এদেশকে চিরকালই অত্যন্ত বন্ধুর পথ পার করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়েছে। অনেক কষ্ট, ত্যাগ- তিতিক্ষার পরে যখন বাংলার মানুষ স্বাধীনতার আলো দেখতে পেতে শুরু করে, ঠিক তখনই এদেশকে সম্মুখীন হতে হয় ভবিষ্যতকে অন্ধকার করে দিতে চাওয়া এক গভীর ষড়যন্ত্রের। বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে এদেশের শত্রুরা হত্যা করে যায় সেসব সোনার সন্তানদের, যাঁদের হাত ধরেই হয়তো রচিত হতো এদেশের অন্য কোনো ভবিষ্যৎ। আর বাংলাকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার সেই ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে এদেশেরই কিছু বিশ্বাসঘাতক।
বাংলার বিজয় ঠেকানো তখন অসম্ভব, আজ নয়তো কাল আত্মসমর্পণ করতেই হবে। এমতাবস্থায় আত্মসমর্পণের মাত্র দুদিন আগে পাক-হানাদারেরা আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল- বদর বাহিনীর সদস্যরা বাড়ি থেকে তুলে তুলে হত্যা করে দেশের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সাংবাদিকদদের। সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরই একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম। সাম্য, মানবতা ও স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী আলীম যে এদেশকে আরেকটু হলেও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, তা সেদিন হানাদারেরা বুঝতে পেরেছিলো। মুক্তির সংগ্রামে তাঁর সাহায্য ও অবদানের সাথে পরিচিত ছিলো বিশ্বাসঘাতক আল-বদর বাহিনীর লোকেরা। তাই একাত্তরের ১৪ই ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র একদিন আগে ডা. ফজলে রাব্বীর মতো স্বনামধন্য চিকিৎসকের সাথে রচিত হয় আলীমেরও চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার গল্প।
আলীমকে আমরা চিনি একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একজন হিসেবে, জানি আল-বদর বাহিনীর করা বিশ্বাসঘাতকতার কথা। কিন্তু কেন সেদিন অন্যান্য সূর্যসন্তানদের সাথে আলীমকে বেছে নিয়েছিলো তারা? কেন আলীমদের দেশপ্রেমের আদর্শকে এত ভয় পেয়েছিল তারা? কারণ তারা জানতো, আলীমরাই এদেশের সেই সন্তান; ভয়, লোভ-লালসা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা- কিছুই হারাতে পারবে না তাদের। ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন তিনি। কিশোর বয়স থেকেই রাজনীতি সচেতন আলীম ছাত্রাবস্থা থেকেই বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘট সফল করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও ছিলো আলীমের সক্রিয় উপস্থিতি, এসময় তিনি কারাবরণও করেছেন। ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহ-সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলার মানুষের অধিকার ও মুক্তির জন্য তিনি আমৃত্যু কঠোর তপস্যা করেছেন, সয়েছেন অবর্ণনীয় নির্যাতন আর অকথ্য অত্যাচার। আরাম-আয়েশের সহজ জীবন ছেড়ে হেঁটেছেন জীবনের অগ্নিময় পথে, তবু আদর্শ ছিলো তাঁর জলের মতো স্বচ্ছ, দেশপ্রেমের প্রতি ছিলেন আমৃত্যু অটল-অবিচল এক প্রাণ। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন সরকারের বিরোধিতা করার জন্য দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যেতে হয় তাঁকে। ১৯৬১ সালে ইংল্যান্ড থেকে লাভ করেন ডি. ও. ডিগ্রি।
কিন্তু অন্য দেশে থাকা মানেই তাঁর জন্য দেশের কাজ করা বন্ধ করে দেওয়া ছিলো না কখনো। ১৯৬২ সালে তিনি লন্ডনে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন এর আহবায়ক ও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। দেশে থাকা অবস্থায় ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (তৎকালীন পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন) এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পরে ১৯৬৭ সালে এই সংগঠনেরই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হোন। ১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান অপথালমোলজিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হোন।
আলীমের পুরো নাম ছিলো আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আব্দুল আলীম চৌধুরী। তিনি ১৯২৮ সালে কিশোরগঞ্জের খয়েরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কিশোরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপরেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রে পাঠ নেওয়া শুরু করেন।
আলীম কেবল যে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন তা নয়, পাশাপাশি তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ। ছাত্রজীবনেই তিনি আলোকচিত্র ও সাংবাদিকতায় পাঠ গ্রহণ করেন, ছিলেন চিন্তানির্ভর ও বুদ্ধিদীপ্ত সৃজনশীল লেখায় বিশেষ পারদর্শী। ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ নামক তখনকার দুটি বাংলা দৈনিকে তিনি সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘খাপছাড়া’ ও ‘যাত্রিক’ নামের দুটি মাসিক পত্রিকা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে সহকারী প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মুক্তির আকাঙ্ক্ষী আলীম মুক্তিযুদ্ধের সময় আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার। নিজের অবস্থান ও সাধ্যানুযায়ী দেশের মুক্তিসংগ্রামে অবদান রেখে গেছেন। শহরের কারফিউ উঠে গেলে আলীম শুরু করতেন তাঁর নিজের চেষ্টা। নিজের গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন ফার্মেসি আর ওষুধের কোম্পানি থেকে ঘুরে ঘুরে তিনি ওষুধ সংগ্রহ করতেন। তারপর গোপনে সেগুলো পৌঁছে দিয়ে আসতেন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে। এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য আব্দুল আলীম, ফজলে রাব্বীসহ আরো কয়েকজন চিকিৎসকের সহায়তায় গড়ে উঠেছিলো একটা গোপন হাসপাতাল। ১৮ ডিসেম্বর যখন আলীমের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায়, তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা আবেগপ্রবণ হয়ে তাই বলেন, “আলীম ভাইয়ের দেওয়া আমার চোখের ব্যান্ডেজটি এখনো আছে, কিন্তু আমার আলীম ভাই আর নেই।”
কীভাবে পাকিস্তানী ঘাতকেরা খোঁজ পায় দেশদরদী এই চিকিৎসকের? সেটা এক কাপুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। ১৯৭১ সালের কিছু আগে আজিমপুরের বাসা ছেড়ে পরিবারসহ পুরানো পল্টনের একটা তিনতলা বাড়িতে এসে উঠেছিলেন আব্দুল আলীম, ভেবেছিলেন দুই ও তিন তলায় থাকার বাসা হিসেবে রাখবেন আর নিচতলায় তাঁর ক্লিনিকটা চালাবেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেলে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল পিডিপির সাথে জড়িত আব্দুল মতিন নামের এক প্রতিবেশী ভদ্রলোক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মওলানা মান্নানকে নিয়ে এলেন আলীমের কাছে। তাঁকে জানানো হলো, এই ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে অত্যন্ত বিপদে পড়েছেন। আলীমের সরল মনের সুযোগ নিয়ে মান্নান আলীমেরই বাসার নিচের তলায় থাকতে লাগলেন। সপ্তাহখানেকের মাথায় মওলানা মান্নানের ঘর জিনিসপত্রে ভরে উঠতে শুরু করলো। বাড়িঘর সব আগুনে পুড়ে গেছে, তাহলে এত জিনিসপত্র আসছে কোত্থেকে?
মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই মান্নানের আসল পরিচয় সামনে এসে গেলো। এই লোকটা আল-বদর বাহিনীর সংগঠক এবং সেইসাথে এদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের নেতৃস্থানীয়দের একজন। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের এক চিঠি এলো মান্নানের কাছে, তাতে বলা হয়- “আলীম ভাই ওপরে না থাকলে তোকে কবেই বোমা মেরে উড়িয়ে দিতাম।” তখন থেকেই আলীমের বাসার চারপাশে ছদ্মবেশী কয়েকজন আল-বদরের লোক দিয়ে পাহারা বসায় মান্নান। মুখে কিন্তু আলীমকে বলতে থাকেন, তাঁর উপকার জীবনেও ভুলবে না, তার জীবন থাকতে আলীমের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু নিজের দেশের সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, অন্য আর কারোর সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে কি তাদের আটকায়? ১৫ ডিসেম্বর আলবদরের লোকেরা যখন কাদামাখা একটা মাইক্রোবাসে আলীমকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়, তখন অনেক ডাকার পরেও মান্নান তার ঘরের দরজা খোলে না, এমনকি আলীম যেন বাসার পেছনের দরজা দিয়ে চলে যেতে না পারেন, তাই সেই দরজাও তিনি পেছন থেকে বন্ধ করে রেখেছিলেন। পরদিন, ১৬ ডিসেম্বর থেকে মান্নান গা ঢাকা দেয়।
১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার, ইটখোলার বধ্যভূমিতে অন্যান্য আরো অনেক বুদ্ধিজীবীদের সাথে খুঁজে আলীমের ছোট ভাই হাফিজ পান ভাইয়ের লাশ। পরনের লুঙ্গি-শার্ট তখনো তেমনই আছে, শুধু বুকটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা, চোখ বাঁধার গামছা গলায় এসে ঠেকেছে। চোখের চিকিৎসক আলীমের চোখ দুটো বেয়নেট দিয়ে উপড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলো হানাদারেরা, এ যেন এদেশের শিকল ভেঙে দেওয়ার আগে অন্ধ করে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র, আলীমের কপালে বেয়নেটের আঘাত ছিলো এদেশের ভবিষ্যতের ওপর এক সজোরে আঘাত।
আর সেই মওলানা মান্নানের কী হলো ? পরবর্তীতে ইনকিলাব পত্রিকার মালিক সেই মওলানা মান্নান জিয়া সরকারের আমলে হন প্রতিমন্ত্রী, এরশাদ আমলে হোন পূর্ণমন্ত্রী। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর নয়জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসককে হত্যার ষড়যন্ত্র জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে আদালত চৌধুরী মইনুদ্দীন আহমেদ ও আশরাফ-উজ-জামান খানকে দন্ডদান করে।
আলীমদের আদর্শকে এদেশের মাটি থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলো সেদিনকার পাকিস্তানী শাসকেরা আর এদেশেরই এক শ্রেণীর মানুষ। আলীমদের হত্যা ছিলো সেই চেষ্টার এক অংশ। তাদের সে চেষ্টা কি সফল হয়েছে? এদেশের মানুষ কি ভুলে গেছে সেই আদর্শ আর মুক্তির চেতনা? নাকি রক্তে রক্তে লাল হয়ে সেই থেকে আরো দ্বিগুণ হয়ে বেঁচে থাকলো আলীম কোটি প্রাণে?
ফিচার ইমেজ: dailysun.com