জনগণকে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত হন পুলিশ অফিসাররা। কিন্তু একবার ভাবুন তো, স্বয়ং সেই পুলিশই যদি সিরিয়াল কিলার হয়, তখন নিরাপত্তার জন্য কোথায় আশ্রয় পাবে সাধারণ মানুষ? হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। সিরিয়াল কিলারদের তালিকায় আছে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসারের নামও। সৃজিত মুখার্জির সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ‘বাইশে শ্রাবণ’ এর পুলিশ অফিসার প্রবীরের মতো বাস্তব জীবনেও কিছু রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আজ তাহলে জেনে নেওয়া যাক তাদের গল্প।
টরি হেইডেন
ওটস চুরি করে অপরাধ জীবন শুরু করেছে এমন অপরাধী বোধহয় খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তবে সুইডিশ সিরিয়াল কিলার টরি হেইডেনের অপকর্মের সূত্রপাত ঘটেছিল ওটসকে কেন্দ্র করে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্থানীয় একটি দোকানে ঢুকে সামান্য ওটস চুরি করে সে। এরপরেই তার মাথায় আসে হাতের ছাপ রেখে গেলে তো পুলিশের কাছে ধরা পড়তে হবে, কাজেই পুরো দোকানে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সব সূত্র নষ্ট করে দিল হেইডেন।
এই ঘটনার ঠিক আট বছর পরে, ১৯৫১ সালে, অত্র শহরের পুলিশ অফিসার হিসেবে হেইডেনকে নিযুক্ত করার জন্য একটি মিছিল বের করে তার মতোই কয়েকজন তরুণ। মিছিল শেষ হওয়ার পর হেইডেন তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে খুন করে খুনির খাতায় নাম ওঠায়। পোকার খেলতে গিয়ে বন্ধু জন অ্যালান নিলসনকে খুন করে, আগেরবারের মতো সমস্ত তথ্য-প্রমাণ মুছে দিতে আগুন ধরিয়ে দেয় অপরাধপটে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ঐ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে তাকেই পাঠানো হয় ক্রাইম সিনে। জাতীয় টেলিভিশনে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কিত অগ্রগতি জানিয়ে সাক্ষাৎকারও দেয় সে।
নিলসনকে হত্যা করার প্রায় এক বছর পরে, তার খুনে নেশার উন্মত্ততার শিকার হয় বান্ধবী উলা অস্টবার্গ। তার অপরাধ ছিল হেইডেনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। ক্রোধে অন্ধ হেইডেন সোজা চলে যায় স্যাক্সট্রপে, তার নিজের বাবার বাড়িতে। নিজ হাতে বাবা-মা দুজনকেই খুন করে যথারীতি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় সে।
এরপর আসে উলার পালা। উলাকে খুঁজতে তার বাবার বাড়িতে চলে আসে হেইডেন। উলা তখন তার মায়ের সাথে বেডরুমে ঘুমিয়ে ছিল। কুড়াল দিয়ে আঘাত করে দুজনকেই মেরে ফেলে হেইডেন। এরপর বাড়ির সব দরজা বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেয় সে। ঐ বাড়িটিতে তখন চারজন বয়স্ক লোক ছিলেন, ঘটনাস্থলেই মারা যান তারা। পঞ্চম এক ব্যক্তিকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারও মৃত্যু হয়।
এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যায় হেইডেন। স্থানীয় পুলিশের ততক্ষণে আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, সব ক’টি হত্যাকাণ্ডের পেছনে কার হাত ছিল। ম্যানহান্ট নামে একটি কর্মসূচি চালিয়ে খুব দ্রুত হেইডেনকে ধরার পরিকল্পনা করে তারা। কয়েকদিনের মধ্যেই একটি লেকের পাশে হেইডেনের গাড়িটি পাওয়া যায়, সাথে ছিল একটি সুইসাইড নোট। নোটে লেখা ছিল, অন্য অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব বুঝতেই নিজে খুন করে বেড়াত সে। আর বাবা-মাকে নিজ হাতে মেরে ফেলেছে, যাতে তার অপরাধের জন্য ঐ দুজনকে ভুগতে না হয়। লেকের পানি থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
জন ক্রিস্টি
সিরিয়াল কিলার জন ক্রিস্টির আর যা-ই হোক, অন্তত পুলিশ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার কথা ছিল না। চুরি আর সহিংস হামলার অপরাধে তার নামে আগে থেকেই মামলা ছিল, এমনকি জেলের ঘানিও টানতে হয়েছে তাকে। তবে সে রেকর্ডকে পাত্তা না দিয়ে যুদ্ধের সময় রিজার্ভ পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ক্রিস্টিকে। এখানে তার দায়িত্ব ছিল খুবই দক্ষতার এবং বিশ্বাসযোগ্যতার। পুলিশ হিসেবে চাকরি করতে গিয়ে খুনি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ক্রিস্টি।
রুথ ফুয়েরেস্ট নাম্নী একুশ বছর বয়সী এক পতিতার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ক্রিস্টি। এক রাতে রুথকে খুন করে তার বাড়ির বাগানেই মৃতদেহ দাফন করে দেয় সে। এতে নারীদের খুন করার প্রতি তার এক ধরনের নেশার উদ্রেক ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে এবার তার শিকারে পরিণত হয় প্রতিবেশী মুরিয়েল এডি। নিজের স্বল্প ডাক্তারি জ্ঞান জাহির করে মুরিয়েলকে পটিয়ে ফেলে সে। বুকে ব্যথার চিকিৎসা করাতে ক্রিস্টির শরণাপন্ন মুরিয়েলের ইনহেলারে কার্বন মনোক্সাইড ঢুকিয়ে দেয় ক্রিস্টি। বেহুঁশ মুরিয়েলকে ধর্ষণ করে হত্যার পর রুথের পাশেই দাফন করে দেয়।
আরেক প্রতিবেশী বেরিল ইভান্স পরিণত হয় তার তৃতীয় শিকারে। বেরিল এবং তার স্বামী টিমোথি চাচ্ছিলেন তাদের অনাগত সন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করে দিতে, আরও একটি সন্তানকে লালনপালন করার আর্থিক সংগতি ছিল না এই দম্পতির। আবারও ডাক্তারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বেরিলকে ধর্ষণ করে ক্রিস্টি, টাই দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলে তাকে। ঐ একই বাগানে ঠাঁই মেলে বেরিলেরও। হাবিজাবি কিছু একটা বলে বেরিলের স্বামীকে সে যাত্রায় বোকা বানায় ক্রিস্টি।
এক বছরের মধ্যে আরও তিনজন পতিতা সহ নিজের স্ত্রী এথেলকে খুন করে ক্রিস্টি। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় তাদের মৃতদেহগুলো লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর শিকার খুঁজতে লন্ডনে পাড়ি জমায় ক্রিস্টি, সেখান থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হঠাৎ করে তার অনুপস্থিতিতে সন্দিহান হয়ে বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে মৃতদের লাশ উদ্ধার করে ক্রিস্টিকে খুঁজতে খুঁজতে লন্ডনে চলে আসে তারা। খুনের দায়ে অভিযুক্ত ক্রিস্টির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৯৫৩ সালের ১৫ জুলাই।
মিখাইল পোপকভ
পেট্রোল কার এবং পুলিশের ইউনিফর্ম দেখিয়ে শিকারের আস্থা অর্জন করে তাদেরকে মেরে ফেলত মিখাইল। ১৯৯২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তার অত্যাচারী মায়ের সাথে চেহারায় মিল আছে এমন সব নারীকে টার্গেট করতো মিখাইল। স্ক্রু ড্রাইভার, কুড়াল কিংবা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত সে ভিক্টিমের উপর। ছিন্নভিন্ন লাশগুলোকে ধর্ষণ করে ফেলে দিয়ে আসত রাশিয়ার আঙ্গারস্ক জঙ্গলে। অন্তত ২২ জন নারীকে হত্যা করেছে মিখাইল, সংখ্যাটি ৩০ এরও বেশি হতে পারে।
হত্যার নৃশংসতায় বাধ্য হয়ে সংবাদপত্রের শিরোনামে মিখাইলকে ‘ওয়ারউলফ’ নামে আখ্যা দেয় সাংবাদিকরা। শহরব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। প্রায় দুই দশক ধরে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় মিখাইল। তার এক শিকার কোনোমতে প্রাণে বেঁচে গিয়ে তাকে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করলেও, তা বিশ্বাস করেনি পুলিশ। ২০১২ সালে বাধ্যতামূলকভাবে সকল পুলিশ অফিসারের ডিএনএ পরীক্ষা করা হলে ধরা পড়ে প্রকৃত ওয়ারউলফ। মিখাইল অবশ্য জানায়, যৌনরোগে আক্রান্ত হয়ে নপুংসক হয়ে পড়েছে সে। কিন্তু পুলিশি তদন্তে তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
ক্রিস্টোফার জর্ডান ডোর্নার
ক্রিস্টোফারের হরর জীবনের সূচনা হয় যখন তাকে পুলিশ বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত করা হয়, তখন থেকে। এক আসামীকে গ্রেপ্তারের সময় অপর একজন পুলিশ অফিসারকে অহেতুকভাবে জোরাজুরি করায় তাকে বের করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ক্রিস্টোফারের মতে, তার সাথে ঘোরতর অন্যায় করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে মাঠে নামে কুখ্যাত এই সিরিয়াল কিলার।
ক্রিস্টোফারের হাতে খুন হওয়া প্রথম দুই ব্যক্তির নাম মনিকা কোয়ান এবং কিথ লরেন্স। গাড়িতে থাকা অবস্থায় একদম কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাদের। দুজনের কেউই ক্রিস্টোফারের পরিচিত ছিল না। কিন্তু মনিকার বাবা পুলিশ অফিসার হওয়ায় খেসারত দিতে হয় তার মেয়েকে। ডিজিটাল এই খুনি তার ইশতেহার ছাপায় ফেসবুকে। কাকে কাকে খুন করা হবে তার তালিকা প্রকাশ করে ক্রিস্টোফার। এরপর কয়েকদিন এলোপাতাড়ি হত্যাযজ্ঞ চালায় সে, তাতে চারজন নিহত হয় এবং দুজন মারাত্মক আহত হয়।
ফেসবুকে এই ইশতেহার দেখার পর পুলিশ কর্তৃপক্ষ আবারও তার বহিষ্কারাদেশ পুনর্বিবেচনা করে দেখবে বলে জানায়। গণমাধ্যমে পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে জানানো হয় ক্রিস্টোফারকে দলে ফিরে পেতে প্রস্তুত তারা। ইতোমধ্যে, ক্রিস্টোফারকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা এবং ম্যানহান্টের ব্যবস্থা করে তারা। কিন্তু সে ফাঁদে পা দেয় না ক্রিস্টোফার। উল্টো অফিসার মাইকেল ক্রেইন এবং তার সহকর্মীকে খুন করে সে।
এরকমভাবে দশদিন ব্যাপী চলতে থাকে ক্রিস্টোফারের উন্মত্ততা। শেষ পর্যন্ত, ১২ ফেব্রুয়ারি এক পাহাড়ের উপরে কেবিনের মধ্যে ধরা পড়ে ক্রিস্টোফার। পুলিশের সাথে গোলাগুলি চলাকালে নিহত হয় ডেপুটি জেরেমিয়াহ ম্যাকায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। কিছুক্ষণের মধ্যে কেবিনের ভেতর থেকে একটি মাত্র গুলির শব্দ শোনা যায়, তারপর নিস্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু। এদিকে কাঁদানে গ্যাসের আঘাতে কেবিনে আগুন ধরে যায়। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর উদ্ধার করা হয় একটি মৃতদেহ। মৃতদেহের ডিএনএ রেকর্ড থেকে সনাক্ত করা হয় ক্রিস্টোফারকে।