দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ঘটে যাওয়া বর্বরতায় হিটলারের মিত্র দেশগুলো কেউ কারও থেকে কম যায়নি। পশ্চিমা গণমাধ্যমের কল্যাণে হিটলারের পৈশাচিক সব গণহত্যা আর পরিকল্পনার কথা পরবর্তীতে যেভাবে বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে সে তুলনায় অন্যদের বর্বরতার কথাগুলো চাপা পড়ে আছে। আলোচনায় না থাকায় বহু গণহত্যা ও বর্বরতার কাহিনী ইতিহাস থেকে মুছে গেছে। হিটলারের মিত্র জাপানীরা এশিয়াতে, বিশেষ করে চীন আর কোরিয়াতে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার নজির ইতিহাসে বিরল। সেই নারকীয় তান্ডবের জ্বলজ্বলে উদাহরণ হল দ্য রেইপ অব নানকিং খ্যাত জাপানী তান্ডব। এই তান্ডবকে নানকিং ম্যাসাকারও বলা হয়ে থাকে।
১৯৩৭ এর শেষের দিকে ইউরোপ ব্যস্ত ছিল জার্মান সামরিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এ সময় জাপান চীন দখল করতে শুরু করেছে। চীন ও জাপানের মধ্যকার বিরোধ বহু প্রাচীন। সে সময় জাপান সরকার তাদের দেশের সীমানা বৃদ্ধির জন্য উদগ্রীব ছিল। শুরুতে একা থাকলেও পরবর্তীতে মিত্র বাহিনীর সহায়তা নিয়ে যুদ্ধের সময় চীন পাল্লা দিয়ে জাপানের সাথে লড়াই করেছে যেন প্যাসিফিক ও ইস্ট এশিয়ায় জাপানী প্রভুত্ব ঠেকানো যায়। এই লড়াইয়ে ২০ মিলিয়ন চীনা নাগরিক প্রাণ হারান। এই ২০ মিলিয়নের ১৭ মিলিয়নই ছিলেন নিরীহ চীনা বেসামরিক নাগরিক, যাদের নিরস্ত্র অবস্থায় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে জাপানীরা। এ যুদ্ধের মাঝেই ১৯৩৭ এর ডিসেম্বরে জাপানীদের হাতে চীনের তৎকালীন রাজধানী নানকিং (বর্তমানে নানজিং) এ ঘটে এক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ।
এক রক্তাক্ত লড়াইয়ে জাপানীদের হাতে সাংহাইয়ের পতন হওয়ার পর চীনা সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করে। জাপানীদের হাতে পুরো সৈন্য বাহিনী হারানোর ভয়ে চীনা সৈন্যদের নানকিং থেকে সরিয়ে আরও ভেতরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। জাপানীদের এগিয়ে আসার খবর শুনে নানকিংয়ের অধিবাসীরা পালাতে শুরু করলে চীনা সরকার তাতে বাঁধা দেয়। জাপানীরা যখন নানকিং এসে পৌঁছায়, তখন শহরের ভেতর ৫ লক্ষ অধিবাসী বসবাস করছিল।
নানকিং ম্যাসাকারের সূচনা জাপানীরা নানকিং দখল করার আগেই শুরু হয়েছিল। এর দিকে এগিয়ে আসার সময় জাপানীরা পথে যা পেয়েছে তা-ই ধ্বংস করেছে। যারাই ওদের হাতে ধরা পড়েছে তাদেরকেই হত্যা করা হয়েছে। জাপানী সৈন্যদের উপর নির্দেশ ছিল সকল বন্দীকে হত্যা করতে হবে।
নানকিংয়ের পথের গ্রামগুলো পোড়াতে পোড়াতে তারা একসময় নানকিং পৌঁছে যায়। গরীব বা ধনী কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বেশিরভাগ লাশকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে সেখানেই খোলা অবস্থায় রেখে জাপানীরা অগ্রসর হয়েছে। বিজিতদের লুট, হত্যা ও ধর্ষণ করা সৈন্যদের অধিকারে পরিণত হয়েছিল। একপ্রকার বিনা লড়াইয়ে নানকিং দখল করার পরও জাপানী সৈন্যদের এমন আচরণের কোনো সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন বিচিত্র উপায়ে তারা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করতো। কে কার আগে নিজ হাতে ১০০ জন চীনাকে হত্যা করতে পারবে সে নিয়ে দুজন জাপানী অফিসার মুকাই এবং নদার মাঝে একটি ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতাও শুরু করেছিল। এই প্রতিযোগিতায় কে কয়টি খুন করেছে তার অগ্রগতির প্রতিবেদন শীর্ষস্থানীয় জাপানী পত্রিকাগুলো প্রতিদিনের আর্কষণীয় সংবাদ হিসেবে প্রচার করেছিল, এ যেন ছিল এক আন্তর্জাতিক খেলার ফলাফল।
১৯৩৭ সনের ১৩ ডিসেম্বর থেকে পরের ছয় সপ্তাহে জাপানীরা নানকিংয়ের সাধারণ মানুষদের হত্যা ও নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে। এ সময় প্রায় ৮০,০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হন। জাপানী সেনারা বিভিন্ন ঘরে চীনা সৈন্য খোঁজার নাম করে নারী ও শিশু কন্যাদের বের করে এনে গণধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ শেষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষিতাদের হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যা ও ধর্ষণের সব আলামত পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, সবকিছুই শুধুমাত্র সৈন্যদের নিজের ইচ্ছাতেই হয়েছে এমন নয়। বরং হত্যা ও ধর্ষণের ব্যাপকতা দেখে পরবর্তীতে ধারণা করা হয়, ব্যাপারগুলো ছিল পরিকল্পিত এবং সৈন্যদের এমন কাজ করার জন্য হয়তো কোনো গোপন নিদের্শনাও প্রদান করা হয়েছিল।
কেবল খুন করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। খুনের আগে যতভাবে মহিলাদের কষ্ট দেওয়া সম্ভব তার প্রায় সব বর্বরতাই জাপানীরা দেখিয়েছিল। গর্ভবতী মহিলাদের পেট কেটে খালি হাতে গর্ভের শিশুকে বের করে ফেলতো সৈন্যরা। যুবতী মেয়েদের দিনে ছয়-সাতবারও ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তরুণীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের জন্য নানকিং থেকে বিভিন্ন জাপানী ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়েছিল। শিশুরাও জাপানী বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বহু শিশুকে হত্যা করা হয়।
নিউ ইর্য়ক টাইমসের এক সাংবাদিক ছিলেন এ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি পরবর্তীতে লিখেছিলেন, সমুদ্রের পাড়ে যাওয়ার পথে আক্ষরিকভাবেই লাশের স্তুপ মাড়িয়ে উনাকে যেতে হয়েছে। সমুদ্রতীরে তার চোখের সামনে মাত্র দশ মিনিটে ২০০ বন্দীকে হত্যা করা হয়।
জাপানী জেনারেলরা তাদের অধীনস্থদের এমন আচরণ জানার কথা কখনোই স্বীকার করেনি। চীনে জাপানী বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল মাতসুই দাবী করেন, সৈন্যদের এমন বর্বরতার মাত্রা সর্ম্পকে তিনি সর্ম্পূনভাবে কখনও অবহিত ছিলেন না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এমন ঘটনার জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেন। যুদ্ধের পর ইন্টারন্যাশন্যাল মিলিটারি ট্রাইবুনাল ফর ফার দ্য ইস্ট জেনারেল মাতসুইকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। ১৯৩৮ সালে জাপানের সর্মথনপুষ্ট এক পুতুল সরকারকে জাপানীরা ক্ষমতায় বসানোর পর নানকিংয়ের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ হয়।
নানকিং গণহত্যায় কয়েক সপ্তাহের ভেতর আনুমানিক তিন লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। নিহত মানুষের সংখ্যা নিয়ে বির্তক রয়েছে। যুদ্ধের পর নানকিং গণহত্যায় অভিযুক্ত জাপানী সেনাদের বিচারের সময় আদালতের রায় অনুসারে নানকিংয়ে দুই লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছিল। তবে সংখ্যাটা যা-ই হোক না কেন, তা কিছুতেই নিরীহ সাধারণ মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণের মতো অপরাধ ও বর্বরতার অপরাধের মাত্রাকে কমিয়ে দেয় না।
নানকিংয়ে যা ঘটেছিল তা সঠিকভাবে প্রচারের আলো না পাওয়ায় অনেকেই এর কথা ভুলে যেতে শুরু করে। জাপান সরকার বহু বছর এ বর্বরতার দায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। বরং বিভিন্ন সময় চীনের প্রকাশিত সংবাদ ও তথ্যকে একপেশে হিসেবে দাবী করেছে। ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তৎকালীন জাপান সরকারের প্রধানমন্ত্রী তমিচি মুরায়ামা চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জাপান যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার জন্য আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু জাপান কখনোই লিখিতভাবে নানকিং গণহত্যার জন্য চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চায়নি।
পরবর্তী জাপানী সরকারগুলো এ ব্যাপারে কোনো দায় নিতে অস্বীকার করে আসছে। ২০১৫ সালে জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো এ্যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭০ বছর উপলক্ষ্যে যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন তাতে চীনে জাপানের এই বর্বরতার বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, যা চীন-জাপান সর্ম্পকে টানাপোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সময় চীন ও জাপানের মাঝে সর্ম্পক অবনতির পেছনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী গণহত্যার প্রভাব সুস্পষ্ট।