আইনস্টাইন কেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি?

সর্বকালের সেরা পদার্থবিজ্ঞানীদের তালিকায় বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নামটি সবচেয়ে উপরের দিকেই থাকবে। অনেকের মতেই, তার মতো বিজ্ঞানী হয়তো আর কখনোই আসবে না। তবে শুধু বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য নয়, জন্মভূমি জার্মানিতে হিটলারের নাৎসিবাহিনীর উত্থানে ব্যথিত হওয়া, ইউরোপে ইহুদিদের ন্যূনতম মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা কিংবা তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি সংহতি জানানোর জন্যও তাকে আলাদাভাবে স্মরণ করা হয়।

বিজ্ঞানীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের যে ধারণা (তারা নাওয়াখাওয়া ভুলে সবসময় গবেষণাগারে পড়ে থাকেন, বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে সেগুলো ধর্তব্যে নেন না) সেটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি গবেষণাগারের বাইরে এসেও সমসাময়িক অনেক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, লেখালেখি করেছেন। তিনি যেমন একজন তুখোড় বিজ্ঞানী ছিলেন, একইসাথে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকাও পালন করেছিলেন। এজন্য আর দশজন বিজ্ঞানীর সাথে তাকে মেলালে বোধহয় ভুলই হবে।

Image Courtesy: News 18

আইনস্টাইন ছিলেন তার সময়ের অন্যতম বড় তারকা। তিনি কত বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন সেই প্রমাণ এটাই যে, তার মৃত্যুর পর পেরিয়ে গিয়েছে ষাট দশকেরও বেশি সময়, কিন্তু এখনও তার অর্জন, ও পদার্থবিজ্ঞানে তার অবদান নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যাওয়া আপেক্ষিকতার সূত্র যখন প্রথম উপস্থাপন করা হয়, তখন সেটি বুঝতে পেরেছিল খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। পরবর্তীতে তার দেয়া সূত্র ধরেই ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের মতো জটিল বিষয়গুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রামাণিক ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে। আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে পরমাণু বোমা তৈরির যে ম্যানহাটন প্রকল্প হাতে নেয়, সেই প্রকল্প শুরুর পেছনে আইনস্টাইনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

জআহু
আলবার্ট আইনস্টাইন পৃথিবীর ইতিহাস সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন; image source: sp-global.com

আইনস্টাইন বেড়ে ওঠেন জার্মানিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভাইমার প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং সেই পর্যন্ত জার্মানিতে ইহুদিদের অবস্থা তুলনামূলক ভালই ছিল। বিপত্তি বাধে যখন ভাইমার প্রজাতন্ত্রের কাছ থেকে ধীরে ধীরে নাৎসিদের হাতে জার্মানির শাসনভার চলে যেতে শুরু করে। ভাইমার প্রজাতন্ত্র ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে, অপরদিকে জার্মান সমাজের সামগ্রিক মনোভাব কাজে লাগিয়ে নাৎসি পার্টি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং একসময় শাসনক্ষমতা দখল করে।

হিটলার ও তার নাৎসি পার্টি যখন জার্মানির ক্ষমতা দখলে ব্যস্ত, তখন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন পেশাগত কারণে আমেরিকায় ভ্রমণ করছিলেন। যখন তার কাছে খবর পৌঁছায় যে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটেছে এবং হিটলার ক্ষমতা দখল করেছেন, তখন তিনি আমেরিকায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ আইনস্টাইন ছিলেন জাতিতে ইহুদি, জার্মানিতে অবস্থানকালে হিটলারের উত্থানের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। নাৎসিদের কারণে জার্মানিতে ইহুদীবিদ্বেষ তখন চূড়ান্ত মাত্রা লাভ করেছিল।

হআহআজব
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বেড়ে উঠেছিলেন জার্মানিতে; image source: cs.mcgill.ca

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ ছিল ইহুদিরা। স্রেফ ইহুদি হওয়ার জন্যই তাদের উপর চালানো হয়েছিল গণহত্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের চালানো বিভীষিকা অবলোকন করে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই নতুন ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য সমর্থন আদায়ে নেমে পড়েন। তিনি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে নিজ হাতে লেখা চিঠি প্রেরণ করেন যাতে করে তারা ইসরায়েলকে কূটনৈতিকভাবে সমর্থন প্রদান করে। ইসরায়েল প্রথম প্রেসিডেন্ট ভাইৎসমান ছিলেন আইনস্টাইনের কাছের বন্ধু। আমেরিকার সমর্থন আদায় করা সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাইৎসমান ও আইনস্টাইনের জোরালো প্রচেষ্টায় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আমেরিকা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ভাইৎসমান ১৯৪৯ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

হগুতিত
ভাইৎসমানের সাথে আলবার্ট আইনস্টাইন; image source: pinterest.com

ভাইৎসমান নিজেও ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। আইনস্টাইনের মতো তিনিও জীবদ্দশায় ইহুদিদের অধিকার ও আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে কথা বলেছিলেন। আইনস্টাইনকে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন ‘সর্বকালের সেরা ইহুদি’ হিসেবে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার চার বছর পরে, ১৯৫২ সালে, তিনি মারা যান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ইহুদিরা তার অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। কিন্তু তার মৃত্যু ইসরায়েলের তৎকালীন নেতৃত্বকে এক সংকটে ফেলে দেয়।

ইসরায়েলের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন– এ নিয়ে বেশ বিতর্ক শুরু হয় ইসরায়েলে। প্রার্থী ছিলেন অনেকেই, কিন্তু তাদের মধ্য থেকে সেরা ব্যক্তিকে বেছে নেয়া ছিল বেশ কঠিন কাজ। এটা ধরেই নেয়া হচ্ছিল, যেসব বিখ্যাত ও জননন্দিত ব্যক্তি ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্য থেকেই একজনকে বেছে নেয়া হবে। অবশেষে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন মনস্থির করেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছেই ইসরায়েলের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হবে। এ নিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন।

১৯৫২ সালের ১৬ নভেম্বর বেন গুরিয়ন সরাসরি আমেরিকার ইসরায়েলি দূতাবাসে চিঠি লেখেন। সেসময় দূতাবাসের প্রধান কর্তাব্যক্তি ছিলেন আব্বা এবন। আইনস্টাইন ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতিত্ব গ্রহণে রাজি আছেন কি না– এর উত্তর বের করার দায়িত্ব দেয়া হয় আব্বা এবনের উপর।

প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে চিঠি পাওয়ার পরের দিনই আব্বা এবন আইনস্টাইনের কাছে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়ে চিঠি লেখেন। ইসরায়েলের সংবিধান অনুযায়ী, যদি আইনস্টাইন রাষ্ট্রপতি হতে চান, তাহলে খুব দ্রুত ইসরায়েলে আসতে হবে এবং ইসরায়েলের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে। সেই সাংবিধানিক শর্তের উল্লেখ করেই আব্বা এবন আইনস্টাইনের কাছে চিঠি লেখেন। পরদিনই আইনস্টাইন চিঠির জবাব নিয়ে সরাসরি বেন গুরিয়নের কাছে নিজের উত্তর পেশ করেন। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,

“আমাদের ইসরায়েল রাষ্ট্রের দেয়া প্রস্তাবে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। একইসাথে আমি দুঃখিত ও লজ্জিত বোধ করছি, কারণ এই প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারছি না। জীবনের পুরোটা সময় আমি ব্যয় করেছি বস্তুগত বিষয়গুলোর রহস্য উদঘাটন করতে, তাই গণমানুষের সাথে কাজ করা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করা– এসবের জন্য যে অভ্যাসগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, তার অভাব রয়েছে আমার মধ্যে। শুধু এই কারণগুলোর জন্যই আমি প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হবো এবং বার্ধক্যের জন্য আগের শক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য আমি সত্যিই অনেক দুঃখিত, যেহেতু ইহুদি জনগণের সাথে আমার আমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের বিপন্ন অবস্থা আমি অবলোকন করেছি।”

ওবওগপগ
ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের সাথে আলবার্ট আইনস্টাইন; image source: albert.ias.edu

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের কাছে লেখা চিঠির এই অংশ পড়লেই বোঝা যায়, বিজ্ঞানী আইন্সটাইন আসলে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক যে গুরুদায়িত্ব, সেটি পালন করতে তেমন আগ্রহী ছিল না। তিনি জীবনের বিভিন্ন সময় ইহুদিদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। এসব কাজের জন্য ইসরায়েলসহ পৃথিবীর সমস্ত ইহুদি তাকে পছন্দ করত। তারাও প্রত্যাশা করেছিল তাদের রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধানের দায়িত্ব এরকম একজন জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তির হাতেই যাক। কিন্তু আইনস্টাইন এসব রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কিংবা ক্ষমতা ভোগের বিষয়ে সবসময়েই উদাসীন ছিলেন।

আইনস্টাইন যদি প্রেসিডেন্ট হতেন, তাহলে তার বৈজ্ঞানিক কাজকর্মে কি সেটা প্রভাব ফেলত? তাকে কি বিজ্ঞানের জগত থেকে সরে আসতে হতো? উত্তর হচ্ছে, না। ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে যদি তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার যে ব্যয়, তার পুরোটুকু রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে প্রদান করা হবে।

তিনি যদি ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হতেন, তাহলে কি ইসরায়েল ফিলিস্তিনের উপর আগ্রাসন চালানো থেকে বিরত থাকতো? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকেই মনে করেন, জায়নবাদী রাষ্ট্রের সমর্থক হলেও তিনি কখনোই আরবদের উপর আগ্রাসন মেনে নিতে পারতেন না। হয়তো তাকে এজন্য ইসরায়েল সমাজের জনসমর্থন হারিয়ে পদত্যাগ গ্রহণও করতে হতো! তবে এসব শুধুই অনুমান। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করায় এসবের উত্তর কখনও পাওয়া হয়নি।

Related Articles

Exit mobile version