পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লুকিয়ে আছে নানা মূল্যবান সম্পদ। মাটির নিচে, সমুদ্রতলে, পাহাড়চূড়ায়। এসব হারিয়ে যাওয়া মণি-মাণিক্যের খোঁজে আজও চলে রোমাঞ্চকর নানা অভিযান। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা নানা কারণে হারিয়ে যাওয়া কোনো জাহাজ বা অতল সমুদ্রে ডুবে যাওয়া গুপ্তধনের খোঁজে বছরের পর বছর সমুদ্রে ভেসে বেড়ানোর গল্প আমরা অনেক রূপকথার বইতে পাই।
কিন্তু বাস্তবেও এ ধরনের অনেক গুপ্তধন রয়েছে যা একসময় সমুদ্রতলে হারিয়ে গিয়েছিল। সেসব গুপ্তধন এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আজ আপনাদের শোনাবো এমনই কিছু হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধনের গল্প যার খোঁজ মিলেছে অতি সম্প্রতি।
কি ওয়েস্টে স্প্যানিশ জাহাজের গুপ্তধন
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত একটি দ্বীপ শহর হল ‘কি ওয়েস্ট’। ১৬২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। নুয়েস্ট্রা সেনোরা দে আটোশা, সান্তা মার্গারিটা, দ্য স্প্যানিশ গ্যালন্স নামের তিনটি স্প্যানিশ জাহাজ কিউবা থেকে স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
জাহাজ তিনটিতে ছিল প্রচুর সোনা-রূপা, মহামূল্যবান হীরে সমেত প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারেরও অধিক সম্পদ। ৬ সেপ্টেম্বর ‘কি ওয়েস্ট’ উপকূলের কাছে এসে জাহাজগুলো একটি ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়। সেখানে সব জাহাজই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং সমুদ্র ডুবে যায়।
এর প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পর ১৯৮৫ সালে ‘মেল ফিসার’ নামের এক ধনী গুপ্তধন সন্ধানী সেই গুপ্তধনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। মেল ফিসার সমুদ্রের অন্তত ৬০০ ফুট নিচে একটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। আচমকা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ১৬২২ সালে সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল যে স্প্যানিশ জাহাজ আটোশা- এ কি সেই আটোশা! যদি তা-ই হয়, তাহলে…
মেল ফিসার তার হৃদপিণ্ডের প্রতিটি হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। সেই দপদপানি শুনতে শুনতেই মেল ফিসার মনঃস্থির করে ফেললেন। তিনি এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঢুকলেন। ১৯৮৫ সালের ২০ জুলাই মেল ফিসার সত্যিই তার স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় ধরেছিলেন।
বুকের ভেতরে তাল-তাল সোনা, রূপো, হীরে আর পান্না নিয়েই আটোশা সত্যিই এতদিন সমুদ্রের তলদেশে নিশ্চুপ হয়ে পড়েছিল। সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। মেল ফিসার তাকে নিয়ে এলেন আবারো পৃথিবীর আলোয়। মেল ফিসারের দাবি তিনি প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন যার মধ্যে ৪০ টন সিলভার ও সোনার বার, ১০০,০০০ স্প্যানিশ রৌপ্য মুদ্রা, সোনা ও রূপার হস্তনির্মিত সামগ্রী এবং নানা মণি-মুক্তা।
কিন্তু অন্যান্য জাহাজগুলোর বেঁচে যাওয়া ক্যাপ্টেন ও নাবিকদের কথা অনুযায়ী আরো প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ ছিল অন্যান্য জাহাজগুলিতে যা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি। এর মধ্যে ছিল প্রায় ১৭ টন রূপার বার, ১ লাখ ২৮ হাজার মুদ্রা (বিভিন্ন ধরনের), ২৭ কেজি পান্না এবং ৩৫টি স্বর্ণের বাক্স। এর খোঁজ এখনো চলছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে সকলের কাছে অধরা।
সান জোসে’র গুপ্তধন
সপ্তদশ–অষ্টাদশ শতকের কথা। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছিল স্পেনের উপনিবেশ। দক্ষিণ আমেরিকার এসব দেশের অর্থ-সম্পত্তি লুট করে সেগুলো জাহাজে করে স্পেনে পাঠিয়ে দেয়া হত। ঠিক এমনই এক জাহাজ ‘সান জোসে’।
১৭০৮ সালের ২৮ মে পানামা বন্দর থেকে নোঙর তুলেছিল ‘সান জোসে’ নামক স্প্যানিশ জাহাজটি। ইনকাদের দেশ থেকে রাশি রাশি সোনা–রূপোর ইট, দুর্মূল্য রঙিন কাঁচের বাতিদান, হীরে, জহরত, মুদ্রা আর মহামূল্যবান রত্নের ভাণ্ডার নিয়ে সে ফিরে যাবে স্পেনের বন্দরে। ধনসম্পদ ছাড়াও কোকো, চামড়া, নীলের মতো বাণিজ্য সামগ্রীও ছিলো সেগুলিতে৷ এসব মণি-মাণিক্য জমা হবে স্পেনের রাজকোষে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সান জোসে জাহাজটি শেষ পর্যন্ত এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে নি। ১৭০৮ সালের ৮ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কলম্বিয়া উপকূলের কাছেই ইংরেজ নৌ-বাহিনীর কমান্ডার চার্লস ওয়েগারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ নৌ-সেনারা আক্রমণ করেছিলেন সান জোসে জাহাজের উপর।
ইংরেজ সেনাদের বিকট গোলার আঘাতে দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে গিয়েছিল সান জোসে। পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষটুকু নিয়েই সে ডুবে গিয়েছিল মাঝ সমুদ্রে। আর সেই সঙ্গে ডুবে গিয়েছিল ৬০০ নাবিক আর রাজকোষের উদ্দেশ্যে পাঠানো লক্ষ লক্ষ টাকার হীরে, জহরত, মণি-মাণিক্য। কলম্বিয়ার উপকূল থেকে প্রায় ১৬ মাইল দূরে ডুবে গিয়েছিল সান জোসে। ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ৭৪০ ফুট গভীরে এখনও ধ্বংসাবশেষ হয়ে পড়ে আছে জাহাজটি।
এ ঘটনার অনেক বছর পর সেই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খোঁজার কাজ শুরু করে কলম্বিয়ার পুরাতত্ত্ব সংস্থা। একদল বিদেশী বিশেষজ্ঞ দলের সাথে কলম্বিয়ার পুরাতত্ত্ব বিভাগ যুক্ত অনুসন্ধান করতে শুরু করে সান জোসে জাহাজের অস্তিত্ব আবিষ্কারে। ৩০৭ বছর আগে ক্যারিবিয়ান সাগরে স্রোত বা বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি কেমন ছিল, তা নিয়ে গবেষণা চালানোর পাশাপাশি, স্পেন ও কলম্বিয়ার ঔপনিবেশিক নথিপত্রতেও অনুসন্ধান চালাতে থাকেন গবেষকরা৷ অবশেষে সাফল্য আসে৷
কলম্বিয়া ও মার্কিন সরকারের নেতৃত্বে চলে সান জোসে’র খোঁজ। এর বেশ কিছুদিন পর, ২০১৫ সালে কলম্বিয়া সরকার জানায় যে, সান জোসের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। কলম্বিয়া সরকারের অনুমান, ওই ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার হওয়া সম্পদের দাম প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ কোথায় পাওয়া গেছে তা জানাতে অস্বীকার করে কলম্বিয়া সরকার। তবে বিভিন্ন তথ্য মতে, যতটুকু জানা যায়, কলম্বিয়ার বারু দ্বীপের কাছেই ওই গুন্তধনের সন্ধান মিলেছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ডুবে যাওয়া সম্পত্তি আবিষ্কারের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলির মধ্যে এটা অন্যতম।
কলম্বিয়া সরকারের দেয়া তথ্যমতে, ধ্বংসাবশেষ থেকে ব্রোঞ্জের তৈরি কয়েকটি ডলফিনের আকৃতি খোদাই করা দুর্মূল্য কামান পাওয়া গেছে। এ থেকেই অনুমান করা হচ্ছে জাহাজের ধ্বংসাবশেষটি সান জোসেরই৷ এই জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া সামগ্রীগুলি সংরক্ষণের জন্য কলম্বিয়া সরকারের পক্ষ থেকে কার্তাহেনাতে একটি সংগ্রহশালা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানানো হয়। তবে এখনও সব সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায় নি। কলম্বিয়া সরকারের ভাষ্যমতে, খুব শীঘ্রই এই গুপ্তধনের খোঁজ তারা পাবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
এভাবে সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া অনেক গুপ্তধন ধীরে ধীরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। একসময় যেসব গুপ্তধন কাহিনী ছিল গল্প বইয়ের প্রধান উপকরণ, সেসব গুপ্তধনের সত্যি সত্যিই বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
শুধুমাত্র মেল ফিসার বা কলম্বিয়ার সরকারই নন, গুপ্তধনের খোঁজে আজও ঘুরে বেড়ান হাজার হাজার অনুসন্ধিৎসু মানুষ। ক্যালিফোর্নিয়া, পেরু বা স্পেন, সর্বত্র এখনও মানুষের চোখের আড়ালে নাকি রয়ে গেছে অজস্র গুপ্তধন। প্রতিটি গুপ্তধনের কাহিনীও নাকি সমানভাবে বিচিত্র, রোমাঞ্চকর বটে।
কিং সলোমনস মাইনস বা টম সয়ারের যুগ আজও শেষ হয় নি, গুপ্তধনের খোঁজে এখনও পৃথিবীর দিকে দিকে চলছে বিচিত্র সব অ্যাডভেঞ্চার। সেসব গুপ্তধনের কথা ধারাবহিকভাবে প্রকাশের ইচ্ছে রইল। চলবে…