আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগেকার কথা। দিনটি ছিলো ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ। আমেরিকার ৮ম বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য কলোরাডোর এক শহর ফ্রুইটাতে বাস করতেন এক কৃষক দম্পতি, নাম তাদের লয়েড ওলসেন এবং ক্লারা ওলসেন। ক্লারার মনে সেদিন খেলা করছিলো অন্যরকম এক আনন্দ। কারণ তার মা সেদিন রাতে তাদের বাড়িতে খেতে আসবেন। তাই মায়ের পছন্দের খাবারগুলো তৈরি করার দিকেই মন দিচ্ছিলেন তিনি। ক্লারার মা অর্থাৎ লয়েডের শাশুড়ি মুরগির গলা খেতে খুব পছন্দ করতেন। তাই ক্লারা তার স্বামীকে পাঠালেন একটি মুরগি জবাই করে নিয়ে আসার জন্য। শাশুড়ির এ পছন্দের কথা লয়েডেরও অজানা ছিলো না। তাই তিনি খুব দেখেশুনে সাড়ে পাঁচ মাস বয়সী এক মুরগীর বাচ্চাকে বেছে নিলেন। বাচ্চা এ মোরগটির নাম ছিলো মাইক।
মাইককে জায়গামতো রেখে তার মাথা বরাবর কুড়ালটি তাক করলেন লয়েড ওলসেন। শাশুড়ি যাতে গলার পুরোটাই খেতে পারেন তাই শুধুমাত্র মাথাটিই কাটতে চেয়েছিলেন তিনি। খুব দেখেশুনে, বুকভরা এক নিঃশ্বাস নিয়ে কুড়ালটি চালিয়ে দিলেন মি. লয়েড। কিন্তু হায়! এ কি দেখছেন তিনি? কেবলমাত্র মাথা কাটতে গিয়ে তিনি যে আসলে মাথাটিও ঠিকমতো কাটতে পারলেন না। বরং তিনি মাইকের একটি কান এবং মস্তিষ্কের প্রায় পুরোটাই কাটতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘটনা যদি এখানেই শেষ হতো তাহলেও কথা ছিলো। কিন্তু ঘটনা যে আসলে এখান থেকেই শুরু। এত ভয়াবহ একটি আঘাতের পরও কিছুই হলো না মাইকের। জবাই করা আট-দশটি মোরগ-মুরগীর মতো সে-ও কিছুক্ষণ মাটিতে গড়াগড়ি দিলো। শরীরটি তার রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো। তারপরই মাইক উঠে দাঁড়ালো! শুধু তা-ই নয়। লয়েডের চোখ কপালে তুলে দিয়ে সে মাটি থেকে খাবার খুঁটে খাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো! বাচ্চা মোরগটির এ অবস্থা দেখে অবশেষে দয়া হলো তার মালিকের। মাইককে ছেড়ে দিলেন তিনি।
পরদিন সকালের কথা। লয়েড আসলেন মাইককে দেখতে। তিনি ভেবেছিলেন এতক্ষণে মাইক বোধহয় মরে গেছে। কিন্তু মুরগির খোঁয়াড়ে এক নজর তাকিয়ে তার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। মাইক তার কাটা মাথাটি পাখার নিচে নিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে! একটি প্রাণির বাঁচার এত আকুলতা দেখে লয়েডের মন গলে গেলো। গতকাল যে মানুষটি মাইকের প্রাণবায়ু বের করে দিতে চেয়েছিলেন, তিনিই পরদিন মাইককে বাঁচাতে তৎপর হয়ে উঠলেন।
প্রথমেই লয়েডের মাথায় আসলো মাইকের খাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা। খুব ভেবেচিন্তে তিনি একটি চোখের ড্রপারকেই বেছে নিলেন। এর সাহায্যেই তিনি মাইককে পানি ও দুধের মিশ্রণ খাওয়াতে লাগলেন। এছাড়া মাঝে মাঝে মাইককে ছোট ছোট যবের দানাও খাওয়ানো হতো।
একসময় লয়েড বুঝতে পারলেন, মাইক আসলে বিশেষ কিছু। তাই মাইককে সঙ্গে করে ২৫০ মাইল পাড়ি দিয়ে তিনি চলে গেলেন সল্ট লেক সিটির উতাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানকার সংশয়বাদী বিজ্ঞানীরাও অপেক্ষা করছিলেন মাইককে দেখার জন্য, বুঝতে চাচ্ছিলেন মাথা ছাড়াও একটি মোরগের বেঁচে থাকার রহস্য। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা বুঝতে পারলেন, লয়েডের কুড়ালের আঘাত মাইকের মাথার কিছুটা কাটতে পারলেও কাটতে পারেনি তার জুগুলার ভেইন। সেই সাথে তাৎক্ষণিকভাবে জমাট বেঁধে যাওয়া রক্তও অবিরাম রক্তক্ষরণে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে মাইককে। যেহেতু একটি মুরগীর রিফ্লেক্স অ্যাকশনের অধিকাংশই তার মস্তিষ্কের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাই মাইক আসলে পুরোপুরি সুস্থই ছিলো। শুধু তার মাথাটাই ছিলো না, এই যা!
এবার লয়েডের মাথায় খেলে গেলো অন্য আরেক চিন্তা, “আচ্ছা, মাইককে দিয়ে ব্যবসা করলে কেমন হয়?” চিন্তা করতেই যা দেরি হলো। এর বাস্তবায়নে খুব একটা দেরি করলেন না তিনি। মাইককে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন এক ন্যাশনাল ট্যুরে। আস্তে আস্তে মাইকের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগলো বিশ্বজুড়ে। গিনেজ বুক অফ রেকর্ডসে জায়গা করে নিলো মাথাবিহীন মাইক। তাকে নিয়ে ফিচার হলো বিখ্যাত টাইম এবং লাইফ ম্যাগাজিনে। মাইককে এক নজর দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলো আমেরিকার মানুষজন। নিউ ইয়র্ক, আটলান্টিক সিটি, লস অ্যাঞ্জেলস এবং স্যান ডিয়েগোতে ২৫ সেন্টের টিকিট কেটে দলে দলে মানুষ তাকে দেখতে আসলো। বিস্ময়ের ঘোর যেন কারোরই কাটতে চায় না। খ্যাতির চুড়ায় থাকা অবস্থায় মাইকের মাসিক আয় ছিলো তখনকার দিনে ৪,৫০০ ইউএস ডলার! বর্তমান বাজারে এ অঙ্কটা ৪৭,৭০০ ইউএস ডলারের মতো। মাইকের দাম ধরা হয়েছিলো ১০,০০০ ইউএস ডলার। এর জন্য ইনস্যুরেন্সও করা হয়েছিলো ১০,০০০ ইউএস ডলারের। মাইকের বিভিন্ন শো ঠিকমতো পরিচালনা করার জন্য নিয়োগ দেয়া হলো একজন ম্যানেজারকেও!
দিকে দিকে মাইকের খ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিলো যে কেউ কেউ এতে বেশ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লো। তারা ভাবলো, “এ আর এমন কী? একটু সাবধানে মাথা কাটলেই তো হলো!” এ কথা ভেবে অনেকেই তাদের মুরগীর বাচ্চার মাথা কেটে ফেললো! কিন্তু আফসোস! সেসব মুরগীর বাচ্চার কোনোটিই দু-একদিনের বেশি বাঁচেনি। অতি লোভে তাতি নষ্ট কথাটির এক বাস্তব উদাহরণই যেন ছিলো এ ঘটনাগুলো।
মাইককে নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন ফটোশ্যুটের আয়োজন হতো। সেখানে লয়েড অথবা ম্যানেজার তার কাটা মাথাটি তার সামনে ধরে ছবি তুলতেন! আরো মজার ব্যাপার হলো, যে মাথাটিকে সবাই মাইকের মাথা ভাবতো সেটিও আসলে তার মাথা ছিলো না। লয়েডের পোষা বিড়াল অনেক আগেই সেটি নিয়ে চম্পট দিয়েছিলো!
কাটা মাথার মাইককে নিয়ে লয়েডের সময়গুলো বেশ ভালোই কাটতে লাগলো। ভুল করে কেটে ফেলা নিজের মাথাবিহীন পোষা মোরগকে দিয়ে যেন সংসারে সুদিন ফিরে এসেছিলো তার। কিন্তু উপরওয়ালার ইচ্ছে ছিলো বোধহয় অন্যরকম।
১৯৪৭ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। এক ট্যুর শেষ করে লয়েড তার দলবল নিয়ে অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফিনিক্সে যাত্রাবিরতি দিলেন। একটু বিশ্রাম শেষে সবাই যার যার মতো করে ঘুরতে বেরোলো, ঘরে রইলো শুধু মাইক। এতদিনের আদর-আপ্যায়নে মাইকও বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছিলো। আড়াই পাউন্ড থেকে আট পাউন্ডে গিয়ে ঠেকেছিলো তার ওজন।
হঠাৎ করেই মাঝরাতের দিকে দম বন্ধ হয়ে এলো মাইকের। আদরের মোরগের এমন দুরবস্থা দেখে হায় হায় করে উঠলেন লয়েড। সারা ঘর জুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন মাইককে খাওয়ানোর সেই ড্রপারটি। কারণ এ ড্রপার দিয়ে তিনি মাইকের খাদ্যনালী পরিষ্কার দিতেন। কিন্তু হায়! ড্রপারটি তিনি খুঁজে পেলেন না। আগের দিনের প্রদর্শনী শেষে ড্রপারটি ভুলে সেখানেই ফেলে এসেছিলেন তিনি। অনেক চেষ্টা করা হলো মাইককে বাঁচানোর। কিন্তু কোনো কিছুতেই লাভ হলো না। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাইকে কাঁদিয়ে দম বন্ধ হয়ে মারা গেলো মাইক।
মাইক মারা গেলেও হারিয়ে যায়নি তার স্মৃতি। তার এমন সাহসিকতা ও তেজস্বী মনোভাবের কথা কলোরাডোর মানুষেরা আজও ভুলতে পারেনি। তাই প্রতি বছর মে মাসের তৃতীয় রবিবার তারা আয়োজন করে Mike the Headless Chicken Festival যেখানে খাবারদাবার, গান ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্মরণ করা হয় মাইককে।