সুমেরীয় সভ্যতার জনপ্রিয় দেব-দেবীদের অজানা কাহিনি

পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা হিসেবে সুমেরীয়রা বসতি গেড়েছিল মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণে, ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতো সুমেরীয় সভ্যতার লোকজনও বিশ্বাস করত, পৃথিবী ও মহাজাগতিক সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন অদৃশ্য দেব-দেবীরা। এই বিশ্বাস থেকেই সুমেরীয় সভ্যতায় জন্ম নিয়েছে তিন হাজারেরও অধিক দেব-দেবী। সময়ের সাথে সাথে মেসোপটেমিয়াতে সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়কালের (আক্কাদীয়, ব্যবিলনীয়, ক্যালডীয়) পরিবর্তন ঘটলেও উপকথার শেকড় প্রোথিত রয়েছে এক জায়গাতেই। সেজন্য মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত বিভিন্ন সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে ভিন্ন নামের দেব-দেবীর উপস্থিতি থাকলেও তাদের কাহিনির বহমান স্রোত গিয়ে মিলেছে একই সমুদ্রে। সুমেরীয় সভ্যতা হলো মেসোপটেমীয় সভ্যতার স্রষ্টা। তাই ধরা যায়, মেসোপটেমীয় ধর্মের ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছে এই সভ্যতার সময়েই। সুমেরীয় সভ্যতার জনপ্রিয় দশ দেব-দেবী নিয়েই আজকের এই আয়োজন। তবে এর আগে দেবতাদের সম্পর্কে কিছু ধারণা পরিষ্কার করে নেওয়া যাক।

প্রাচীন সুমের; Image Source: Art Station.

সুমেরীয় দেবতাদের মানব প্রকৃতি

প্রাচীন সুমেরীয় ধর্মতে দেবতাদের উপস্থাপন করা হয়েছে মানব আকৃতির সাথে মিল রেখে। উপকথা অনুযায়ী, দেব-দেবীদের অলৌকিক শক্তি বিদ্যমান থাকলেও, মননে ও গড়নে এরা ছিল মানুষের মতোই। মানবজাতির মতোই দেবতারা মনে পোষণ করতেন লোভ, লালসা, কামক্ষুধা, আবেগ, ভালোবাসা, হিংসা, ঈর্ষাপরায়ণতা ইত্যাদি। মানুষের মতো জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠলেও মানুষের সাথে ছিল তাদের একটাই ফারাক। দেবতারা ছিলেন অমর। সোজা ভাষায়, গড়নে এরা মানুষের মতো হলেও, শক্তিমত্তা এবং সৌন্দর্যে এরা মানুষের চেয়ে উৎকৃষ্ট। কোনো সুমেরীয় দেবতাই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তারা আকারে ছিলেন বিশাল।

সাতজন প্রধান দেব-দেবী নিয়ে গঠিত দল আনুনাকি; Image Source: Wikimedia Commons.

পৃষ্ঠপোষক দেবতার ধারণা

সুমেরীয় সভ্যতার আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো, পৃষ্ঠপোষক দেবতাদের ধারণা। প্রতিটি প্রধান শহর তাদের প্রধান স্থানীয় দেবতা হিসেবে আলাদা আলাদা দেবতার পূজা করত। উদাহরণস্বরূপ, উরুকের লোকেরা দেবতা আন এবং দেবী ইনানাকে শ্রদ্ধা করত। ওদিকে নিপ্পুরের বাসিন্দারা এনলিলকে তাদের পৃষ্ঠপোষক দেবতা বলে মনে করত এবং এরিদু এনকিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে ধরা হতো। প্রতিটি শহরের উপাসকরা মন্দিরে গিয়ে প্রধান দেবতাকে শ্রদ্ধা জানাতেন। শুরুর দিকে মন্দিরগুলো সাধারণ আকার নিয়ে গড়ে ওঠা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তা জটিল আকারে রূপ নিতে থাকে। ফলে গড়ে উঠে বিশাল বিশাল সব জিগুরাত, ব্যাবিলনের পিরামিডের মতো প্রাচীন চোখধাঁধানো সকল প্রাচীন স্থাপনা।

জিগুরাত; Image Source: Art Station.

নাম্মু

সুমেরীয় উপকথার সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী, আদিতে ছিল শুধু এক ঘূর্ণায়মান জলধারা, যার নাম হলো নাম্মু। আমাদের চিরচেনা পৃথিবীর আকাশ, বাতাস কিংবা স্বর্গ, নরক কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না তখন। নাম্মু জন্ম দিলেন স্বর্গ ও পৃথিবীর। এই নাম্মু হলেন প্রারম্ভিক মেসোপটেমীয় ধর্মের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। সুমেরীয় পুরাণে খুব বেশি জায়গায় নাম্মুর কথা উঠে আসেনি। এনকি আর নিন্মাহের কাহিনি থেকে সর্বপ্রথম জানা যায়, সুমেরীয় এই মাতৃদেবী অন্যান্য সকল প্রধান দেবতার জন্ম দিয়েছিলেন।

পৌরাণিক কাহিনীর আরেক সংস্করণ থেকে পাওয়া যায়, দেবতা এনলিল যখন নাম্মুর কাছে মানুষ সৃষ্টির ধারণা উত্থাপন করেছিলেন, তখন নাম্মু এনলিলকে বলেন, এনকির সাহায্য নিয়ে সেই মহাকর্ম সম্পাদনা করতে। এনলিল তখন ছোট আকারে দেবতাদের প্রতিরূপে এক মূর্তি তৈরি করলেন। এই মূর্তি থেকেই মানবজাতির উত্থান। তারপর মূর্তিকে জীবন্ত করার উদ্দেশ্যে নিন্মাহসহ সাত দেবীর দ্বারস্থ হন তিনি। দেবীরা বর দেওয়ার পরেই শ্বাস নেওয়া শুরু করে মূর্তিটি। উল্লেখ্য, এখানে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছিলেন নাম্মু।

যেহেতু এরিদু শহরে তাকে অন্যতম প্রধান দেবী হিসেবে তাকে মান্য করা হতো, তাই ধারণানুযায়ী, ওই শহরেই তার মন্দির অবস্থিত ছিল। তবে, প্রাচীন ব্যাবিলনের সম্রাট লুগাল-কিসালসির শাসনামলে উর শহরে তাকে উৎসর্গ করে একটি মন্দির বানানো হয়েছিল বলে নিপ্পুর এবং ব্যাবিলনের পাঠ্যগুলোতেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় তিনি তিয়ামাত নামে পরিচিত ছিলেন।

দেবতা এনলিল; Image Source: Art Station.

আনু

আনু ছিলেন আকাশ বা স্বর্গের অধিপতি। এছাড়াও দেবকূলে তিনি ছিলেন সামগ্রিকভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীন ও গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। তবে প্রাচীন সুমেরীয় পুরাণের বিপুল শক্তির অধিকারী এই দেবতার টিকে থাকা কোনো চাক্ষুষ চিত্রের খোঁজ পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র পাওয়া যায় আনু সম্বন্ধীয় একটি শিং-যুক্ত টুপির।

তিনি ছিলেন উরুক শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা। মেসোপটেমিয়ার ধর্ম অনুসারে তার অবস্থান ছিল সকল দেবতার ঊর্ধ্বে। তাকে গ্রিক উপকথার জিউসের সাথে তুলনা করা যায়। নাম্মুর থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল দেবতা আনুর, যাকে স্বর্গের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন নাম্মুই। আর পৃথিবীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দেবী ‘কি’কে। আনু একাধারে ছিলেন দেবী ‘কি’র ভাই এবং স্বামী, উভয়ই। একসময় তাকে সমস্ত সৃষ্টির প্রকৃত পিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। 

সুমেরীয়রা স্বর্গ বলতে বুঝত আকাশকে। তাদের ধর্মবিশ্বাস মতে, এই আকাশেই বাস করতেন দেব-দেবীরা। সাতজন প্রধান দেব-দেবী নিয়ে আনুনাকি নামে একটি দল গঠন করা হয়েছিল। ওই দলের সদস্যরা হলেন আন, এনলিল, এনকি, কি, নান্না, উতু এবং ইনানা।

আনু; Image Source: Nelson Mendoza/Alamy Stock Photo.

কি

নাম্মু থেকেই জন্ম হয়েছিল ‘কি’র। তিনি ছিলেন পৃথিবীর দেবী। কি এবং আনুর গভীর প্রণয়ে জন্ম নেন দেবতা এনলিল। এই এনলিলকে বিয়ে করেই ‘কি’ পৃথিবীর সমস্ত জীব তথা প্রাণের জন্ম দেন। একসময় তিনি দেবতা এনকিরও সহধর্মিণী ছিলেন। তাদের নিনুর্তা, আশগি এবং পানিগিঙ্গারা নামে মোট তিনটি সন্তান ছিল। সুমেরীয় পৌরাণিক কাহিনীতে তার কথা উল্লেখ থাকলেও প্রাচীন নথিতে তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বর্ণিত নেই। তার উপাসনা করার জন্য আলাদা কোনো ধর্মও গড়ে ওঠেনি, এবং বলা হয় যে তিনি নিন্মা, নিনহুরসাগ এবং নিন্তু দেবীদের মতো একই সত্তা।প্রাচীন একটি সীলমোহরে তাকে একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং শিংযুক্ত শিরস্ত্রাণ পরিহিত দীর্ঘ বাহুর একজন মহিলা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল। উপকথা অনুযায়ী, তিনি মহাবিশ্বের পাশাপাশি মানবসভ্যতা সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নিপ্পুর এবং মারিতে তার মন্দিরের অস্তিত্ব মিলেছে।

দেবী কি; Image Source: Nekochan491/Deviant Art.

এনলিল

দেবতা এনলিল হলো আনু এবং কির সন্তান। তিনি ছিলেন একাধারে তিনি বায়ু, বৃষ্টি, আর ঝড়ের দেবতা। এনলিল তার মায়ের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে করে পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টি করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিনলিল দেবীকে বিয়ে করে জন্ম দেন দেবতা নিনুর্তা, চন্দ্রদেবতা নান্না এবং সূর্যদেবতা উতুরকে। নিনুর্তাকে যুদ্ধ ও কৃষি দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো। তিনি ছিলেন গিরসু শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা। ওদিকে নিনলিল ছিলেন নিপ্পুর শহরের মাতৃকা দেবী এবং তিনি এনলিলের সাথে একই মন্দিরে বাস করেন। এনলিলকে নিপ্পুর শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো। নিপ্পুরের অধিবাসীরা তাকে ‘পিতা’, ‘স্রষ্টা’, ‘প্রভু’, ‘মহা-পর্বত’, ‘বিক্ষিপ্ত ঝড়’ এবং ‘বিদেশের রাজা’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছিল। পৃথিবীতে রাজাদের রাজত্ব প্রদান করেছিলেন এই এনলিল। প্রাচীন কিছু গ্রন্থে তাকে আক্রমণাত্মক, বিরোধী দেবতা হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, অন্যান্য গ্রন্থে তাকে দয়ালু, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং পরোপকারী সত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে, যিনি সুমেরীয়দের সমূহ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তার মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের আজও বিদ্যমান।

দেবতা এনলিল; Image Source: Usama Shukir

এনকি

এনকি ছিলেন মিষ্টি জলের দেবতা। এছাড়াও তিনি পুরুষদের যৌন সক্ষমতা ও জ্ঞানের দেবতা হিসেবেও সুপরিচিত। শুরুতে বাতাস আর পৃথিবী এক হবার পর উঠে এসেছিলেন দেবতা এনকি। তার নির্দেশেই প্রবাহিত হয়েছিল টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর স্রোতধারা, জমি হয়ে উঠেছিল উর্বর। এনকি পৃথিবীতে দেবতাদের জন্য বানিয়েছিলেন এক শহর, যেটি এরিদু নামে পরিচিত। এরপর দেবতারা ভাবলেন জনশূন্য এই ধরণী মানুষের পদচারণায় মুখরিত হওয়া দরকার। ফলে দেবতা এনকি এরিদুতে প্রথম মানব হিসেবে সৃষ্টি করলেন আদাপাকে।

পৃথিবীর প্রথম মানব আদাপা; Image Source: Art Station.

তার কাজ ছিল নদী থেকে দেবতাদের জন্য মাছ ধরে নিয়ে আসা। নিত্যদিনের মতো মাছ ধরতে গেলে একবার দখিনা হাওয়া তার কাজে বিঘ্ন ঘটায়। ক্ষোভে বায়ুর ডানা ভেঙে দেন আদাপা। এর ফলে এরিদুর বাসিন্দারা বঞ্চিত হতে থাকে শীতল দখিনা হাওয়া থেকে। এ নিয়ে ‘আদাপার গল্প’ পুরাদস্তুর এক গল্প বর্ণিত আছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সৃষ্টিতত্ত্বে। আক্কাদীয় সংস্কৃতিতে এনকি পরিচিত ছিল ‘ইয়া’ নামে। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এনকির মন্দিরকে বলা হতো ‘ই-আবজু’, এবং এই এরিদু শহরের আবজুতেই ছিল ইয়া/এনকির বসবাস। এনকির প্রধান মহিষী শুরুতে দেবী কি থাকলেও পরবর্তীতে তিনি সুমেরীয় ভূ-দেবী নিনহুরসাগের কাছে চলে যান। নিনহুরসাগকে পূজা করা হতো কেশ ও আদাব শহরে। এমনকি তার তিন কন্যা দামকিনা, নিনসার এবং নিনকুরার সাথেও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। মেসোপটেমীয় পুরাণের সাহসী বীর মারদুক ছিল এনকির পুত্র।

এনকি; Image Source: Alamy Stock Photo.

ইনানা

দেবী নাম্মু শুরুর দিকে আধিপত্য বজায় রাখলেও, প্রশ্নাতীতভাবে মেসোপটেমীয় দেবীদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে সুমেরীয় দেবী ইনানা। শুধু মেসোপটেমিয়াই নয়, প্রাচীন সভ্যতার সকল দেব-দেবীর মধ্যেও তিনি ছিলেন বহুল সমাদৃত ও মর্যাদাসম্পন্ন। তিনি ছিলেন মাতৃত্ব, যৌনতা, ভালোবাসা, প্রজনন, যুদ্ধ, এবং জন্ম-মৃত্যুর দেবী। এনলিলের এই কন্যা ছিলেন সূর্যদেবতা উতু এবং পাতাল-দেবী এরেশকিগালের বোন। উরুক শহরের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ওখানের বাসিন্দারা বেছে নিয়েছিলেন ইনানাকে, ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় যিনি ইশতার নামে পরিচিত।

ইনানা; Image Source: Feedington.

অ্যাগেইড এবং নিনেভা শহরেও তার মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। মেষপালকদের দেবতা দুমুজির সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। সুমেরীয় পুরাণে ইনানাকে বর্ণনা করা হয়েছে কামাতুর, সহিংস, এবং প্রতিশোধপরায়ণা দেবী হিসেবে। প্রিয় রাজাদেরকে যুদ্ধে তিনি শুক্রগ্রহ, শুকতারা, কিংবা সন্ধ্যাতারার রূপ ধরে সাহায্য করতেন। সেজন্য তার প্রতীক তারাকে সবসময় দেখানো হয়েছে ছয় থেকে আটটি চিহ্নসমেত, যা সুমেরীয় জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত। প্রাচীন কিছু সীলমোহরে দেখা গেছে, ডানাযুক্ত পিঠে ইনানা অস্ত্র বহন করে আছেন, মাথায় শিং-যুক্ত শিরস্ত্রাণ, আর তার পা দুটো সিংহের পিঠে। এছাড়াও বলা হয়, পৃথিবীতে রাজ্য পরিচালনার জন্য তিনিই সর্বপ্রথম আইন প্রণয়ন করেছিলেন।

আক্কাদীয় সভ্যতায় দেবী ইশতারের প্রতিমূর্তি; Image Source: Wikimedia Commons.

এরেশকিগাল

সুমেরীয় পুরাণে পাতালপুরী ‘কিগাল’ বা ‘ইরকালা’ নামে পরিচিত। পাতালপুরীতে সূর্যালোক পৌঁছায় না বলে স্বাভাবিকভাবেই সেই জায়গাটা ছিল ভীষণ স্যাঁতসেঁতে এবং ঘন অন্ধকার। সুখ বা শান্তির ছিটেফোঁটাও নেই ওখানে, চারদিক শুধু ছেয়ে আছে বিষণ্নতায়। নরকতুল্য সেই পাতালপুরীর শাসিকা ছিলেন দেবী এরেশকিগাল, বাস করতেন নানা দৈত্য-দানব ও প্রেতাত্মা নিয়ে। তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন যুদ্ধ, মৃত্যু এবং রোগের দেবতা নেরগালের সাথে। বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও নিজ বোন ইনানার প্রতি তার মন ছিল অবজ্ঞা ও ঘৃণায় পরিপূর্ণ। স্বভাব-চরিত্রে তিনি অতিশয় নিষ্ঠুর হওয়ায়, তিনি উদ্ভট এক নিয়ম বানিয়েছিলেন। নিয়মটা ছিল এমন, পাতালপুরীতে কেউ একবার প্রবেশের পর সেখান থেকে ফিরে যেতে চাইলে, তাকে অবশ্যই বদলি হিসেবে কাউকে রেখে যেতে হবে।

এরেশকিগাল; Image Source: Iren Horrors.

গুলা

আরোগ্য এবং নিরাময়কারী দেবী হিসেবে সুমেরে দেবী গুলার খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী। গুলা ছাড়াও তাকে নিনিসিনা, নিন্তিনুগা, নিনকারাক নামেও ডাকা হতো। তিনি ছিলেন চিকিৎসকদের পৃষ্ঠপোষক, এবং ধারণা করা হতো তিনি চিকিৎসা সরঞ্জাম, যেমন- শল্য ছুরি চালনা, ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিলেন। তার স্বামী কে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে, কিছু অনুমান মতে, তার স্বামী হতে পারেন দেবতা নিনুর্তা কিংবা দেবতা আবু।

তার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া সন্তান দামু এবং নিনাজু; দুজনেই ছিলেন আরোগ্য নিয়াময়ের ক্ষমতাপ্রাপ্ত দেবতা। চিকিৎসা ছাড়াও গৌণ দেবতা দামু পিশাচ দমনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত, যা বিভিন্ন সুমেরীয় কবিতায় বহুবার উঠে এসেছে। চিকিৎসাক্ষেত্র ছাড়াও তিনি ছিলেন কুকুর ও অন্যান্য চারপেয়ে জন্তুর দেবী। তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছিলেন ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। গুলার প্রধান মন্দির উম্মা শহরে অবস্থিত হলেও আদাব, নিপ্পুর, লাগাশ, উরুক, উরু শহরেও তিনি ছিলেন সমাদৃত। শুরুর দিকে তার মন্দিরকে এসাবাদ এবং এগালমাহ বলে সম্বোধন করা হতো।

গুলা; Image Source: Wikimedia Commons.

নান্না

সর্বেশ্বরবাদী প্রাচীন সভ্যতা, যেমন- মিশরীয় সভ্যতা, অ্যাজটেক সভ্যতাগুলোতে প্রধান নাক্ষত্রিক দেবতার আসনে সূর্যদেবতাকে বসানো হলেও, সুমেরীয় সভ্যতার ক্ষেত্রে তা খানিকটা ভিন্ন। তাদের প্রধান নাক্ষত্রিক দেবতা ছিল চন্দ্রদেবতা নান্না, যিনি আবার সিন নামেও পরিচিত। বায়ু-দেবতা এনলিল এবং নিনলিলের সন্তান ‘নান্না‘ রাতের আকাশে আলো জ্বালতেন চাঁদের সাহায্য নিয়ে। আকাশে সকল গ্রহ-নক্ষত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য মূলত তিনিই দায়ী। দেবী নিনগালকে বিয়ে করে তিনি ইনানা এবং তার যমজ ভাই উতুর জন্ম দেন।

কথিত আছে, নান্নার ঘরে যমজ সন্তান হওয়ায় দারুণ ক্ষুব্ধ হন তার বাবা এনলিল। চন্দ্রদেবতা ছাড়াও নান্না ছিলেন গাভীর দেবতা, কারণ গাভীর শিংগুলো দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির। এনলিলের বিশ্বস্ত মন্ত্রী অগ্নি-দেবতা নুস্কু ছিলেন নান্নারই সন্তান। তিনি ছিলেন উর শহরে পৃষ্ঠপোষক দেবতা। তার প্রধান মন্দির একিশনুগাল বার বার বিভিন্ন শাসক পুনর্নির্মাণ করেছেন। তাকে উৎসর্গ করে নির্মিত আরও কিছু স্থাপত্য হলো মন্দির কুরিগালজু, এবং জিগুরাত ইলুগালগালগাসিসা। তার পূজারী হতে পারতেন শুধু রাজকুমারীরা, যাদের গিপার নামে এক কক্ষে থাকতে হতো। চিত্র থেকে দেখা যায়, নান্না ছিলেন একজন দাড়িওয়ালা পুরুষ, যিনি বসা অবস্থায় হাতে চাঁদ ধরে আছেন।

নান্না; Image Source: Galaatear.

উতু

সুমেরীয় সভ্যতায় সূর্যদেবতা উতুর উপাখ্যান সূর্যের মতোই দীপ্তিমান। আক্কাদীয় সভ্যতায় তিনি শামাশ নামে পরিচিত ছিলেন। সুমেরীয়রা বিশ্বাস করত, প্রতিদিন বিশ্বে যা কিছু হয়, তা সবই দেখতে পান দেবতা উতু। এজন্য তিনি ছিলেন ন্যায়বিচারের দেবতা। এছাড়াও পরিব্রাজকদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও বর্তানো ছিল তার কাঁধেই। দেবতা আদাদের পাশাপাশি তিনি ভবিষ্যদ্বাণীর দেবতা হিসেবেও ভূমিকা পালন করতেন। চন্দ্রদেবতা নান্না এবং নিনগালের ঘরে জন্মেছিলেন উতু।

উতু; Image Source: Wikimedia Commons.

উষাদেবী আয়ার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। সূর্যাস্তের সময় তারা প্রতিদিন এক পাহাড়ের চূড়ায় মিলিত হতেন। তার সন্তান ছিল কিত্তুম, স্বপ্ন-দেবী মামু, সিসিগ, জাকার এবং দেবতা ইশুম। উতুর দেওয়া সৌরশক্তির ফলেই পৃথিবীতে বেড়ে উঠত উদ্ভিদেরা। দেওয়ালচিত্রে দেখা গেছে, হাতে ছুরি এবং সূর্যরশ্মি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তবে অন্যান্য সুমেরীয় দেবতার মতো তাকে এত ঘটা করে পূজা করা হয়নি। তিনি ছিলেন সিপ্পার ও লারসা শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা।

This is a Bangla article about famous god and goddess of Sumerian civilization.

References:

1. The Sumerians: Their History, Culture, and Character, Samuel Noah Kramer, University of Chicago Press; Revised ed. edition (February 15, 1971).
2. Sumerian Mythology: Captivating Myths of Gods, Goddesses, and Legendary Creatures of Ancient Sumer, Matt Clayton, Independently published (July 13, 2019)

Feature Photo: Art Station.

Related Articles

Exit mobile version