প্রায় ৩১ বছর আগে ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত সোভিয়েত ইউক্রেন এর চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পারমাণবিক চুল্লী বিস্ফোরিত হয়ে এক প্রলয়ংকারী দুর্ঘটনা ঘটে। ইতিহাসে এটি পরিচিত চেরনোবিল বিপর্যয় হিসেবে। চেরনোবিলের এই ঘটনাটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী পারমাণবিক বিপর্যয় বলা হয়ে থাকে। সেই বিপর্যয়ের মধ্যেই এমন আরো একটি দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল যেটি মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ প্রাণসংহারী ঘটনা হতে পারত। কিন্তু নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেটা রুখে দিয়েছিলেন তিন অসমসাহসী মানুষ। দ্য চেরনোবিল ডাইভারস নামে খ্যাত চেরনোবিলের সেই বীরদের স্মরণে আজকের লেখা।
দুর্ঘটনাটি ঘটে যখন চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অপারেটররা বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাকআপ বন্ধ হয়ে গেলে সে অবস্থায় কীভাবে পারমাণবিক চুল্লী চালানো যায় তা পরীক্ষার জন্য একটি ‘স্ট্রেস টেস্ট’ করছিলেন তখন। স্ট্রেস টেস্ট মানে হল কোনো সিস্টেমের মধ্যে কৃত্রিম জরুরী অবস্থা তৈরি করে ভবিষ্যতের এমন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করা হবে সেটা পরীক্ষা করা। পরীক্ষা শুরুর সময়ে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারটি পারমাণবিক চুল্লীর মধ্যে একটি চুল্লীতে অনিয়ন্ত্রিত বিক্রিয়া শুরু হয় যার কারণে দুটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে দুটি পারমাণবিক দুর্ঘটনাকে সর্বোচ্চ মাত্রার বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর একটি ঘটেছে চেরনোবিলে, আরেকটি ঘটেছে ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাইচির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। চেরনোবিলের দুর্ঘটনার পরপরই এর পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ফলে মারা যায় ৫৬ জন যাদের মধ্যে ছিল ৯ জন শিশু। পরবর্তীতে আরও চার হাজার মানুষ এই তেজস্ক্রিয়তার কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
চেরনোবিল বিপর্যয়ের ভয়াবহতা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক। দুর্ঘটনার কারণে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে অন্তত ছয় লক্ষ মানুষ জীবনঝুঁকিতে রয়েছে আজও। কিন্তু এই দুর্ঘটনা আরও ভয়ঙ্কর ভাবে মানব ইতিহাসের মহাপ্রলয়ংকারী বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারত। কিন্তু সেটা হয় নি তিন জন দুঃসাহসী মানুষের দুর্লভ বীরত্বের কারণে।
চেরনোবিল দুর্ঘটনা ঘটবার পাঁচ দিন পর ১৯৮৬ সালের মে’র ১ তারিখে সোভিয়েত কর্মকর্তারা আবিস্কার করল এক ভয়াবহ তথ্য। যে পারমাণবিক চুল্লীটি বিস্ফোরিত হয়েছে সেটার কোর অর্থ্যাৎ মূল অংশটি তখনও উত্তাপে গলে চলছিল! সেই কোরের মধ্যে তখন ছিল ১৮৫ টন পারমাণবিক জ্বালানী এবং সেখানে তখনও পারমাণবিক বিক্রিয়া হচ্ছিল!
এই ১৮৫ টন পারমাণবিক জ্বালানীর ঠিক নিচেই ছিল ৫ মিলিয়ন গ্যালন ধারণ ক্ষমতার একটি পুল অর্থ্যাৎ জলাশয়। সেই পুলের পানি ব্যবহৃত হত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শীতলীকরণে কাজে। তো সেই পুল আর বিস্ফোরিত চুল্লীর কোরের মধ্যে ছিল কেবলমাত্র একটা কনক্রিট স্ল্যাব, মানে জমাটবাঁধা পাথরের তৈরি ঢাকনা । যদিও স্ল্যাবটি যথেষ্ট মোটা ছিল, কিন্তু কোরটির ভেতরে তো ছিল পারমাণবিক জ্বালানী! আগুন নেভানোর জন্য অগ্নিনির্বাপন কর্মীরা প্রচুর পানি ব্যবহার করছিল আর সেই সাথে হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হচ্ছিল বালি, কাদামাটি ও বোরন পাউডার। আগুন তৎক্ষণাৎ নেভানো যায় নি এবং এই পানি আর হেলিকপ্টার থেকে ফেলা দ্রব্যগুলো জমা হচ্ছিল চুল্লীর কোরের নিচের অংশে। এগুলো একসাথে মিশে আগ্নেয়গিরির লাভার মত এক ধরণের মিশ্রণ তৈরি করে এবং স্থানটি উত্তপ্ত থাকায় ধীরে ধীরে মিশ্রণটি স্ল্যাবের মধ্যে ছিদ্র তৈরি করে এর মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। এভাবে স্ল্যাবটি গলে গিয়ে নিচের পানিতে কোরের পারমাণবিক জ্বালানী মিশিয়ে দেবে, এমন কিছুই ঘটতে যাচ্ছিল তখন।
আর যদি গলতে থাকা কোরটি নিচের পানি স্পর্শ করতে পারে তাহলেই ঘটবে এক মহাবিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে গোটা ইউরোপের অধিকাংশ এলাকায়। চেরনোবিল বিপর্যয়ের পঞ্চম দিনে এসে এমন এক দুর্ঘটনার সম্ভাবনার তথ্য পাওয়া গেল যেটার কাছে প্রথম দিনের বিস্ফোরণ কিছুই নয়।
বিজ্ঞানীদের হিসেব মতে, যদি সেই জ্বালানী সহ গলিত কোর পানি স্পর্শ করত তাহলে বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট উত্তাপে অন্য তিনটি চুল্লীর পারমাণবিক জ্বালানীও বাষ্পীভূত হত। তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ত অন্তত তিন কোটি মানুষের ব্যবহার্য পানিতে। স্কুল অব রাশিয়ান এন্ড এশিয়ান স্টাডি’র গবেষকদের মতে, এই মহাবিস্ফোরণের ফলে গোটা ইউরোপের কমপক্ষে অর্ধেক অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হত এবং ইউরোপ, ইউক্রেন ও রাশিয়ার অনেক অংশ অন্তত পাঁচ লক্ষ বছরের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ত।
যাই হোক, ঐ সময় সেখানে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা জানালেন, গলতে থাকা কোরটি ধীরে ধীরে কনক্রিট স্ল্যাবের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করছে এবং প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে পানির কাছে যাচ্ছে।
ইঞ্জিনিয়াররা এই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা কীভাবে থামানো যায় তার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তারা একটা সমাধান বের করলেন। পুলের ভেতরে পানি প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য যে পাইপ রয়েছে তার ঢাকনা খোলা বা বন্ধ করার জন্য রয়েছে এক জোড়া গেট ভালভ। তিন জন মানুষ পুলের মধ্য দিয়ে সাঁতার কেটে যাবে গেট ভালভগুলো যেখানে আছে সে জায়গাটায়। পুলের গেট ভালভ খুলে দিলে পানি আটকে রাখার ঢাকনা খুলে যাবে এবং জমে থাকা পানি বের হয়ে যাবে নির্গমন পথ দিয়ে। স্ল্যাব গলিয়ে কোরটি পানির সংস্পর্শে আসার আগেই করতে হবে কাজটা।
এই পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারলে আসন্ন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হয়ত ঠেকানো যাবে, কিন্তু পুলের মধ্যে নেমে কাজটা করবে কারা? পারমাণবিক চুল্লীর গলতে থাকা কোরের ঠিক নিচের ঐ পুলের পানি সম্ভবত ঐ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অনিরাপদ জায়গা। ওই স্থানের তেজস্ক্রিয়তা সেই তিনজনের জীবন বাতি যে চিরদিনের জন্য নিভিয়ে দেবে সেটা বলাই বাহুল্য। নিজ জীবন বিলিয়ে দিয়ে সেখানে সাঁতার কাটতে যাবে এমন কেউ কি সেখানে ছিল?
ছিলেন। এগিয়ে এলেন তিনজন। এবং তারা নিশ্চিতভাবেই জানতেন, এই কাজের পরিণতি মৃত্যু। ভ্যালেরি বেজপালভ এবং অ্যালেক্সি আনানেকো ছিলেন বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের প্রকৌশলী আর বরিস বারানভ ছিলেন প্ল্যান্টের একজন কর্মী। প্রকৌশলী দুজন জানতেন ভালভ দুটো কোথায় আছে, বরিস তাদের সঙ্গী হলেন পানির নিচে কাজ করে এমন একটি ল্যাম্প নিয়ে।
পর দিন তিনজন সাঁতারের পোশাক পড়ে নামলেন সেখানে। যাবার আগে শুধু বলে গেলেন তাদের মৃত্যুর পর যেন তাদের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়া হয়।
পুলের ভেতরটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। কপালের কী দুর্গতি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের কাছে থাকা ল্যাম্পটির আলো ফিকে হয়ে এল।
আলো আঁধারের মধ্যে সাঁতরাতে হচ্ছে, এবং প্রতিটা মুহূর্তে মৃত্যুর একটু একটু করে কাছে যাচ্ছেন তিনজন। কিন্তু গেট ভালভ পাওয়ার আগ পর্যন্ত খুঁজে যেতেই হবে। এর উপর নির্ভর করছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন মৃত্যুর সিদ্ধান্ত। এমন সময় হঠাৎ নিভে গেল সাথের ল্যাম্পটি। গাঢ় অন্ধকার নেমে এল। কিন্তু ক্ষীণ আশা আছে তখনও, কারণ বাতি নেভার আগ মুহূর্তেই এর আলোতে তাদের চোখে পড়েছিল একটা পাইপ। দুই ইঞ্জিনিয়ার সেই পাইপটির কাছে চলে গেলেন। তারা জানতেন, সেই পাইপ ধরে এগিয়ে গেলে খুঁজতে থাকা ভালভ দুটো পেয়ে যাবেন।
তিন ডুবুরি পাইপের পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন। চারিদিকে কোনো আলো নেই, তাদের শরীরকে প্রতি মুহূর্তে অল্প অল্প করে ধবংস করে দিতে থাকা তেজস্ক্রিয়তা থেকে বাঁচবার মত কোনো সুরক্ষা নেই, কেবল সেই অন্ধকারের মধ্যে কোথাও আছে দুটো গেট ভালভ যেগুলো খুঁজে পেলে বাঁচবে লাখো প্রাণ। এক সময় পাওয়া গেল সে দুটো।
তারা ভালভ দুটো খুলে দিলেন। পানি বের হয়ে যেতে লাগল পাইপের মধ্য দিয়ে। পুল খালি হতে শুরু করল ধীরে ধীরে। মহাবিস্ফোরণ ঠেকিয়ে দিলেন তিনজন।
তিন দুঃসাহসী ডুবুরি সাঁতরে ফিরলেন এরপর, উঠে এলেন পানি থেকে। সেখানে অপেক্ষায় থাকা কর্মী আর সৈন্যরা সেই বীরদের জড়িয়ে ধরল। তখনকার পত্রিকার রিপোর্টারদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, সেই দুঃসহ সময়ের মধ্যেও এই তিনজন মানুষের সাফল্যে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন সেখানে উপস্থিত অনেকেই।
এক দিনের মধ্যেই চতুর্থ চুল্লীর নিচে থাকা পুলের সমস্ত পানি বেরিয়ে গেল। যে মহাবিস্ফোরণের আশঙ্কা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা তার ভয়ানক পরিণতির হাত থেকে বেঁচে গেল অসংখ্য মানুষ।
পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার কারণে দ্য চেরনোবিল ডাইভারস নামে খ্যাত এই তিন ব্যক্তির মারা যাওয়ার কথা ছড়ালেও, তাদের অভিযান ও পরিণতি নিয়ে জানা যায় ইংল্যান্ডের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক এন্ড্রু লেথারব্যারোর লেখা থেকে। ২০১৬ সালে তার প্রকাশিত বই ‘Chernobyl 01:23:40’ তে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে তাদের মৃত্যু হয়নি। লেথারব্যারো জানান, তাদের একজন বরিস বারানভ হৃদরোগে মারা গেছেন ২০০৫ সালে এবং অন্য দুজন অন্তত ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় নি। যদিও তিনি স্বীকার করতে ভোলেন নি, তারা তিনজন যদি বেঁচেও থাকেন তবুও এই দুঃসাহসী কাজের গুরুত্ব কোনোভাবেই কমে না। গণমাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ভ্যালেরি বেজপালভ এবং অ্যালেক্সি আনানেকো বেঁচে ছিলেন ২০২০ সাল পর্যন্তও।
এই বইয়ের তথ্যের সত্যতা জানতে আরও গবেষকদের বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে একটি ব্যাপারে সকলেই একমত, এই তিন অসমসাহসী মানুষ মানবজাতিকে ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম মৃত্যুর মিছিলের অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা করেছিলেন। জীবনের ঝুঁকি তো অবশ্যই ছিল। সেটা জেনেও তারা নেমে পড়েছিলেন পুলের মধ্যে। এর চেয়ে দুঃসাহসী অভিযান আর কী হতে পারে! অমন কঠিন মুহূর্তে জীবন বাজি রেখে যারা এগিয়ে এসেছিলেন অজস্র মানুষের প্রাণ বাঁচাতে, সেই মহত্তম তিন মানবকে পৃথিবী অনন্তকাল স্মরণ করবে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা নিয়ে।