দান্তের বিয়েট্রিস: এক অব্যক্ত ভালোবাসার ইতিকথা

দান্তে না দান্তের সৃষ্টি ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’ স্মরণীয় তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তবে তিনি ও তার সৃষ্টি দুটোই যে অমর হয়ে টিকে থাকবে- সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

দুরান্তে দেগলি আলিঘিয়েরি, সাধারণভাবে দান্তে নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। ইতালির ফ্লোরেন্সবাসী এই কবির জন্মসাল ১২৬৫। তবে জন্মদিন নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। ধারণা করা হয়ে থাকে, ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ২১ তারিখ থেকে জুন মাসের ২০ তারিখের মধ্যে যেকোনো একদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম দ্য ডিভাইন কমেডিকে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সাহিত্যকর্মের মধ্যে অন্যতম সেরা হিসেবে গণ্য করা হয়। ডিভাইন কমেডিকে আধুনিক ইতালিয়ান ভাষার ভিত্তি বলেও গণ্য করা হয়

দান্তে (১২৬৫-১৩২১); Source: magazine.pellealvegetale.it

দান্তের সাথে যখন বিয়েট্রিসের প্রথম দেখা হয়, তখন দান্তের বয়স মাত্র নয় বছর। বিয়েট্রিস ছিলেন আট বছরের বালিকা। তার পুরো নাম বিয়েট্রিস পোরতিনারি। বিয়েট্রিসের পরিবার বাস করতো দান্তের বাসার কাছেই। দান্তের অন্যতম কাব্যগ্রন্থে ভিটা নোভাতে তিনি লিখেছেন, বিয়েট্রিসের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় পোরতিনারিদের বাসায়।

সেখানকার রীতি অনুসারে, দান্তে ও বিয়েট্রিসের পরিবার ফ্লোরেন্সের বাইরেও প্রতিবেশী ছিলো। ফিয়েসোলের পর্বতের কাছে দুই পরিবারের সামার ভিলা ছিলো। খুব সম্ভবত তাদের পরস্পরের সাথে সেখানেও দেখা হয়ে থাকতে পারে।

বিয়েট্রিসকে প্রথম দেখাতেই দান্তে বিমোহিত হয়েছিলেন। পরে তিনি লিখেছিলেন, “সে মুহূর্ত থেকেই ভালোবাসা আমার আত্মাকে পুরোপুরি অধীনস্থ করে নিয়েছিলো”। পরবর্তী ন’বছর দান্তে বিয়েট্রিসের মাঝেই বুঁদ হয়ে ছিলেন। কিন্তু তাকে তিনি কখনোই ভালোবাসার কথা বলতে পারেননি। এমনকি দান্তের সাথে প্রথম দেখার পর তাদের মাঝে প্রথম কথা হয় ন’বছর পর।

বিয়েট্রিস পোরতিনারি; Source: alchetron.com

দান্তের বর্ণনানুযায়ী, যখন বিয়েট্রিসের সাথে তার প্রথম দেখা হয়, তখন বিয়েট্রিস ছিলেন গাঢ় লাল রঙের পোষাক ও কোমরবন্ধনী পরা। তার চেহারা ছিলো দেবদূতের মতো। তিনি ভেবেছিলেন, বিয়েট্রিসের মাঝে দৈবশক্তি ও মহৎ চরিত্রের গুণাবলী আছে।

ন’বছর পর তাদের মাঝে প্রথম কথা হবার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুতভাবে হয়েছিল। বিয়েট্রিস সাদা রঙের পোষাক পরে, সাথী হিসেবে দুজন বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন আর্নো নদীর পাশে অবস্থিত ফ্লোরেন্সের এক রাস্তায়। বিয়েট্রিস তাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে সম্ভাষণ জানান। কিন্তু দান্তে তার সম্ভাষণের কোনো উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান।

বিয়েট্রিসের সম্ভাষণ দান্তের মনকে আনন্দে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল। তিনি রুমে ফিরে এসে বিয়েট্রিসের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েন। সে সময় দান্তে একটি স্বপ্ন দেখেন। সে স্বপ্নকে ভিটা নোভাতে দান্তে তার প্রথম সনেটের বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করেন।

এর পরবর্তী সময়ে দান্তে ও বিয়েট্রিসের মাঝে আরো দুবার দেখা হয়েছিলো। দুবারই খুব অল্প সময়ের জন্য তাদের দেখা হয়। প্রথমবার ছিলো সান্তা মারগারিটা দে চার্চ এ। ড্যান ব্রাউনের ইনফার্নোতে রবার্ট ল্যাংডন এবং সিয়েনা ব্রুকস এই চার্চই ভ্রমণ করেছিলেন, এটি চার্চ অফ দান্তে বলেও পরিচিত, প্রচলিত কথা অনুসারে এখানেই দান্তে ও বিয়েট্রিসের প্রথম দেখা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার তারা একে অপরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে।

চার্চ অফ দান্তে; Source: magazine.brunelleschihotelflorence.com

তেরো শতকে পরিবারের ঠিক করে দেয়া পাত্র-পাত্রীদের মাঝে বিয়ে করা ছিলো ফ্লোরেন্সের নিয়ম। এই নিয়ম বিশেষভাবে ধনী ও ওপরতলার শ্রেণীর জন্য প্রযোজ্য ছিলো। দান্তে ও বিয়েট্রিস দুজনই এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রচলিত নিয়মানুসারে, দান্তের বয়স যখন একুশ বছর, তখন তার বিয়ে হয়ে যায় গেমা দোনাতির সাথে। দান্তের বয়স যখন বারো, তখন তার বাগদান হয়েছিল গেমার সাথে। দান্তের বিয়ের এক বছর পর বিয়েট্রিসেরও বিয়ে হয়। যে বছর বিয়েট্রিসের বিয়ে হয়, তার তিন বছর পর বিয়েট্রিস মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় বিয়েট্রিসের বয়স ছিল মাত্র চব্বিশ বছর। তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দান্তে প্রচণ্ড রকম বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। তার বাকি জীবনে তিনি কখনো বিয়েট্রিসকে ভুলতে পারেননি।

বিয়েট্রিসের মৃত্যুর পর দান্তে তার তীব্র পড়াশোনার অভ্যাস থামিয়ে তার স্মরণে কবিতা রচনা করতে শুরু করেন। বিয়েট্রিস দান্তের জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এই প্রভাব শুধুমাত্র অনুপ্রেরণার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। বিয়েট্রিসের মৃত্যুর পর তাকে লেখা কবিতাগুলোসহ এর আগে তিনি বিয়েট্রিসের কথা মনে করে তার ডায়েরিতে যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন, সেগুলো একত্রিত করে তৈরি করা হয় লা ভিটা নোভা, গীতিকবিতা মেশা এক গদ্য রচনা।

দান্তের অমর সৃষ্টি দ্য ডিভাইন কমেডি; Source: barnesandnoble.com

দান্তে তাদের পরস্পরের সাথে সাক্ষাতের কথা বর্ণনা করেছেন। বিয়েট্রিসের রুপ, উদারতা, গুণের কথা বর্ণনা করেছেন। তাদের দুজনের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা বর্ণনা করেছেন। বিয়েট্রিসের প্রতি তার অনুভূতি তিনি সেখানে লিখেছেন। লা ভিটা নোভাতে বিয়েট্রিসের মৃত্যুর দিনের কথাও বলা হয়েছে, যেদিন দান্তে জানেন বিয়েট্রিস মৃত্যুবরণ করেছেন।

বিয়েট্রিস দান্তের দুটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মে চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন- লা ভিটা নোভা এবং ডিভাইন কমেডি। এই দুটি রচনার প্রায় প্রত্যেক লেখাতেই তার ওপর বিয়েট্রিসের গভীর প্রভাব ও বিয়েট্রিসের প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করা যায়। লা ভিটা নোভার কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হচ্ছে,

“তার সাথে প্রথম দেখা হবার ঠিক ন’বছর পর, শেষ দিনটিতে, সে অভূতপূর্ব মুহূর্তটি আমার সামনে পুনরায় ঘটতে থাকে। সম্পূর্ণ শুভ্র সাদা পোশাক পরে দুজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গী হয়ে আমার সামনে দিয়ে সে হেঁটে চলেছিল। আমাকে অতিক্রম করে চলে যাবার মুহূর্তে সে আমার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল। আমি তখন কুণ্ঠিত হয়ে কাঁপছিলাম। অসম্ভব রকমের শিষ্টতার সাথে সে আমাকে অভিবাদন জানিয়েছিল। তার সে অভিবাদন জানানো আমার মনে এক অভূতপূর্ব রকমের আনন্দ এনে দিয়েছিল। … 

তখন দিনের ঠিক নবম ঘন্টাটি চলছিল। এটা ছিল প্রথমবার, সে আমার সাথে কথা বলেছিল। আমার মনে এত প্রচণ্ড রকম আনন্দের সৃষ্টি হয়েছিল যে, আমি নিজেকে কোলাহলপূর্ণ অবস্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে আমার নির্জনতায় পরিপূর্ণ কক্ষে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেখানে আমি একাকী বসে সেই মঙ্গলময় সত্তার কথা চিন্তা করছিলাম।”

লা ভিটা নোভার আরেক অংশে তিনি বর্ণনা করেছেন,

“যখন যেখানেই সে উপস্থিত হতো, তার সেই অলৌকিকতাপূর্ণ অভ্যর্থনা পাবার আশায় আমার মনে হতো, পুরো পৃথিবীতে আমার কোনো শত্রু নেই। আমার মনে এক অভূতপূর্ব উদারতাপূর্ণ মনোভাবের সৃষ্টি হতো। ঐ সময় আমাকে ব্যথিতকারী সকলকে আমি ক্ষমা করে দিতাম। ঐ মুহূর্তে যদি কেউ আমাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতো, তবে সেই প্রশ্নের বিষয় যা-ই হোক না কেন, আমার উত্তর হতো একটাই, ‘ভালোবাসা’। সে যখন আমাকে অভিবাদন জানাবার মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছিল, অভূতপূর্ব এক প্রেমময় ভাব আমার মনকে দখল করে নিয়েছিল, সেই প্রেম আমার অন্য সকল ইন্দ্রিয়কে ধ্বংস করে দিয়েছিল সেই মুহূর্তে। আমার ঠুনকো দৃষ্টিশক্তিকে হঠিয়ে দিয়ে তা আমায় বলেছিল, ‘যাও, তোমার প্রেমিকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো’। যদি কেউ কখনো ভালোবাসার দর্শন করতে চেয়ে থাকে, তবে সেই মুহূর্তে সে আমার চোখের স্পন্দিত হওয়া দেখে তা অনুভব করতে পারতো।”

দান্তে আলিঘিয়েরি ১৩২১ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেন। 

ফিচার ইমেজ: historyofliterature.com

Related Articles

Exit mobile version