নতুন অভিযান
ব্রিটিশরা লড়াই থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে রয়ে গেলেন শুধু লুই। তার ব্যবস্থা করতে প্রিন্স অফ অরেঞ্জ উইলিয়াম সংকল্পবদ্ধ হলেন। ১৬৭৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্টাডহোল্ডারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন ৬৭ বছর বয়স্ক ডি রুইটার। উইলিয়াম তার সাথে আলোচনার পর নৌবহরের বাজেট কাটছাঁট করে সেনাবাহিনীর পেছনে অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিলেন।
ফরাসিদের একটা শিক্ষা দেবার গোপন পরিকল্পনাও করেন উইলিয়াম। ক্যারিবিয়ানে ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন দ্বীপপুঞ্জ (French Antilles) আর ফ্রান্সের উপকূলে হামলার কথা পাকা হলো। ডি রুইটার অ্যান্টিলসে আক্রমণের পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি নিজেই এই ভার নেন। ট্রম্পের ঘাড়ে চাপল ফরাসি উপকূলে আক্রমণের দায়িত্ব।
ডাচ বহরে তখন মোট ১৫০টি জাহাজ। এর ৫৪টি ভারি জাহাজ, ১২টি ফ্রিগেট, আর ৮৪টি হালকা রণতরী যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাত প্রদেশে। সব মিলিয়ে ১৮,৪০০ নাবিক আর ২,৭০০ মেরিন সেনা ডাচ নৌবাহিনীতে কর্মরত। কথা ছিল- উইলিঙ্গেনে ডি রুইটারের সাথে অন্যান্য প্রদেশ থেকে আসা বহর একত্রিত হবে। কিন্তু খারাপ আবহাওয়া একে বিলম্বিত করে।
ডি রুইটার আগে আগে রওনা দিতে চাইলেও আবহাওয়ার কারণেই তার জাহাজ সেভেন প্রভিন্সেসে’র (De Zeven Provinciën) পাল তুলতে তুলতে মে-র ১৪ তারিখ চলে আসে। ২৭ তারিখ তিনি ডোভারের কাছে এসে পৌঁছেন। জুনের ৯ তারিখ ৫৬টি জাহাজে ১১২টি কামান, ৪,৩৩৬ জন নাবিক আর কয়েক হাজার সৈনিক নিয়ে তিনি ব্রিটিশ জলসীমা ছেড়ে এলেন। তার পুরনো সহকারী ভ্যান নেস আর ব্যাঙ্কার্ট এবারো তার সঙ্গে আছেন, ছেলে এঙ্গেলও বহরে যোগ দিয়েছেন। ট্রম্প রয়ে গেছেন ইংলিশ চ্যানেলে ফরাসিদের উপর আঘাত হানার আকাঙ্ক্ষায়।
এদিকে যাত্রায় দেরি হওয়ায় ডাচ পরিকল্পনা আর গোপন ছিল না। লুই ট্রম্পের মোকাবেলা করতে তৈরি হতে লাগলেন। ক্যারিবিয়ানে খবর পাঠানো হলো যে শত্রুরা সেখানে আক্রমণ করতে আসছে। ডি রুইটার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিন ভাগে বহরকে ভাগ করে এগিয়ে চলছিলেন। এঙ্গেলকে আগে আগে পাঠানো হলো রসদপত্রের জন্য নিরাপদ ঘাঁটি সন্ধান করতে।
২১ জুন দিগন্তে ভেসে উঠল আফ্রিকার উত্তর-পূর্বে পর্তুগালের ম্যাডেইরা দ্বীপপুঞ্জ। এর তিন দিন পরেই আটলান্টিকে স্প্যানিশ দ্বীপ টেনেরিফের কাছে এসে পৌঁছল ডাচ বহর। এখানে সান্টা ক্রুজ বন্দরে নোঙর করলেন ডি রুইটার। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করে আবার যাত্রা শুরুর পর জুলাইয়ের ২ (মতান্তরে ১৯) তারিখে মার্টিনিক আর সেন্ট লুসিয়া বরাবর এসে পড়ল ডাচরা।
ডি রুইটার ক্যাপ্টেন লিনকোর্টকে তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠালেন। লিনকোর্ট খবর নিয়ে এলেন- ফরাসিরা ডি রুইটারের আগমন সম্পর্কে অবগত, এবং তারা প্রতিরক্ষার সমস্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অঞ্চলে থেকে পণ্যবাহী সমস্ত ফরাসি জাহাজ ১০-১৫ দিন আগেই চলে গেছে, ফলে সহজ শিকারগুলোও ফস্কে গেছে ডাচদের হাত থেকে। দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য আবহাওয়ার প্রতি অভিসম্পাত করতে করতে ডি রুইটার প্রস্তুতি নিলেন ফরাসিদের মোকাবেলার।
ফোর্ট রয়্যাল
মার্টিনিকের সৈকতের অনতিদূরে শক্তিশালী ফরাসি এই দুর্গ। ৪০০-৫০০ সৈন্য ২০টি কামান লাগিয়ে দুর্গের প্রাচীরে সদাপ্রস্তুত। আশেপাশের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে আগুয়ান শত্রুদের উপর হামলা করাও খুব সহজ। দুর্গের পশ্চিমের পাহাড়েও একটি চৌকি বসানো। দ্বীপের বন্দরে ৫-৬টি ফরাসি জাহাজ অপেক্ষমান, তাদের সাথে ৪০টি কামান। দুর্গের দিকে যেকোনো অভিযানে তারা বাধা দেবে।
১৬৭৪ সালের ২০ জুলাই, সকাল ১১টা।
দুর্গের পশ্চিম দিকের সৈকতে মেরিন সেনা নামিয়ে দিলেন ডি রুইটার। নৌবহর দূরে রেখে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে সেনাদের আক্রমণের জন্য তীরে পাঠানো হয়। প্রায় ১,০০০ সেনার এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল উইটেনহোভ। তবে অতর্কিত হামলা চালানোর কোনো সুযোগ ছিল না, যেহেতু ফরাসিরা জানত ডি রুইটার এসেছেন ফরাসি ঘাঁটিতে আঘাত হানতেই, ফলে ক্যারিবিয়ানে তাদের সমস্ত অবস্থানই অত্যন্ত সুরক্ষিত করা হয়েছিল। সুতরাং প্রথম থেকেই ডাচরা পিছিয়ে ছিল।
উইটেনহোভ দুর্গের দিকে এগোতে থাকলে বন্দরের ফরাসি জাহাজের কামান গর্জে উঠল। দুর্গ থেকে বেরিয়ে ফরাসিরা জঙ্গলের ভেতরে আড়াল নিয়ে বন্দুক ছুড়তে থাকে অগ্রসরমান ডাচদের দিকে। পাহাড়ের দিক থেকেও গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ডি রুইটার দেখতে পেলেন- এই হামলা সফল হবার সম্ভাবনা নেই। কোনোভাবে দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও বন্দর থেকে যে হারে গোলা ফেলা হচ্ছে তাতে দখল বজায় রাখা সম্ভবপর হবে না। ফলে রাতের আঁধারে তিনি উইটেনহোভকে তুলে নেন। ১৪৩ জন ডাচ সৈনিক ব্যর্থ এই অভিযানে নিহত হয়, ৩৭৮ জন হয় আহত। জাহাজে পানি আর জ্বালানী কাঠের অভাবে পুনরায় হামলা করার সুযোগও ছিল না।
২৩ জুলাই ডি রুইটার ডমিনিক দ্বীপে চলে যান, সংগ্রহ করলেন প্রয়োজনীয় মালামাল। দিন দুই পর সব অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন তিনি। সিদ্ধান্ত হলো- ক্যারিবিয়ানে সুবিধা করা যাবে না। যদি অতর্কিতে তারা অভিযান চালাতে পারতেন তাহলে সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু দেরিতে রওয়ানা দেয়ায় সেই সুযোগ তারা খুইয়েছেন। ইত্যবসরে ফরাসিরা সব জায়গায় শক্ত প্রতিরক্ষা বসিয়েছে। ফলে লড়াই করলে অনর্থক প্রচুর মেরিনের প্রাণ যাবে। কাজেই পরদিন দেশের পথে পাল তুলল ডাচ নৌবহর। ৩০ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে এলেন ডি রুইটার।
ক্যারিবিয়ান অভিযানের ব্যর্থতা নিয়ে উইলিয়াম খুব রুষ্ট হননি। কারণ ১৬৭৩ সালেই তিনি ডাচ ভূখণ্ড থেকে ফরাসিদের তাড়াতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার সাথে যোগ দিয়েছে স্পেন, হলি রোমান এম্পায়ার, আর লরেইনের সেনারা। লুইয়ের সাথে একমাত্র সুইডেন ছাড়া আর কেউ নেই। তবে তিনি স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডসে শক্ত হয়ে বসেছেন।
চার্লসের আমন্ত্রণ
১৬৭৪ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ড সফরের আমন্ত্রনপত্র বয়ে নিয়ে এলেন দুই ব্রিটিশ অভিজাত নাগরিক। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড আরলিংটন আর তার সঙ্গি লর্ড ওসি। ডি রুইটার আর ট্রম্পকে চার্লস তার অতিথি হবার অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা ডি রুইটারের হাতে রয়্যাল নেভির অ্যাডমিরাল বেকওয়েলের একটি পত্রও তুলে দেন, যেখানে যুবরাজ রুপার্ট আর ডিউক অফ ইয়র্ক তাদের এককালের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ডি রুইটার তখন পরিবারের সাথে শান্ত অবসর কাটাতে ইচ্ছুক, ফলে চার্লসের অনুরোধ ভদ্রভাবে ফিরিয়ে দিলেন তিনি। তবে ট্রম্প ইংল্যান্ড ঘুরে এলেন।
১৬৭৫ সাল অবধি নির্ঝঞ্ঝাটে কাটিয়ে দেন ডি রুইটার। ফরাসিদের সাথে কার্যত লড়াই জারি থাকলেও নেদারল্যান্ডসের মূল ভূখণ্ডে তাদের কোনো উপস্থিতি আর ছিল না, ফলে দেশের প্রতি তেমন বড় কোনো হুমকি এই মুহূর্তে নেই। ডি রুইটার মনে করলেন- তার কাজ শেষ হয়েছে, এবার স্ত্রী আর সন্তানদের মাঝে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন।
স্পেনের ডাক
নেদারল্যান্ডসের সাথে জোট বাধায় লুই স্পেনের উপর যারপরনাই ক্ষুব্ধ ছিলেন। সিসিলি ছিল স্পেনের অধিকারে, সেখানে ফরাসি গুপ্তচরদের উস্কানিতে ১৬৭৩ সালে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। মেসিনা শহরে বিদ্রোহীরা বেশ সফলতা লাভ করে। ইতালির মেসিনা ছিল স্পেনের অধীনে। একে কেন্দ্র করে ভূমধ্যসাগর আর তার পার্শ্ববর্তী ইতালীয় অঞ্চলে ফরাসি প্রভাব বাড়তে থাকলে স্প্যানিশরা শঙ্কিত হয়ে পড়ল।
মেসিনাতে স্প্যানিশ নৌবাহিনী অবরোধ জারি করে। মেসিনার বিদ্রোহীরা লুইয়ের সহায়তা প্রার্থনা করলে এই অঞ্চলের সাগরে আগমন ঘটল ফরাসি নৌবাহিনীর। ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৬৭৫ সালে তারা লিপারা দ্বীপের যুদ্ধে স্প্যানিশ অবরোধ ভেঙে ফেলে। বিপদগ্রস্ত স্প্যানিশরা ১৬৭৫ সালে নেদারল্যান্ডসের কাছে নৌ সহায়তা প্রার্থনা করে, এবং ডি রুইটারকে ডাচ বহরের ভার নিতে অনুরোধ জানায়। তাদের সাথে ২২টি স্প্যানিশ জাহাজও যোগ দেবে।
এই সময় ডাচ নৌবহর খুব ভাল অবস্থায় ছিল না। ডি উইট নৌবাহিনী সাজাতে গিয়ে যেমন সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করেছিলেন, ততটা না হলেও উইলিয়াম সেনাবাহিনীর পেছনে যতটা মনোযোগ দিয়েছিলেন নৌবহরের ব্যাপারে ততটা দেননি। অনেক জাহাজও মেরামত করা হচ্ছিল। হাতে থাকা জাহাজগুলোও তেমন মানসম্পন্ন নয়। সর্বোপরি, ফরাসিদের মোকাবেলা করতে ভারি জাহাজের কমতি ছিল ডাচদের।
এস্টেট জেনারেলরা ডি রুইটারের হাতে ১৮টি রণতরী তুলে দেন, সাথে চারটি ফায়ারশিপসহ ১২টি হালকা জাহাজ। সব মিলিয়ে এতে ছিল ১,০১২টি কামান, আর ৪,৮০০ লোক। ডি রুইটার ভাল করেই জানতেন- এই বহর নিয়ে ফরাসিদের মুখোমুখি হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি লিখিতভাবে জাহাজ আর সরঞ্জামের অপ্রতুলতার কথা এস্টেট জেনারেলদের অবহিত করলেও তারা ডি রুইটারের পত্র উপেক্ষা করেন।
কোনো কোনো নিন্দুক অভিযোগ করে বসে- বয়সের ভারে তাদের অ্যাডমিরাল ন্যুব্জ হয়ে গেছেন, তার বুকে আগের মতো আর বল নেই। ডি রুইটার জবাব দিলেন- তাকে একটিমাত্র জাহাজ দিয়েও যদি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে বলা হয়, তাহলেও তিনি সাগরে বেরিয়ে পড়বেন। তার আক্ষেপ শুধু এই জায়গাতে যে- এত স্বল্প জনবল নিয়ে নেদারল্যান্ডস বিশাল ফরাসি নৌবহরের সাথে শক্তি পরীক্ষায় নামতে চাচ্ছে। এতে নেদারল্যান্ডসের সম্মানেই আঘাত লাগতে পারে।
সত্যিকার অর্থে নতুন জাহাজ তৈরি আর পুরনো জাহাজ মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ তখন তাদের হাতে ছিল না। ডি রুইটারও দ্বিরুক্তি না করে দেশের ডাকে আরেকবার সাড়া দিতে স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।