ আশ্রমের নিষ্পাপ নিরীহ শিশুদের রক্ষা করে সেখানকার কর্মচারী ও ইউনিয়ন আর্মি। ম্যাককুন ও আরো অনেক কৃষ্ণাঙ্গ পরিবার এই হত্যাযজ্ঞ দেখে ম্যানহাটন থেকে ব্রুকলিন চলে আসেন।
জেমস ম্যাককুন স্মিথ শুধু প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ চিকিৎসক ও বর্ণবাদবিরোধী ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, তিনি উনিশ শতকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবীও ছিলেন। তাঁর অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য অবদান ছিলো বর্ণবাদের পক্ষে দেওয়া মিথ্যা বৈজ্ঞানিক উপাত্তকে ভুল প্রমাণ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অকাট্য তত্ত্বের আলোকে বর্ণবাদের অসারতা প্রমাণ করা। সেসময় বর্ণবাদ সমর্থক পত্র-পত্রিকা সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য ফ্রেনোলজি নামের মিথ্যা বিজ্ঞানের সাহায্যে কালো মানুষদের মেধাগত ও মানবিক অক্ষমতার অসার প্রচার চালাতো। তাঁর লেখা কলাম ও মনোজ্ঞ বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি সেসব মিথ্যা প্রচারের কঠোর জবাব দিতেন।
১৮৬৩ সালে ম্যাককুন ওহাইয়ো রাজ্যের উইলবারফোর্স কলেজের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। উল্লেখ্য, এই কলেজ ছিলো কালো মানুষের মালিকানা ও অর্থায়নে প্রথম কোন কলেজ। কঠোর পরিশ্রমের ফলে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে তখন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।
১৮৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর জেমস ম্যাককুন স্মিথ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লং আইল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর মাত্র ১৯ দিন পর মার্কিন সংবিধানের ১৩ তম সংশোধন করে সমগ্র দেশে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়।