দক্ষিণ আমেরিকার সূর্যের সন্তান ও তাদের সাম্রাজ্য

আসুন, আজ এক প্রাচীন জাতির কথা বলা যাক। এরা কোনো লোহা বা ইস্পাতের ব্যবহার জানতো না, জানতো না চাকার ব্যবহার, ঘোড়া বা খচ্চরের নামগন্ধ ছিল না তাদের এলাকায়, তাদের কোনো অক্ষর ছিল না, এমনকি মুদ্রা ব্যবস্থার মতো অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপারটা পর্যন্ত তাদের মধ্যে অনুপস্থিত।

ভাবছেন কোন দুর্গম অঞ্চলের অনগ্রসর জাতির কথা বলছি? তা কিন্তু না। কেননা আলোচ্য জাতিটি ১৪৩৮-১৫৩৩ সাল পর্যন্ত শাসন করে গিয়েছে আন্দিজ পাহাড় ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ। আধুনিককালের আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর আর কলম্বিয়াজুড়ে বিস্তৃত ২০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই সাম্রাজ্যে বসবাস করতো প্রায় দেড় কোটি মানুষ। ইনকা সাম্রাজ্য নামের এই বিরাট অঞ্চলটির পতন ঘটে স্প্যানিশদের শঠতা আর আধুনিক অস্ত্রের আক্রমণের মুখে। তবে ইনকা সাম্রাজ্যের অসাধারণ স্থাপত্য, যোগাযোগব্যবস্থা, কৃষিব্যবস্থা ও নিখুঁত প্রশাসনিক দক্ষতা আধুনিক মানুষের কাছে এক বিস্ময় হয়ে রয়েছে।

ইনকা সাম্রাজ্য; Image Source: Freeman-pedia

ইনকাদের আগমন

ইনকাদের আগমন সম্বন্ধে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে হেয়াঁলি লক্ষ্য করা যায়। ইনকারা নিজেদেরকে সূর্যের সন্তান বলে মনে করতো। তাদের মধ্যে প্রচলিত গল্প হচ্ছে, পেরুর টিটিকাকা হ্রদের কাছে তিনটি গুহা ছিল। এর মাঝের গুহাটি থেকে একদিন বেরিয়ে আসে চারটি ছেলে ও চারটি মেয়ে, এরা সবাই ছিল সূর্যদেব ইন্তির সন্তান। ইন্তি আবার স্রষ্টা ভিরাকোচার সন্তান। যা-ই হোক, এদেরই একজন, মানকো কাপাক ও তার বোন মামা ওলেকোকে ইন্তি একটি নিরেট সোনার দন্ড দিয়েছিলেন। মাঝের গুহার দু’পাশের গুহা থেকে বার হয়েছিল ইনকাদের গোত্রগুলোর পূর্বপুরুষেরা। মানকো কাপাক আর তার বোনকে ইন্তি বলেছিলেন, যেখানে স্বর্ণদন্ডটি বিনা আয়াসে মাটির মধ্যে পোঁতা যাবে, সেখানেই যেন তারা বসতি স্থাপন করে।

দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে বর্তমান কুজকো শহরের কাছে মানকো কাপাক এই নতুন বসতি স্থাপন করেন। সেখানকার অধিবাসীদেরকে তিনি শেখালেন কৃষিকাজ, মামা ওলেকো শেখালেন চরকায় সুতা কাটা। এভাবেই ইনকা সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। আরেকটি কিংবদন্তী অনুসারে টিটিকাকা হ্রদের কাছে কিছু দাড়িওয়ালা শ্বেতবর্ণের মানুষ ইনকাদেরকে কুজকোতে বসতি স্থাপনের নির্দেশ দেয়। স্প্যানিশরা ইনকা সাম্রাজ্যে হানা দিলে বহু ইনকার ধারণা হয় যে, তাদের সেই সাদা বর্ণের পবিত্র পুরুষেরা হাজির হয়েছে। পরে অবশ্য কংকুইস্তাদোরসদের লুঠতরাজ আর খুন খারাবী দেখে তাদের মোহ ভাঙ্গে।

টিটিকাকা হ্রদ; Image Source: Zoom Vacations

গল্পগাথাঁ ছেড়ে বাস্তবে আসা যাক। ইনকা ইতিহাসের কোনো লেখ্যরূপ না থাকায় তাদের উৎপত্তি নির্ধারণ করাটা কঠিন। তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, ইনকারা অতীতে ছিল কোনো পশুপালনকারী ভ্রাম্যমান জাতি। কোথা থেকে তারা এসেছে না জানলেও তাদের সাম্রাজ্যের ইতিহাস অনেকটাই আজ পরিষ্কার। ইনকারা দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে কুজকোকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করে। শ’খানেক বছরের মধ্যে তারা বহু দেশ জুড়ে ইনকা সাম্রাজ্য গঠন করে ফেলে। প্রায় শতাধিক বছর টিকেছিল তাদের রাজ্য।

মজার কথা হচ্ছে, ইনকাদের সাথে সমসাময়িক ইয়ুকাটান, মায়া বা অ্যাজটেকদের কোনো যোগাযোগই ছিল না। যদিও অ্যাজটেকদের উৎপত্তির ইতিহাসের সাথে ইনকাদের কিছুটা মিল আছে। অ্যাজটেকরাও লোনা জমিতে কাঁটাগাছের ওপরে বসে ঈগলে সাপ খাচ্ছে, এই দৃশ্যের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে বর্তমান মেক্সিকো সিটিতে বসতি স্থাপন করে বলে কথিত আছে। বর্তমান ঐতিহাসিকদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, মানকো কাপাক বলে আসলেই এক নেতা ছিলেন এবং তিনিই প্রথম ইনকাদের একত্র করে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।

সাপা ইনকাদের শাসন

ইনকাদের সম্রাটকে বলে হত সাপা ইনকা। ভিকুনা নামের না-উট, না-ভেড়া গোছের এক প্রাণীর দুষ্প্রাপ্য লোম দিয়ে বানানো উষ্ণীষ পরতেন তিনি, তাতে গোজাঁ থাকতো দুটি কোরাকেংকুর পালক। কেরাকেংকু বা ভিকুনা কেবল সম্রাটের জন্যই বৈধ ছিল।

শিল্পীর কল্পনায় সাপা ইনকা; Image Source: Fine Art America

ইনকারা ছলে-বলে-কৌশলে প্রতিবেশী জাতিগুলোকে বশ করেছিল। এদের অনেকেই উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল। ইনকাদের রাজধানী কুজকো সে আমলে ছিল এক চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো শহর। পাহাড়ের ধাপ কেটে কৃষিকাজ; মরুভূমি, চাষের জমি আর শহরে চমৎকার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, দুর্গম দেশের আনাচে কানাচে রাস্তা বানিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, কিপু নামক গিট পাকানো রঙিন সুতায় হিসেব বা ইতিহাসের রেকর্ড রাখবার পদ্ধতি, কোনোরকম সিমেন্ট জাতীয় উপাদান না ব্যবহার করে স্রেফ পাথরের খাঁজে পাথর বসিয়ে বিরাট বিরাট সূর্যমন্দির আর রাজপ্রাসাদ এবং শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী ছিল ইনকাদের।

চাকা ছাড়া কিভাবে তারা এমনভারী কাজ সমাধা করলো, কিভাবে লোহা, তামা বা ইস্পাতের ব্যবহার না জেনেও এত উন্নত শহর বা কৃষিব্যবস্থা ইনকারা গড়লো তা এক রহস্য। লামা বা ভিকুনার লোম থেকে বানানো ইনকা কাপড় ছিল গুণে-মানে অতুলনীয়। কৃষিনির্ভর এই সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় জমির ফসলের তিন ভাগের এক ভাগই সূর্যমন্দিরে, এক ভাগ সাপা ইনকাকে আর এক ভাগ কৃষককে দেওয়া হত। তবে এরপরেও সমৃদ্ধি ছিল যথেষ্ট। ইনকারা ব্রোঞ্জের ব্যবহার জানতো। তাদের সেনাবাহিনীর শক্তিও ছিল যথেষ্ট। সাকাহুয়াসমান নামক বিরাটকায় দুর্গের মতো অসংখ্য সামরিক ঘাঁটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ইনকাদের এলাকায়। হুয়ানা কাপাক বা পাচাহুতির মতো শক্তিশালী সম্রাট তাদের ধন-গৌরব বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিলেন। 

কেরাকেংকু; Image Source: Pinterest

পতন

পানামা উপনিবেশের নাম ছিল ক্যাস্তিল্লে দে অরো ওরফে সোনার ক্যাস্তিল। স্প্যানিয়ার্ডরা মেক্সিকো আর মধ্য আমেরিকা জয় করে তখন দক্ষিণে পা বাড়াবার তাল করছে। স্প্যানিশ কংকুইস্তাদোরসদের বৈশিষ্ঠ্য ছিল যে তারা সোনা ছাড়া আর অন্য কিছুর খোঁজ করতেন না বললেই চলে। সোনা এবং রুপা, সেই সাথে আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের খতম করে দাস বানানো এবং বিরাট বিরাট জমিজমা নিজেদের কব্জায় আনা- এই করেই স্প্যানিশ আমেরিকার অর্থনীতি চলতো। তো এহেন স্প্যানিয়ার্ডরা পানামায় থাকতে খবর পেল দক্ষিণে পাহাড়ের মাথায় নাকি ভয়ানক সমৃদ্ধ এক সাম্রাজ্য আছে, সেখানকার মানুষেরা সবাই সূর্যের সন্তান এবং তারা সোনার থালায় ভাত খায়, সোনার জিনিসপত্র ব্যবহার করে। চরম ধনী এই সাম্রাজ্যের কথা শুনে স্প্যানিশদের তো পাগল বনবার দষা। সেসময়েই ১৫১৪ সালে স্প্যানিশরা প্রশান্ত মহাসাগরের তট আবিষ্কার করে, আবিষ্কার হয় পানামা যোজক।

আতাহুয়ালপা; Image Source: Ancient Origins

গাসপের দে এসপিনা নামের এক মহাজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে আধবুড়ো এক দুঃসাহসী মানুষ, ফ্রান্সিসকো পিজারো পানামার দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল ধরে বেশ কিছু অভিযান চালান। এমনই এক অভিযানে পিজারো আর তার দলবল টমবেজ বন্দরে পৌঁছান। টমবেজের সমৃদ্ধি দেখে তারা বুঝতে পারেন বিশাল আন্দিজের ওপরে বিরাট এক সাম্রাজ্য আছে যেটা সোনাদানায় পরিপূর্ণ। তিনি ইনকা শাসনে অসন্তুষ্ট জাতিগুলির সাথে জোঁট বাধলেন। ১৫৩০ এর দশকের সেই সময়টাতে আবার ইনকা সাম্রাজ্যে চলছে ক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধ। একদিকে সাপা ইনকা হুয়াসকার আর আরেকদিকে তার ভাই আতাহুয়ালপা। আতাহুয়ালপা হুয়াসকারকে পরাস্ত ও বন্দী করেন।

এরপরে তিনি স্প্যানিয়ার্ডদেরকে নিজের সাম্রাজ্যের একদম ভেতরে নিয়ে এসে একটা ছোট্ট শহরে থাকতে দেন। ১৮০ জন ইউরোপীয়ান আর ষাটটির মতো ঘোড়ার বিপরীতে আতাহুয়ালপার অধীনে ছিল আশি হাজার পদাতিক সৈন্য। কিছুদিন পরে তিনি বুঝতে পারেন, স্প্যানিয়ার্ডরা আদতে দেবতা নয়, নিছক লুঠেরা। তবে তার আগেই এক বৈঠকের সময় পিজারো আর তার দলবল আতাহুয়ালপাকে বন্দী করে ফেলে। আতাহুয়ালপা বন্দী অবস্থাতেই হুয়াসকারকে খুন করান। এছাড়া পিজারোকে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে দুই মাসের মধ্যে ২২ ফুট লম্বা, ১৭ ফুট চওড়া আর ৮ ফুট উঁচু একটা ঘরভর্তি করে সোনা আর দুই ঘর ভর্তি রুপা দিবেন। পিজারো ধনদৌলত ঠিকই নিলেন, কিন্তু মুক্তির বদলে আতাহুয়ালপাকে পরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন। দোষ? হুয়াসকারকে খুন করা এবং বিধর্মী হওয়া। যদিও আতাহুয়ালপা মৃত্যুর আগে আগে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করায় তাকে আগুনে না পুড়িয়ে ‘করুণা’ দেখানো হয়। সেকালে স্প্যানিশরা বিধর্মীদের আগুনে পুড়িয়ে মারতো কি না।

ইনকা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ; Image Source: Andean Travel Web

শেষ লড়াই

ইনকারা গৃহযুদ্ধের কারণে এক হতে পারেনি ঠিকই, তাদের হাতে স্প্যানিশদের মতো কামান, বন্দুক বা তরবারিও ছিল না, কিন্তু তারপরেও ইনকা নেতারা একের পর এক বিদ্রোহ আর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে বহুদিন। ভিলকাবাম্বার গহীন জঙ্গলের ভেতরে আতাহুয়ালপার বংশধরেরা এক স্বাধীন ইনকা রাজ্য গড়ে তুলে অনেকদিন যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। শেষমেষ ১৫৭২ সালে শেষ উল্লেখযোগ্য নেতা তুপাক আমারুর সেনাদল পরাস্ত হলে ইনকাদের ইতি ঘটে। মজার কথা হচ্ছে, গত শতাব্দীর শুরুতে হাইরাম বিংহাম পেরুর মাচুপিচ্চু আবিষ্কার করলে পুরো বিশ্ব অবাক হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, দীর্ঘদিন ইনকারা এখানে স্প্যানিশদের অগোচরে বাস করে গিয়েছে।

মাচু পিচ্চু; Image Source: machupicchu.com

ইনকাদের গৃহযুদ্ধ, প্রযুক্তিক্ষেত্রে অনগ্রসরতা আর বিরোধী গোত্রগুলোর বিদ্রোহ ইনকা সাম্রাজ্য পতনের অন্যতম কারণ। তবে এর থেকেও গুরুতর সমস্যা ছিল বোধহয় স্প্যানিয়ার্ডসহ ইউরোপীয়দের নিয়ে আসা হাম, স্মল পক্সের মতো অসুখ। তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে স্প্যানিশ আমেরিকার ৯৩ ভাগ আদিবাসী মরে সাফ হয়ে যায় এই অসুখে। ফলে ক্রমেই ইনকাসহ আদিবাসী ইন্ডিয়ান বিরোধীদের শক্তি বিলীন হয়ে যায়।

প্রভাব

ইনকা সাম্রাজ্য নিয়ে বেশ কিছু সাহিত্যকর্ম আছে। আঠারো শতাব্দীর পেরুতে তুপাক আমারু নামের আরেক দুর্দান্ত নেতা স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সত্তরদের দশকে এই পেরুতেই আবার তুপাক আমারু নামের একটি উগ্র বামপন্থী গেরিলা দল গড়ে তুলেছিলেন ভিক্তর কাম্পোস নামের এক নেতা।

ফিচার ইমেজ – Northstar Travel

Related Articles

Exit mobile version