বিল গেটস বনাম স্টিভ জবস: দুই মহারথীর দ্বৈরথ

ক্রোধে উন্মত্ত স্টিভ জবস চিৎকার করে উঠলেন, “এক্ষুণি গেটসকে ডেকে নিয়ে এসো” অ্যাপলের কর্মকর্তা মাইক ভয়েস ছুটলেন বিল গেটসের খোঁজে। গেটস আসলেন জবসের কনফারেন্স রুমে। বিল গেটস একা, এদিকে জবসকে ঘিরে অ্যাপলের আরো জনাদশেক কর্মকর্তা। তারা দাঁড়িয়ে আছেন মজা দেখার জন্য। স্টিভ জবস কীভাবে বিল গেটসকে হেনস্থা করেন সেই দৃশ্য দেখার থেকে বঞ্চিত হতে চাইছিলেন না কেউ। বিল গেটস নিজেও জানতেন, জবস এ সময় রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে আছেন।

জবস হতাশ করেন নি। গেটসকে দেখেই তিনি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “তুমি আমাদের সাথে প্রতারণা করেছো। তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম। আর তুমি এখন আমার ঘরেই চুরি করছো!” বিল গেটস বিচলিত হননি। শীতল চাহনিতে জবসের চোখে চোখ রেখে তিনি যে জবাবটি দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। গেটসের জবাবটি কী ছিল সে কথায় পরে আসছি। তার আগে এই দুই মহারথীর বৈরিতার প্রেক্ষাপটটা একটু জেনে নেয়া যাক।

বিল গেটসস্টিভ জবস দুজনই প্রযুক্তি জগতের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব। পার্সোনাল কম্পিউটারের আজকের অবস্থানের জন্য দুজনের ভূমিকাই অসামান্য। মাইক্রোসফটের মাধ্যমে বিল গেটস সফটওয়্যারের জগতে বিপ্লব এনেছেন। অন্যদিকে অসাধারণ সব আইডিয়া ও ভিশনের বাস্তবায়ন করে এ যাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে স্টিভ জবস ও তার প্রতিষ্ঠান অ্যাপল।

স্বপ্নের ম্যাকিনটশ কম্পিউটারের সাথে স্টিভ জবস; Image source: theverge.com

জবস ও গেটসের মধ্যে প্রথমদিকে একপ্রকার বন্ধুভাবই ছিলো বলা যায়। ‘অ্যাপল-২’ কম্পিউটারের জন্য সফটওয়্যার সম্পর্কিত কিছু কাজ করে দিয়েছিল মাইক্রোসফট। এ কাজের তদারকির জন্যে নিয়মিতই অ্যাপলের হেডকোয়ার্টারে যাতায়াত ছিল গেটসের। জবসের সাথে তার আলাপ হতো। কথা হতো প্রযুক্তি নিয়ে, তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে। এরপর জবস যখন তার স্বপ্নের ম্যাকিনটশ কম্পিউটারের প্রজেক্ট হাতে নেন, তখন তিনি আবার গেটসের দ্বারস্থ হন।

জবস ম্যাকিনটশ কম্পিউটারের মাধ্যমে এক নতুন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বা শখের প্রযুক্তিবিদদের কুঠুরি থেকে কম্পিউটারকে তিনি সাধারণ মানুষের টেবিলে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। আর এটি বাস্তবায়নের জন্য তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI)। গ্রাফিক্যাল  ইউজার ইন্টারফেসে আদি যুগের মতো কী-বোর্ডে টাইপ করে করে কমান্ড দিতে হতো না। স্রেফ মাউসের ক্লিকের মাধ্যমেই ইউজার নির্দেশ দিতে পারতো কম্পিউটারকে।

এই ইন্টারফেস ব্যবহার করে ম্যাকিনটশে ডেস্কটপ মেটাফোরের ধারণা নিয়ে আসা হয়। কম্পিউটার হয়ে উঠে ডেস্কের মতো যেখানে স্রেফ আঙ্গুলের ইশারায় আপনি কোনো ফোল্ডারে ডুকতে পারছেন, গান শোনা, ভিডিও দেখা বা যে কোনো কাজ করতে পারছেন। এককথায় কম্পিউটারের সাথে খুব সহজেই যোগাযোগ করতে পারছেন। আগের ইন্টারফেসে ছোট কাজ করতে হলেও একের পর এক মুখস্থ করা কমান্ড টাইপ করার ঝামেলা পোহাতে হতো।

কমান্ড লাইন ইন্টারফেস; Image source: wikipedia

ম্যাকিনটশের জন্য ওয়ার্ড, এক্সেল এর মতো কিছু সফটওয়্যারের গ্র্যাফিকাল ভার্সন ও বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের একটি ভার্সন তৈরি করার জন্য গেটস চুক্তিবদ্ধ হন। গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেসই যে কম্পিউটার প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ তা জবস এবং গেটস দুজনেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আর ব্যবহারকারীদের জন্য এটি এতোটা আকর্ষণীয় করে অ্যাপলই সর্বপ্রথম বাজারে ছাড়তে যাচ্ছিলো।

তবে এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেসের আইডিয়াটা জবসের নিজস্ব আইডিয়া ছিল না। জেরক্স কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা এর উদ্ভাবন করেন। এটি সম্পর্কে শুনে জবস এর বিস্তারিত জানতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। এদিকে জেরক্স কর্পোরেশন অ্যাপলে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল। জবস তখন শর্ত দেন, জেরক্স তাদের নতুন উদ্ভাবনগুলোর বিস্তারিত দেখালে তবেই তারা অ্যাপলে এক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সুযোগ পাবে।

জেরক্সের গবেষকরা এতে অসন্তুষ্ট হলেও হেডকোয়ার্টারের চাপে তারা তাদের রহস্য উন্মোচন করতে বাধ্য হয়। জবস ও তার দল জেরক্সের গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেসের খুঁটিনাটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। সেখান থেকে ফেরার পথেই, জবস অ্যাপলের প্রোগ্রামার বিল এটকিন্সনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এটি করতে আমাদের কতদিন লাগতে পারে?” এভাবেই জেরক্সের আইডিয়া থেকে আসে অ্যাপলের ইউজার ইন্টারফেস। অবশ্য অ্যাপল এটিকে আরো উন্নত করেছিল।

স্টিভ জবস ও বিল গেটস, ১৯৮৪; Image source: nydailynews.com

যা হোক, জবস ও গেটসের কাহিনীতে ফিরে যাই। তার আগে এ সময়কালটা একটু স্মরণে রাখা দরকার। এটি ছিল আশির দশকের শুরুর দিকে। মাইক্রোসফটের বিখ্যাত উইন্ডোজ তখনো বাজারে আসেনি। বিল গেটস তখনো বিল গেটস হয়ে ওঠেননি। বিভিন্ন কোম্পানির কম্পিউটারের জন্য সফটওয়্যার তৈরিই ছিল মাইক্রোসফটের প্রধান আয়ের উৎস। এমন একটি চুক্তি অনুসারেই মাইক্রোসফটের কর্মীরা ম্যাকিনটশের জন্য কাজ শুরু করে। একটা সময় এমনও হয়েছে যে, দেখা গেছে ম্যাকিনটশের টিমে অ্যাপলের চেয়ে মাইক্রোসফটের লোকবল বেশী।

এই কাজের সময় জবস আর গেটসের মধ্যে কিছুটা রেষারেষির সৃষ্টি হয়। মানুষ হিসেবে স্টিভ ছিলেন রগচটা ও উগ্র প্রকৃতির। কর্মীদের গাধার মতো খাটিয়ে নিতেন। আর কাজের বিষয়ে ছিলেন ভীষণ খুঁতখুঁতে। কোনো কাজকে জবসের পছন্দসই করে তুলতে গিয়ে কর্মীদের অবস্থা খারাপ হয়ে যেতো। আর একটু ত্রুটি বিচ্যুতি হলেই যাচ্ছে তাই ব্যবহার করতেন। গেটসকে তো একবার বলে বসেছিলেন, “আসলে তোমাদের আমার কোনো দরকার নেই। আমরাই একটি অসাধারণ কম্পিউটার তৈরি করতে সক্ষম।” এছাড়া প্রায়ই বলতেন, “মাইক্রোসফটের তৈরি করা এপ্লিকেশনগুলো বিচ্ছিরি রকমের”। এ ধরনের মনোভাবের কারণে গেটসের সাথে তার মনোমালিন্য হতে শুরু করে।

ম্যাকিন্টশের কাজ ছাড়াও মাইক্রোসফট তখন ডস (DOS) নামে একটি অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করেছিলো। এতে আগের সেই কমান্ড লাইন ইন্টারফেস ব্যবহার করা হয়েছিলো। আইবিএম সহ কয়েকটি কোম্পানি এটি ব্যবহার করে। মাইক্রোসফট ম্যাকিন্টশের জন্য কাজ শুরু করে গ্র্যাফিকাল ইউজার ইন্টারফেসের খুঁটিনাটি বিষয়ে ভালোই ধারণা পেয়ে যায়। অ্যাপলের কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন মাইক্রোসফট এই ইন্টারফেসের অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা শুরু করতে পারে।

পল অ্যালান ও বিল গেটস, মাইক্রোসফটের দুই কর্ণধার; Image source: mac-history.net

গ্র্যাফিক্যাল ইন্টারফেসই ছিল ম্যাকিনটশের অনন্য হওয়ার মূল কারণ। তাই স্টিভ জবস উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তবে তিনি গেটসকে মানিয়ে নিতে সমর্থ হন। গেটস রাজি হন যে, ম্যাকিনটশ বাজারে আসার আগ পর্যন্ত মাইক্রোসফট গ্র্যাফিকাল ইন্টারফেসের কোনো অপারেটিং সিস্টেম বাজারে আনবে না। তখন ম্যাকিনটশের বাজারে আসার তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু গেটসের সৌভাগ্য কিংবা জবসের দুর্ভাগ্যই বলা যায়, ম্যাকিনটশের রিলিজের তারিখ এক বছর পিছিয়ে যায়।

আর চুক্তির নিয়ম মেনেই ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে মাইক্রোসফট তাদের বিখ্যাত উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম বাজারে ছাড়ে। আইবিএম সহ অন্য কোম্পানিগুলো তখন এটি লুফে নিতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে। বেশ আড়ম্বরের সাথে ‘উইন্ডোজ’ রিলিজের ঘোষণা দেয়া হয়। আর এসব দেখেশুনেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেন স্টিভ জবস। বিল গেটসকে ডেকে চোর বলে গালাগাল দিতে শুরু করেন, যে ঘটনা প্রথমে বলা হয়েছে।

তবে বিল গেটস, জবসের মতো রগচটা স্বভাবের ছিলেন না। তিনি ঠান্ডা মাথায় জবসকে বলেন, “স্টিভ দেখো, এই পুরো ঘটনাটাকে একটু ভিন্নভাবেও দেখা যায়। যেমন ধরো, আমাদের দুজনেরই জেরক্স নামে একজন ধনী প্রতিবেশী ছিল। আমি তার বাসায় হানা দিয়েছিলাম তার টেলিভিশন চুরি করার জন্য। কিন্তু গিয়ে দেখি তুমি আগেই সেই টেলিভিশনটি চুরি করে বসে আছো।” এতে জবসের মোক্ষম জায়গায় আঘাত লাগে। এরপর তিনি অনেক চেষ্টা চরিত করেও গেটসকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেন নি।

একটি আইবিএম কম্পিউটারের সাথে বিল গেটস; Image source: iriba24.com

শেষে আর না পেরে জবস বলেছিলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আমাদের হুবুহু কপি করো না।” তাছাড়া জবস বুঝেছিলেন, মাইক্রোসফটের সিস্টেমটি তাদের মতো অতোটা সুন্দর নয়। ওদের এটি সম্পূর্ণ করতে আরো অনেক দেরী হবে। ততদিনে ম্যাকিন্টশ মার্কেট ধরে ফেলবে। কিন্তু এ দৌড়ে শেষ পর্যন্ত মাইক্রোসফটই এগিয়ে যায়। তাদের অপারেটিং সিস্টেমটি সিরিজ হিসেবে হওয়াটা তাদেরকে সুবিধা করে দেয়।

জবস এটি কখনোই ভুলতে পারেননি। সুযোগ পেলেই তিনি বিল গেটস ও মাইক্রোসফটকে এ নিয়ে খোঁচা দিয়েছেন। অন্যদিকে গেটসের চিন্তা ছিল ভিন্ন রকম। তিনি ভাবতেন, অ্যাপল হয়তো এটিকে উন্নত করেছে। কিন্তু মূল আইডিয়াটিও তাদের না। তাছাড়া ভবিষ্যৎ কম্পিউটার প্রযুক্তির খোলনলচে বদলে দেয়া এ সিস্টেমের ওপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যেরও কোনো মানে হয় না।

সবশেষে আমরা বলতে পারি, মূল আইডিয়াটা যাদেরই হোক, এই দুই মহারথীর ‘মহান চুরির’ ফলে আদতে পৃথিবীই লাভবান হয়েছে। জেরক্স তাদের এ অসামান্য আইডিয়াকে এতটা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারেনি, যেটা জবস ও বিল গেটস পেরেছিলেন।

This article is in Bangla. It's about the fight between steve jobs and bill gates.

References:

স্টিভ জবস, ওয়াল্টার আইজ্যাকসন; অনুবাদ: মহিউল ইসলাম মিঠু, চারদিক প্রকাশনী, ২০১৪ (পৃষ্ঠা:১৪৫-১৪৬)

For more references check hyperlinks inside the article.

Featured Image: hdwallpapers.in

Related Articles

Exit mobile version