আজ থেকে প্রায় ৭৩ বছর আগেকার কথা। দিনটি ছিল ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট। আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমান ‘এনোলা গে’ থেকে সেদিন জাপানের শহর হিরোশিমার উপর ফেলা হয়েছিল ‘লিটল বয়’ নামক পারমাণবিক বোমাটি। সাথে সাথেই মানবজাতি বুঝে গেলো, নিজেদের সমূলে ধ্বংস করার অস্ত্র তারা আবিষ্কার করে ফেলেছে। সেদিনের ভয়াবহতার মাত্রা লিখে কখনোই প্রকাশ করা যাবে না, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনা শুনে কখনো সত্যিকার অর্থে অনুভব করা যাবে না। সেদিনের ছবিগুলোতে ধ্বংসের মাত্রা দেখে বুক কেঁপে ওঠে, হতাহত মানুষগুলোর ক্ষতবিক্ষত চেহারা আর আর্তনাদ দেখলে মন কেঁদে ওঠে।
হিরোশিমাতে ফেলা ৬ তারিখের সেই বোমার আঘাতে মারা গিয়েছিল ৭০,০০০-১,২৬,০০০ সাধারণ মানুষ এবং ২০,০০০ এর মতো সেনাসদস্য। এর ৩ দিন পর আগস্ট মাসের ৯ তারিখে নাগাসাকি শহরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিক্ষেপ করে ‘ফ্যাট বয়’ নামে অপর একটি পারমাণবিক বোমা। সেই বোমার আঘাতে মারা যায় আরো প্রায় ৩৯,০০০-৮০,০০০ মানুষ।
এরপর আর খুব বেশিদিন ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলেনি। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখেই অবসান ঘটে এ যুদ্ধের। আর নিজের দেশে এমন ভয়াবহ আক্রমণের মুখে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আত্মসমর্পণ করেছিলেন আরো আগেই, আগস্ট মাসের ১৫ তারিখে।
আজকের এ ফটোব্লগে আমরা ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের উপর চালানো সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ছবিগুলোই দেখাতে যাচ্ছি। ছবিগুলো নেয়া হয়েছে সিবিএস নিউজ, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, বিজনেস ইনসাইডার এবং ডেনভার পোস্টের ওয়েবসাইট থেকে।
১) বামের ছবিতে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পর সৃষ্ট মাশরুম ক্লাউড এবং বোমা নিক্ষেপের ক্ষেত্রটি দেখানো হয়েছে।
২) ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমার পারমাণবিক বোমার সেই মাশরুম ক্লাউডের উচ্চতা ছিল প্রায় ২০,০০০ ফুট!
৩) এই ‘এনোলা গে’ থেকেই হিরোশিমার উপর বোমাটি নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সামনে দাঁড়ানো সদস্যদের পরিচয় দেয়া যাক একে একে (বাম থেকে ডানে)- ইঞ্জিন মেকানিক প্রাইভেট হ্যারল্ড ওলসেন, কর্পোরাল জন জ্যাকসন, ক্রু চিফ স্টাফ সার্জেন্ট ওয়াল্টার ম্যাককেলেব, পাইলট পল ডব্লিউ. টিবেটস জুনিয়র, ইঞ্জিন মেকানিক সার্জেন্ট লিওনার্ড মার্কলে, ইঞ্জিন মেকানিক সার্জেন্ট জিন কুপার ও ইঞ্জিন মেকানিক সার্জেন্ট প্রাইভেট জন লেসনিয়েস্কি।
৪) হিরোশিমায় হামলা চালানোর অপারেশন অর্ডারের কপি।
৫) বোমগুলোকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘স্পেশাল’ হিসেবে। আসলে যে সেগুলো কতটুকু স্পেশাল ছিল তা তো আজ সবাই জানে।
৬) পারমাণবিক বোমা ফেলার আগে (বামে) ও পরে (ডানে) হিরোশিমার অবস্থা।
৭) প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের ছবি সম্বলিত আকাশ থেকে ফেলা এই লিফলেটে জানানী হয়, জাপান যদি আত্মসমর্পণ করে, তবে দেশটির সাধারণ নাগরিকদের কোনো ক্ষতি করা হবে না।
৮) সেই লিফলেটের ইংরেজি অনুবাদও ছিল সাথে।
৯) অনুবাদের বাকি অংশ।
১০) হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত টাইনিয়ান বেজে অবতরণ করছে এনোলা গে।
১১) হিরোশিমায় বোমা নিক্ষেপের পরদিন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মূল শিরোনামই ছিল
‘FIRST ATOMIC BOMB DROPPED ON JAPAN;
MISSILE IS EQUAL TO 20,000 TONS OF TNT;
TRUMAN WARNS FOE OS A ‘RAIN OF RUIN’’
১২) হিরোশিমার ধ্বংসযজ্ঞ কতটা ভয়াবহ ছিল, সেটাই যেন বলতে চাইছে এই সাদা-কালো ছবিটি।
১৩) আগস্ট মাসের ৯ তারিখে সহাস্য বদনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, হিরোশিমায় হামলা আসলে কেবল প্রথম চাল। যদি জাপান আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে এর চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
১৪) এটাও হিরোশিমারই ছবি। আশেপাশের ধ্বংসস্তূপের বিরান প্রান্তরে মাঝে মাঝে বিল্ডিংগুলো যেন বুক উঁচিয়ে ধ্বংসের সাক্ষ্য দিতেই দাঁড়িয়ে আছে।
১৫) হিরোশিমায় বোমা হামলায় আহত ছোট ভাইকে পিঠে করে বয়ে চলেছে আহত বড় ভাই, ছোট ভাইয়ের আঘাতের মাত্রাটাই বেশি ছিল। তাদের মতো এমন হাজার হাজার মানুষ উত্তাপ ও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
১৬) বিধ্বস্ত হিরোশিমার একটি ছবি। জাপানের সম্রাট হিরোহিতো ১৫ই আগস্ট বিনাশর্তে জাপানের আত্মসমর্পণ ঘোষণা করেন। অবশ্য অফিসিয়ালি মিত্র বাহিনীর কাছে সেটা হয় ২ সেপ্টেম্বর। আর এর মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে ২য় বিশ্বযুদ্ধের।
১৭) প্লুটোনিয়াম-সমৃদ্ধ এ পারমাণবিক বোমাটির নামের সাথে এর গঠনের মিল আছে। এটি দেখতে মোটাসোটা, নামও ছিল এর ‘ফ্যাট ম্যান’। এই ফ্যাট ম্যানকেই নিক্ষেপ করা হয়েছিল নাগাসাকির উপর। ২২ কিলোটন টিএনটির সমান বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন এই ফ্যাট ম্যান ছিল হিরোশিমাতে নিক্ষিপ্ত লিটল বয়ের চেয়েও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। এর ভর ছিল প্রায় ১০,০০০ পাউন্ড।
১৮) হিরোশিমার মতো নাগাসাকিতেও পারমাণবিক বোমাটি নিক্ষেপের পরপরই প্রায় ২০,০০০ ফুট উঁচু মাশরুম ক্লাউড দেখা গিয়েছিল। তবে নাগাসাকিবাসীর সৌভাগ্য বলতে হবে। কারণ তাদের শহরটি ছিল পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ফলে প্রকৃতিই যেন তার অগণিত মানবসন্তানকে সেদিন পাপাত্মাদের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেছিল। ফ্যাট ম্যানের প্রভাব তাই মূলত বিস্তৃত ছিল ২.৬ মাইল এলাকা জুড়ে। তবে এই অঞ্চলের মাঝেই সে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এসেছিল।
১৯) নাগাসাকিতে বোমা হামলায় আহত মা-মেয়ে। বোমা বিষ্ফোরণের ফলে সৃষ্ট উত্তাপে তাদের শরীরের অনেক স্থানই ঝলসে গিয়েছে। আহতদের জন্য খাদ্যের সরবরাহও ছিল বেশ অপ্রতুল।
২০) শত্রুপক্ষের বিমান হামলার সময় নিরাপদ আশ্রয় দিতে বানানো হয়েছিল এই গুহাগুলো। সেদিন যারা এর ভেতর আশ্রয় নিতে পেরেছিল, তারা অনেকটাই বেঁচে গিয়েছিল পারমাণবিক বিষ্ফোরণ ও থার্মোনিউক্লিয়ার রেডিয়েশনের ভয়াবহতা থেকে।
২১) ইউএস সিগনাল কর্পসের পক্ষ থেকে তোলা এ ছবিতে এক লোককে নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
২২) হিরোশিমা প্রিফেকচারাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোমোশন হলের এ ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে। পরবর্তীতে পারমাণবিক বোমা হামলার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এটি সংরক্ষণ করা হয়, যা হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল, অ্যাটমিক বোম্ব ডোম, গেনবাকু ডোম ইত্যাদি নানা নামেই পরিচিত।
২৩) মহিলার পরনে ছিল জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনো। পারমাণবিক বোমা বিষ্ফোরণের ফলে সৃষ্ট তাপে জামার নকশাও পুড়ে গিয়ে তার গায়ে বসে গিয়েছিল!
২৪) মিত্রপক্ষের এক সংবাদদাতা ৮ই সেপ্টেম্বর দাঁড়িয়ে আছেন হিরোশিমার এক মুভি থিয়েটারের সামনে।
২৫) পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের প্রায় ১ মাস পর আকাশ থেকে তোলা হিরোশিমার এ ছবিটিই যেন ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা কতটা ভয়াবহ ছিল সেটা দেখিয়ে দিচ্ছে।
২৬) হিরোশিমায় বোমা নিক্ষেপের ফলে আহতরা ওতাগাওয়া নদীর তীরে স্থাপিত এক সেবা কেন্দ্রে সেবাশুশ্রূষা নিচ্ছে। তাদের শরীরের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে, এতটাই ভয়াবহ ছিল পারমাণবিক বোমার অভিশাপ।
২৭) সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে তোলা এ ছবিতে দেখা যাচ্ছে ২১ বছর বয়সী এক জাপানী সৈন্যকে, হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাতে যিনি নিজেও বেশ ভালোভাবেই আহত হয়েছিলেন।
২৮) মাটিতে কেন বিশালাকৃতির এ তীরটি পুঁতে রাখা হয়েছে? খুব স্বাভাবিকভাবেই যে কারো মনে এ প্রশ্নটি আসতে বাধ্য। আসলে নাগাসাকির ঠিক এ জায়গাটিতেই আঘাত হেনেছিল ফ্যাট ম্যান।
২৯) বিষ্ফোরণের আঘাতে ভেঙে পড়া হিরোশিমা রেড ক্রস হাসপাতালের পাশে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে লোকজন।
৩০) মাটিতে শুয়ে আছে নাগাসাকিতে বোমা হামলায় আহত এক ব্যক্তি। এ দুটি পারমাণবিক বোমা বিষ্ফোরণের ফলে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।
৩১) জাপানের একটি শিন্টো প্রার্থনালয়ের সামনে অবস্থিত এ গেটটি যেন পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার গল্প শোনাতে বেঁচে ছিল।
৩২) বোমা নিক্ষেপের প্রায় বছর তিনেক পরের ছবি। ততদিনে হিরোশিমা আবার ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠতে শুরু করেছে রুপকথার সেই ফিনিক্স পাখির মতোই।
৩৩) তিনটি বছর পেরিয়ে গেছে, ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৯৪৮ সাল চলছিল তখন। তবুও এ শিশুগুলো মুখোশ ব্যবহার করছিল তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার আশায়।
৩৪) হিরোশিমার যে স্থানটিতে বোমা বিষ্ফোরিত হয়েছিল, সেখান থেকে ৯০০ গজ দূরের এ থিয়েটারের ধাতব কাঠামোটি দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে বিষ্ফোরণের ধাক্কায়।
৩৫) নাগাসাকিতে বোমা হামলায় আহত এক শিশুকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে শিন কোজেন এলিমেন্টারি স্কুলে।
৩৬) ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করছেন একজন নারী। জাপান সরকারের তথ্যমতে, হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমার বিষ্ফোরণে সেখানকার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ঘরবাড়িই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
৩৭) রাস্তার পাশে পড়ে আছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনের টুকরো। সেগুলো সরিয়ে আবারো নতুন করে চলাচল শুরু করেছে মানুষ। এ যেন নবজীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
৩৮) হিরোশিমায় বোমা নিক্ষেপের ৩ সপ্তাহ পর এই ছবিটি আকাশ থেকে তোলা হয়েছিল। খুব অল্প কিছু ভবনই দাঁড়িয়ে থাকবার মতো দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিল।
৩৯) হিরোশিমার দুই ভুক্তভোগী।
৪০) চলছে লিটল বয়ের নির্মাণযজ্ঞ।
৪১) সৈনিক এবং শ্রমিকেরা ফ্যাট ম্যানের নাকে তাদের নাম ও বিভিন্ন রকম বার্তা লিখে দিচ্ছেন।
৪২) ট্রান্সপোর্ট ট্রেইলারে তোলা হয়েছে ফ্যাট ম্যানকে।
৪৩) শেষবারের মতো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে লিটল বয়কে।
৪৪) হাইড্রলিক লিফটের সহায়তায় লিটল বয় চালান হয়ে গেল এনোলা গে’র পেটে।
৪৫) পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, প্লেনের ভেতরের সকল সংযোগ ঠিক আছে কিনা।
৪৬) উড্ডয়নের আগে হাত নেড়ে অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন এনোলা গে’র পাইলট কর্নেল পল টিবেটস জুনিয়র।
৪৭) জরুরি স্বাস্থ্যসেবার অপেক্ষায় রয়েছে হিরোশিমার আক্রান্তরা।
৪৮) ককুতাইজি মন্দিরের পবিত্র গাছগুলোও রেহাই পায়নি।
৪৯) মায়ের ভালোবাসা।
৫০) হিরোশিমা হামলার একজন ভুক্তভোগী।
৫১) তিনিও একই জায়গার বাসিন্দা।
ফিচার ইমেজ: History Conflicts