চার্চের টাওয়ারের চুড়ায় উঠেই ৩৩ বছর বয়স্ক স্যামুয়েল পেপিস আগুনের যে ভয়াবহ লেলিহান শিখা দেখতে পেলেন সেদিন, সেটা কোনোদিন ভুলতে পারেননি তিনি! দিনটা ছিল ১৬৬৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। আর, শহরটা যেনতেন শহর না, খোদ লন্ডন। তাঁর উক্তি ছিল, “আশপাশে যেদিকেই তাকাই আগুন আর আগুন, ধ্বংসের এরকম বিরূপতা আমি কোনোদিন দেখিনি আগে! সব পুড়ে যাচ্ছিল।” কী হয়েছিল সেদিন যার ফলশ্রুতিতে ধ্বংস হয়ে যায় লন্ডনের ৮৮% মানুষের ঘর?
ঘটনার শুরুটা হয়েছিল ১৬৬৬ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ, রবিবার। আগুনের সূত্রপাত থমাস ফ্যারিনার নামের এক লোকের বেকারি থেকে, বেকারিটা বিখ্যাত লন্ডন ব্রিজের কাছেই, পুডিং লেনে, কিংবা মতান্তরে ফিশ ইয়ার্ডে। আগুন লাগবার পরপরই ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা লন্ডন শহর জুড়ে! তখন তো আর আজকের মতো আধুনিক দমকলকর্মী ছিল না, তখন যে উপায়ে আগুন থামানো হতো সেটা হলো আগুনের পথে কোনো কিছুকে ধ্বংস করে দেয়া। তবে লন্ডনের তৎকালীন মেয়র স্যার থমাস ব্লাডওয়ার্থের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে আগুন আরো ছড়িয়ে যায়, সিদ্ধান্ত না বলে বরং সিদ্ধান্তের অভাব বলা উচিত, কারণ তিনি আগুন থামাবার চেষ্টার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করছিলেন। রবিবার গড়িয়ে সোমবার হতেই লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে চলে আসে অগ্নিঝড়।
লোকে অবশ্য এটাকে দুর্ঘটনা ভাবেনি। গুজব রটে যায় যে, বিদেশী শত্রুরা এসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে। বিদেশী বলতে ফ্রেঞ্চ আর ডাচদের প্রতি ধেয়ে যায় সন্দেহের তীর, তখন ডাচদের সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ চলছিল। ফলে যা হবার তা-ই হলো, সে দেশের অভিবাসীরা লন্ডনের পথে পথে হানাহানির শিকার হতে লাগলো।
সোমবার গড়িয়ে যখন মঙ্গলবার শুরু হলো তখন ইতোমধ্যে ‘প্রায়’ পুরো শহর ছেয়ে ফেলেছে আগুন। ধ্বংস হয়ে গেছে বিখ্যাত সেন্ট পল ক্যাথেড্রাল। রিভার ফ্লিটের পানির কাছে এসে আগুন আর পেরিয়ে ওপারে হোয়াইট হলে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের দরবারে পৌঁছাতে পারেনি। ততক্ষণে আগুন থামাবার জন্য যা যা করা সম্ভব করে ফেলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুটো কারণে আগুনের গতি থামানো যায়। প্রথমত, পূর্ব দিকে যাওয়া বাতাস থেমে যায়, আর দ্বিতীয়ত, লন্ডন টাওয়ারের গ্যারিসনে মজুদ সকল গোলাবারুদ ব্যবহার করে আগুনের সামনের পথ ধ্বংস করা হয়।
এই আগুন গ্রেট ফায়ার অফ লন্ডন বা লন্ডনের মহা অগ্নিকাণ্ড নামে পরিচিত। আগুনে ধ্বংস লন্ডনের অবস্থা ভাষায় বর্ণনা করবার মতো ছিল না। রাজা দ্বিতীয় চার্লস তো রীতিমত দাঙ্গা বিদ্রোহের ভয় করছিলেন এ ঘটনার পর। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আগুনের আগে লন্ডনের রাস্তাঘাটের মানচিত্র যেমন ছিল, প্রায় অবিকল সেভাবেই আবার লন্ডনকে পুনরায় গড়ে তোলা হয়।
এমন না যে সেই কাঠে গড়া লন্ডনে আগে কখনো আগুনে ক্ষতি হয়নি। ১৬৬৬ সালের আগে সবচেয়ে বড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল ১৬৩২ সালে। এরপর থেকে কাঠ ব্যবহার করতে মানা করা হয়েছিল, কিন্তু কে শোনে কার কথা, সস্তা জিনিসের ব্যবহার চলতেই থাকে। শুধুমাত্র শহরের মাঝের অংশ জুড়ে ধনী এলাকাতেই পাথরের ব্যবহার ছিল। তখনকার সময় লন্ডনে ছয় থেকে সাত তলা বাড়ি দেখা যেত।
থেমস নদীর তীরের এলাকাগুলোতে না হয় আগুন লাগলে নদী পথে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা ছিল, ওখানে নদীর পানি ব্যবহার করে আগুন নেভাবার উপায়ও ছিল। কিন্তু নদী থেকে দূরে শহরের মাঝের এলাকাগুলোতে আগুন মানে ছিল আরো ভয়ংকর ব্যাপার!
তখন আগুন লাগত খোলা ফায়ারপ্লেস থেকে, কিংবা মোমবাতি, ওভেন বা দাহ্য পদার্থের দোকান থেকে। আগুন লাগলে ছিল না কোনো পুলিশ বা দমকলকর্মী। তখন ডাকা হতো লন্ডনের স্থানীয় মিলিশিয়াকে, তারা পরিচিত ছিল ‘Trained Bands’ নামে। শুধু আগুন না, যেকোনো প্রয়োজনেই ডাকা হতো তাদের, অনেকটা আজকের 911 কিংবা 999 কলের মতোই। তাদের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল কোথাও আগুন লাগল কিনা দেখা। এরকম প্রায় হাজারখানেক ‘ওয়াচম্যান’ বা ‘বেলম্যান’ ঘুরে বেড়াত রাতের লন্ডনের রাস্তায়। আর স্থানীয় বাসিন্দাদের অবদান তো থাকতই আগুন নেভাতে। আগুন লাগলে গির্জার ঘণ্টা বাজিয়ে সতর্ক করা হতো সকলকে। সকলে জমায়েত হলে শুরু হতো জোর দমে আগুন নেভানোর কাজ। চার্চে লম্বা মই, বালতি, কুড়াল ইত্যাদি মজুদ রাখার আইন ছিল। আগুন লাগলেই এগুলো বের করে আনা হতো, আবার আগুন নেভার পর জায়গা মতো রেখে আসা হত। অনেক সময়ই বারুদ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিশাল দালান ধ্বসিয়ে দেয়া হতো যেন আগুন আর এগুতে না পারে।
লন্ডন ব্রিজ তখন ছিল শহরের সাথে থেমস নদীর দক্ষিণে যাবার একমাত্র রাস্তা। পুরো ব্রিজ জুড়ে ছিল বাড়ি আর বাড়ি, মোটেও দেখতে আজকের মতো ছিল না। ১৬৩২ সালের ভয়াবহ আগুনে এটা মরণফাঁদ ছিল। সে বছরের আগুনে সবগুলো ঘর আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়।
১৬৬৬ সালের মহা অগ্নিকাণ্ডের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলেছিল প্রায় কয়েক মাস। আগুনের কারণে দালানগুলো কংকালের মতো হয়ে গিয়েছিল। লন্ডনকে নতুন করে গড়ে তুলবার জন্য এসব ভবন একদম গুঁড়িয়ে দিতে হয়েছিল মাটির সাথে। এরকম অরাজকতার মাঝে অপরিচিত লন্ডনের রাস্তায় কিছু ‘মহানুভবের’ উদয় ঘটে, তারা পথ হারিয়ে ফেলা মানুষদের পথের সন্ধান দিয়ে নিয়ে যেত। এরপর কোনো নীরব গলিতে ঢুকিয়ে সর্বস্ব নিঃস্ব করে পালিয়ে যেত।
যেহেতু তখন ডাচদের সাথে যুদ্ধ চলছিল, তাই সহজাতভাবেই ধরে নেয়া হয় এই অগ্নিকাণ্ড বুঝি তাদেরই কাজ। লন্ডনের স্যার রবার্ট হোমসের নেতৃত্বে আক্রমণ করা হয় অভিবাসী ডাচদের। ধ্বংস করা হয় ১৫০টি ডাচ বাণিজ্য জাহাজ! ডাচদের West-Terschelling শহরটা পুড়িয়ে দেয়া হয়। ডাচদের আক্রমণ করা হচ্ছে জেনে লন্ডনে হর্ষধ্বনি বয়ে যায়, চার্চের ঘণ্টা বাজানো হয়। সে সময়ে ডাচদের দেশে ইংলিশ গুপ্তচর হিসেবে থাকা মেয়ে আফ্রা বেন জানান যে, এ সংবাদ অ্যামস্টারডামে পৌঁছাবার পর দাঙ্গা লেগে গিয়েছিল।
এই মহা অগ্নিকাণ্ডে যত ক্ষয়ক্ষতিই হোক না কেন, মানুষ মারা যায় খুবই কম। এডওয়ার্ড চেম্বারলেইন বলেছিলেন, “ছয় কি আটজনের বেশি মানুষ মারা যায়নি।” যথেষ্ট সতর্কবাণী পাবার কারণে মানুষ সরে যেতে পেরেছিল নিরাপদ স্থানে। কিন্তু এ মতের বিরোধিতা করা মানুষও আছেন। জন এভেলিনের মতে বাতাসে ভেসে আসা কটু গন্ধটা আসলে মানুষ পোড়ার ছিল। তার মতে সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হবে।
মজার ব্যাপার হলো, ১৬৬৬ সালের এপ্রিলে জন র্যাথবোন আর উইলিয়াম সন্ডার্সকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় রাজা চার্লসকে গুপ্তহত্যা করবার ষড়যন্ত্র করবার জন্য। তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল লন্ডন শহর পুড়িয়ে দেয়া।
১৬৬২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ডাচদের মিত্র ছিল ফ্রেঞ্চরা। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইংলিশদের বিরুদ্ধে লড়ছিল ফ্রেঞ্চরা। ঘটনার এক সপ্তাহ পরে যখন সংবাদ ফ্রান্সের রাজধানীতে পৌঁছে তখন সেখানে নিযুক্ত ভেনিসের রাজদূত মন্তব্য করেন, “এই দুর্ঘটনা শতকের পর শতক ধরে মনে থাকবে মানুষের।” ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই হয়ত মনে মনে খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু অবশ্যই সেটা প্রকাশ করেননি। খুশির কারণ এই যে, গুজব রটেছিল যে ইংল্যান্ডের বারুদ মজুদ নষ্ট হয়ে গেছে আগুনে আর এজন্য ইংলিশ নৌবাহিনী যুদ্ধ থামিয়ে দেবে। আসলে কিন্তু ধ্বংস হয়নি! তবে, রাজা লুই আদেশ দেন যে এই আগুনের ঘটনায় ফ্রান্সে উৎসব করা যাবে না। তিনি লন্ডনের জন্য ত্রাণ সামগ্রীও পাঠান।
কেমন হত যদি লন্ডন শহর পুড়ে না যেত এত বছর আগে? তবে কি আমরা ভিন্ন রকমের কোনো লন্ডন দেখতাম আজ?
ফিচার ইমেজ: 111cazza/Youtube