জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণ ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এই আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। কিন্তু জাপানের এই পার্ল হারবার আক্রমণের নেপথ্যে কি কোনো উদ্দেশ্য ছিল? কেনই বা জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে জেনেও এই আক্রমণ চালাতে সিদ্ধান্ত নিলো? তা জানার জন্য চলুন ইতিহাসের দিকে একবার দৃষ্টি ফেরানো যাক।
পার্ল হারবার আক্রমণের পূর্বের কিছু ঘটনা
১৯৩১ সালের দিকে জাপান এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সারা বিশ্বে এ সময় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। তাই নিজের দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য নিজের ভৌগলিক সীমা পেরিয়ে খনিজ সম্পদে প্রাচুর্য রয়েছে এমন দেশসমূহের অধিকার নেওয়ার জন্য জাপান রাজনৈতিক ও সামরিক কুটকৌশল চালাতে থাকে।
সুযোগ বুঝে প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পদশালী দেশ চীনের রাজ্যগুলো দখলের পাঁয়তারা করতে থাকে জাপান। ফলশ্রুতিতে, ১৯৩৭ সালে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জাপান এবং চীনের বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। এসময় জাপান চীনের ন্যানকিং শহরে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ন্যানকিং ম্যাসাকার হিসেবে পরিচিত এই গণহত্যায় বিশ্ব বিবেক জাপানের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র জাপানের এই মনোভাবের তীব্র প্রতিবাদ জানালেও জাপান তাতে খুব একটা কর্ণপাত করেনি।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলো জাপানের এই স্বেচ্ছাচারিতা, জবরদখলে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। চীন জাপানের বিরূদ্ধে যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কাছ থেকে অর্থ ও সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করে। ১৯৪০ সালে জাপান ফরাসি ইন্দো-চীনে জোরপূর্বক ও অন্যায়ভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করায় যুক্তরাষ্ট্র জাপানে উড়োজাহাজ, মেশিনের যন্ত্রাংশ লোহা, স্টিলের পাত ও পেট্রোলিয়াম যন্ত্রের আমদানী পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। উল্লেখ্য যে, জাপানের শিল্প-বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। জাপান যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল, পেট্রোলিয়াম যন্ত্রের কাঁচামাল, মেশিন তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে লোহা ও স্টিলের পাত আমদানী করতো।
এদিকে, ১৯৩৯ সালের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ক্যালিফোর্নিয়া থেকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবার এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নৌঘাঁটি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। জাপানী আগ্রসনকে দমন করার জন্য ফিলিপাইনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তৈরি করার নির্দেশ দেন। জাপানের এই অদম্য মনোভাবের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই চিন্তিত ছিল। তাই কোনো কারণে জাপান যদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে আক্রমণ চালায়, তাহলে যুক্তরাজ্যের মিত্র হিসেবে আমেরিকা তাতে দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে পারে, সেই লক্ষ্যে মার্কিন কর্তৃপক্ষ এই ঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এইসময় জাপান জার্মানি এবং ইতালির সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ফলে স্বভাবিকভাবেই জার্মানির বিপক্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে থাকে জাপান। ১৯৪১ সালে জার্মানির কাছে ফ্রান্সের পতনের পর সুযোগ বুঝে জাপান ইন্দো-চীনে আক্রমণ করে। এই আগ্রাসনের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র জুলাই মাসের দিকে জাপানে তেল রপ্তানী স্থগিত করে। ফলে শিল্প কারখানার ওপর তা ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই জাপান বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে থাকে। এদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে খনিজ তেল ও রাবারের সম্পদ দখলস্বত্ত্ব লাভের বিপুল সম্ভাবনা দেখে মালয় ও ডাচ ইস্ট ইন্ডিজেও আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় জাপান।
পার্ল হারবার আক্রমণের ব্যাপারে জাপানী সামরিক বাহিনীর জরুরী বৈঠক
১৯৪১ সালের জুন মাসের দিকে জাপানের সামরিক নেতৃত্বে থাকা উর্ধ্বতন সামরিক অফিসাররা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, প্রশান্ত মহাসাগরে প্রধান মার্কিন নৌঘাঁটি ও বিমান ঘাঁটিগুলোর উপর আকস্মিক আক্রমণ করতে হবে। এর ফলে মার্কিন নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান শক্তিসমূহকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। একইসাথে যত দ্রুত সম্ভব ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, নিউগিনি ও সলোমন দ্বীপুঞ্জগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদপূর্ণ এলাকাগুলো অধিকার করে নেওয়া যাবে।
পরবর্তীতে ম্যারিয়ানা ও বিসমার্ক দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও বার্মার পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত অধিকৃত যুদ্ধসীমা বিস্তৃত করা হবে বলে এই সভায় সিদ্ধান্ত হয়। পার্ল হারবার নৌ-ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়া গেলে জাপান বেশ কিছুটা সময় পাবে এসব অঞ্চলে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার এবং নিজের সামরিক শক্তিও সদৃঢ় করার সুযোগ পাওয়া যাবে।
পার্ল হারবার আক্রমণের পূর্বে টোকিও-ওয়াশিংটন আলোচনা
জাপানের পক্ষ থেকে এই আক্রমণের পরিকল্পনা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু টোকিও এবং ওয়াশিংটনের মধ্যকার শান্তি আলোচনার কারণে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়। ফলে আক্রমণের পরিকল্পনা বাদ দেওয়া না হলেও তা কিছু সময়ের জন্য ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। এই আলোচনার একপর্যায়ে, ২০ নভেম্বর ১৯৪১ সালে জাপান একটি প্রস্তাব পেশ করে। সেই প্রস্তাবে ছিল-
১. ফরাসি ইন্দো-চীনের যে অংশে জাপানী সৈন্যরা রয়েছে, সেখানে ছাড়া জাপানী ও মার্কিন কোনো সৈন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় প্রবেশ করবে না।
২. জাপান ও চীনের মধ্যে কিংবা প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় শান্তি ফিরে এলে ফরাসি ইন্দো-চীন থেকে জাপান সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।
৩. ওলন্দাজ দ্বীপপুঞ্জে জাপান ও আমেরিকার যে সমস্ত পণ্য দ্রব্যের প্রয়োজন, উভয় সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতায় সেগুলো সংগৃহিত হবে।
৪. উভয় দেশের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরায় উজ্জীবিত করা হবে। জাপান প্রয়োজন মতো যুক্তরাষ্ট্রকে তেল সরবরাহ করবে।
৫. জাপান ও চীনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টায় মার্কিন সরকার কোনো রূপ হস্তক্ষেপ করবে না।
টোকিও-ওয়াশিংটন আলোচনায় জাপানের দেওয়া এই শর্তগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আদৌ গ্রহণযোগ্য ছিল না। ফলে ২৬ নভেম্বর মার্কিন সরকার পাল্টা একটি প্রস্তাব দাখিল করে। এই প্রস্তাবে ছিল-
১. প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় যেসব দেশের স্বার্থ রয়েছে, সেসব দেশের সরকারের মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি সই করা।
২. ইন্দো-চীনের ভূমিগত সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা এবং এর ফলে কোনোরূপ অর্থনৈতিক বিশেষ সুবিধা গ্রহণ না করা।
৩. চীনের জাতীয় সরকার ছাড়া অন্য কোনো সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়া।
৪. চীনে সকল বিদেশী শক্তির রাষ্ট্রাতিরিক্ত অধিকার পরিত্যাগ।
৫. পারস্পরিক সম অধিকার সম্পন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের শর্ত।
৬. পারস্পরিক সম্পত্তি আটকের অধ্যাদেশ প্রত্যাহার।
৭. ডলার ও ইয়েনের মুদ্রা বিনিময় হার নির্দিষ্ট করা।
জাপানীরা যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাব কিছুতেই মেনে নিতে রাজি ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রস্তাব জাপান সরকারের কাছে প্রত্যাখাত হলো।
পার্ল হারবার আক্রমণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন
এই আলোচনার চলাকালে জাপান তাদের আক্রমণের পরিকল্পনা সাজাতে লাগলো। এই চক্রান্তের কথা জাপানের উর্ধ্বতন কয়েকজন নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা ছাড়া অনেকেই জানতেন না। উল্লেখ্য, পার্ল হারবার আক্রমণের সিদ্ধান্ত ৫ নভেম্বর তারিখেই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। অথচ ২০ নভেম্বর জাপানী রাষ্ট্রদূত নোমুরা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি কর্ডেল হালের নিকট জাপানের তরফ থেকে আপোষ রফার শর্ত পেশ করা হয়।
২৭ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে যু্ক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, হাল, কুরুসো ও নোমুরা এক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। এদিকে ২২ নভেম্বর জাপানের পরাষ্ট্রমন্ত্রী টোগো গোপন সাংকেতিক বার্তায় নোমুরাকে জানিয়ে দেন যে, ২০ নভেম্বরের প্রস্তাবই কিন্তু ‘শেষ ও চূড়ান্ত প্রস্তাব’। আর ২৯ নভেম্বর হলো তার সময়সীমা। এটিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জাপানের চরমপত্র।
মার্কিন নৌবিভাগের কর্মকর্তারা টোগোর এই গোপন বার্তা ধরে ফেলে এবং এই সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হলেও হোয়াইট হাউস আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলো। এই আলোচনা চলতে থাকলে পার্ল হারবার আক্রমণের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। অথচ ৩ ডিসেম্বর টোকিও থেকে এক গোপন বার্তা পাঠানো হলো। বার্তাটি ছিল ‘ইস্ট উইন্ডস রেইনিং’- যার অর্থ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত সব জাপানী দূতাবাসের গোপনীয় দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ।
এসময় জাপানী ভাইস এডমিরাল চুইচি নগুমোর নেতৃত্বে ৭২টি যুদ্ধ যুদ্ধজাহাজ, ক্রুজার, বিমানবাহিনীর জাহাজ, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার সহ মোট ৭২টি যুদ্ধ জাহাজের এক নৌবহর নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে পার্ল হারবার অভিযানে বের হয়। ৫ ডিসেম্বর নৌবহরটির উদ্দেশ্যে আবার জাপানী সাংকেতিক রেডিও বার্তা যাতে ছিল-‘ক্লাইম মাউন্ট নিটাকা’। বার্তাটির মধ্য দিয়ে আক্রমণের চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হয়। এই চূড়ান্ত নির্দেশ পাওয়ার পর জাপানী রণতরী এগিয়ে চললো হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে, টার্গেট পার্ল হারবার।
তথ্যসূত্র:
১. শ্রী বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় রচিত জাপানী যুদ্ধের ডায়েরী
২. শ্রী বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় সংকলিত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইতিহাস; প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানী অভিযান;পৃষ্ঠা নং- ৪৮৭- ৫০১
৩. শ্রী বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় সংকলিত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইতিহাস; পৃষ্ঠা নং- ৪৬৯- ৪৮০
ফিচার ইমেজ: wtkoryukan.com