পানি ছাড়া যেমন আমরা খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারি না, তেমনি বিভিন্ন রকম ‘পানীয়’ ছাড়া বেঁচে থাকার স্বাদটাই কেমন যেন পানসে ঠেকে অনেকের কাছে। এর মাঝে প্রথমটি দরকার শরীরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, আর দ্বিতীয়টি দরকার আত্মার পরিতৃপ্তির জন্য, মানসিক শান্তির নিমিত্তে। আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় চায়ের কথাই ধরা যাক। চা পান করা যে মানুষগুলোর কাছে ভালোবাসার অপর নাম, তাদেরকে যদি এ পানীয়টি থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়, তাহলে সব থেকেও কী যেন ‘নেই নেই’ ঠেকে তাদের কাছে।
চা, কফি, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় আমাদের দেশের পানীয়গুলোর মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে বিশ্বজুড়ে এমন সব আজব পানীয়ও রয়েছে, যেগুলোর প্রস্তুতপ্রণালী শুনলে বিস্ময়ে যে কারো চোখগুলো গোল গোল হয়ে উঠতে বাধ্য। কারো গা যদি বিচিত্র এক অনুভূতিতে ঘিনঘিন করে ওঠে, তবে তাতেও খুব বেশি আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। কেন? সেই কথা তো একটু পরেই বুঝতে পারবেন!
হরিণের পুং জননেন্দ্রিয়ের ওয়াইন
খেলাধুলায় পারফর্মেন্স বর্ধক হিসেবে প্রাণীদেহের বিভিন্ন অঙ্গ ব্যবহারের ইতিহাস চাইনিজদের অনেক পুরনো। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তাদের ট্র্যাক কোচ মা জুনরেনের এক কথাতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের অজ্ঞাতনামা বেশ কিছু অ্যাথলেটের কতগুলো ওয়ার্ল্ড রেকডের পেছনের কারিগর হিসেবে তিনি একটি পানীয়র কথা বলেছিলেন যা কচ্ছপের রক্ত এবং শুঁয়োপোকার মিশ্রণ দিয়ে বানানো হয়েছিলো।
রোগ নিরাময়ের জন্য চাইনিজদের প্রস্তুতকৃত ওষুধের মাঝে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পুরুষ হরিণের লিঙ্গ। এটা তারা অনেকদিন আগে থেকেই ব্যবহার করে আসছে।
হরিণের এ ফিউচার জেনারেশন প্রোডাকশন মেশিনটি তার জীবিতাবস্থায়ই দেহ থেকে অপসারণ করা হয়, নাহলে নাকি সেটার ঔষধি গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। এরপর সেটি চাইনিজ নারীরা ছোট ছোট করে কেটে রোস্ট করে রোদে শুকাতে দেন। তাইওয়ানের নাঙ্গাং জেলার গর্ভবতী নারীরা নিজেদের এবং অনাগত সন্তানদের সুস্বাস্থ্যের জন্য এটি এখনও খেয়ে থাকেন।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত বেইজিং অলিম্পিকের কথাই বা বাদ যাবে কেন? নয় বছর আগের সেই মহাযজ্ঞে অ্যাথলেটদের খাদ্য তালিকা থেকে পুরুষ হরিণের লিঙ্গ, কচ্ছপের রক্ত ও অ্যাঞ্জেলিকা (রান্নায় ও ওষুধ প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত সুগন্ধি লতাবিশেষ) মূল দিয়ে তৈরি ওষুধ নিষিদ্ধ করে আয়োজক কমিটি। এর পেছনে মূল কারণ ছিলো হরিণের লিঙ্গ। কারণ চাইনিজরা ঐতিহ্যগতভাবে অ্যালকোহলে হরিণের এই অঙ্গটি ডুবিয়ে রেখে বিশেষ এক প্রকার পানীয় তৈরি করে যা ‘Deer Penis Wine’ নামে পরিচিত। এ ওয়াইনটির দ্রুত আরোগ্য আনয়নের ক্ষমতা আছে যা অ্যাথলেটরা ইনজুরি থেকে দ্রুত সেরে উঠতে ব্যবহার করতে পারতো। আর এ পানীয়তে অ্যাথলেটদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত পারফর্মেন্স বর্ধক উপাদানের উপস্থিতি আছে বলেই চীন তাদের অ্যাথলেটদের এটি পান থেকে বিরত থাকতে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছিলো।
হরিণের পুং জননেন্দ্রিয় দিয়ে তৈরি এ ওয়াইনের এক গ্লাসের মূল্য ১২ ইউএস ডলার করে। আর যদি কেউ পুরো ২ লিটারের বোতলই কিনতে চায়, তবে দাম পড়বে ৪৫৫ ইউএস ডলার।
ব্যাঙের জুস
বৃষ্টি হলে ব্যাঙের ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ’ ডাকের মাঝে যে মাদকতা আছে, সেই মাদকতা যেকোনো মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি ভুলিয়ে অন্য এক জগতে নিয়ে যেতে সক্ষম। কিন্তু মাদকতা সৃষ্টিকারী সেই ব্যাঙের জুস পানের কথা যদি আপনাকে জানানো হয়, তাহলে আপনি কী করবেন?
এখন চলুন একটু আন্দিজ পর্বতমালা থেকে ঘুরে আসা যাক। এখানে বলিভিয়া-পেরু সীমান্তে রয়েছে টিটিকাকা নামে সুগভীর, সুবৃহৎ, নয়নাভিরাম এক লেক। পানির পরিমাণ এবং পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বিবেচনা করলে এটিই দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ লেক।
এই টিটিকাকাতেই পাওয়া যায় প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ১ কেজি ভরের এক প্রজাতির ব্যাঙ, নাম তার ‘টিটিকাকা ওয়াটার ফ্রগ’; বৈজ্ঞানিক নাম Telmatobius culeus। তবে সেখানকার বাসিন্দাদের তৈরি বিশেষ এক ধরনের জুসের পাল্লায় পড়ে বিশালাকৃতির এ ব্যাঙের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।
টিটিকাকা ওয়াটার ফ্রগ দিয়ে যে জুসটি তৈরি করা হয় তাকে বলা হয়ে থাকে ‘পেরুভিয়ান ভায়াগ্রা’! এর প্রস্তুত প্রণালীটাও বেশ অদ্ভুত। এজন্য অ্যাকুরিয়াম থেকে একটি ব্যাঙ নিয়ে প্রথমে এটিকে আছাড় মারতে থাকা হয় যতক্ষণ না তা মারা যায় কিংবা অজ্ঞান হয়ে না পড়ে (এ সম্পর্কে মতভেদ আছে)। এরপর ব্যাঙটির পেটের কাছে দুটো জায়গায় কেটে তুলে ফেলা হয় পুরো চামড়া। এরপর চামড়াবিহীন সেই ব্যাঙ, শিম, মধু, অ্যালো ভেরা ও মাকা (আন্দিজে পাওয়া এক প্রকার মূল যা শারীরিক শক্তি ও যৌন ক্ষমতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়) একসাথে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করা হয়! ফলস্বরুপ পাওয়া যায় ঝাঁজালো এক ধরনের পানীয় যা পানের লোভে সেখানে ভিড় জমায় অনেক পর্যটক।
পান্ডার মলের চা
পান্ডা নামক প্রাণীটির কথা শুনলে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মনে আসল পান্ডার চেয়ে নকল আরেক পান্ডার ছবিই বেশি ভেসে উঠে। নকল পান্ডা বলতে আসলে ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কুং ফু পান্ডা’ এনিমেশন মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘পো’-কেই বোঝানো হয়েছে। একইসাথে অ্যাকশন আর কমেডি ঘরানার এ ছবির পুরো অংশ জুড়ে পো’র নানা মজাদার কথাবার্তা, কাজকারবার নির্মল বিনোদন দিয়ে গেছে বিশ্বের অগণিত দর্শককে।
দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় চা উৎপাদনের জন্য এ পান্ডা, আরো ভালো করে বলতে গেলে পান্ডার মলকেই বেছে নিয়েছেন চীনের সিচুয়ান ইউনিভার্সিটির ক্যালিগ্রাফির প্রফেসর অ্যান ইয়ানশি। সিচুয়ান প্রদেশেই রয়েছে বাইফেংজিয়া পান্ডা বেজ, ২০১৩ সালের হিসাব মতে যেখানে ছিলো ৮০টির মতো পান্ডা। এ পান্ডার মলেই গ্রীন টি উৎপাদনের নতুন এক পদ্ধতি পেটেন্ট করেছেন ইয়ানশি।
‘পান্ডা ইকোলজিক্যাল টি’ নামে বাজারজাত করা এ চা-কে মান অনুযায়ী তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। এর মাঝে সবচেয়ে দামী চায়ের প্রতি কেজির মূল্য ৭২,০০০ ইউএস ডলার।
কিন্তু চা উৎপাদনের জন্য কেন পান্ডার মলকেই বেছে নিলেন ক্যালিগ্রাফির এ প্রফেসর? এ প্রশ্নের জবাবে ইয়ানশির জবাবটিও ছিলো বেশ চমৎকার। তিনি বলেছিলেন, “পান্ডারা যে খাবার খায়, তার ত্রিশ ভাগেরও কম পুষ্টি উপাদান তাদের দেহে শোষিত হয়। বাকি প্রায় সত্তর ভাগ বেরিয়ে যায় মলের মাধ্যমে।” এজন্য নিজের পান্ডা চা-কে পুষ্টির আধার বলেও মনে করেন তিনি।
পাখির বাসা থেকে প্রস্তুতকৃত পানীয়
খড়কুটো দিয়ে পাখিকে বাসা বানাতে দেখেই অভ্যস্ত আমরা অধিকাংশ মানুষ। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। এই যেমন কিছু প্রজাতির সুইফট পাখির কথাই ধরা যাক। এরা বাসা বানানোর জন্য খড়কুটোর পরিবর্তে নিজেদের গিলে ফেলা খাদ্যকেই পুনরায় বের করে দেয়। আঠালো সেই খাদ্যাংশ এভাবে গাছের শাখায় ধীরে ধীরে আটকে থেকে তৈরি করে শক্ত একটি বাসা। শক্তিশালী যকৃত, কার্যক্রম ইমিউন সিস্টেম এবং কোমল ত্বকের জন্য চীনের অনেকে বেছে নিয়েছে পাখিটির এ বাসাকেই।
এজন্য প্রথমে বাসা থেকে পালক ও অন্যান্য ময়লা পরিষ্কার করা হয়। এরপর ধুয়ে নিলে সাদা স্পঞ্জের মতো এক ধরনের পদার্থ খুঁজে পাওয়া যায়। পাখির এ বাসাটির দামও নেহায়েত মন্দ না। প্রতি ক্যাটির দাম প্রায় ৫০০ ইউএস ডলার। উল্লেখ্য, ক্যাটি হলো ভর পরিমাপের চাইনিজ একটি একক যার পরিমাণ ১ পাউন্ডের সামান্য বেশি।
বিভিন্ন কোম্পানিই পাখির বাসা প্রক্রিয়াজাত করে প্রাপ্ত স্পঞ্জটি পরবর্তীতে আরো প্রক্রিয়াজাত করে কোমল পানীয় তৈরি করছে। স্বাদহীন, জেলির মতো সেই পানীয়ের বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই পাখির বাসার ক্ষুদ্র অংশ ভেসে বেড়াতে দেখা যায়।
প্লাসেন্টা
আম্বিলিক্যাল কর্ডের মাধ্যমে গর্ভের শিশুর অক্সিজেন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর পদার্থের সরবরাহ নিশ্চিত করে জরায়ুস্থ প্লাসেন্টা নামক টেম্পোরারি অর্গানটি। এতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার আয়রন, ভিটামিন বি-১২ ও অন্যান্য হরমোন। অনেকের মনে করেন যে, এটি খেলে মায়ের শক্তি এবং সন্তানের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় বুকের দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া মায়েদের প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা, রক্তপাত কমানো এবং ত্বক কোমল করতেও এটি বেশ উপকারী বলে বিশ্বাস করে অনেকে।
প্লাসেন্টা খেলে আসলেই এমন সব উপকার পাওয়া যায় কিনা তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে এখনো প্রমাণিত না। তবে তাতে মানুষের বিশ্বাসের কোনো কমতি পড়ে নি। এই যেমন ‘Nihon Sofuken’s Placenta 10000’-এর কথাই ধরা যাক। শূকরীর প্লাসেন্টা থেকে বানানো পীচ ফলের স্বাদের এ পানীয়টি চুমুক দিয়েই সাবাড় করে দেয়া যায়। তবে কেউ যদি শূকরীদের প্লাসেন্টা অতটা কার্যকর হবে না বলে মনে করে, তবে তাদের জন্য আছে ‘Placenta-Pro’, যা কিনা স্ত্রী ঘোড়ার প্লাসেন্টা থেকে তৈরী করা হয়।
দাড়ির বিয়ার
যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন অঙ্গরাজ্যের রোগ অ্যালিস (Rogue Ales) মদ চোলাইখানায় বিশেষ এক প্রকারের বিয়ার তৈরি করা হয় যার নাম Beard Beer। তবে এতে পুরুষের দাড়ি সরাসরি ব্যবহার করা না হলেও এর অবদান আছে ঠিকই। চোলাইখানার মালিক জন মেয়ার ১৯৭৮ সালে সর্বশেষ শেভ করেছিলেন। এরপর থেকে ক্রমাগত বাড়তে থাকা দাড়িতেই তিনি এক ধরনের ছত্রাক চাষ করেন। এই ছত্রাকই পরবর্তীতে বিয়ার গাজানোর জন্য ব্যবহার করা শুরু হয় বলে এর এরুপ নামকরণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন প্রাণীদেহ ব্যবহার করে তৈরি পানীয়
- সাপ কিংবা বিচ্ছুর দেহ মাসাধিককাল ধরে রাইস ওয়াইনে ডুবিয়ে রেখে প্রস্তুত করা হয় এক প্রকারের ওয়াইন। চীনা ওষুধে প্রায়ই এর ব্যবহারের কথা শোনা যায়। চীন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিলবে বিচিত্র এ ওয়াইনের সন্ধান।
- চীন ও ভিয়েতনামে এক প্রকারের ওষুধ তৈরি করা হয় টিকটিকির সাহায্যে। এজন্য ৩টি টিকটিকি (এর কম কিংবা বেশি হওয়া চলবে না!) রাইস ওয়াইনে ডুবিয়ে রেখে ওষুধটি তৈরি করে তারা।
- এবার যে পানীয়র কথা বলবো তার প্রাপ্তিস্থান চীন ও কোরিয়ায়। ইঁদুরের বাচ্চাকে রাইস ওয়াইনে প্রায় এক বছর ডুবিয়ে রেখে তারা প্রস্তুত করে বিশেষ এক প্রকার ওয়াইন, যা তারা সুস্বাস্থ্য লাভের জন্য পান করে থাকে। পানকারীদের মতে এ পানীয়টির স্বাদ অনেকটা অপরিশোধিত গ্যাসোলিনের মতো!
- Wynkoop Brewing Company বিয়ার বানানোর জন্য বেছে নিয়েছে ষাঁড়কে, আরো ভালো করে বলতে গেলে ষাঁড়ের অন্ডকোষকে! এজন্য ষাঁড়ের অন্ডকোষ ভালো করে ভেজে এরপর টুকরা টুকরা করে কেটে যোগ করা হয় সেই বিয়ারের সাথে।
চিচা
আজ যতগুলো পানীয়র কথা আলোচনা করা হয়েছে, তার মাঝে এর প্রস্তুত প্রণালী জেনেই পাঠকদের গা সবচেয়ে বেশি ঘিনঘিন করতে পারে। এটিও এক ধরনের বিয়ার যা প্রস্তুতিতে ভুট্টার সাহায্য নেয়া হয়। গাজানো এবং অ-গাজানো উভয় অবস্থাতেই বিয়ারটি দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার মানুষজন পান করে থাকে।
চিচার বিভিন্ন প্রকারভেদের মাঝে একটি আইটেম হলো ‘চিচা ডি মিউকো (Chicha de Muko)’। এটি প্রস্তুত করার আগে প্রস্তুতকারক ভুট্টার দানাগুলো দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ছোট ছোট বলের মতো বানিয়ে নেন। এরপর সেগুলো পিষে ফেলা হয়। প্রস্তুতকারকের লালাতে থাকা এনজাইম ভুট্টার শর্করাকে বিযোজিত হতে সাহায্য করে। এভাবে প্রাপ্ত জুসকে পরবর্তীতে একটি পাত্রে গাজানোর জন্য রেখে দেয়া হয়।