চলমান প্রুশিয়ান ক্রুসেড
১২৫২ খ্রিস্টাব্দের দিকে হাইনরিখ স্ট্যাঙ্গো স্যামল্যান্ডের মধ্য দিয়ে একটি সেনাদল নিয়ে এগিয়ে যান। ভিস্টুলা নদীর এলাকাতে প্রুশিয়ানরা তাকে পরাজিত এবং হত্যা করে। প্রতিশোধ নিতে টিউটোনিক নাইটরা মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে প্রায় ৬০,০০০ সেনা জড়ো করে। বিশাল এই বাহিনীর সামনে ব্যাটল অফ রুডাউ’তে (Battle of Rudau) প্রুশিয়ান সেনাদের বড় অংশ আত্মসমর্পণ করে। এরপর ১২৫৯ পর্যন্ত মোটামুটি শান্তি বিরাজ করে। এরপর প্রুশিয়ার প্রতিবেশী লিথুনিয়ার স্যামোজিশিয়ান (Samogitians) গোত্রের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। লিথুনিয়ান ক্রুসেডের অংশ হিসেবে ব্যাটল অফ স্কুডাসে (Skuodas) পৌত্তলিক স্যামোজিশিয়ান সেনারা খ্রিষ্টান বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়। উৎসাহিত হয়ে প্রুশিয়ানরা আবার অস্ত্র তুলে নেয়। এক বছর ধরে তারা টিউটোনিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ সফলতা পায়। কিন্তু পরের বছর হলি রোমান এম্পায়ার থেকে সহায়তাকারী সেনা এসে পৌঁছলে প্রুশিয়ানরা আবার পরাস্ত হয়।
প্রায় কয়েক দশক রক্তপাতের পরে টিউটোনিক নাইটরা অবশেষে প্রুশিয়াকে মোটামুটিভাবে বশীভূত করতে সক্ষম হলো। প্রাচীন দেবদেবীর উপাসনাকারী প্রুশিয়ানদের পরিণত করা হয় ক্যাথলিক খ্রিস্টানে। স্রোতের মতো আসতে থাকা জার্মান গোত্রের চাপে নিজ ভূমিতে প্রুশিয়ানরাই পরবাসী হয়ে পড়ে। টিউটোনিক নাইটরা প্রুশিয়ার সাথে পোল্যান্ডের দাবীকৃত পোমেরেলিয়াও ছিনিয়ে নেয়, ফলে পোলিশ সাম্রাজ্যের সাথে তাদের বিবাদ শুরু হয়। ক্রমাগত লড়াইতে টিউটোনিক বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৪৬৬ সালে টরুনের দ্বিতীয় চুক্তির (Treaty of Torun) মাধ্যমে পোমেরানিয়া আর প্রুশিয়ার পশ্চিমাংশ পোল্যান্ডের সরাসরি শাসনে চলে যায়। পশ্চিম প্রুশিয়ার নাম হলো রয়্যাল প্রুশিয়া।
রয়্যাল প্রুশিয়ার একদিকে বাল্টিকের তীরে ব্র্যান্ডেনবার্গ যার শাসকেরা পোল্যান্ডের সম্রাটের প্রতি আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য থাকতেন। পূর্ব প্রুশিয়া, বা ডুকাল প্রুশিয়াও (ducal Prussia) একই শর্তে নাইটদের কাছে দেয়া হয়।। ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে টিউটোনিক গ্র্যান্ড মাস্টার আলবার্ট প্রুশিয়াকে সেক্যুলার ঘোষণা করেন। পোল্যান্ডের রাজা প্রথম সিগিসমুন্ড পূর্ব প্রুশিয়াকে ডাচি (একজন ডিউকের অধীনে শাসিত এলাকা) হিসেবে স্বীকৃতি দেন। আলবার্ট হলেন এখানকার ডিউক। টিউটোনিক নাইটদের প্রতিপত্তি আগে থেকেই কমে যাচ্ছিল, আলবার্টের এই কাজের পর তারা ইউরোপিয়ান রাজনীতিতে পুরোপুরিই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
আলবার্ট ছিলেন হনজোলার্ন (Hohenzollern) পরিবারের লোক। হনজোলার্ন জার্মানির নামকরা রাজপরিবার, যাদের লোকেরা জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষমতায় ছিলেন। পূর্ব প্রুশিয়ার প্রতিবেশী ব্র্যান্ডেনবার্গের ক্ষমতাতেও ছিলেন একজন হনজোলার্ন। বংশানুক্রমে এই পরিবারের লোকেরাই পূর্ব প্রুশিয়া আর ব্র্যান্ডেনবার্গ শাসন করতে থাকেন।
ব্র্যান্ডেনবার্গের প্রসার
সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন।
বাল্টিক সাগরের তীরে হলি রোমান এম্পায়ারের অন্তর্গত অঞ্চল ব্র্যান্ডেনবার্গ। বার্লিনকে রাজধানী করে বংশানুক্রমে এখানে শাসন করছেন একজন মার্কুইস (কাউন্টের এবং উপরে এবং ডিউকের ঠিক নিচের উপাধি), হলি রোমান এম্পেররের কাছ থেকে যিনি মারগ্রেভ পদবীপ্রাপ্ত হন। সম্রাট ষষ্ঠ চার্লস ব্র্যান্ডেনবার্গের মারগ্রেভকে হলি রোমান এম্পায়ার নির্বাচনে ভোটদানের ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন, তাই তাদের বলা হত ইলেক্টর। এই মারগ্রেভরা ছিলেন হনজোলার্ন বংশভুক্ত। তাদের আত্মীয়রা ছিলেন ডাচি অফ প্রুশিয়ার মসনদে, যার রাজধানী কনিগসবার্গ (বর্তমান রাশিয়ার কালিনিগ্রাদ)। কিন্তু ১৬১৮ সালে ডাচির শাসক হনজোলার্ন বংশধারা নিঃশেষ হয়ে গেলে এখানকার ক্ষমতা বর্তাল ব্র্যান্ডেনবার্গের হনজোলার্নদের কাছে।
এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরেই রাইন নদীর ধারে আরেক ডাচি ক্লিভসের (Duchy of Cleves) দখল নিয়ে ব্র্যান্ডেনবার্গের সাথে নিউবার্গের সংঘর্ষ চলছিল। অবশেষে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মধ্যস্থতায় ১৬১৪ সালে ব্র্যান্ডেনবার্গের শাসক সিগিসমুন্ডের সাথে নিউবার্গের কাউন্ট প্যালাটাইনের সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। য্যান্টেন শহরে স্বাক্ষরিত হয় বলে ইতিহাসে এই চুক্তি য্যান্টেন চুক্তি (Treaty of Xanten) নামে পরিচিত। শর্ত অনুযায়ী ক্লিভসের বিরাট এলাকা ব্র্যান্ডেনবার্গের হস্তগত হয়। ফলে জার্মানিতে ব্র্যান্ডেনবার্গের হনজোলার্ন শাসকেদের প্রতিপত্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেল। তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী ব্র্যান্ডেনবার্গের অধীনস্থ অঞ্চল ছোট ছোট এলাকা, বা এস্টেটে ভাগ করা থাকত। প্রতিটি এস্টেট তাদের নিজস্ব সভা বা ডায়েট (Diet) দ্বারা পরিচালিত ছিল, যেখানে অভিজাত এবং ধনবান ব্যক্তিরাই সদস্য হতেন। ডায়েটের প্রধান নিজ এলাকা থেকে কর আদায় করতেন এবং এর একাংশ দিতেন ব্র্যান্ডেনবার্গের শাসকের কোষাগারে জমা দিতেন, যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহ হত। ফলে ব্র্যান্ডেনবার্গের শাসক এস্টেটের প্রধানদের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভর করতেন।
ফ্রেডেরিক উইলিয়াম
১৬১৮-৪৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপে বাজছিল যুদ্ধের দামামা। হলি রোমান এম্পায়ারের অন্তর্ভুক্ত প্রটেস্ট্যান্ট আর ক্যাথলিকদের দ্বন্দ্ব রূপ নিয়েছিল ইউরোপের পরাশক্তিগুলোর লড়াইয়ে। ধর্মীয় মতপার্থক্য থেকে সূচনা হলেও শেষপর্যন্ত এই বিবাদ রূপ ন্যায় আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের যুদ্ধে। ইতিহাসের পাতায় এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত অভিহিত ত্রিশ বছরের লড়াই (Thirty Years’ War) নামে, যেখানে আট মিলিয়নেরও বেশি মানুষ হতাহত হয়। এই সংঘাত স্পেন আর নেদারল্যান্ডসের মধ্যে চলমান আশি বছরের লড়াইয়ের জার্মান পর্যায় বলেও অনেকে মনে করেন। জার্মানি এই যুদ্ধের ফলে প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্র্যান্ডেনবার্গের জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ লড়াইতে নিহত হয়, তাদের অনেক এলাকাও শত্রু আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ডাচি অফ প্রুশিয়া সেই তুলনায় অনেকটা নিরাপদ ছিল।
ব্র্যান্ডেনবার্গের তৎকালীন ইলেক্টর জর্জ উইলিয়ামের সন্তান ফ্রেডেরিককে বিপদ থেকে দূরে রাখতে পাঠিয়ে দেয়া হলো নেদারল্যান্ডস। সেখানে চার বছর অবস্থান শেষে ১৮ বছর বয়স্ক তরুণ ফ্রেডেরিক জন্মভূমিতে ফেরত এলেন। তার পিতা তখন ইউরোপিয়ান পরাশক্তিদের সাথে দর কষাকষিতে ব্যস্ত। প্রথমে জর্জ উইলিয়াম সুইডেনের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলেও অচিরেই তিনি অস্ট্রিয়ান হাবসবুর্গদের (Habsburgs) দলে যোগ দেন। তার প্রধান সহকারী অ্যাডাম ভন শোয়ার্জেনবার্গ সব কলকাঠি নাড়ছিলেন। জর্জ উইলিয়ামের অর্থ খরচ করে তিনি দাঁড়া করিয়েছিলেন ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী।
এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে ১৬৪০ সালে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ব্র্যান্ডেনবার্গের ক্ষমতা নিলেন। প্রথম তিন বছর তিনি বার্লিনে না থেকে অবস্থান করেন কনিগসবার্গে। তিনি চলমান যুদ্ধে দুই পক্ষেই পা দিতে চাইলেন। নিরপেক্ষতার কথা বলে তিনি সুইডেনের সাথে ব্র্যান্ডেনবার্গের অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষর করেন, অপরদিকে নিজের ছোট সেনাদল হাবসবুর্গ সম্রাটের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। ১৬৪৪ সালে ত্রিশ বছরের লড়াইয়ের সমাপ্তি টানতে আলোচনার সূচনা হলে ফ্রেডেরিক নিজেকে গুছিয়ে নেয়া আরম্ভ করলেন।
শোয়ার্জেনবার্গকে তিনি অনেক আগে থেকেই সরাতে চাইছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন শুধু উপযুক্ত সময়ের। শোয়ার্জেনবার্গের বাড়াবাড়িতে এস্টেটগুলো নিজেরাই ফ্রেডেরিকের সহায়তা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে অপসারিত করেন। এরপর তিনি নিজের জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরিতে হাত দেন। এজন্য অর্থের দরকার হলে ফ্রেডেরিক স্পব ডায়েট, বিশেষ করে ডাচি অফ ক্লিভসের এস্টেটের কাছে টাকা চাইলেন। কিন্তু তারা গড়িমসি শুরু করলে তিনি বিদ্যমান ছোট সেনাদল দিয়েই সরাসরি ডায়েটের অধিবাসীদের থেকে কর আদায় করতে শুরু করেন। ফলে অনন্যোপায় হয়ে এস্টেটগুলো তার কাছে নতি স্বীকার করে এবং সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান হয়।
ফ্রেডেরিক ছোট কিন্তু সুশৃঙ্খল একটি সেনাদল প্রতিষ্ঠা করেন। সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্যে তা যথেষ্ট না হলেও ডায়েট বশে আনতে এই সেনাদল খুব কাজে দেয়। সৈন্যদের দিয়ে ফ্রেডেরিক সমস্ত ডায়েটের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা ভিত গড়ে দেয় প্রুশিয়ান সাম্রাজ্যের। তার ছোট সেনাদল কালক্রমে হয়ে ওঠে জার্মানি, তথা ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীতে।
১৬৪৯ সালে ওয়েস্টফ্যালেয়া শহরে ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলোর চুক্তির মধ্য দিয়ে সমস্ত সংঘাতের অবসান হল। সব পক্ষই এখান থেকে কিছু না কিছু লাভ করে। বাল্টিকের তীরবর্তী সম্পদশালী পোমেরানিয়া দুই ভাগ করে পূর্বাংশ ফ্রেডেরিক আর পশ্চিমাঞ্চল সুইডেনের কাছে হস্তান্তর করা হল। হলি রোমান এম্পেরর ব্র্যান্ডেনবার্গের উপর ফ্রেডেরিকের সার্বভৌমত্ব দান করেন।
প্রুশিয়ার অভ্যুদয়
১৬৪৮ সালে পোল্যান্ডের রাজা হলেন দ্বিতীয় কাসিমির। তিনি একইসাথে ছিলেন লিথুয়ানিয়ার গ্র্যান্ড ডিউক। কাসিমির ছিলেন ক্যাথলিকদের জেসুইট মতবাদে বিশ্বাসী, ফলে অনেক পোলিশ অভিজাত তার উপর নাখোশ ছিলেন। তারা সুইডেনের রাজা, কাসিমিরের কাজিন দশম গুস্তাভকে সিংহাসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান। পোল্যান্ডের লিভোনিয়া অঞ্চলের দিকে সুইডেনের নজর বহুদিনের। কয়েকবারই তারা লিভোনিয়ার দিকে অভিযান চালিয়েছিল। ফলে গুস্তাভ কাসিমিরকে উৎখাত করবার ছলে পাকাপাকিভাবে লিভোনিয়া দখল করবার এই সুযোগ নষ্ট করতে চাইলেন না। ১৬৫৫ সালে তিনি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে প্রথম নর্দার্ন যুদ্ধের (First Northern War) সূচনা হলো।
ফ্রেডেরিককে পক্ষে টানতে গুস্তাভ প্রুশিয়ার উপর তাকে সার্বভৌমত্ব দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। পোল্যান্ডের প্রতি আনুগত্যের শপথ থাকায় ফ্রেডেরিক প্রথমে ইতস্তত করছিলেন। ইত্যবসরে সুইডিশ বাহিনী পোল্যান্ডের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং পূর্ব প্রুশিয়ার দিকে এগিয়ে আসে। ফলে ফ্রেডেরিক গুস্তাভের প্রস্তাব মেনে নেন এবং সেনাদল নিয়ে সুইডিশ বাহিনীর সাথে যোগ দেন। পরের বছর জুলাইয়ে সম্মিলিত এই বাহিনী ব্যাটল অফ ওয়ারশ’তে পলিশ-লিথুয়ানিয়ান মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করে শহরে ঢুকে পড়ে।
কাসিমির পালিয়ে গেলেও শিগিগিরি তিনি রাশিয়া আর হলি রোমান এম্পায়ারের সাহায্য অর্জন করেন। ডেনমার্ক আর নেদারল্যান্ডসও তার পক্ষে চলে আসে। গুস্তাভ দমে না গিয়ে ডেনমার্কে হামলা করে তছনছ করে দেন। ড্যানিশরা বহু এলাকা তার কাছে হারাল। কিন্তু চতুর ফ্রেডেরিক বুঝতে পারছিলেন এত শত্রুর বিপক্ষে গুস্তাভ শেষ অবধি টিকতে পারবেন না। তাই তিনি পক্ষ বদল করলেন। কাসিমির ব্র্যান্ডেনবার্গের সাথে আগে থেকেই জোট বাঁধতে চাইছিলেন। তিনিও গুস্তাভের মত একই প্রতিশ্রুতি দিলেন, লড়াইয়ে তাকে সহায়তার বিনিময়ে ফ্রেডেরিক ডাচি অফ প্রুশিয়ার উপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করবেন। ১৬৫৭ সালে ওয়াহ্লাউ চুক্তি ফ্রেডেরিক আর পোল্যান্ডের মধ্যে এই শর্তের ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত হলো।
মিত্রদের সাথে নিয়ে ফ্রেডেরিক পোমেরানিয়ার পশ্চিম থেকে সুইডিশদের তাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু সুইডেনের পক্ষে ফ্রেঞ্চরা ওকালতি করলে বাধ্য হয়ে ফ্রেডেরিক আবারো পোমেরানিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের উপর থেকে দাবি তুলে নেন। এদিকে ১৬৬০ সালে গুস্তাভের মৃত্যু হলে নর্দার্ন লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়। সে বছরেই অলিভা চুক্তির মাধ্যমে ফ্রেডেরিক স্বাধীন ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করেন। তার উপাধি হলো মারগ্রেভ ও ইলেক্টর অফ ব্র্যান্ডেনবার্গ এবং ডিউক অফ প্রুশিয়া।
ফ্রেডেরিকের ইচ্ছা ছিল ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়ার রাজা হিসেবে মসনদে বসবার। কিন্তু এখানে আইনগত বাধা ছিল। ব্র্যান্ডেনবার্গসহ তৎকালীন জার্মান ভূখণ্ড হলি রোমান এম্পায়ারের সীমানা অভ্যন্তরে পরিগণিত হত। ফলে এখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন হলি রোমান এম্পেরর। তাই নিয়মানুযায়ী এই এলাকার কাউকেই রাজা উপাধি দেয়া হত না, কারণ তা এম্পেররের ক্ষমতার সাথে সাংঘর্ষিক। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বোহেমিয়ার রাজা। তবে ব্র্যান্ডেনবার্গ জার্মান অঞ্চলে হলেও তর্কযোগ্যভাবে প্রুশিয়া কিন্তু হলি রোমান এম্পায়ারের সীমানার বাইরে অবস্থিত। আইনের এই ফাঁককে কাজে লাগিয়ে পরে ফ্রেডেরিকের ছেলে রাজা হয়ে বসেছিলেন।
এতদিন ধরে ডায়েটগুলো ফ্রেডেরিকের কোন পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট হলে পোল্যান্ডের রাজার কাছে প্রতিবিধান চাইতে পারত, যেহেতু ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়া তার কাছে দায়বদ্ধ ছিল। এখন ফ্রেডেরিক তাদের উপর ক্ষমতা পেয়ে গেল সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৬৬০ সালের ভেতরেই ব্র্যান্ডেনবার্গের সমস্ত ডায়েট ফ্রেডেরিকের পরিপূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করল।
কিছুটা গড়িমসি করলেও ১৬৭১ সালের মধ্যেই প্রুশিয়ান ডাচির সকল ডায়েটকেও ফ্রেডেরিকের একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নিতে হলো। নিজের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ফ্রেডেরিক জনগণের উপর করের বোঝা চাপিয়ে দিলেন, আর প্রাপ্ত অর্থ কাজে লাগালেন সেনাবাহিনী শক্তিশালী করতে। তার শাসনামলের শেষদিকে প্রায় ২০,০০০ সৈন্যের এক সুশৃঙ্খল বাহিনী রাজ্যের প্রতিরক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিল। তবে এই সেনাদল নিয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্প্রসারণে সফল হননি। এছাড়া অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যাও তাকে মোকাবেলা করতে হয়। ফ্রেডেরিক ছিলেন ক্যাল্ভিনিস্ট খ্রিস্টান, যেখানে ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়া ছিল মূলত লুথেরান চার্চের অনুসারী। ফলে রাষ্ট্রের অতি রক্ষণশীল পাদ্রি গোষ্ঠীর কাছে ফ্রেডেরিক খুব প্রিয় ছিলেন না। তবে দক্ষ হাতে তিনি সব সামাল দিতে থাকেন।
এই সিরিজের আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে: