দক্ষিণ এশিয়ায় সভ্যতাভিত্তিক ইতিহাসে পাকিস্তানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। থাকবেই বা না কেন? সুপ্রাচীন মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে শুরু করে গান্ধার রাজ্য, তখত-ই-বাহিসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক গুরুত্ব দখল করে আছে দেশটি। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে গড়ে উঠেছিল ‘গান্ধার’ নামে এক ইন্দো-আর্য রাজ্য। এই গান্ধার ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের ষোড়শ মহাজনপদের একটি। তক্ষশীলা ছিল এর রাজধানী। উন্নত শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য তখন সারা বিশ্বব্যাপী দারুণ খ্যাতি কুড়িয়েছিল তক্ষশীলা।
প্রায় হাজার বছর ধরে মাটির নিচে চাপা পড়েছিল তক্ষশীলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আঠারো শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ রাজ সরকারের দুই প্রত্নতাত্ত্বিক আলেকজান্ডার কানিংহাম, এবং জন মার্শালের প্রচেষ্টায় সকলের সামনে আসে তক্ষশীলার ধ্বংসাবশেষ। মার্শাল সিন্ধু সভ্যতার পাশাপাশি প্রাচীন এই সুসংগঠিত নগরীকেও আলোর মুখ দেখান।
নামকরণ
রামায়ণ অনুসারে, দশরথের দ্বিতীয় ছেলে ভরত গান্ধার রাজ্য জয়ের পর নিজ সন্তান ‘তক্ষ’ এর নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম দেন ‘তক্ষশীলা’। মহাভারতেও তক্ষশীলার উল্লেখ আছে। আবার অনেকের মতে, প্রাচীন ভারতের নাগা জনগোষ্ঠীর ‘তক্ষক’ নাম থেকে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছিল ‘তক্ষখন্ড’। সময়ের পরিক্রমায় ‘তক্ষখন্ড’ শব্দটি রূপ নেয় তক্ষশীলায়। গ্রীকদের লেখনীতে তক্ষশীলা হয়ে ‘ট্যাক্সিলা’। বর্তমানে ইংরেজিতে তক্ষশীলাকে ‘Taxila’ লিখা হয়।
প্রাগৈতিহাসিক তক্ষশীলা
বহুকাল আগে থেকেই এই এলাকায় মনুষ্যবসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রি.পূ. প্রায় ৩,৫০০ অব্দের দিকে মাইক্রোলিথিক শিকারিরা এখানের তিনটি গুহায় (ভামালা, মোহরা মোরাডু, খানপুর) বসবাস করত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। খ্রি.পূ. ৩৫০০-২৭০০ অব্দের দিকে কৃষির সাথে সম্পৃক্ত সম্প্রদায়ের লোকেরা সারাইকালা উপত্যকার দিকে বসতি গড়ে তোলে। এখানে পাথর, হাড়, ছোট ছোট পাথরের হাতিয়ার, কুঠার, হস্তনির্মিত মৃৎশিল্পের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। খ্রি.পূ. ২৭০০ – খ্রি.পূ. ২১০০ অব্দের দিকে নব্য প্রস্তর থেকে ব্রোঞ্জ যুগে প্রবেশ করে তক্ষশীলা।
তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়
তৎকালীন বিশ্বে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় বা তক্ষশীলা মহাবিহার ছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। খ্রি.পূ. প্রায় ৫০০ অব্দে নির্মিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল বিভিন্ন পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। সারা এশিয়া থেকে জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ করতে এখানে আসতেন জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীরা। তক্ষশীলা মহাবিহারের আঙিনা মুখরিত থাকত বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীর পদচারণায়। তবে কেউ ইচ্ছা করলেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেত না। সেজন্য তার বয়স কমপক্ষে ষোলো বা তার বেশি হতে হতো। নিজ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে তাকে প্রমাণ করতে হতো, সে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের যোগ্য।
পড়াশোনার খরচ শিক্ষার্থীকেই বহন করতে হতো। তবে যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিল, তারা গায়ে-গতরে খেটে তা পরিশোধ করে দিত। এখানে পড়ানো হতো গণিত, বেদশাস্ত্র, অর্থনীতি, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ব্যাকরণ বিষয়ক বিভিন্ন জিনিস। এর শিক্ষা পদ্ধতি ছিল যথেষ্ট আধুনিক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িতে আছে চাণক্য, পাণিনি, চরক, আত্রেয়, বিষ্ণু শর্মা, নাগার্জুন, জীবকের মতো প্রাচীন বিশ্বের প্রথিতযশা পণ্ডিত ও গুণীজনদের নাম। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৫ অব্দের দিকে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন এসেছিলেন এই শিক্ষাঙ্গনে। তিনি একে অত্যন্ত পবিত্র এবং সমৃদ্ধশালী বলে যথেষ্ট প্রশংসায় ভাসিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
তক্ষশীলা তার জীবদ্দশায় এই অঞ্চলকে পালাক্রমে বহু শাসকের হাত বদল হতে দেখেছে। কখনো স্বদেশী রাজা, কখনো ভিনদেশীরা এসে শাসন করে গেছে। তক্ষশীলার শাসকবর্গের তালিকা:
- আকেমেনিড (খ্রি.পূ. ৬০০-৪০০ অব্দ)
- গ্রিক (খ্রি.পূ. ৩২৬-৩২৪ অব্দ)
- মৌর্য (খ্রি.পূ. ৩২৪-১৮৫ অব্দ)
- ইন্দো-গ্রিক (খ্রি.পূ. ২৫০-১৯০ অব্দ)
- শক (খ্রি.পূ. ২য় শতক – ১ম শতক)
- পার্থিয়ান (খ্রি.পূ. ১ম শতক – খ্রিস্টাব্দ ১ম শতাব্দী)
- কুশান (খ্রিস্টাব্দ ১ম শতাব্দী – খ্রিস্টাব্দ ৫ম শতাব্দী)
- হূণ (৫ম শতাব্দী)
- হিন্দু শাহী (৯ম – ১০ম শতাব্দী)
খ্রি.পূ. ৬০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ৩৭২ অব্দ পর্যন্ত আকেমেনিড সাম্রাজ্যের ছায়া বিস্তৃত ছিল গান্ধারে। এরপর আসেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তবে তিনি বেশিদিন এই এলাকাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেননি। খ্রি.পূ. ৩২১ অব্দে ক্ষমতার নাট্যমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মৌর্য সাম্রাজ্য, ভারতের প্রথম ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের পাড় পৃষ্ঠপোষক। তাই তখন বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে তক্ষশীলা। চন্দ্রগুপ্তের পর সম্রাট অশোকের আমলে তক্ষশীলা তার স্বর্ণযুগ পার করে। অশোকের মৃত্যুর পর গান্ধারে আক্রমণ করে বসে ইন্দো-গ্রীকরা। মধ্য এশিয়া থেকে শকরা এসে তাদের হারায়। আবার খ্রি.পূ. ১ম শতকে পার্থিয়ানরা এসে দখল করে এই জায়গা।
প্রায় শতবর্ষ ধরে চলতে থাকে পার্থিয়ান অনুশাসন। ৫০ খ্রিষ্টাব্দে চীনের উত্তর-পশ্চিম থেকে আগত কুশান গোত্র কাবুল উপত্যকা এবং গান্ধার জয় করে নেয়। কুশান সম্রাট কনিষ্কের আমলে (৭৮ খ্রিষ্টাব্দে) পুরো কুশান সাম্রাজ্যে গান্ধার হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র। পশ্চিমে মারভে থেকে পূর্বের খোতান, এবং উত্তরে আরাল সাগর থেকে দক্ষিণের আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছিল এর সীমানা। কনিষ্কের পাশাপাশি তার বংশধর হুবিষ্ক এবং বসুদেবকেও এই রাজ্যের উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছিলেন। একসময় কুশান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে, একে একে বহু রাজবংশের ক্ষমতা হাতবদল হয় গান্ধারের।
স্থাপত্যশিল্প
বৌদ্ধ স্থাপত্যশিল্পে ঢিবির আকৃতিবিশিষ্ট বৌদ্ধ সমাধিস্তম্ভ হিসেবে খ্যাত ‘স্তূপ’ এর কদর ছড়িয়ে আছে সারাবিশ্বে। প্রাচীন ভারতের বহু সাম্রাজ্যে এই সুনিপুণ কারুকার্যখচিত স্তূপের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। স্থাপত্যশিল্পের পাশাপাশি এগুলো ধর্মীয় গুরুত্বও বহন করত। তক্ষশীলায় নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্তূপ:
ধর্মরাজিক স্তূপ
মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক এই ধর্মরাজিক স্তূপের নির্মাতা। এটিই তক্ষশীলার সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ স্থাপত্যকীর্তি। বিশ্বাস করা হয়, গৌতম বুদ্ধকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছিল, সেখান থেকে তার অবশিষ্টাংশ এখানে স্থানান্তর করে এই সৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল।
কুণাল স্তূপ
এই কুণাল স্তূপের কিংবদন্তি অশোকের সন্তান কুণালের সাথে সম্পৃক্ত। সম্রাট অশোকের পঞ্চম স্ত্রী তিস্যরাক্ষা ছিলেন কুণালের সৎ মা। তিনি কপটতার আশ্রয়ে সম্রাট অশোকের নাম করে কুণালের কাছে একটি চিঠি পাঠান, যেখানে কুণালের দুই চোখ উপড়ে ফেলার আদেশ লেখা ছিল। অথচ, অশোক এই ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। পরে অশোকের দরবারে কুনাল নিজের চোখ উপরে পাঠালে তাতে দারুণ ব্যথিত হন অশোক। সাথে সাথে তিস্যরাক্ষাকে মৃত্যুদণ্ড দান করেন তিনি। জনশ্রুতি অনুসারে, বোধ গয়াতে নিয়ে কুণালের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অশোক। এই কাহিনির উপর ভিত্তি করেই তক্ষশীলায় গড়ে ওঠে কুনাল স্তূপ।
সিরকাপ
সিরকাপ শহরের গোড়াপত্তন ঘটে ইন্দো-গ্রিকদের হাত ধরে, খ্রি.পূ. দ্বিতীয় শতকের দিকে। এই সিরকাপ স্তূপের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে স্থানীয় লোকগাথার বীর রাসালুর কিংবদন্তি, যিনি সাতটি রাক্ষসের সাথে লড়েছিলেন। বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি সিরকাপ নামে এক রাক্ষসকে এই স্থানেই বধ করেছিলেন।
গ্রিকদের নগরায়ণ পরিকল্পনা এই শহরে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান থাকলেও এখানে গ্রিকদের কোনো মন্দির কিংবা প্রাসাদের অস্তিত্ব নেই। পরবর্তীতে এখানে ভারতীয়রা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য বলতে এখানে রাজকীয় বাসভবন, সূর্য মন্দির, আপসিডাল মন্দির, দ্বিমস্তকবিশিষ্ট স্তূপ, জৈন মন্দির উল্লেখযোগ্য।
সিরসুখ
কুশান জাতি দ্বারা নির্মিত সিরসুখের গোড়াপত্তন ঘটে খ্রিষ্টাব্দ প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ধারণা করা হয়, ভূমিকম্প কবলিত সিরকাপকেই এখানে স্থানান্তর করা হয়েছিল। আয়তাকার এই নগরীতে লাইমস্টোনের দুর্গ এবং গোলাকার গম্বুজের নিদর্শন পাওয়া যায়, যার সাথে মিল রয়েছে ইউরোপীয় স্থাপত্যবিদ্যার। এখন পর্যন্ত পুরো এলাকাটি খনন করা সম্ভব হয়নি। তবে গবেষকদের ধারণা, নির্মাণের ১০০০ বছর পর্যন্ত প্রাণবন্ত ছিল এই শহর।
তক্ষশীলার পতন
দীর্ঘ সময় যাবত বহু জাতির ক্ষমতা-কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত তক্ষশীলা আস্তে আস্তে ভেতর থেকে ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছিল। কফিনে সর্বশেষ পেরেকটি ঠুকেছিল হূণ জাতির লোকেরা। এই সময়ে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ভারতে প্রাধান্য লাভ করে, যার ফলে পতন ঘটে বৌদ্ধধর্মের, যা এই অঞ্চলে এক হাজার বছর ধরে নিজের প্রভাব বজায় রেখেছিল। হূণ শাসকরা শিবের উপাসক হওয়ায়, গান্ধারে বৌদ্ধ ধর্ম তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ফলে, বৌদ্ধ মঠগুলো হারায় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা। এর পুরো প্রভাব পড়ে নগর জীবনে। এরপর আর কখনো নিজ গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারেনি তক্ষশীলা। ক্রমশ ভেঙে পড়তে পড়তে নিঃশেষ হয়ে এককালের খ্যাতিমান এই নগরী।