২০১৫ এর জুন। মনিপুরের চান্দেল জেলায় একদল বিদ্রোহীর আক্রমণে নিহত হয় ১৮ ভারতীয় সৈন্য। পাল্টা জবাব হিসেবে ভারতীয় সেনারা মায়ানমারের ভেতর হামলা চালায় ও অন্তত বিশজন বিদ্রোহীকে হত্যা করেছে বলে জানায়। সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে বিশেষ শোর ওঠেনি। তবে বহু দশক ধরে লড়তে থাকা এই বিদ্রোহীদের চমকপ্রদ ইতিহাস আছে। উল্লেখ্য, চান্দেলে আক্রমণের জন্য ভারতীয়রা যাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, তারা মূলত ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অভ নাগাল্যান্ড (খাপলাং) এর সদস্য।
উত্তর-পূর্ব ভারত আর মায়ানমারের উত্তর-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র বিপ্লব খুব পরিচিত ঘটনা। এখানে সরকারের হাত স্বভাবতই দুর্বল, আর স্বাধীনচেতা এ জাতিগুলোর অনেকে বহু দূরে অবস্থিত রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসনে নারাজ। দেশভাগের ফেরে পরে অনেক জাতিই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের সশস্ত্র আন্দোলন এর ফলে হয়ে উঠেছে আরো জটিল, আরো সংগ্রাম মুখর। আজকের আয়োজন মূলত ভারত আর মায়ানমারের নাগাদের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে।
নাগা ও নাগাদের দেশ
মায়ানমার আর ভারতের সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে নাগা পার্বত্য অঞ্চল। ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্য ছাড়াও আসাম, মনিপুর, অরুণাচলে বহু নাগা বসবাস করে। মায়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে নাগা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসহ অনেক স্থানে নাগারা বসবাস করে। সব মিলিয়ে লক্ষাধিক বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে সংখ্যায় তারা তিরিশ লক্ষের বেশি। মায়ানমারের নাগা অধ্যূষিত অঞ্চলকে পূর্ব নাগাল্যান্ড বলে অনেকে। পাহাড়চূড়ায় সুরক্ষিত দুর্গ সদৃশ গ্রামে বসবাসকারী এই পার্বত্য জাতি অনেকগুলো গোত্রে বিভক্ত। অতীতে গৃহবিবাদ আর পার্শ্ববর্তী জাতিগুলোর সাথে নাগাদের যুদ্ধ-ফ্যাসাদ লেগেই থাকতো।
পরাস্ত প্রতিপক্ষের মুণ্ডু কেটে নেওয়ার রীতি থাকায় নাগারা বেশ আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ছিল বলা চলে। পরে খ্রিষ্টধর্ম এবং আধুনিক রীতিনীতির পাল্লায় পড়ে তাদের মধ্যে ক্রমশ একটা ঐক্য গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক সচেতনতা আর আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
প্রেক্ষাপট
ব্রিটিশ আমলে আসাম সংলগ্ন অঞ্চলে নাগা আক্রমণ ছিল পরিচিত ঘটনা। ১৮৮০ এর দিকে ব্রিটিশরা নাগা অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। ১৮৮৭ সালে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা মায়ানমারকে ভারতীয় উপনিবেশের অংশ হিসেবে জুড়ে নেয়। পরে, শাসনের সুবিধার্থে ১৯৩৭ সালে মায়ানমারকে আলাদা করা হয়। কিন্তু সীমান্ত অঞ্চলে অসংখ্য পার্বত্য জাতি এতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আসামের গভর্নর রবার্ট রেইড ১৯৪১ সালে নাগা আর চিন-লুসাই জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে ভারত থেকে পৃথক করার প্রস্তাব দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সব ভেস্তে গেল।
যুদ্ধে জাপানীদের বিরুদ্ধে নাগা আর কাচিনদের পাশাপাশি অনেকগুলো গোত্র অংশ নিয়েছিল। ব্রিটিশরা এদের জন্য পৃথক অঞ্চল গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজও শুরু করেছিল। কিন্তু পরে ক্লিমেন্ট অ্যাটলির সরকার এসে সব বন্ধ করে ভারতের স্বাধীনতার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন।
স্বাধীনতা আন্দোলন: ভারত
১৯৪৭ সালে, ভারতের স্বাধীনতার কয়েক সপ্তাহ পূর্বে, নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল (এনএনসি) এর সাথে ভারতের কর্তাদের নয় দফা সমঝোতা হয়। সমস্যা হচ্ছে, এই সমঝোতার একটি ধারা নিয়ে দুই পক্ষ দু’ রকম অর্থ করে বসলো। ভারত বলল, দশ বছর পর নাগারা আরো বিস্তারিত একটা চুক্তি স্বাক্ষর করবে। আর নাগাদের বক্তব্য হলো, দশ বছর ভারতের সাথে থাকবার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবে। এ নিয়ে বেঁধে গেল গোলমাল এবং ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট, অংগামী জাপু ফিজোর নেতৃত্বে এনএনসি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসলো। তবে ভারত সেনা পাঠায় এবং আর্মড ফোর্সেস (স্পেশাল পাওয়ার্স) অ্যাক্ট প্রয়োগ করে। এনএনসি দুর্গম অঞ্চলগুলোতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে থাকে।
১৯৬৩ সালে নাগা প্রদেশ গঠন করা হলেও এনএনসি নেতারা পূর্ব নাগাল্যান্ডে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলতে থাকে। জাপু ফিজো তখন লন্ডনে পালিয়ে আছেন। দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে। তবে ১৯৭৫ সালে শিলং চুক্তির ফলে এনএনসি-এর অনেক কর্তা সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়।
স্বাধীনতা আন্দোলন: মায়ানমার
১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট, মায়ানমারের পূর্ব নাগাল্যান্ডে নাগা ন্যাশনাল কনভেনশনও স্বাধীনতা ঘোষণা করল। তাদের নিজস্ব কারণ ছিল। মায়ানমারের এ অঞ্চলে ভারতীয় অংশের থেকেও বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে। এখন রেঙ্গুনের শাসন তারা মানতে রাজি হলো না। ১৯৪৭ সালে ঐতিহাসিক পাংলং সমঝোতাতে মায়ানমারের সব জাতিকেই পর্যাপ্ত স্বায়ত্ত্বশাসনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জেনারেল অং আততায়ীর হাতে নিহত হলে সেই চুক্তি আর ঠিকভাবে কার্যকর হয়নি।
পূর্ব নাগাল্যান্ড অত্যন্ত দুর্গম, নাগারা নিজেরাও মারমুখো জাত। প্রশাসনিকভাবে অঞ্চলটি সাগাইং অঞ্চলের আওতাধীন। দুর্গম পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বহু বিমান দুর্ঘটনা এবং করুণ মৃত্যুর সাক্ষী। কোনো রাস্তাঘাট না থাকায় ঐ অঞ্চলে সরকারের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ১৯৬২ সালে জেনারেল নি উইন ক্ষমতা দখল করে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেন, বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। এদিকে প্রতিবেশী কাচিনদের সাথে সংঘর্ষ বেঁধে গেল এক টুকরো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তো কাচিন আর বর্মীদের অব্যাহত আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নাগারা ক্রমশ দলবদ্ধ হলো। গঠিত হলো ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের অস্ত্রের কমতি ছিল না। গোটা সত্তরের দশকটা নাগারা কাচিন আর তাতমাদাও-এর বিরুদ্ধে সাফল্যের সাথে লড়াই চালায়। পূর্ব নাগাল্যান্ডের কর্তৃত্ব চলে যায় ইস্টার্ন নাগা রেভোল্যুশনারী কাউন্সিল (ইএনআরসি) নামক সংগঠনের হাতে। এর অন্যতম নেতা ছিলেন এস খাপলাং।
সংঘবদ্ধ আন্দোলন ও গৃহবিবাদ
এনএনসির বড় বড় কয়েকজন হর্তাকর্তা আর অনেক ক্যাডার ভারত সরকারের সাথে আলোচনাকে ভালোভাবে নেয়নি। অনেকেই তখন চীনে প্রশিক্ষণরত। তারা সীমান্ত পেরিয়ে ইএনআরসি-তে যোগ দেন। এভাবে ১৯৮০ সালে গঠন করা হয় ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অভ নাগাল্যান্ড (এনএসসিএন)। এই প্রথম ভারত আর মায়ানমারের দুই অঞ্চলেই একক নেতৃত্বের আওতায় এলো। ভাইস চেয়ারম্যান আইজ্যাক চিসি, ডেপুটি এস খাপলাং আর সাধারণ সম্পাদক থুইনগালেং মুইভা।
গঠিত হলো নাগা গণ প্রজাতন্ত্র সরকার (জিপিআরএন)। পররাষ্ট্র, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে ২০ জন কিলোনসের বা মন্ত্রী, তাদের অধীনে রাজাপিউ (তিনটি গ্রামের শাসক) এবং রানাপিউ (১টি গ্রামের শাসক) নিয়োগ দেওয়া হলো। চীনা আর কাচিন সাহায্য এলো অল্পবিস্তর। ফলাফল হলো চমৎকার। ১৯৮৫ সাল নাগাদ পূর্ব নাগাল্যান্ড তো বটেই, অরুণাচল, মনিপুর আর ভারতের নাগাল্যান্ডের অধিকাংশ অঞ্চলেই এনএসসিএন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলো।
তবে এনএনসি আর এনএসসিএনর মধ্যে সংঘর্ষে বহু লোক মারা যায়। মায়ানমারেও কোনো গ্রাম অবাধ্য হলে এনএসসিএনের সেনারা হামলা চালাত। গ্রামকে গ্রাম মাটিতে মিশিয়ে দিল খোদ নাগারাই। এসব সংঘর্ষে ফল হলো- ১৯৮৮ সালে খোদ আইজ্যাক আর মুইভা এনএসসিএন ভেঙে ভারতের সাথে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেন। খাপলাং-এর সেনারা কোনোভাবে এ সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে হামলা চালায় এবং আইজ্যাক-মুইভাহয়ের শতাধিক লোক খতম করে। উলফার সহযোগিতায় এই নেতারা পরে আসামে পালিয়ে যান। শুরু হলো ভাঙন।
১৯৮৮ সাল নাগাদ দেখা গেল, খাপলাং পূর্ব নাগাল্যান্ডে এবং আইজ্যাক-মুইভাহ ভারতীয় নাগাল্যান্ডে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে মায়ানমারে আসে ১৯৯০ সালের নির্বাচন। একদল নাগা নাগা হিলস রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট পার্টি টিকিটে নির্বাচন করলেও জয়ীদেরকে নানা উছিলায় বাদ দেওয়া হয় ও নাগা প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই, খনিজ আর বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ অনেক অঞ্চল বাদ দিয়ে নাগাদের একটা নামে মাত্র স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল গঠন করে দেওয়া হলো। পাল্টা জবাব হিসেবে খাপলাং শুরু করলেন অপারেশন দাও। জোর সংঘর্ষ বেঁধে গেল।
দু’পক্ষই অবাধে হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করলো। তবে, মায়ানমার এই দুর্গম অঞ্চলে অবিরাম যুদ্ধ চালানোটা সমীচীন মনে করল না। বিশেষত দেশ জুড়ে কাচিন, কারেন, শান আর তাংসহ অনেকগুলো জাতিভিত্তিক গেরিলা দল থাকায় তারা দুর্গম পূর্ব নাগাল্যান্ডে অভিযান চালানো একরকম বন্ধ করে দেয়। ২০০০ সাল নাগাদ একটা অলিখিত বোঝাপড়ার মাধ্যমে রক্তপাতের সাময়িক ইতি ঘটে। পরে ২০১২ সালে একে লিখিত রূপ দেওয়া হয়। খাপলাং নিজের অধিকৃত অঞ্চলে অনেকটা নিরুপদ্রবে শাসন চালাতে শুরু করেন। আসাম আর মনিপুরের অনেকগুলো বিদ্রোহী দলও নাগাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে থাকে।
আইজ্যাক-মুইভাহ আবার আলাদাভাবে ১৯৯৭ সালে ভারত সরকারের সাথে আলোচনায় বসেন। ভারতের নাগাল্যান্ড এবং মনিপুর, আসাম, অরুণাচলের অন্যান্য নাগা অধ্যুষিত অংশ নিয়ে বৃহত্তর নাগা প্রদেশ বা নাগালিম গঠন হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। খাপলাং-এর দলকে ক্রমেই ভারতীয় নাগাল্যান্ড থেকে হটিয়ে দিতে থাকেন তারা। ওদিকে ২০০১ সালে খাপলাং ও ভারতের সাথে অস্ত্রবিরতি মেনে নেন। ২০১১ নাগাদ তার দলে আরেক দফা ভাঙন ঘটে। এসব মতবিরোধই অস্ত্রবিরতি বা শান্তিচুক্তি নিয়ে নেতাদের অনৈক্যের ফল বলা চলে।
বর্তমান
২০১৫ সালে মায়ানমারে এনএসসিএন (খাপলাং), ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা), কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অভ বোড়োল্যান্ড (এনডিএফবি) মিলে ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্ট অভ ওয়েস্টার্ন সাউথ ইস্ট এশিয়া গঠন করেছে। আগের অস্ত্রবিরতি বাতিল করা হয়। উল্লেখ্য, এই জোটই মনিপুরের হামলার জন্য দায়ী ছিল। ২০১৭ সালে হৃদরোগে খাপলাং-এর মৃত্যু হয়। তার সংগঠন থেকে আরো দুই-তিনটি শাখা বের হয়েছে, প্রত্যেকেই মায়ানমারের সাথে দেন-দরবারে ব্যস্ত। আইজ্যাকের মৃত্যু হয় তার আগের বছর। বছর পাঁচেক আগে মুইভাহ ভারতের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করলেও ২০১৯ নাগাদ এই অগ্রগতি আবার ভেঙে পড়েছে বলা চলে।
আপাতত ভারত আর মায়ানমারের অসংখ্য স্বাধীনতা-স্বায়ত্ত্বশাসন আন্দোলনকারীদের মতো নাগারাও নানা ভাগে বিভক্ত। ভারত আর মায়ানমার সরকার এই বিভক্তির সুযোগ নিয়ে বারবার স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করেছে। নাগা নেতারা নিজেরাও অন্তর্দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন অসংখ্যবার। কাজেই দশকের পর দশক ধরে দুই দেশে বিচ্ছিন্ন এই আন্দোলন সফল হবে কি না, সেটা ভবিষ্যতই ভালো জানে।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে