জন্ম তার চারশো বছর আগে, আনুমানিক ১৬২৫ সালে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিল জাপানের হিরোশিমা থেকে মাত্র ২ মাইল দূরে এক সম্ভ্রান্ত ইয়ামাকি পরিবারে। আজ এত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে। বহু ইতিহাসের নি:শব্দ সাক্ষী। গত তিন শতক ধরে বিশ্বজুড়ে ঘটে গিয়েছে বহু ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অতিক্রম করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং সেখান থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা প্রাপ্তি, বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া একের পর এক যুগান্তকারী ঘটনা— সব কিছুর সাক্ষী থেকেছে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আঁচ তেমনভাবে না লাগলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে দেখেছে যুদ্ধের ভয়াবহ নির্মম পরিণতি।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক ভয়াবহ কলঙ্কের দিন ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। তাইতো বারাক ওবামার কন্ঠের নির্মম স্বীকারোক্তি- “৭১ বছর আগে একদিন হিরোশিমার আকাশ থেকে মৃত্যু নেমে এসেছিল। মানবসভ্যতা যে চাইলে নিজেকেই ধ্বংস করতে পারে, সেদিন তা বোঝা গিয়েছিল। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে।’’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন মানব সভ্যতার কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমা চাওয়া এবং তেমনি অপরাধবোধের কথাও ফুটে ওঠে।
হ্যাঁ। আজ আপনাদের জানাব সে ঘটনারই এক নিরব সাক্ষী ৩৯১ বছরের এক বনসাই বৃক্ষের অজানা কাহিনী।
বনসাই অর্থাৎ বামন গাছ। তবে দেখতে ছোট হলেও এই গাছটির জীবনকাল অনেক দীর্ঘ। প্রায় ৪০০ বছরের বেশি বাঁচে এই গাছ। এই বনসাই অন্তত সেই সত্যেরই প্রতিধ্বনি করে। উচ্চতায় খাটো, একে জাপানিজ হোয়াইট পাইনও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রবীণ এই বনসাই গাছটি হিরোশিমা গাছ নামেই অধিক পরিচিত। প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো দিনের ইতিহাসকে বুকে লালন করে ঠাঁই উচ্চ শিরে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। কেমন করে এই গাছ পারমাণবিক বোমার নিষ্ঠুর আঘাত থেকে বেঁচে গেছে, আর এখন সে কোথায়? কেমন আছে? তা জানতে আপনাদের চঞ্চল মন যদি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তাহলে মনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ মানুষই হচ্ছে সে জীব যে সবসময় অজানাকে জানতে, অ-দেখাকে দেখতে, ভয়কে জয় করতে চায়। আজ সে গল্পই শোনাব।
৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সাল। সময় ৮ টা বেজে ১৫ মিনিট। জীবিকার লক্ষ্যে ছুটে চলা হাজার হাজার মানুষের কেউ জানতেন না যে সেদিন তাদের জীবনে কী ভয়াবহ অন্ধকার নেমে আসছে। জাপানের রাজধানী টোকিও মহানগর থেকে ৫০০ মাইল দূরে হিরোশিমা নামক শহরের উপরে ঘটে গেলো পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম ন্শংসতা যা আজও ভাবলে যে কারো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবেই নিঃসন্দেহে।
প্রথম পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপে ইতিহাস সৃষ্টি করল যুক্তরাষ্ট্র। বোমাটির ডাকনাম যদিও ছিল ‘লিটল বয়’, তার কার্যক্রম কিন্তু মোটেও লিটল ছিল না, যেকোনো নির্মম ধ্বংসযজ্ঞকে হার মানায় সে। সেদিনের সেই ঘটনার জন্য আজও জাপানবাসীরা প্রতিনিয়ত মাশুল দিয়ে যাচ্ছে। বোমার তীব্রতার কারণে দুই কিলোমিটারের মধ্যে যতগুলো কাঠের স্থাপনা ছিল সব ক’টি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ৫০০ মিটার বৃত্তের মধ্যে আলিশান দালানগুলো চোখের পলকে ভেঙেচুরে ধুলিসাৎ হয়ে যায়।
৫ বর্গমাইল এলাকা মোটামুটি ছাই এবং ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার সময় হিরোশিমা নগরীর লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার। পারমাণবিক বোমার দাপটে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার অধিবাসীর মৃত্যু ঘটেছিল। আহত হয় আরও কয়েক লক্ষ মানুষ। শুধু তাই নয়, এই বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমার অভিশাপের নির্মম শিকার হয় পরবর্তী প্রজন্মও। বেঁচে ফেরা অনেক পরিবারে জন্ম নিতে থাকে বিকলাঙ্গ শিশু।
হিরোশিমার যে এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সেখান থেকে মাত্র ২ মাইল দূরে থাকত ইয়ামাকি পরিবার। সেই সময় বনসাইটি ছিল ওই পরিবারের সঙ্গেই। বোমার আঘাতের তীব্রতায় এই পরিবারের বাসাবাড়ি সম্পূর্ণ তছনছ হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বৈদ্যুতিক সব সংযোগ। বিকল হয়ে পড়ে টেলিফোন লাইন। আশেপাশের পরিবারগুলোর যে কেউ, কাউকে সাহায্য করবে, সে অবস্থা পর্যন্ত তখন কারোই ছিল না। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় হল, এত কিছুর পরও কোন এক অলৌকিক কারনে ওই বিস্ফোরণ থেকে কোনও মতে রক্ষা পান ইয়ামাকি পরিবার। বেঁচে গিয়েছিল সেই গাছটিও। বোমার চরম বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়ে বেঁচে গেল সেই পরিবার আর তার সাথে এই বনসাই বৃক্ষটি। এরপর থেকে এই গাছের নাম হয়ে যায় হিরোশিমা বনসাই।
এর পরের কাহিনী আরো চমকপ্রদ। ইতিহাস তার যোগ্যতম স্থান খুঁজে নেয়। এই কথার যৌক্তিকতা প্রমাণ করেন সেই ইয়ামাকি পরিবারের এক বংশধর মাসারু ইয়ামাকি। তিনি ১৯৭৫ সালে এই বনসাই বৃক্ষটিকে দান করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যান ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাশনাল আরবোরেটুম এ হিরোশিমা বনসাইকে রাখা হয়েছে। কিন্তু অতি আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গাছটি যুক্তরাষ্ট্রকে দান করার সময় ইয়ামাকি পরিবারের তরফ থেকে সেদিন জানানো হয়নি, এই গাছটির সঙ্গে হিরোশিমার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে ।
কিন্তু কেন? কেনই বা তিনি বা তাঁর পরিবার গাছটিকে যুক্তরাষ্ট্রকে দিলেন? এ এক রহস্য যা এখনো উন্মোচন হয়নি। এ প্রশ্নের উত্তর এখনো তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। হয়ত তিনি বা তার পরিবার, এর মধ্য দিয়ে আমেরিকার নিষ্ঠুরতার কথা নীরবে জানান দিতে চেয়েছেন। হিরোশিমা বৃক্ষের মধ্য দিয়ে হিরোশিমার ঘটনা মানুষ মাঝে আবার নতুনভাবে জানতে পারবে, হয়তো বা পরবর্তী প্রজন্ম এই ঘটনা সারা পৃথিবীকে জানান দিবে এমন মনোবাসনা ছিল ইয়ামাকি পরিবারের।
ঠিক এই উদ্দেশ্যেই হয়ত ২০০১ সালে মাসারু ইয়ামাকির নাতিরা যখন এই গাছটিকে দেখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, সেদিন তারা সমগ্র বিশ্ববাসীর সম্মুখে আনলেন এই সত্য ঘটনা যা ঘটেছিল আজ থেকে ৭২ বছর আগে। কিন্তু ইতিহাস অনেকেই স্বীকার করতে চান না। বিশেষ করে, যারা এই ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ইয়ামাকি পরিবারের দেয়া তথ্যকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে এবং এই তথ্যকে ভিত্তিহীন বলে জানিয়ে দেয় যে, দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব বাড়াতেই এই উপহার দিয়েছিলেন ইয়ামাকি পরিবার। ভবিষ্যত প্রজন্মই এই সত্যতার ভিত্তি খুঁজবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ইতিহাসের এক অংশীদার এই হিরোশিমা বৃক্ষ।
গাছ মানেই এক অর্থে জীবন। বাড়ির আঙিনায় কিংবা রাস্তার ধারে, বা মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ যে শুধু দূষণ প্রতিহত করে তা কিন্তু নয়, যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা এই ধরিত্রীর ইতিহাস সে অবলীলায় নি:শব্দে ধরে রাখে। পোড়া বাড়ির দেওয়াল ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা কিংবা রাস্তার ধারে গজিয়ে ওঠা বট-অশ্বত্থ বৃক্ষও বহু ক্ষয়ে যাওয়া পরিবারের ইতিহাসের সাক্ষী। মনে করিয়ে দেয় দীর্ঘ সময়ের অজানা নানান কথা। কিন্তু সেই গাছই যদি ৩৯১ বছরের পুরনো হয়, তাহলে প্রায় চার শতকের ইতিহাসেরও সাক্ষী হয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। আর সেজন্য এই হিরোশিমা গাছটিই এখন খবরের শিরোনামে।