অলিম্পিক গেমসের কথা প্রায় সকলেই জানে। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ সালের গ্রীষ্মে পশ্চিম গ্রিসের অলিম্পিয়ায় আয়োজিত হয়েছিল অলিম্পিক গেমস। অলিম্পিয়া ছিল এমন একটি জায়গা যেখানে মানুষ যেত তাদের দেবতাদের উপাসনা করতে। বস্তুতঃ অলিম্পিক গেমসের সৃষ্টিও হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে বিখ্যাত, সকল দেবতার রাজা, জিউসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে। ক্রীড়াবিদরা জিউসের কাছে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করত, এবং সফল হলে ধন্যবাদস্বরূপ জিউসের জন্য উপহারসামগ্রী রেখে যেত।
জিউসের উপাসনা ছিল খুব কম সংখ্যক ব্যাপারে মধ্যে একটি, যাতে প্রাচীন গ্রিসের সকলে ঐক্যমত পোষণ করত। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্র কিংবা বসতিতে বিভক্ত গ্রিকরা প্রায় সবসময়ই পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। কিন্তু এমনকি সবচেয়ে অস্থির পরিস্থিতিতেও, বিবদমান নগর-রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিত, যেন তাদের ক্রীড়াবিদরা অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে পারে। তবে তখনকার দিনে আজকের মতো নারী-পুরুষ উভয়ই অংশ নিতে পারত না। অলিম্পিক গেমসে শামিল হতো কেবল পুরুষরা, তাও আবার নগ্ন হয়ে।
তখনকার অনেক ইভেন্ট, যেমন দৌড় কিংবা কুস্তি, আধুনিক গেমসেরও অংশ। তবে কিছু কিছু ইভেন্ট আজ কেবলই ইতিহাস। যেমনটি বলা যায় রথ প্রতিযোগিতার ব্যাপারে। ঠিক সেরকম আরো একটি ইভেন্টও অনেকদিন আগেই বিস্মৃত হয়ে গেছে। সেটি হলো প্যানক্রেশন, যা একসময় বিবেচিত হতো যুদ্ধ-ক্রীড়ার শেষ কথা হিসেবে। কারণ এ খেলায় ছিল না কোনো ওজন শ্রেণি, ছিল না কোনো সময়সীমা, এবং নিয়মও ছিল হাতে গোনা কয়েকটি: প্রতিপক্ষকে কামড়ানো যাবে না, চোখ উপড়ে নেওয়া যাবে না, পুরুষাঙ্গে আঘাত করা যাবে না।
এই খেলা কেবল তখনই শেষ হতো, যখন দুজন প্রতিযোগীর মধ্যে একজন আত্মসমর্পণ করত, কিংবা আরো ভয়াবহ, মৃত্যুবরণ করত। সুতরাং এখন নিশ্চয়ই আর বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, কেন আধুনিক অলিম্পিক গেমস থেকে বিলুপ্তি ঘটল এ খেলার।
প্যানক্রেশন (Pankration) শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ pan (সব) এবং kratos (শক্তি) থেকে। তাহলে খেলাটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘সর্বশক্তি’। অর্থাৎ, সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে খেলাটিতে জয়লাভের জন্য, এবং এ খেলায় জয়লাভ করলেই নিজেকে দাবি করা যাবে সর্বশক্তিমান হিসেবে।
প্যানক্রেশন খেলাটি অলিম্পিকে প্রথম যুক্ত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৬৪৮ সালে, এর ৩৩তম সংস্করণে। এবং তাৎক্ষণিকভাবেই এটি জিতে নেয় দর্শকদের মন। কেননা এটি ছিল ইতঃপূর্বে তাদের দেখা যেকোনো লড়াইয়ের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর।
প্যানক্রেশন ছিল মূলত দুই ধরনের- আনো প্যানক্রেশন (যেখানে লড়াই চালাতে হবে দাঁড়িয়ে, অনেকটা কিকবক্সিংয়ের মতো), এবং কাটো প্যানক্রেশন (যেখানে লড়াই করতে করতে মাটিতে বসে বা শুয়ে পড়াও যাবে)।
তবে বক্সিং ও রেসলিংয়ের সমন্বয়ে গঠিত প্যানক্রেশন খেলাটি ক্রমশই আরো বেশি ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের গুরুতর আহত হবার পাশাপাশি অনেকের মৃত্যুও হচ্ছিল, কেননা তারা আত্মসমর্পণ করতে রাজি ছিল না। এদিকে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলো ক্রমশ বাস্তববাদী ও সভ্য হয়ে উঠছিল। তাই ধীরে ধীরে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের প্যানক্রেশনের জায়গা দখল করে নিচ্ছিল কমবয়সী তরুণদের প্যানক্রেশন, যেটি ছিল অপেক্ষাকৃত কম ভয়ঙ্কর। প্যানক্রেশনের এই সংস্করণটি আনুষ্ঠানিকভাবে অলিম্পিকসে প্রবেশ করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে।
এদিকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের পরও আদি প্যানক্রেশন খেলা অব্যাহত ছিল বটে, কিন্তু এরিনার মাঝে খেলা চলাকালীন যেন আর কোনো খেলোয়াড়ের মৃত্যু না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে খেলার নিয়মে এসেছিল বড় ধরনের রদবদল। নতুন নিয়ম অনুযায়ী বিচারকদের দেয়া হয়েছিল জরুরি অবস্থায় খেলা থামিয়ে দেবার অধিকার। তাছাড়া রেফারিরাও ইস্পাতের মোটা ঢাল, ছড়া বা সুইচ নিয়ে এরিনার মাঝে প্রবেশ করত, যেন প্রয়োজনে তারা খেলোয়াড়দেরকে অবদমিত করতে পারেন ভয়াবহ কিছু করা থেকে।
খেলা ততক্ষণ পর্যন্ত চলত, যতক্ষণ না একজন প্রতিযোগী পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, কিংবা নিজেই তর্জনী উঁচিয়ে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জানিয়ে রাখা ভালো, অলিম্পিক গেমসই কিন্তু প্যানক্রেশনের একমাত্র ক্ষেত্র ছিল না। খেলাটি এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, গেমসের বাইরেও প্রায় প্রতিটি নগর-রাষ্ট্রেই প্যানক্রেশনের আলাদা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো, এবং সকল প্রতিযোগিতাই শুরু হতো দেবতাদের উদ্দেশে বিশেষ প্রার্থনা বা উৎসর্গের মাধ্যমে।
অলিম্পিক গেমসে ৩৩তম আসর থেকে নাম লেখালেও, গবেষকদের দাবি মার্শাল আর্টের এই ঘরানাটির বয়স আরো অনেক বেশি। এমনকি এর সাথে পৌরাণিক যোগাযোগও রয়েছে। প্যানক্রেশনের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হেরাকল ও থিসিউসের কাহিনীতে, যারা কিংবদন্তী অনুযায়ী প্যানক্রেশনের কৌশল কাজে লাগিয়েছিল যথাক্রমে নিমিয়ান সিংহ ও মাইনোটরের বিরুদ্ধে।
আরো চমকপ্রদ বিষয় হলো, আন্দ্রেয়াস জিয়োর্জু তার “Pankration–An Olympic Combat Sport” বইয়ে প্যানক্রেশনের অস্তিত্ব দেখিয়েছেন খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দেও, যা এটিকে পরিণত করে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম মার্শাল আর্টগুলোর একটিতে।
এছাড়া তার মতে এটি নিছক কোনো খেলাই ছিল না, এটি ছিল একটি সমরকৌশলও। এই সমরকৌশলটি যুদ্ধের ময়দানে প্রয়োগ করতো স্পার্টান হপটাইল এবং আলেকজান্ডার দি গ্রেটের মেসিডোনিয়ান ফাল্যাংক্সরা। বিশেষত আলেকজান্ডার দি গ্রেট এবং প্যানক্রেটিয়াস্ট ডিওক্সিপাসের আখ্যান তো আজো জগদ্বিখ্যাত।
ডিওক্সিপাস ছিলেন এথেন্স থেকে আসা প্যানক্রেশনের একজন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। তিনি এশিয়া অভিযানের জন্য আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। আলেকজান্ডার বরাবরই ছিলেন যুদ্ধ-ক্রীড়ার একজন পাঁড় ভক্ত। তাই তিনি ডিওক্সিপাসের অনুরোধ রেখেছিলেন। তাকে জায়গা দিয়েছিলেন নিজের ঘনিষ্ঠ মহলের একজন অভিজাত সদস্য হিসেবে।
তবে ডিওক্সিপাসের এই অন্তর্ভুক্তিতে নাখোশ ছিলেন অনেকেই। তাদের মধ্যে একজন কোরাগাস। তিনি ছিলেন খুবই বিখ্যাত একজন যোদ্ধা। ঢাল-তলোয়ার নিয়ে তৈরি হয়ে তিনি এসেছিলেন ডিওক্সিপাসের বিরুদ্ধে লড়বেন বলে। এদিকে ডিওক্সিপাসের হাতে একটি লাঠি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবু তিনি কোরাগাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সম্মত হয়েছিলেন, এমনকি তাকে হারিয়েও দিয়েছিলেন। অবশ্য ডিওক্সিপাস শেষ পর্যন্ত প্রাণে মারেননি কোরাগাসকে।
একপর্যায়ে রোমানরাও প্যানক্রেশনে মজেছিলে, এবং তারা লাতিন ভাষায় এর নাম দিয়েছিল প্যানক্রেশিয়াম (pancratium)। কিন্তু ৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে এই প্রাচীন মার্শাল আর্টসহ গ্ল্যাডিয়েটরদের সকল যুদ্ধ, এবং প্যাগান উৎসবগুলোকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন খ্রিস্টান বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস। পরবর্তী শতকগুলোতে পৃথিবীর বুক থেকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে শুরু করে প্যানক্রেশন।
তবে ১৯৬৯ সালে জিম আরভানাইটিস নামের এক গ্রিক-আমেরিকান মার্শাল আর্টিস্টের হাত ধরে পুনরাবিষ্কৃত হয় প্যানক্রেশন। আরভানাইটিসের মাধ্যমে মধ্য সত্তরের দশকে বিশ্বব্যাপী আবারো জনপ্রিয়তা লাভ করে এটি। তবে তার যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সকল ইতিহাসবিদ একবাক্যে স্বীকার করে নেন যে প্যানক্রেশনের বর্তমান রূপের সাথে প্রাচীন যুগের স্পার্টান, এথেনিয়ান কিংবা মেসিডোনিয়ানদের সেই বর্বর, রক্তক্ষয়ী মার্শাল আর্ট প্যানক্রেশনের খুব কম মিলই রয়েছে।
তারপরও, আরভানাইটিসকে একেবারে ব্যর্থ বলা যাবে না। কেননা প্যানক্রেশন আজ বিবেচিত হয় বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় মিক্সড মার্শাল আর্টের আদিরূপ হিসেবে। আর আরভানাইটিসকে মনে করা হয় মিক্সড মার্শাল আর্টের অন্যতম পথিকৃৎ। এছাড়া প্যানক্রেশনের সাথে মিল রেখে জাপানি একটি মিক্সড মার্শাল আর্ট সংগঠনের নামও রাখা হয়েছে প্যানক্রেজ।
পুনশ্চ: স্পার্টানরা অলিম্পিক গেমসে প্যানক্রেশনে অংশ নিত না। কেননা গেমসে চোখ উপড়ানো, কামড়ানো বা জননাঙ্গে আঘাত হানা বিষয়ক যেসব নিয়ম ছিল, সেগুলোর পক্ষপাতী ছিল না তারা। বরং তারা মনে করত, এসব নিয়ম মেনে খেলতে অভ্যস্ততার এক পর্যায়ে তারা যুদ্ধের ময়দানেও প্রতিপক্ষকে প্রশ্রয় বা ছাড় দিতে আরম্ভ করবে। এ থেকে আরো প্রমাণিত হয়, স্পার্টানরা এমনকি ক্রীড়াক্ষেত্রেও নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা করত না।