সাংবাদিকতা যেভাবে হলুদ হলো

সাংবাদিকতার সাথে জড়িত নয় এমন সব লোকও জোসেফ পুলিৎজারকে এক নামে চেনে। তাকে বলা হয় সাংবাদিকতার দাদা। কারণ আর তেমন কিছু নয়, সাংবাদিকতার বড় এক স্বীকৃতি ও সম্মানজনক পুরস্কার পুলিৎজার। হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান সাংবাদিক পুলিৎজার আঠারো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের গোড়া অব্দি সোল্লাসে বিচরণ করেছেন সাহিত্য আর সংবাদের উঠোনে। লেখনীর জনপ্রিয়তা ও সংবাদপত্র দিয়ে কম সময়ে বেশ বিপুল অঙ্কের টাকা জমে তার। ১৯১১ সালে মৃত্যুর আগে কলম্বিয়া স্কুল অব জার্নালিজমে তার টাকার বিরাট একটি অংশ দান করে যান। মৃত্যুর পর থেকে চালু হয় পুলিৎজার পুরস্কার দেওয়া।

পুলিৎজার পুরস্কার; image source: WISN-TV

প্রতি বছর সাংবাদিকতা, শিল্পকলা, পত্র ও কল্পকাহিনী বিভাগে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। সাধারণত আমেরিকার পত্রপত্রিকার সাংবাদিকরা এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। এখন অনলাইন সাংবাদিকতায়ও এই পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এখানে মোট ২১টি ক্ষেত্রে পুরস্কারের সুযোগ থাকে।

হলুদ রঙের সাংবাদিকতার কথা বলতে এসে জোসেফ পুলিৎজারের পরিচয় দিয়ে শুরু করাটা ধান ভানতে শিবের গীতের মতো শোনায় বটে। তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ সাংবাদিকতার এই দাদা, যিনি কি না ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি এনে বৈচিত্র্য দিয়েছিলেন সাংবাদিকতায়, তিনিই প্রথম এই পেশাকে নোংরা প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে নিয়ে যান।

হলুদ সাংবাদিকতা বলতে সাধারণত বোঝানো হয় অতিরঞ্জিত সাংবাদিকতাকে। এখানে সত্যকে বাড়িয়ে বলা হয়, অথবা অতি সাধারণ সংবাদের এমন এক গুরুতর শিরোনাম দেওয়া হয় যে পাঠক পড়তে আকৃষ্ট হবেই। কেলেঙ্কারি ধরনের খবর এই সংবাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। সাধারণ সংবাদকে প্রথম পাতায় নিয়ে এসে পাতা জুড়ে বড় অক্ষরে রংচঙে শিরোনাম করাও হলুদ সাংবাদিকতার মাঝে পড়ে।

জোসেফ পুলিৎজার; image source: The State Historical SOciety of Missouri

১৯৪১ সালে ফ্রাংক মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি লক্ষণের কথা বলেছিলেন। এর মাঝে আছে বিশাল অক্ষরে ছাপা শিরোনাম, যা মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়, নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে, অথচ তেমন কিছুই না। যেসব সংবাদে অনাবশ্যকভাবে বেশি বেশি ছবি ব্যবহার করা হয়, যেখানে মিথ্যা সাক্ষাৎকার দেয়া হয়, কুসংস্কারকে বিজ্ঞান বলে দাবী করা, ভুল তথ্য দিয়ে ‘গবেষণায় পাওয়া যায়’ বা ‘বিশেষজ্ঞরা মনে করেন’ বলে দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় রঙের ব্যবহার।

কিন্তু পৃথিবীতে এত রঙের বাহার থাকতে হলুদ রঙটা কী এমন দোষ করলো যে অসৎ সাংবাদিকতার সাথে তার নাম জুড়ে যাবে?
পুলিৎজারের কথা দিয়ে শুরু করা হয়েছিল, ফিরে যাওয়া যাক আবার তার কাছেই।

১৮৯০ সাল নাগাদ প্রযুক্তির এগিয়ে যাওয়া সংবাদপত্রগুলোকে দিন দিন সস্তা করে তুলছিল। নিউ ইয়র্কের পত্রিকা মালিকেরা নিজেদের মাঝে লড়াইয়ে নামলেন, যে যত দাম কমিয়ে ক্রেতা বাড়াতে পারেন। কিন্তু এর মাঝে জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম র‍্যাডলফ হার্স্টের লড়াই চিরদিন মনে রাখার মতো। দুটো পত্রিকাকেই খদ্দের ধরতে খবরে রঙ চড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হতো, যদিও তারা ভালো রিপোর্টিং কম করেনি একেবারে।

১৮৮৩ সালে পুলিৎজার নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড পত্রিকাটি কিনে নেন। তিনি প্রথমে চেষ্টা করেন যেন তার পত্রিকাটি আর দশটা গৎবাঁধা পত্রিকার মতো না হয়। পাঠকের জন্য সহজপাঠ্য করে তোলার এই চেষ্টায় পত্রিকার বিশাল একটা অংশ ভরে গেলো সস্তা ভাঁড়ামিতে। পাঠকসংখ্যা বাড়াতে পাতায় পাতায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, মজার খেলা ও ছবি দেওয়া হলো। যতটুকু জায়গায় সংবাদ হতো, সেটুকু চাঞ্চল্যকর অপরাধবিষয়ক সংবাদে ভরা থাকতো। গুরুত্বপূর্ণ খবর বাদ দিয়ে, ‘সত্যিই কি আত্মহত্যা?’ বা ‘করুণার জন্য চিৎকার’ নামের শিরোনামগুলো বড় হরফে লিখে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হত।

পুলিৎজার নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের দাম ঠিক করেন দুই সেন্ট। দুই সেন্টে তিনি পাঠকদের আট থেকে বারো পাতার সংবাদপত্র দিতেন। অন্যদিকে নিউ ইয়র্কে সে সময় চলা দুই সেন্টের পত্রিকাগুলো চার পাতার বেশি ছিল না। পুলিৎজার নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড কেনার পর দুই বছরে সেটা নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় আর সর্বাধিক বিক্রিত পত্রিকায় পরিণত হয়েছিল।

হলুদ সাংবাদিকতার নমুনা; Google Sites

উইলিয়াম র‍্যান্ডলফ হার্স্ট এদিকে স্যান ফ্র্যান্সিসকো এক্সামিনার পত্রিকাটি কিনে নিলেন। অনেকদিন ধরেই তিনি পুলিৎজারের কৌশল দেখে আসছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হার্স্টের কাছে পুলিৎজার তার পত্রিকা দিয়ে আদর্শ হয়ে ওঠেন। তিনি সবসময় চাইতেন তার নিজের একটা পত্রিকা হোক নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের মতো। এক্সামিনার কেনার পর ২৪ শতাংশ জায়গা দেওয়া হলো অপরাধকে। নগ্নতা আসতে শুরু করলো পত্রিকার প্রথম পাতায়। হার্স্ট পত্রিকাটি কেনার একমাসের মাথায় সংবাদগুলো সংবাদ কম, অপ্রয়োজনীয় সাহিত্যে বেশি পরিণত হলো।

অবশ্য হার্স্টও পুলিৎজারের মতো মানুষের জন্য কাজ করেছেন। অপরাধ বিষয়ক সংবাদকে প্রাধান্য দেওয়ার পর পুলিশকে চাপ দিয়ে অনেক অপরাধীকে গ্রেফতার করিয়েছিল তার পত্রিকা। তার পত্রিকার প্রতিবেদক উইনফ্রেড ব্ল্যাক রোগের অভিনয় করে স্যান ফ্র্যান্সিসকো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শুধুমাত্র খবর সংগ্রহের জন্য। তার করা রিপোর্টের পরের দিনই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুরো হাসপাতালের সব কর্মচারীকে বরখাস্ত করে।

উইলিয়াম হার্স্ট; image source: nytimes.com

এক্সামিনার পত্রিকায় সফল হার্স্টের স্বপ্ন স্যান ফ্র্যান্সিসকো ছাড়িয়ে তখন নিউ ইয়র্কের রাস্তায় হাঁটছে। ১৮৯৫ সালে হার্স্ট কিনে নিলেন নিউ ইয়র্ক জার্নাল, আর কারোর নয়, একেবারে পুলিতজারের ভাইয়ের পত্রিকা।

শুরু হলো দুই পত্রিকার যুদ্ধ। দুই সেন্টে বিক্রি হওয়া নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড দেখে বড় হওয়া হার্স্ট নিজের পত্রিকার দাম রাখলেন এক সেন্ট। অর্ধেক দামে একই রকম সংবাদপত্রের লোভে রাতারাতি পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে লাগলো। পুলিতজার প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও, যখন তার পত্রিকার প্রায় সব গ্রাহক হার্স্টের পত্রিকায় চলে গেল, পত্রিকার দাম কমিয়ে এক পেনি করে ফেললেন। ভাবলেন, এর চেয়েও যদি দাম কমাতে চায়, তবে হার্স্টকে সব হারিয়ে রাস্তায় বসতে হবে। হার্স্ট বাছলেন অন্য রাস্তা। পুলিৎজারের পত্রিকার নামীদামী সব সাংবাদিককে নিজের পত্রিকায় নিয়ে এলেন। অনেকেই বলে, হার্স্ট টাকার লোভ দেখিয়ে কর্মীদের নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কর্মীরাই আসলে অন্য কোনো বিকল্প খুঁজছিল বদরাগী পুলিতজারের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য।

পত্রিকার লড়াই; image source: jakolodny.net

পত্রিকা দুটির রবিবারের পাতা ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। দুই পত্রিকার একটিও কাউকে ছাড় দিত না সেরা হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায়। রবিবারের কাগজে পুলিৎজারের হয়ে ‘হোগান্স এলি’ নামের কমিক স্ট্রিপ আঁকতেন রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট। এই কার্টুনে টাক মাথায় হলুদ জামা পরা এক বাচ্চা সমাজের অসংগতির সাথে সাথে পুলিৎজারের শত্রুদের দিকে কাদা ছুড়তো। পক্ষপাতদুষ্ট এই কমিক নিউ ইয়র্কের বাসিন্দাদের ভীষণ পছন্দের ছিল। এর ডাকনাম ছিল ‘দ্য ইয়েলো কিড’। কিন্তু একের পর এক কর্মচারী হাত করতে করতে হার্স্ট একদিন কিনে নিলেন আউটকল্টকে। ইয়েলো কিডও তার পত্রিকার হয়ে গেল। তখন পুলিৎজার জর্জ লুক্সকে চাকরি দিয়ে ইয়েলো কিড কমিকটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। শহরে এসে গেল দুটো হলুদ বালক, যারা মজার ছলে একে অপরকে নিয়ে কুৎসা রটাতে লাগল। এ সময় নিউ ইয়র্ক হ্যারল্ড পত্রিকার প্রকাশক আরভিং ওয়ার্ডম্যান ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ নামটি দিয়েছিলেন।

ইয়েলো কিড; image source: yellowkid.se

পত্রিকা দুটির স্নায়ুযুদ্ধ চলার সময় অন্যসব খবরের থেকে মানুষের আগ্রহ বেশি ছিল তাদের এই লড়াইয়ে। কিন্তু দিনের পর দিন এই লড়াই দেখতে দেখতে একসময় মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পত্রিকা দুটিও নিজেদের লড়াই আর চালিয়ে যেতে চাচ্ছিলো না। সবার অলক্ষ্যে ধীরে ধীরে এই হলুদ লড়াই স্তিমিত হয়ে যায়।

ফিচার ইমেজ: jakolodny.net

Related Articles

Exit mobile version