পার্ল হারবার। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালের দিনটি অন্য সব রবিবারের মতোই হতে পারতো। কিন্তু সকাল ৮টা বাজার আগেই বিকট শব্দে যেন গোটা আকাশ ভেঙে পড়েছিল পার্ল হারবারে। জাপানের বিমান হামলার মুখে মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যায় সবকিছু। এই বিমান হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২০টি জাহাজ ও ৩০০টিরও অধিক বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হঠাৎ আক্রমণে নিহত হয় ২,৪০০ জনের বেশি আমেরিকান, যাদের মধ্যে বেসামরিক ব্যক্তিবর্গও ছিলেন। আহত হয় ১,০০০ এরও অধিক মানুষ।
পার্ল হারবার আক্রমণে জাপানিদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ছিল যে বিমানটি, সেটি হলো মিতসুবিশি এ৬এম জিরো ফাইটার। জাপানের সামরিক বাহিনীর অন্যতম শক্তি ও গর্বের এই বিমানটি ছিলো তৎকালের অন্যতম সেরা যুদ্ধ বিমান, যা একটা সময় পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর প্রায় সব বিমানকে পর্যুদস্ত করে পরাক্রমে দাপিয়ে বেড়িয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রায় ১০,৪৩০টি, মতান্তরে প্রায় ১১,০০০টিরও বেশি জিরো ফাইটার তৈরি করেছিল জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এবং দেশটির তৈরিকৃত বিমানের মধ্যে তখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ।
জিরো বা মিতসুবিশি এ৬এম তৈরি করা হয়েছিল জাপানের নৌ বাহিনীর জন্য, যা নেভি টাইপ জিরো নামেও পরিচিত। বিমানটির নকশা প্রণয়নের কাজ মূলত শুরু হয় ১৯৩৭ সালে, যখন দেশটির নৌবাহিনী তাদের জন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ক্যারিয়ার বেজড ফাইটার বিমান তৈরি করার জন্য নির্দেশ দেয়। নৌবাহিনী চেয়েছিল এমন একটি ফাইটার বিমান, যা প্রায় ১৩,০০০ ফুট উপরে ৩১০ মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে, টানা দুই ঘন্টা সর্বোচ্চ এবং ক্রুইজিং গতিতে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা আকাশে উড়তে পারবে।
যেহেতু ফাইটারটি ক্যারিয়ার বেজড হতে হবে অর্থাৎ বিমানটিকে স্বল্প দূরত্বের রানওয়ে থেকে আকাশে পাড়ি জমাতে হবে, সেহেতু বিমানটির উইংস্প্যান কিছুতেই ৩৯ ফুট বা ১২ মিটারের বেশি হওয়া যাবে না। তখনকার সময়ে, এমন একটি বিমানের কথা চিন্তা করা যেন তেন কাজ ছিল না। এমন চাহিদার কথা শুনে এবং এই প্রকল্প প্রায় অসম্ভব ভেবে, জাপানের আরেকটি অন্যতম ফাইটার বিমান নির্মাতা কোম্পানি আগেই এই প্রকল্প থেকে সরে যায়। কিন্তু মিতসুবিশির প্রধান নকশাকার জিরো হরিকশি পিছু না হটে সম্ভাব্য নকশা নিয়ে কাজ শুরু করেন।
নকশাকারের নামে জিরো থাকায় অনেকেই ভাবতে পারেন, হয়তো তার নাম থেকেই এই যুদ্ধবিমানটির নাম জিরো ফাইটার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আসলে তা নয়। ১৯৩৯ সালে প্রথম টেস্ট ফ্লাইট সম্পন্ন করার পর বিমানটি পুরোদমে বাণিজ্যিকভাবে বানানো শুরু হয়। বছরটি ছিল জাপানের কিংবদন্তি প্রথম সম্রাট জিম্মুর সিংহাসনে আরোহণের ২,৬০০তম বার্ষিকী। ইম্পেরিয়াল বছরের শেষ শূন্য থেকেই বিমানটির নামকরণ করা হয় জিরো।
কাজ করতে গিয়ে হরিকশি দেখলেন, প্রয়োজন মতো গতি ও ম্যানুভার্যাবিলিটির (Maneuverability) জন্য বিমানটিকে অত্যধিক হালকা ওজনের হতে হবে। অত্যন্ত গোপনীয় হিট ট্রিটেড (Heat Treated) অ্যালুমিনিয়াম টি-৭১৭৮ ব্যবহার করে প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু এর জন্য ত্যাগ করতে হয়েছিল অনেক বড় কিছু।
সুরক্ষা! বিমানের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য ছিল না কোনো ভারী আর্মার। ইঞ্জিন, ফুয়েল ট্যাংক বা ককপিট কোথাও সুরক্ষার জন্য ভারী আর্মার ছিল না যুদ্ধবিমানটিতে! এমনকি, ফুয়েল ট্যাংকেও সেলফ-সিলিং ব্যবস্থা ছিল না। সেলফ সিলিং ব্যবস্থা থাকলে ফুয়েল ট্যাংকে গুলি লেগে ফুটো হয়ে গেলেও, তা নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যায় বিশেষ ব্যবস্থায়। সেই সাথে বিমানটিতে যুক্ত করতে হবে দুটি ৭.৭ মিলিমিটারের মেশিন গান এবং আরও দুটি ২০ মিলিমিটারের কামান।
দুর্দান্ত গতি, অসাধারণ ম্যানুভার্যাবিলিটি ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বিমানটির সবচেয়ে পুরো অংশ ছিল মাত্র ১.৫ মিলিমিটার এবং সবচেয়ে পাতলা অংশ ছিল মাত্র ০.৫ মিলিমিটার! তাছাড়া, ককপিটের আকারও তুলনামূলক ছোট ছিল। যদিও অপেক্ষাকৃত খাটো জাপানি পাইলটদের এতে তেমন একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। প্রোটোটাইপ জিরোতে মিতসুবিশি জুইসেই ১৩ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হলেও, পরে নৌ বাহিনীর নির্দেশে নাকাজিমা সাকায়ে ১২ ইঞ্জিন ব্যবহার করতে বাধ্য হয় মিতসুবিশি।
অন্যদিকে, ১৯৪১ সালে নৌবাহিনীর নির্দেশে নাকাজিমা তাদের প্ল্যান্টে প্রতিপক্ষ কোম্পানির ডিজাইন করা জিরো ফাইটার তৈরি করতে বাধ্য হয়, যে প্রকল্প অসম্ভব বলে হাল ছেড়ে দিয়েছিল তারা। তারপর ১৯৪০ সালে এক সিটের ক্যারিয়ার সম্পন্ন জিরো ফাইটার যখন শত্রুর আকাশে উড়তে শুরু করলো, তখন তা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে সেরা বিমানগুলোর একটি।
এ৬এম জিরো ফাইটারের বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রয়োজন সাপেক্ষে তৈরি করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এ৬এম২ মডেল ২১, এ৬এম৩ মডেল ৩২ এবং এ৬এম৮সি। প্রথম দুটি সংস্করণে নাকাজিমা ইঞ্জিন ব্যবহার করা হলেও, পরেরটির ইঞ্জিন ছিল মিতসুবিশি কিন্সেই ৬২। এ৬এম২ মডেল ১১ সংস্করণটি জাপানের নৌবাহিনী তাদের ক্যারিয়ার সম্পন্ন জিরো ফাইটার হিসেবে অনুমোদন দেয়।
চীনের সাথে জাপানের যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪০ সালের ১৯ আগস্ট প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে জিরো ফাইটার। যদিও প্রথমবারের মতো শত্রু বিমান বধ করা শুরু হয়েছিল একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বরে। সেদিন মাত্র ১৩টি জিরো ফাইটার কমপক্ষে ২৭টি চীনা বিমান ধ্বংস করে দেয় চোখের নিমেষে। চীনে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে বেশি সময় লাগেনি যুদ্ধ বিমানটির।
পরবর্তীতে মাত্র কয়েক মাসে ৯৯টি চীনা বিমান ধ্বংস করে এ৬এম২ এবং এই পরিসংখ্যানের বিপরীতে মাত্র ২টি ধ্বংস হয়েছিল জাপানের। এক বছরের বেশি সময় ধরে চীনে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গিয়েছে জিরো। ক্লেয়ার নামের এক ইউএসএএসি অফিসার পশ্চিমাদের নতুন এই যুদ্ধবিমান সম্বন্ধে সতর্ক করলেও, তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়নি। তাই জাপানের এই নতুন শক্তির সাথে প্রতিপক্ষ দেশগুলো খুব একটা পরিচিত ছিল না।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধের প্রথম বছরে জাপানের জিরোর কাছে ধরাশায়ী হয়েছে প্রায় সব পশ্চিমা বিমান। গতি, ম্যানুভার্যালিটি, ক্লাইম্ব রেট ও লং রেঞ্জ, সব কিছুতেই এগিয়ে থাকা জিরো ফাইটার তখন আকাশের ত্রাস। পার্ল হারবারে আক্রমণের পরদিন ওয়েক দ্বীপে আক্রমণ করে জাপান। মাটিতে থাকা অবস্থাতেই ৮টি এফ৪এফ ওয়াইল্ড ক্যাট ধ্বংস করে দেয় জিরো ফাইটার। বাকিগুলো কোনো রকম প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ২২ ডিসেম্বর দ্বীপের বাকি ২টি ওয়াইল্ড ক্যাট অবশেষে পরাস্ত হয়।
একই দিনে ক্লার্ক ফিল্ডে আক্রমণ করতে গিয়ে জিরো ফাইটার আকাশেই আমেরিকার ১৫টি এবং মাটিতে থাকা ৫০টি বিমান চোখের পলকে ধ্বংস করে দেয়। ওয়াইল্ড ক্যাটের মতোই পি-৪০ ওয়ারহকও সুবিধা করতে পারেনি মিতসুবিশির যুদ্ধ বিমানের বিপক্ষে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জিরো ফাইটার আকাশে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে প্রতাপের সাথে। মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ বিমানগুলো তখন চেষ্টা করতো জিরোর বিপক্ষে ডগ ফাইট যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে মাত্র তিন মাসে ২০০টি এ৬এম২ পরাস্ত করেছে তার বিপক্ষে আসা সব প্রতিপক্ষকে। যুদ্ধ বিমানগুলোর মধ্যে ডাচ, ব্রিটিশ, আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ান বাহিনীর মডেল ৩৩৯ বাফোলোজ, কার্টিস-রাইট সিডব্লিউ-২১ বেস, কার্টিস হক ৭৫এ-৭এস এবং কার্টিস পি-৪০ উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, আকাশ যুদ্ধে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জিরো ফাইটার প্রায় অপরাজেয় ছিল।
জিরো ফাইটারের বিপক্ষে অবশ্য অসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল আমেরিকান ভলান্টিয়ার গ্রুপের ফ্লাইং টাইগার্সের পাইলটেরা। তারা দ্রুতই বুঝতে পেরেছিল যে, জিরোর ম্যানুভার্যাবিলিটির বিপক্ষে তারা সুবিধা করতে পারবে না। তাই তারা তাদের পি-৪০ ফাইটারের গতি, অধিক উচ্চতা ও শক্তিশালী আর্মারের সুবিধা নিয়ে ১৯৪২ সালের জুলাই পর্যন্ত ২৮৬ জাপানি বিমান আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয় মাত্র ১৩ জন পাইলট হারিয়ে।
দুর্ধর্ষ জিরোর বিদায় ঘণ্টা বাজার প্রাথমিক ঘটনাটি ঘটে ১৯৪২ সালের জুনের ৩ তারিখ। ডাচ উপকূলে আক্রমণ করতে গিয়ে ফুয়েল ট্যাংকে গুলি লাগায় একটি জিরো আকোতান দ্বীপে ভূপাতিত হয়। বিমানটির পাইলট সেখানেই মারা যান। প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া জিরো তখন মিত্রবাহিনীর অন্যতম সেরা অর্জন বলতে হবে। কারণ প্রাপ্ত জিরোটি নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকায়। সেখানে বিমানটি মেরামত করে আকাশে উড়িয়ে বের করা হয় এর শক্তি ও দুর্বলতা। বিস্তর গবেষণায় বেরিয়ে আসে জিরোর খুঁত, সেই সাথে জিরোর বিপক্ষে ঠিক কী কৌশলে লড়াই করতে হবে তা-ও নির্ধারিত হয়ে যায়। একইসাথে এই বিমানের চেয়ে আরও শক্তিশালী বিমান তৈরিতে হাত দেয় আমেরিকা।
জিরো তখন পৃথিবীর সেরা ম্যানুভার্যাবিলিটি সম্পন্ন ক্যারিয়ার বেজড ফাইটার। স্বল্পগতিতে এর ম্যানুভার্যাবিলিটি অসাধারণ হলেও, গতি বৃদ্ধির সাথে সাথে তা কমতে থাকে এবং প্রচণ্ড গতিতে বিমানটির ডাইভ দেওয়ার সক্ষমতাও যথেষ্ট দুর্বল ছিল। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল বিমানটির সুরক্ষাবিহীন হালকা ও পাতলা কাঠামো। মাত্র একটি গুলির আঘাতই যথেষ্ট ছিল জিরোকে শেষ করে দেওয়ার জন্য।
জিরোকে পরাস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৩ সালে বেশ বড় পরিসরে শক্তিশালী ও অধিক গতি সম্পন্ন যুদ্ধ বিমান নিয়ে আসে। এগুলো হলো এফ৬এফ হেলক্যাট ও এফ৪ইউ করসার। প্রায় সবক্ষেত্রেই জাপানি বিমানটির চেয়ে এগিয়ে ছিল বিমান দুইটি এবং পূর্বসূরিদের মতো শক্তিশালী আর্মার তো ছিলোই। এই ফাইটার দুইটি আকাশে ওড়ার পর, জিরোর আধিপত্য মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হয়।
শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লড়াই করতে গিয়ে দেখা যায়, জিরোর কিল রেট ১:১ থেকে ১:১০ এর উপরে নেমে আসে। তবে ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জিরো ফাইটারের হাতে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ১,৫৫০টি আমেরিকান বিমান। সত্য বলতে, যে সুরক্ষা ব্যবস্থার বিসর্জন জিরোকে আকাশে অপরাজেয় করে তুলেছিল, সেই ব্যবস্থাটিই ছিল বিমানটির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।