জোয়ে কসমোডেমিয়ান্সকা: রুশ বীর কিশোরীর আত্মত্যাগের কথা

“আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি”

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতার মতো ঠিক আঠারোতেই মেয়েটি স্বদেশের জন্য জেনেছিলো রক্তদানের পুণ্য, শত্রুপক্ষের নির্মমতায়ও মাথা নোয়ায়নি প্রাণ থাকা পর্যন্ত। ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়েও দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলো জয়ধ্বনি।

জোয়ে অ্যান্টোলিইয়েভনা কসমোডেমিয়ান্সকা; Source: russiapedia.rt.com

১৯২৩ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন পরিবারের সকলের আদরের জোয়ে, তার পুরো নাম রাখা হয় জোয়ে অ্যান্টোলিইয়েভনা কসমোডেমিয়ান্সকা। বাবা অ্যান্টোলি কসমোডেমিয়ান্সকা, মা লিউবভ কসমোডেমিয়ান্সকা এবং ছোটো ভাই আলেক্সাজান্ডার কস্মোডেমিয়ান্সকা। টমবভ প্রদেশের কিরসানভোস্কি জেলার ওসিনো-গাই নামে ছোট্টো এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করা পরিবারের সকলের আদরের জোয়ে পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সকলের কাছে হয়ে উঠেছিলেন শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করার মতো এক বীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই অষ্টাদশী কিশোরীই প্রথম নারী, যাকে মরণোত্তর সম্মানিত করা হয়েছিল তার মাতৃভূমির সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাব ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ দিয়ে।

স্কুলজীবন থেকেই তার মধ্যে নিজের দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ প্রকাশ পেতে থাকে। একরাশ বব করা সতেজ কালো চুলের এই কিশোরী ছিলেন গম্ভীর আর চাপা স্বভাবের। কাজের ক্ষেত্রে একরোখা জোয়ে নিজ দেশের সাহিত্য ভালোবাসতেন ভীষণ। ছাত্রজীবনেই পুশকিন, গোগল, টলস্টয়, বেলিনস্কি, তুগেনিয়েভ, চেরনশেভস্কী, হারজেন, নেক্রাশোভদের লেখা পড়ে ফেলেছিলেন ভালোভাবে, লেখায় অঙ্কিত অতীত বীরদের বীরত্বের প্রভাব পড়ে তার মধ্যে। ভালোবাসতেন সংগীতও, চাইকোভস্কি ও বেথোফেন ছিলো তার প্রিয়। স্কুলে পড়াকালীন ক্লাসের তরুণ সাম্যবাদী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ছিলেন All-Union Leninist Young Communist League-এর সদস্য;
Source: historyinanhour.com

১৯৪১ সালে জোয়ের দশম শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে গেলো দেশের অস্তিত্বের জন্য সংকটময় পরিস্থিতি। নাৎসিদের অনুপ্রবেশে দখল হচ্ছে সোভিয়েতের বিভিন্ন অংশ। দেশের জন্য কিছু করার চেতনা আর তাকে ঘরে বসে থাকতে দিলো না। জোয়ে যোগ দিতে চললেন বিচ্ছিন্ন সৈন্যদলে। সৈন্যদলের অধিনায়কের জিজ্ঞেস করা অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে একটির জন্য জোয়ের উত্তর ছিলো এরকম,

– “যদি জার্মানেরা তোমাকে ধরে ফেলে, অত্যাচার করে?”
– “আমি আমার মুখ বন্ধ করে রাখবো”

পরবর্তীতে উপরের দুটি কথাই ঠিক ঠিক মিলে গিয়েছিলো। শত্রুপক্ষের পাশবিক নির্যাতনেও শুধুমাত্র জোয়ের ছদ্মনাম ‘তানিয়া’ ছাড়া আর কোনো তথ্য নাৎসিরা বের করতে পারেনি।

১৯৪১ সালের ২২শে জুন নাৎসি বাহিনী সোভিয়েট ইউনিয়ন আক্রমণ করে, নভেম্বরের শেষের দিকে তারা লেনিনগ্রাদের (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) দখল নিয়ে ফেলে। প্রতিরোধকৌশল হিসেবে সেসময় সোভিয়েট ইউনিয়ন বেছে নিচ্ছিলো স্বেচ্ছাসেবী, যাদের কাজ থাকতো দখলকৃত মাটিতে অবস্থানরত নাৎসিদের চোরাগোপ্তা হামলা করে যতটা সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি করা। অত্যন্ত দুঃসাহসিক ও বিপজ্জনক এ কাজের জন্যই যেন নিজেকে এতদিন ধরে প্রস্তুত করছিলো জোয়ে।

১৯৪১ এর ৩১ অক্টোবর, জোয়ে ও আরও দুই হাজার তরুণ সাম্যবাদী স্বেচ্ছাসেবী যোগ দেয় চোরাগোপ্তা হামলা করার দলে, যেটির সাংগঠনিক নাম ছিলো ‘গেরিলা ট্রুপ অফ দ্য ৯৯০৩ স্টাফ অফ দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে তাকে পাঠানো হয় ভলোকোলামস্কে, সেখানে জোয়ে ও তার দল রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখতো। পরবর্তীতে স্টালিনের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিভিন্ন শহর ও গ্রামে নাৎসি সৈন্যদের অবস্থানের বিঘ্ন ঘটাতে দলটি এক সপ্তাহের মধ্যেই পেট্রিশ্চেভসহ দশটির মতো স্থানে অগ্নিসংযোগ ঘটাতে সক্ষম হয়।

২৭ শে নভেম্বর ক্রেইনেভ, ভ্যাসিলি ক্লুবকোভ এবং জোয়ে শত্রুদের অবস্থানরত তিনটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তাদের আবার যেখানে দেখা হওয়ার কথা, সেখানে বাকিদের জন্য অপেক্ষা না করেই ক্রেইনেভ পালিয়ে যায়, ক্লুবকোভ নাৎসি সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে আর একলা পড়ে যাওয়া জোয়ে পেট্রিশ্চেভেই গিয়ে আরও অগ্নিসংযোগের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এবার শত্রু সৈন্য ও স্থানীয় কিছু তাদের পক্ষপাতী অধিবাসীরাও তক্কে তক্কে ছিলো। পরদিন সন্ধ্যায় নাৎসিদের অনুগত এক অধিবাসীর গোলাঘরে আগুন দেওয়ার সময় সেটির মালিক সভিরিডভের হাতে ধরা পড়ে যান জোয়ে। নাৎসিরা এক বোতল ভদকা দিয়ে পুরষ্কৃত করে এই বিশ্বাসঘাতককে। পরবর্তীতে এই কৃতকার্যের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো।

নাৎসিরা চোরাগোপ্তা হামলাকারীকে আটক করার পর এক অষ্টাদশী কিশোরীকে দেখে প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায় এবং তারপর শুরু হয় বর্ণনাতীত নির্যাতন। তাকে বিবস্ত্র করে উপর্যুপরি চাবুক মারা হতে থাকে। তবুও জোয়ের ছদ্মনামটি ব্যতীত আর কোনো তথ্য বের করতে পারে না তারা। চাবুক মারতে মারতে হয়তো ক্লান্ত হয়ে নতুনভাবে অত্যাচারের ফন্দি বের করে। জোয়েকে তীব্র বরফশীতের শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরিহিত অবস্থায় খালি পায়ে তুষারাবৃত রাস্তায় ঘোরানো হয়। শীতবস্ত্র পরিহিত হয়েও তার সাথের প্রহরী তীব্র শীতে টিকতে না পেরে অবশেষে তাকে এক অধিবাসীর ঘরে আটকে রাখে।

জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসিকাঠে এবং ফাঁসি কার্যকর করা হচ্ছে জনসম্মুখে; Source: iconicphotos.wordpress.com

পরদিন সকালে প্রস্তুত হল ফাঁসির মঞ্চ। জোয়ের বুকে একটি বোর্ড ঝুলিয়ে লিখে দেওয়া হয়েছে ‘অগ্নিসংযোগকারী’।
ফাঁসির দড়ি গলায় রেখে সে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,

“কমরেডবৃন্দ! তোমরা এত বিমর্ষ কেন? মনোবল জাগিয়ে তোলো। রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ো। বিমর্ষতা তোমাদের জন্য নয়। জার্মানদের জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও, জার্মানদের মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করো”

এটুকু শুনে তার সামনে থাকা এক নাৎসি সৈন্য এসে আবারো আঘাত করলো, মুখ চেপে ধরে বন্ধ করে দিতো চাইলো তার দৃপ্ত স্বরকে। কিন্তু তখনও যে দেহে প্রাণ আছে জোয়ের, ঝটকা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে আরো বলে যেতে লাগলেন,

“কমরেডবৃন্দ! মরতে আমার ভয় নেই। তোমাদের জন্য প্রাণদান করা যে সুখের…”

এর মধ্যে নাৎসি বাহিনী তাদের শৌর্য প্রকাশের জন্য ফাঁসির দড়ি পরিহিত অবস্থায় জোয়ের ছবি তুলে ফেললো কিছু।

 “তোমরা এখন আমাকে ফাঁসি দিচ্ছো। কিন্তু আমরা বিশ কোটি মানুষ। সকলকে তোমারা ফাঁসিতে লটকাতে পারবে না। আমরা প্রতিশোধ নেবোই…”

আরও কী যেন বলতে চাইছিলেন, কিন্তু আর বলতে পারলেন না, তার পায়ের নিচের বাক্স সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর শেষ হলো মৃত্যুযন্ত্রণা, নিথর হয়ে ঝুলে রইলো তার দেহ, অবশেষে মৃত্যু এলো। আশপাশের মানুষ সৈন্যদের জোরে নীরবে এই নিষ্ঠুরতা দেখলেন ও চোখের জল ফেললেন।

জোয়েকে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি নাৎসি বাহিনী, তার মৃতদেহ সেই ফাঁসিকাঠে একমাস ঝুলে ছিলো, রোজ সেদিক দিয়ে নাৎসি বাহিনী চলাচলের সময় যতোরকম অবজ্ঞা প্রকাশ করা সম্ভব তা-ই করে যেতো। একদিন মদ্যপ অবস্থায় এক নাৎসি সৈন্য জোয়ের মরদেহের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং ছুরি দিয়ে বক্ষস্থল ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। এরপর দিন জার্মানরা তার মরদেহ নামিয়ে সেই গ্রামের পাশে কবর দেয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন মুক্ত হলে তাকে পুনরায় মস্কোর নভদিয়েভশ্চিয়ে সেমেট্রিতে সমাহিত করা হয়।

পিইটর লিডভ ‘তানিয়া’ নামে প্রাভডা খবরের কাগজে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করলে তার কথা সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ জানতে পারে। তার ১৭ বছর বয়সী ভাই আলেক্সান্ডার বোনের ওপর এমন নৃশংসতার কথা জেনে যোগ দেয় প্রতিরোধ যুদ্ধে।

১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জোয়ে কসমোডেমিয়ান্সকাকে মরণোত্তর ভূষিত করা হয় সোভিয়েট ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সম্মান ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’-এ।

টম্বভে স্মৃতিস্তম্ভ; Source: wikimedia commons

জোয়ে কসমোডেমিয়ান্সকার অবদান রাশিয়াতে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। অসংখ্য স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে তাকে নিয়ে। স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তার জন্মস্থান, পঠিত স্কুল, পেট্রিশ্চেভসহ বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয়েছে যাদুঘর। এছাড়া তার নামে নামকরণ হয়েছে অসংখ্য রাস্তা, গ্রাম, স্কুল, ইলেকট্রিক ট্রেন, জাহাজ, পর্বত-চূড়া এমনকি গ্রহাণু পর্যন্ত! এছাড়াও তাকে নিয়ে সাহিত্য, গান, ছবির সংখ্যাও অসংখ্য; তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র এবং চলচ্চিত্র।

সুকান্তের সেই কবিতাটি দিয়েই শেষ করা যাক-

“এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে”

নিজের দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে, তার ওপর শত্রুদের অযাচিত অবস্থান প্রতিহত করতে যে শপথ নিয়েছিলেন জোয়ে, তা পালনে তিনি সফল হয়েছেন। নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দৃপ্ত কন্ঠে শপথ পাঠ করতে পারে খুব অল্প মানুষই। তাই তিনি জাতীয় বীর, বীরত্বের মূর্ত প্রতীক।

ফিচার ইমেজ- Edited by Anindeta Chowdhury

তথ্যসূত্র:

বই- ‘তানিয়া’ মূল: পি. লিডভ অনুবাদ: আহমদ ছফা প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৪ প্রকাশক: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি

Related Articles

Exit mobile version