মঙ্গোল সম্রাট কুবলাই খান ১২৭৪ এবং ১২৮১ সালে জাপান দখল করার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। সেই সময় চীনসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল মঙ্গোল শাসনের অধীনে চলে এসেছিল। ফলে মঙ্গোলরা ক্ষমতার চূড়ান্ত স্বাদ আস্বাদন করছিল তখন। ব্যাপারখানা এমন ছিল যে, কোনো অঞ্চলে মঙ্গোল অভিযান মানেই সেই অঞ্চল তাদের অধিকারে চলে আসা।
ঐতিহ্যবাহী সামুরাইদের কাছে এই যুদ্ধ ছিল নিজেদের সম্মান রক্ষার। অন্যদিকে কুবলাই খানের কাছে এই জয় ছিল অত্র অঞ্চলে নিজেদের নিশ্ছিদ্র আধিপত্য নিশ্চিত করা। কিন্তু বিপত্তি বাধল জাপানীদের বন্দরে তরী ভেড়াতে এসে। সামুরাইরা প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছিল নিজেদের ভূমি আর সম্মান রক্ষার্থে। হঠাৎ কোথা থেকে এক অলৌকিক ঝড় এসে মঙ্গোলদের সবগুলো জাহাজ ডুবিয়ে দিলো! মুহূর্তের ভেতর যুদ্ধের ফলাফলটাই বদলে গেলো। তাই তো সামুরাইদের আখ্যান আধুনিক জাপানের সঙ্গেও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
১২৬৬ সাল, মঙ্গোল সম্রাট কুবলাই খান চীন, কোরিয়া এবং মঙ্গোলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের অধীনে নিয়ে এসেছেন। এই অবস্থায় তার নজর গেলো সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত জাপানের দিকে। তিনি জাপানের সম্রাটের কাছে দূত মারফত একটি চিঠি প্রেরণ করলেন। যেখানে লেখা ছিল,
‘’হে ক্ষুদ্র জনপদের শাসক, আপনি আমাকে সার্বভৌম সম্রাট হিসেবে মেনে নিন!‘’
খানের দূত কোনো উত্তর ছাড়াই চীনে ফিরে গেলো। পরবর্তী ৬ বছরে খান বেশ কয়েকবার সম্রাটের কাছে বার্তা প্রেরণ করেন। প্রতিবারই তার উত্তর ছিল, ‘’মঙ্গোলরা জাপানের মাটিতেই পা রাখতে পারবে না।‘’
১২৭১ সালে কুবলাই খান সুং রাজবংশকে পরাজিত করে ইউয়ান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর তিনি ভাবলেন, জাপান সম্রাটের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাকে শিক্ষা দেওয়ার সময় এসে গেছে। তাই তার পরামর্শকদের কথা অনুযায়ী, ৬০০ জাহাজ এবং ৪০,০০০ সৈনিকের এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করলেন। অন্যদিকে, জাপানের সামুরাইদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীতে ছিল মাত্র ১০,০০০ সৈন্য।
এই অবস্থাতেই ১২৭৪ সালের শরতে কোরিয়ার মাসান বন্দর থেকে খানের নৌবহর জাপানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। প্রথম আঘাতেই তারা কোরিয়ান উপদ্বীপের কিছু অংশ এবং জাপানীদের সুসীমা ও আইকি দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। এখানকার বাসিন্দাদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে পূর্বদিকে যাত্রা করে তারা।
নভেম্বরের ১৯ তারিখে মঙ্গোল নৌবহর হাকাতা উপসাগরে পৌঁছে। এখানে এসে তারা সামুরাই টেকজাকি সুয়েনাগার বাহিনীর মুখোমুখি হয়। সুয়েনাগার হাতে লিখিত একটি পার্চমেন্ট থেকে জানা যায়, ‘’সামুরাইদের ভেতর লড়াইয়ের জন্য একটা ঐতিহ্য প্রচলিত ছিল। যার নাম ‘বুশিডো কোড।‘ এই সংকেত অনুসারে প্রতিটি গোত্র হতে একজন করে সামুরাই আলাদা হয়ে দাঁড়াতেন। তারপর তারা একে-একে নিজেদের নাম এবং গোত্রের নাম উচ্চারণ করে সত্রুর মুখোমুখি হতেন! দুঃখজনকভাবে, মঙ্গোলরা এই সংকেতের সঙ্গে পরিচিত ছিল না। ফলে যখনই একজন সামুরাই খানের বাহিনীর সামনে যেত, তারা তাকে আনন্দ সহকারে হত্যা করত! অনেকটা গুনে গুনে পিঁপড়া মারার মতো।
জাপানী সামুরাইদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মঙ্গোলরা নিজেদের তীরের ডগায় বিষ মাখিয়ে দিলো। তাছাড়া তারা এমন সব ধনুক ব্যবহার করতে শুরু করে, যেগুলো আকারে জাপানীদের ব্যবহার করা ধনুকের দ্বিগুণ। মঙ্গোল বাহিনীর মতো জাপানীরাও সত্রুর যুদ্ধকৌশল জানতো না। কিন্তু তারা শত্রুর হাতে এককভাবেই মারা পড়তে শুরু করে।
সুয়েনাগা এবং তার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সামুরাই আহত হয়েছিলেন এই অসম লড়াইয়ে। তাদের দ্রুত উপদ্বীপ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। রাতেরবেলা সেবা-শুশ্রূষারও ব্যবস্থা করা হয় প্রত্যেকের। শারীরিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হলেও তাদের মনোবল অটুট ছিল। তাই তারা নিজেদের তাঁবুতে ভোরের অপেক্ষা করতে থাকেন। সবকিছু নতুনভাবে শুরু করার দৃঢ় প্রত্যয় সবার চোখে-মুখে। সকলে ঘুমিয়ে পরার কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ প্রবল বাতাস বইতে শুরু করে। তারপর ঝুম বৃষ্টি নামে। সকাল হতে না হতে পুরো এলাকা জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে।
এদিকে খানের জাহাজের নাবিকেরা বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। আবহাওয়ার এমন আচরণের কারণে তাদের সেনাপতিরাও দ্বিধায় ভুগতে থাকে। উপায় না দেখে নিজেদের রণতরীগুলো চীনের দিকে মুখ করে দেয় তারা। সাগরের পানি আরও উত্তাল হতে শুরু করলে, জাহাজের সবাই বুঝতে পারে, বিপদ আসন্ন। পরবর্তী দুদিনের যাত্রার পর মঙ্গোলদের অর্ধেক জাহাজ অতল সাগরে তলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে তাদের ১৩,০০০ সৈনিকও চিরদিনের জন্য গায়েব হয়ে যায়। অবশেষে বেঁচে থাকা ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত মঙ্গোল বাহিনী তাদের ঘরে ফেরে।
কুবলাই খান তখন রাজধানী দাদুতে (বর্তমান বেইজিং) অবস্থান করছিলেন। এই সংবাদ পাওয়ার পর তিনি হতাশায় মুষড়ে পড়েন। মনে মনে তিনি প্রকৃতির এই নির্মমতাকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন। আর এদিকে জাপানীরা নিজেদের আকস্মিক বিজয় উদযাপন করতে শুরু করে দেয়!
ঐতিহ্যগতভাবে, যেকোনো যুদ্ধ জয়ের পর সামুরাইদের পুরষ্কার হিসেবে জমি উপহার দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই যুদ্ধে মঙ্গোলদের কাছ থেকে কিছুই লুট করতে পারেনি তারা। ফলে হাজার হাজার সামুরাইকে পুরষ্কার দেওয়া একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অল্প সংখ্যক সামুরাইকেই কেবল পুরস্কৃত করা হয়। যার কারণে সামুরাইদের মাঝে চরম অসন্তোষ প্রকাশ পায়।
এই অবস্থার মাঝেই কুবলাই খান জাপানে আবার দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু এবারও জাপানীরা কোনো জবাব দেয়নি চিঠির। তার বদলে তারা দূতের শিরশ্ছেদ করে বসে। যে ঘটনার কারণে খান আবারও জাপান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এজন্য একটি কমিশন গঠন করেন। ১২৮০ সালে গঠিত এই কমিশন খানকে পরের বসন্তে জাপান আক্রমণের পরামর্শ দেয়।
খানের দূতকে হত্যা করার পর, জাপানীরা নিজেদেরকে অনিবার্য যুদ্ধের জন্য তৈরি করতে থাকে। সামুরাইদের সংখ্যা অনুপাতে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দেওয়া হয়। হাকাতা উপসাগরের চারদিকে ৫-১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর বানাতে শুরু করে তারা।
১২৮১ এর বসন্তে জাপানীরা আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ে। এবার তারা আগের চেয়েও বেশি প্রস্তুত, আরও সুসংঘটিত। সামুরাইরা নিজেদের তলোয়ারে শান দিয়ে নিয়েছে। তারপর তাদের যুদ্ধের দেবতা হাচিমানের কাছে প্রার্থনা করেছে। যাতে তারা শত্রুদের কাছ থেকে নিজেদের ভূমি এবং ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পারে।
কুবলাই খানও এবার জাপান জয়ের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি জানতেন, আগেরবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার হাত থেকে জাপানকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেই তুলনায় জাপানী সামুরাইরা তলোয়ারের কোনো কারিশমাই দেখাতে পারেনি।
জাপানীরা এবার ৪০,০০০ সামুরাই সৈনিক জোগাড় করতে পেরেছে। যারা হাকাতা উপদ্বীপে গড়ে তোলা প্রাচীরের আড়ালে ওঁত পেতে আছে। তাদের দৃষ্টি পশ্চিমে। মঙ্গোলরা এবার নিজ বাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। একটি অংশে ছিল চীনা, কোরিয়ান এবং মঙ্গোলদের নিয়ে ৪০,০০০ সৈনিকের বাহিনী। এই বাহিনীর রণতরীর সংখ্যা ছিল ৯০০। বাহিনীটি মাসান বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। অন্য বাহিনীতে ছিল ১০০,০০০ সৈনিক এবং ৩,৫০০ রণতরী।
মঙ্গোলদের কোরিয়ান বহরটি ১২৮১ সালের ২৩ জুন হাকাতা বন্দরে পৌঁছে। অন্যদিকে চীন থেকে আসা রণতরীগুলো আড়ালেই রয়ে গেলো তখন পর্যন্ত। মঙ্গোলদের ছোট ছোট নৌবহরগুলো থেকে প্রাচীর টপকে হামলা করা অনেক কষ্টসাধ্য ছিল। তারপরও তাদের সফলতা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। অন্যদিকে জাপানী সামুরাইরা রাতের আঁধারে চুপিসারে শত্রুদের রণতরীগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিতে থাকে। এভাবে প্রায় ৫০ দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। গুপ্ত হামলার শিকার হতে হতে কোরিয়ান সৈনিকরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। চীনা বহরের প্রতীক্ষায় বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তাদের।
অবশেষে মঙ্গোলদের মূল নৌবহরটি, ১২ আগস্ট হাকাতা উপসাগরের পশ্চিমে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়। এই বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল সামুরাইদের প্রায় দ্বিগুণ। এই বাহিনী সহজেই সামুরাইদের ধরাশায়ী করে ফেলে। সামুরাইরা যখন আর পেরে উঠছিল না, তখন তারা কেবল নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু বিধাতার কী খেয়াল! সামুরাইরা যখন মঙ্গোলদের হাতে কচুকাটা হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় আবার এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। ১২৮১ সালের ১৫ আগস্ট রহস্যময় ঝড়টি আবার ফিরে আসে। যে ঝড়ের কবলে পড়ে খানের রণতরীগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে। সৈনিকদের ভয়ার্ত চিৎকার উত্তাল ঢেউয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। তীরের দিকে ফিরতে থাকা মঙ্গোল সৈনিকদের এবার সামুরাইরা গণহারে হত্যা করতে শুরু করে। ফলে একসময় যে সামুরাইরা আশা হারিয়ে নিজেদের সত্রুর হাতে সঁপে দিচ্ছিল, তারাই এখন নতুন উদ্যমে লড়াই শুরু করে দিলো।
যুদ্ধ শেষে খানের বাহিনীর কেউ নিজ ভূমে ফিরতে পারেনি। অনেকেই জাহাজে থাকা অবস্থায় ডুবে মারা গেছে। আর যারা বেঁচে গেছে, তারা তীরে আসার পর সামুরাইদের হাতে জীবন দিয়েছে।
জাপানীদের কাছে এই বিজয় তাদের দেবতার পক্ষ হতে এক অসামান্য উপহার। যা প্রমাণ করে, সামুরাইদের ঐতিহ্য চিরস্থায়ী। অন্যদিকে কুবলাই খানও বিশ্বাস করতে শুরু করেন, জাপানীদের ওপর ঐশ্বরিক প্রভাব রয়েছে! যার বলে তারা বারবার সেখানে গিয়ে অপমানজনক পরাজয়ের শিকার হচ্ছে। ফলে তিনি আর সেখানে আক্রমণ করার সাহস করেননি।
সামুরাইদের ঐতিহ্যবাহী প্রভাব এখনো জাপানের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে রয়েছে। তাই যেকোনো যুদ্ধ কিংবা বিপদের সময়, তারা তাদের অতীতকে স্মরণ করে। এভাবেই জাপানীরা নিজেদের সমস্যা মোকাবেলার অন্তর্নিহিত শক্তি লাভ করে। মঙ্গোল বধের দীর্ঘ সময় পরেও, বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের নতুন প্রজন্মের কাছে বীরত্ব আর অলৌকিকতার গল্প শুনিয়েছেন। যা তাদের সাহিত্যের অংশ হয়ে গিয়েছে।