পুরান ঢাকার প্রথম পর্বে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সম্পর্কে জেনেছি। আজ জানব পুরান ঢাকায় স্থাপিত কিছু ‘বাজার’ নামের এলাকা সম্পর্কে। কীভাবে এই বাজারগুলো গড়ে উঠেছিল, কারা গড়ে তুলেছিলেন, কী পাওয়া যেত এবং তার বর্তমান অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে। তাহলে শুরু করা যাক।
শাঁখারিবাজার
চারশো বছরের পুরনো ঢাকা শহরের এক ঐতিহ্যপূর্ণ এলাকা শাঁখারিবাজার। শঙ্খ বাঁ শাখ শিল্পে পটুয়ারা বংশানুক্রমে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখেন। তাদের পেশার নামানুসারেই শাঁখারিবাজার নামকরণ করা হয়েছে। এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজার যাবতীয় সামগ্রী, শাঁখা, পূজার থালা, সিঁদুর, টিপ, আবির, প্রদীপ, বিয়ের টোপর, ফুল ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়।
একসময় ঢাকা বিখ্যাত ছিল শাঁখারিদের তৈরী শাঁখার জন্য। ইতিহাস বলে, আঠারো শতকে প্রায় সাড়ে আটশো শাঁখারি শিল্পী ঢাকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। শাঁখারিবাজার হিন্দু বসবাসকারী এলাকা হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ, হানাদার বাহিনী সবার প্রথমে শাঁখারি বাজার গুড়িয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় শাঁখারিরা দেশ ত্যাগ করেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর তারা আবার এসে বসবাস শুরু করেন এই শাঁখারি পট্টিতেই।
তাঁতীবাজার
তাঁতীবাজার, অর্থাৎ যেখানে কাপড়ের বাজার বা তাঁতীদের অবস্থান। কিন্তু পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের সংজ্ঞা একটু ভিন্ন। এখানে কাপড় নয়, সোনা-রূপার ব্যবসায় ব্যস্ত তাঁতিরা। একসময় কাপড়ের রমরমা ব্যবসা ছিল ঠিকই। কাপড়ের ব্যবসায় লোকসান দেখা দিলে তাঁতিরা ধীরে ধীরে বস্ত্রবুনন ছেড়ে অলংকার ব্যবসার দিকে ঝুঁকে যান, কারণ অলংকারের ব্যাপক চাহিদা ছিল সে সময়। জানা যায়, তাঁতীবাজারের আশপাশ ঘিরেই সে সময় ঢাকা হয়ে উঠেছিল মোগল ভারতের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র।
লক্ষ্মীবাজার
ইতিহাস বলে, ১৭৩০ সালে কাশ্মীরের মিয়া সাহেব আব্দুর রহিম রিজভী নামের এক মুসলিম ব্যক্তি পুরান ঢাকার এই এলাকায় এসে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকে এই এলাকার নাম হয় মিয়া সাহেবের ময়দান। তার মৃত্যুর পর এখানেই তার একটি মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়।
পলাশীর যুদ্ধের পর এখানে, এই এলাকাতেই লক্ষ্মীনারায়ণ ঠাকুর, স্বনামে লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির স্থাপন করেন। ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে তাই পূর্বের নাম পরিবর্তন করে লক্ষ্মীবাজার রাখা হয়।
কলতাবাজার
কলতাবাজার পুরান ঢাকার একটি প্রাচীন মহল্লা। এখানে ঢাকার সর্বপ্রথম বরফকল স্থাপিত হয়েছিল বলে এই এলাকাটির নাম ছিল বরফকল। মানুষের মুখে মুখে এলাকাটি বরফকল বলে খ্যাতি পায়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে শব্দ পাল্টে যায় এবং ‘বরফ’ শব্দটি উঠে গিয়ে শুধু ‘কল’ শব্দটি রয়ে যায়। আর এভাবেই কলতাবাজার নামে পরিণত হয় পুরানো মহল্লা বরফকল। কলতাবাজার আরও একটি কারণে বেশ সুপরিচিত ছিলো। এখানে বসবাস করতেন সে সময়ের সেরা কুস্তিগীর। মাঝে মাঝে বিকেলবেলায় লোকসমাগম হতো কুস্তি দেখার জন্য।
চকবাজার
মোঘল যুগে, মোঘলরা যেখানেই যেত, সেখানেই দূর্গ নির্মাণ করত। আর এভাবেই দূর্গকে ঘিরে আশেপাশে বাজার বসত। দূর্গকে কেন্দ্র করে যেসব বাজার গড়ে উঠত, তাদের ‘পদশাহী বাজার’ বলা হত। এভাবে চকবাজার, একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠার পেছনে চকবাজারের আরেকটি কারণ আছে। চকবাজারকে পূর্বে ‘নাখাস’ নামেও ডাকা হতো। ‘নাখাস’ শব্দের অর্থ ক্রীতদাস। প্রথমদিকে এখানে ক্রীতদাস বেচাকেনা হতো, তাই এ সূত্রেই হয়ত বাজার বসেছিলো আজকের চকে।
ইতিহাসবিদদের মতে, বাণিজ্যিক গুরুত্ব নিজেই গড়ে উঠেছেছিল চকবাজার। এক সময় বিয়ের কেনাকাটার প্রধান বাজার ছিলো এটি। এমনকি বরযাত্রীদের চকবাজার ঘুরে যাওয়ার একটা রীতিও নাকি ছিল! কিন্তু আজ সেসব রীতি কেউ না মানলেও, বাজার হিসেবে চকের জৌলুশ অপরিবর্তনীয় আছে।
বেগমবাজার
এই এলাকার নামের পেছনে একটা ঘটনা আছে। লোকে বলে, ১৯৩৯-১৯৪০ এর দিকে ঢাকার নায়েব-ই-নাজিম ছিলেন সরফরাজ খানের আদরের কন্যার নাম, ‘লাডলি বেগম’ এর নামে এই এলাকাটির নামকরণ হয়েছে বেগমবাজার। বেগমবাজার মসজিদের কাছে নির্মিত মাছের বাজারের মালিক ছিলেন লাডলি বেগম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৭৭৭ সালে বড় ধরনের এক অগ্নিকাণ্ডে বাজারটি পুড়ে যায়। পরে তৎকালীন সরকার নামমাত্র মূল্যের বিনিময়ে বাজারটি ক্রয় করেন।
আলুরবাজার
আলুর বাজার শুনলে অবশ্যই যে কেউ বলবে, আলুর পাইকারি বাজারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আদতে এই এলাকার নামের সাথে আলুর কোনো সম্পর্কই নেই। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে জাফর খান ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি লালবাগ এলাকায় থাকতেন এবং বর্তমানের আলুর বাজার নামক এলাকাটি তখন তার দখলে ছিল। তার পুত্রের নাম ছিল ‘আলাইয়ার খান’। আলাইয়ার জন্মের পর থেকে বাজার খুব রমরমা চলছিল। অনেকের মতেই, এই বাজারটির নাম আসলে ‘আলাইয়ার খানের বাজার’ ছিল কিন্তু বলার সুবিধার্থে মুখে মুখে নামটি আলুর বাজারে পরিণত হয়েছে।
বাবু বাজার
ঢাকায় একসময় পাকুর নামের এক দেশীয় ফল পাওয়া যেত। যে এলাকা গড়ে উঠেছিল পাকুর গাছে, সে এলাকার নাম হয়ে গিয়েছিল পাকুরটুলি। তৎকালীন পাকুরটুলি এখন বাবুবাজার নামে পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে জমিদারবাবুরা বাবুবাজারের গোড়াপত্তন করে।
বাবুবাজারই ঢাকা শহরের প্রথম পাইকারি চালের বাজার। এটি ১৯২৫ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে স্থাপিত হয়। ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা আব্দুল হাফিজ এবং কয়েকজন ব্যবসায়ী বাজারটি স্থাপনের জন্য সরকার কতৃক ইজারা নেয় নদী তীরবর্তী জায়গাটি। কিছু জটিলতার কারণে সরকার চালের বাজারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, কিন্তু ১৯৫৪ সালে বাংলার যুক্তফ্রন্ট সরকার নিষেধাজ্ঞাটি প্রত্যাহার করে এবং পুনরায় বাজারটি সচল হয়।
নাজিরাবাজার
পুরান ঢাকার একটি এলাকা হচ্ছে নাজিরা বাজার। এই এলাকাটির প্রকৃত নাম নাজির বাজার, কিন্তু লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে এই এলাকাটি এখন নাজিরা বাজার নামেই পরিচিত। প্রকৃত নামটি এখন কেবল কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এলাকাটি পুরান ঢাকার খাবারের ঐতিহ্য ধারণ করে বিধায় এটি পুরান ঢাকার একটি উল্লেখযোগ্য এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়।
বঙ্গবাজার
ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় বঙ্গবাজার অবস্থিত। এটি মূলত তৈরী পোশাকের বাজার। ১৯৬৫ সালে এখানে হকার ও ছোট দোকানদাররাই বেশি ছিল। জায়গাটি তখন ঢাকার প্রধান রেলস্টেশনের লাগোয়া ছিল। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ জায়গার মালিকানা ছাড়তে রাজি হয় না। এ অবস্থায় দোকানিরা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বার্ষিক ইজারা চুক্তির ভিত্তিতে দোকান বসানোর অনুমতি পায়। শেষে ১৯৮৫ সালে সিটি করপোরেশন জায়গাটির মালিকানা পায় এবং ১৯৮৯ সালে পাকা বিপণনকেন্দ্র নির্মিত হয়। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে এটি তৈরী পোশাকের বাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
বাংলাবাজার
বাংলাবাজারের আসলে কীভাবে নামকরণ হয়েছে, সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে এই এলাকা যে প্রাচীনতম এলাকার একটি, এইটুকু ধারণা করা যায় মাত্র। অনেক পরিব্রাজকের লেখায় দেখা যায় যে, ‘বেঙ্গালানগর’ এর নাম, কারণ তখন এই এলাকাটিকে ঢাকার কেন্দ্রস্থল বলে বিবেচনা করা হতো।
প্রথমদিকে, ঢাকার চকবাজারে মুসলিম পুঁথি ছাপা হতো কেতাবপট্টি নামের এলাকার। এরপর বাবুবাজারেও বই ছাপা হতো। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের পর বাংলাবাজারে আস্তে আস্তে বইয়ের দোকান চালু হতে লাগল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে ঘিরে পূর্ববাংলায় এক সাংস্কৃতিক জাগরণ শুরু হয়। ওই সময় থেকে বাংলাবাজার হয়ে ওঠে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-গবেষকদের আড্ডাখানা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে পশ্চিম বাংলার মুসলমান বই ব্যবসায়ীরা বাংলাবাজারে এসে বসে। এর সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিল একঝাঁক নতুন প্রকাশনা সংস্থা– নওরোজ কিতাবিস্তান, স্টুডেন্ট ওয়েজ, গ্রেট ইস্ট লাইব্রেরি, মালিক লাইব্রেরি, খোশরোজ কিতাব মহল, হার্ডসন অ্যান্ড কোম্পানি ইত্যাদি।
কাপ্তান বাজার
কাপ্তান শব্দটি ইংরেজি শব্দ ‘ক্যাপ্টেইন’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে কাপ্তান হয়েছিল। ক্যাপ্তেইন ফোর্ডের নামানুসারে ‘গর্ড বাজার নির্মিত হয়েছিলো ঢাকায়। বাজারটি বেশ সুখ্যাতি লাভ করে। পরে মানুষের মুখে মুখে কাপ্তান বাজার নামকরণ হয়। বর্তমানে এটি ঢাকায় কবুতর পাখি কেনাবেচার সবচেয়ে বড় বাজার বলে পরিচিত।
এই ছিল তৎকালীন ঢাকায় স্থাপিত কয়েকটি প্রধান বাজারের গল্প। এগুলো ছাড়াও, ফিরিঙ্গি বাজার, নয়াবাজার, বকশিবাজার, ঠাটারিবাজার এলাকাও সে আমলেরই নিদর্শন।