আধুনিক সুইডেনের ‘ঘটনাবহুল’ জন্ম | শেষ পর্ব

[আগের পর্বে ছিল কালমার ইউনিয়ন, সুইডেনের উপর ড্যানিশ আধিপত্য, সুইডিশ প্রশাসক স্টেন স্টিউরের স্বাধীনতাকামী মানসিকতা, রাজার হাতে তরুণ গুস্তাভ ভাসার বন্দীদশা ও কারাগার থেকে পলায়ন, সুইডেনে ক্ষমতার পালাবদল। এই পর্বে থাকছে গুস্তাব ভাসার নাটকীয় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, স্বাধীনতার জন্য সুইডিশ জনগণকে সংগঠিত করা, ড্যানিশ রাজার অনুগত প্রশাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই ও স্বাধীনতা অর্জনের গল্প। দুই পর্বের লেখার এটাই শেষ পর্ব]

আগের পর্বের শেষাংশে বলা হয়েছে, নতুন ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রশাসকের ভয় ছিল, হয়তো সুইডিশ সমাজের অভিজাতদের মাঝে যারা সাবেক প্রশাসক স্টেন স্টিউরকে সমর্থন করতেন, তারা হয়তো ভবিষ্যতে তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেন। এই ভয় থেকে তিনি এক ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ড্যানিশ রাজার কাছে এই অভিজাতদের একটি তালিকা দেন। রাজা সেই তালিকায় যেসব অভিজাতদের নাম ছিল, তাদেরকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের পর তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর প্রশ্ন তোলা হয়, এই প্রশ্ন তোলেন স্বয়ং সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রশাসক, যিনি ধর্মযাজক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন। যাদের ধর্মবিশ্বাসের উপর প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এরপর গণহারে ফাঁসির পর্ব শুরু হয়। মাত্র অল্প কয়েকদিনেই প্রায় একশো ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ইতিহাসে এই ঘটনাকে ‘স্টকহোম ব্লাডবাথ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

ওডজতজকব
শিল্পীর তুলিতে স্টকহোম ব্লাডবাথের সময় নামেমাত্র বিচারকার্য চলছে; image source: aminoapps.com

তবে তার মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তুলতে সফল হয় আরেকটি ঘটনা। স্টকহোম ব্লাডবাথের পাশাপাশি গুস্তাভ ভাসা জানতে পারেন, তার বাবাকেও ড্যানিশ রাজা ও নতুন প্রশাসক ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। তার বাবাকে হত্যার পেছনে মূল কারণ ছিল- তিনি স্টেন স্টিউরকে সমর্থন করতেন এবং যখন ড্যানিশ রাজার তরফ থেকে নতুন প্রশাসককে ক্ষমতায় আসীন করা হলো, তখন তিনি তাকে সমর্থন দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর এবার গুস্তাভের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না, কোনো অযুহাত দেখানোর অবকাশ ছিল না। তিনি মনস্থির করলেন, এবার সুইডেনের জন্য কিছু করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটা বিষয় তিনি বিবেচনায় নিয়েছিলেন। নতুন প্রশাসক দায়িত্ব পাবার পর প্রশাসনের উপর তিনি এখনও শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, এবং একইসাথে জনগণের এক বড় অংশ এখনও আগের প্রশাসক স্টেন স্টিউরের প্রতি অনুগত আছে। এই সুযোগ যদি কাজে লাগানো না যায়, তাহলে তার জন্য এটি হবে এক ঐতিহাসিক ভুল।

গুস্তাভ ভাসা সরাসরি স্টকহোমে গিয়ে যদি নতুন ক্ষমতা পাওয়া প্রশাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেন, তাহলে বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত তো হতোই, সেই সাথে তার প্রাণ যাওয়ারও শঙ্কা ছিল। সেজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, রাজধানী থেকে অনেক দূরে গিয়ে জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। এরপর সংগঠিত জনগণকে নিয়ে সেনাবাহিনী তৈরি করে ড্যানিশ সৈন্য ও তাদের স্থানীয় দোসরদের সুইডেনে মাটি থেকে তাড়াতে হবে। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তিনি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে দূরে ডালার্না প্রদেশে যান। সেখানে গিয়ে স্থানীয় জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, দ্বিতীয় ক্রিস্টিয়ান কাগজে-কলমে স্বাধীনতা দিলেও বাস্তবে তার পুতুল প্রশাসকের মাধ্যমে তিনিই সুইডেন শাসন করছেন। তার এসব কথায় স্থানীয় মানুষ বেশ প্রভাবিত হয়, তাকে সমর্থন জানায়। কিছুদিনের মধ্যে স্থানীয় বেশ কিছু খনিশ্রমিক জুটে যায়, যারা দেশের জন্য গুস্তাভের সাথে ড্যানিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আগ্রহী। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই প্রায় চারশো যোদ্ধার সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে গুস্তাভ ভাসার সম্মোহনী নেতৃত্বে।

নশজআলনল
গুস্তাভ ভাসা নিজে সেনাবাহিনী পরিচালনা করেছিলেন; image source: reddit.com

গুস্তাভ ভাসা সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রে শত্রুপক্ষের তুলনায় পিছিয়ে থাকার কারণে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। তার সেনাবাহিনীর প্রথম সফলতা আসে ব্রানব্যাক ফেরির আক্রমণে, যে যুদ্ধে তারা ড্যানিশ সেনাবাহিনীর এক বিচ্ছিন্ন ইউনিটকে শোচনীয় পরাজয় উপহার দেন। এরপর গোটাল্যান্ড নামক জায়গায় একটি ঘটনা ঘটে, যেটি গুস্তাভের সেনাবাহিনীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। তার সেনাবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার কথা শুনে রাজার নির্দেশে বিশাল সেনাবাহিনী প্রস্তুত হচ্ছিল তাদের শায়েস্তা করার জন্য। কিন্তু রওনা দেয়ার আগমুহূর্তে তাদের কাছে খবর আসে- গোটাল্যান্ড নামের একটি জায়গায় বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। এরপর সেনাবাহিনী দুই ভাগ হয়ে এক ভাগ গোটাল্যান্ডের দিকে যায়, আরেকভাগ গুস্তাভদের শায়েস্তা করতে আসে। মজার ব্যাপার হলো, গুস্তাব ভাসার সেনাবাহিনী ও গোটাল্যান্ডের বিদ্রোহী, দু’পক্ষের কাছেই ড্যানিশ রাজার সেনাবাহিনী পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভাস্তেরাস নামের আরেকটি জায়গার দখল নিতে সমর্থ হওয়ায় সেখানকার সোনার খনি গুস্তাভের সেনাবাহিনীর দখলে চলে আসে।

এর পরের সময়ে গুস্তাভের সেনাবাহিনীর জয়জয়কার ঘটে। গোটাল্যান্ডের বিদ্রোহীরা সিদ্ধান্ত নেয়- তারা গুস্তাভের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে একত্রে মাতৃভূমি স্বাধীনের সংগ্রাম পরিচালনা করবে। বিভিন্ন খনি থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে গুস্তাভ ভাসার সেনাবাহিনীর আর্থিক সমস্যা দূর হয়ে যায় এবং আরও বেশি করে মানুষ তার সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। তারা নিজেদের মধ্যে একটি নির্বাচনের আয়োজন করে এবং গুস্তাভকে সুইডেনের নতুন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেয়। গুস্তাভ ভাসার সেনাবাহিনীর একের পর এক সফলতায় মুগ্ধ হয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সুইডিশ অভিজাতরা তার পক্ষে তাদের সক্রিয় সমর্থন ব্যক্ত করে। তিনি তাদের সমর্থন নিয়ে সমাজের যেসব ব্যক্তি তখনও ড্যানিশ রাজার প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল, তাদেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলান। এভাবে তিনি ড্যানিশ রাজার অনুগত পুতুল প্রশাসকের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিশোধ নেন।

জতকআলবকব
সোনার খনির দখল নেয়ার পর গুস্তাভ ভাসার সেনাবাহিনীর অর্থকষ্ট দূর হয়; image source: rachelsruminations.com

পরবর্তী দুই বছরে একের পর এক শহরের পতন ঘটতে থাকে গুস্তাভের বাহিনীর কাছে। ১৫২৩ সালে সুইডিশ সমাজের অভিজাত ব্যক্তিরা এক নির্বাচনের আয়োজন করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সুইডেনের রাজা নির্বাচন করা। সুইডেনের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা গুস্তাভ ভাসা যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজা নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, সেটা একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল। নির্বাচন ছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা। নির্বাচনের পর গুস্তাভ সুইডেনের ‘রাজা’ নির্বাচিত হন। বলে রাখা ভালো, আগেও একবার নির্বাচন হয়, এবং সেটাতেও তিনি নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে জয়লাভ করেন। কিন্তু এবারের নির্বাচন ছিল একটু আলাদা, কারণ এতে সুইডিশ অভিজতাদের সমর্থন ছিল, যা আগেরটায় ছিল না।

হতকগকবল
রাজা হিসেবে স্টকহোমে গুস্তাভ ভাসার ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন; image source: popularhistoria.se

১৫২৩ সালের জুন মাসেই গুস্তাভের বাহিনীর হাতে রাজধানী স্টকহোমের পতন ঘটে। এদিকে ড্যানিশ রাজতন্ত্রেও ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, রাজা প্রথম ফ্রেডেরিক ডেনমার্কের রাজসিংহাসন দখল করেন। তিনি ক্ষমতা লাভের পর পূর্বসূরীর মতো সুইডেনের স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে তার কিংবা তার সেনাবাহিনীর আর কিছুই করার ছিল না। ১৫২৩ সালের শেষের দিকে তিনি মালমো চুক্তির মাধ্যমে সুইডেনের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। এই চুক্তির মাধ্যমে সুইডেন কালমার ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যে দেশের রাজা হন স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক গুস্তাভ ভাসা। জন্ম হয় আধুনিক সুইডেনের।

Related Articles

Exit mobile version