পম্পেই (Gnaeus Pompeius Magnus), যিনি পম্পেই দ্য গ্রেট নামেও পরিচিত, তার জন্ম ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তার পিতা পম্পেই স্ট্র্যাবো (Gnaeus Pompeius Strabo)। মূলত পম্পেই ও সিজারের সংঘাতই রোমান প্রজাতন্ত্রের কবর রচনা করে। তার থেকে উদ্ভব হয় রোমান রাজতন্ত্রের।
যোদ্ধা পম্পেই
সোশ্যাল ওয়ার্সের সময় পম্পেইয়ের বাবা অস্কালাম আক্রমণ করেন। এই সময় পম্পেইও তার সাথে ছিলেন। বলার মতো কিছু করতে না পারলেও সমরবিদ্যার হাতেখড়ি এই সময় থেকেই তিনি লাভ করেন। পরে সুলার দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে পম্পেই তার সুযোগ চিনতে ভুল করেননি। তার বাবা ততদিনে প্রয়াত হলেও পুরোনো সেনাদের কাছে স্ট্র্যাবোর আলাদা মর্যাদা ছিল। একে কাজে লাগিয়ে পম্পেই নিজেই একটি সেনাদল গঠন করে ফেলেন এবং সুলার সাথে যোগ দেন। ক্ষমতা দখলের পরে সুলা তাকে পাঠান সিসিলি আর আফ্রিকাতে পালিয়ে যাওয়া মারিয়ানদের বিহিত করতে। পম্পেই সাফল্যের সাথে সেই কাজ সমাপ্ত করেন।
এরপর তার চাপাচাপিতে সুলা তার জন্য ট্রায়াম্ফের ব্যবস্থা করেন, যদিও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পম্পেইয়ের সামাজিক অবস্থান ট্রায়াম্ফের যোগ্য ছিল না। মূলত এই সময় থেকেই পম্পেইয়ের খ্যাতি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুলা এই যুবকের মধ্যে সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খা লক্ষ্য করেছিলেন, তাই তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় পম্পেইকে কোনো উচ্চ রাজনৈতিক পদে আসীন হতে দেননি। যদিও পম্পেই তার স্ত্রী অ্যামেলিয়ার মৃত্যুর পরে সুলার সৎ মেয়ে মিউসিয়াকে (Mucia Tertia) বিয়ে করেছিলেন।
সুলার মৃত্যু ও পম্পেইয়ের উত্থান
৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কন্সাল নির্বাচিত হন লেপিডাস (Lepidus)। যদিও পম্পেইয়ের ইচ্ছা ছিল কন্সাল হবার, কিন্তু মারা যাবার আগে সুলার সমর্থন লেপিডাসের দিকে ছিল, যদিও লেপিডাস সুলার করা আইন বাতিল করার পক্ষে ছিলেন। কন্সাল হবার পর তিনি স্বল্পমূল্যে সরকারি ভাঁড়ার থেকে খাদ্যশস্য প্রদানের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করেন, যা সুলা ইতোপূর্বে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি সুলার ক্ষমতাগ্রহণের পরে যেসব মারিয়ানের ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তা-ও ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। তবে তিনি সফল হতে পারেননি।
এদিকে পরের বছর কন্সাল হিসেবে পম্পেই ক্যাটালাসকে (Quintus Lutatius Catulus) সমর্থন দিলেন। লেপিডাস প্রকন্সালের দায়িত্ব নিয়ে সিসাল্পাইন গলের চলে যান। কিন্তু তিনি রোমে তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার তাগিদ ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। তিনি সিসাল্পাইন গলে সৈন্যবাহিনী তৈরি করে রোমের দিকে এগিয়ে এলেন। উদ্দেশ্য জোর করে কন্সালের পদ দখল করে সুলার করা সমস্ত আইন একবারে রদ করে ফেলা। ক্যাটালাস আর পম্পেই তাকে বাধা দেন। লেপিডাস পালিয়ে সার্ডিনিয়া চলে যান, সেখানেই কিছু সময় পরে তার মৃত্যু হয়। মার্কাস পার্পের্না (Marcus Perperna) লেপিডাসের বেঁচে যাওয়া সেনাদের নিয়ে হিস্পানিয়ে পাড়ি জমান, যেখানে মারিয়ানরা সিনেটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।
হিস্পানিয়াতে পম্পেই
৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কন্সাল সিনা হিস্পানিয়ার এক অংশে (Hispania Citerior) সার্টোরিয়াসকে (Quintus Sertorius) গভর্নর নিযুক্ত করেন। সামরিক কমান্ডার হিসেবে তার নামডাক ছিল। সিনার পতনের পর ৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুলার প্রতিনিধিরা সার্টোরিয়াসকে পদচ্যুত করে। তিনি পালিয়ে গেলেও পরের বছরই লুসিটানিয়ানরা বিদ্রোহ করে এবং সমরকুশলতার জন্য সার্টোরিয়াসের সাহায্য চেয়ে পাঠায়। তার গেরিলা কৌশলে রোমান বাহিনী যথেষ্ট পর্যুদস্ত হয়। সুলা কন্সাল মেটেলাসকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করলেও তিনি সুবিধা করতে পারেননি। উল্টো ৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিস্পানিয়ার একাংশের প্রিট্রর যুদ্ধে নিহত হন, পরের বছর গল থেকে মেটেলাসের সহায়তায় আসা প্রকন্সালেরও একই পরিণতি হয়। হিস্পানিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল সার্টোরিয়াসের অধীনে চলে যায়। সেখানে বহু মারিয়ান আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে পার্পের্নাও ছিলেন।
এই অবস্থায় সিনেট ৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পম্পেইকে হিস্পানিয়ার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়। ৪০,০০০ সেনা নিয়ে পরের তিন বছর চেষ্টা চালিয়েও পম্পেই সার্টোরিয়াসকে কাবু করতে ব্যর্থ হন। এর মধ্যে সার্টোরিয়াস মিথ্রিডেটসের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হলেন এবং তার অধীনস্ত রোমান অফিসারদের পাঠালেন মিথ্রিডেটসের সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য।
এদিকে পম্পেই সিনেটে কাছে নতুন করে আরো সেনার আবেদন করেন। সেনা মঞ্জুর হলে হিস্পানিয়ার যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ৭৩-৭৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বেশ কিছু লড়াইয়ে সার্টোরিয়াসের সেনারা পরাজিত হয়। তার সহযোগীদের আচরণে স্প্যানিশ অনেক গোত্র দলত্যাগ করে পম্পেইয়ের সাথে যোগ দেয়। এদিকে ক্ষমতার কোন্দলে ৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পার্পের্না সার্টোরিয়াসকে হত্যা করেন। এরপর তিনি পম্পেইয়ের সাথে খোলা ময়দানে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। পম্পেই তাকে পরাজিত করেন। পার্পের্না বন্দি হন, তাকে পরে হত্যা করা হয়।
হিস্পানিয়া বশীভূত করে সিনেটের নির্দেশে পম্পেই ৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে ফিরে এলেন। স্পার্টাকাসে বিদ্রোহ দমনের জন্যই মূলত সিনেট তাকে রোমে ডেকে পাঠায়। কিন্তু তিনি ইতালিতে এসে পৌঁছতে পৌঁছতেই ক্রাসুস স্পার্টাকাসের মূল বাহিনীকে পরাস্ত করে স্পার্টাকাসকে হত্যা করেছিলেন। পম্পেই ৫,০০০ দাসের পালিয়ে যাওয়া একটি দল দেখতে পেয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেন। এর সূত্র ধরে তিনি বিদ্রোহ নির্মূলের কৃতিত্ব দাবী করেন।
ক্রাসুস ও পম্পেইয়ের জোট
৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কন্সাল নির্বাচনে ক্রাসুস ও পম্পেই উভয়েই দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন। এজন্য সিনেটের উপর চাপ প্রয়োগ করতে তারা নিয়ম থাকা সত্ত্বেও কেউই তাদের সেনাদল ভেঙে দেননি। সিনেট তাদের কারো প্রার্থীতায় রাজি ছিল না। কারণ পম্পেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার শর্তাবলি পূরণ করেন না, এবং ক্রাসুস আগের বছর প্রিটর থাকায় প্রচলিত নিয়মে সে বছর নির্বাচন করতে পারেন না। উপরন্তু সিনেট এদের দুজনের উচ্চাভিলাষ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল, ফলে তাদের প্রতি অবিশ্বাস খুব জোরাল ছিল।
সিনেটের অনড় মনোভাব দেখে ক্রাসুস ও পম্পেই পারস্পরিক ঈর্ষা ত্যাগ করে একজোট হলেন। তারা পপুলেয়ারদের নিজেদের পক্ষে টেনে আনেন এই কথা বলে যে সুলা ট্রিবিউনের যেসব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন তারা তা ফিরিয়ে দেবেন। অন্যদিকে ইকুইটদের তারা পুনরায় জুরি হিসেবে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন, যা সুলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই জোটের দাবির মুখে সিনেট পিছু হটতে বাধ্য হয়। ক্রাসুস ও পম্পেই বিশেষ আইনে কন্সাল পদে মনোনয়ন পেলেন এবং সেই বছরের জন্য নির্বাচিতও হলেন।
কন্সাল হয়েই পম্পেই ও ক্রাসুস ট্রিবিউনের আগের মর্যাদা পুনর্বহাল করলেন। ফলে ট্রিবিউনরা আবার সিনেটের তদারকি ছাড়া স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ফিরে পায়। নতুন কন্সালরা জুরি প্যানেল পুনর্গঠন করে তিনজনের দলে ভাগ করেন। নিয়ম করা হয় এদের মধ্যে একজন আসবেন সিনেট থেকে, একজন ইকুইট শ্রেণী থেকে আর শেষোক্তজন ইকুইটদের ঠিক নিচের সামাজিক শ্রেণী, ট্রিবিউন এরারি (tribuni aerarii) থেকে।
প্রাচ্যে পম্পেই
গ্যাবিনিয়ান আইন: সিলিসিয়ান জলদস্যুদের ভূমধ্যসাগরে মোটামুটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। প্রথমে আন্টোনিয়াস আর পরে মেটেলাস চেষ্টা করেও তাদের বশে আনতে পারেননি। সাফল্য এটুকুই ছিল যে মেটেলাস ক্রিট দ্বীপ, যেখানে জলদস্যুদের ঘাঁটি ছিল, তা রোমের প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলেন। ক্রমেই জলদস্যুদের উৎপাত বাড়তে থাকে। তারা এতটাই সাহসী হয়ে ওঠে যে ইতালির উপকূল এবং রোমান বন্দর অস্টিয়াতেও লুটতরাজ চালাতে শুরু করে। ফলে শহরে খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। বোঝাই যাচ্ছিল এই আপদ দূর করতে শক্তিশালী একজন সেনানায়কের প্রয়োজন, যার ক্ষমতার পরিধি হতে হবে অত্যন্ত বিস্তৃত। সমস্ত হিসেবে এই কাজের জন্য একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন পম্পেই। কন্সালের মেয়াদ শেষ হবার পর তিনি অন্য কোনো পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে রোমেই অবস্থান করেছিলেন। সিনেট তার হাতে লাগামহীন ক্ষমতা তুলে দিতে রাজি ছিলনা।
এই পরিস্থিতিতে পম্পেই ট্রিবিউনের আইন প্রণয়নের সুবিধা কাজে লাগান। গ্যাবিনিয়াস (Aulus Gabinius) নামে তৎকালীন ট্রিবিউন ৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জলদস্যুদের দমনে একজন কম্যান্ডারের প্রস্তাব তোলেন, যার পদমর্যাদা হবে কন্সালের সমমানের, এবং তার আওতায় থাকবে জিব্রাল্টার থেকে শুরু করে রোমের অধিভুক্ত এলাকার অন্তর্গত সকল সাগর, এমনকি তীর থেকে পঞ্চাশ মাইল ভেতর পর্যন্ত এলাকাও। তিনি রাষ্ট্র প্রদত্ত অর্থের বাইরেও নিজের বাহিনীর জন্য যেকোনো উপায়ে অর্থ সংস্থান করতে পারবেন, এবং নিজের পছন্দ অনুযায়ী সেনাদল তৈরি করার ক্ষমতা পাবেন। তার মেয়াদ হবে তিন বছরের, এবং তিনি শত্রুদের প্রতি তার বিচার-বুদ্ধি মোতাবেক পদক্ষেপ নিতে পারবেন, এজন্য সিনেটের অনুমোদন দরকার হবে না। যদিও সরাসরি পম্পেইয়ের নাম বলা হয়নি, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছিল তাকে মাথায় রেখেই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সিনেট এর বিরুদ্ধে থাকলেও গ্যাবিনিয়াস আইন পাশ করে নেন, সিনেট বাধ্য হয় পম্পেইকে এই পদে নিযুক্ত করতে।
সাগরে সাফল্য: পম্পেই দ্রুততার সাথে কাজে নেমে পড়েন। চল্লিশ দিনের মাঝেই পশ্চিম ভূমধ্যসাগর থেকে জলদস্যুদের উৎখাত করা হয়। আরও ঊনপঞ্চাশ দিনের মধ্যে সিলিসিয়াতে তাদের শক্ত ঘাঁটিগুলো রোমানদের দখলে চলে আসে। পম্পেই দস্যুদের প্রতি যথেষ্ট সদয় আচরণ করেন। তিনি তাদের ক্ষমা করেন, এবং অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষয়িষ্ণু জনসংখ্যার অনেক রোমান কলোনিতে এদের পুনর্বাসন করা হয়। তার মেয়াদের তখন বহু সময় বাকি।
এশিয়া মাইনরে অভিযান: তৃতীয় মিথ্রিডেটিক যুদ্ধে তখন একরকম অচলাবস্থা বিরাজ করছে। ফলে ম্যানিলিয়াস (Caius Manilius) নামে এক ট্রিবিউন ৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিদ্যমান ক্ষমতার সাথে বিথাইনিয়া আর সিলিসিয়া প্রদেশের দায়িত্বভার পম্পেইয়ের হাতে অর্পণের প্রস্তাব দিলেন। এবারও সিনেটের বিরোধিতা সত্ত্বেও তা পাশ হয়ে গেল। পম্পেই তার প্রয়োজন অনুযায়ী যে কারো সাথে সন্ধি বা যুদ্ধে করার অধিকার লাভ করলেন। এক অভূতপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তিনি পা রাখলেন এশিয়া মাইনরে। মিথ্রিডেটসকে তিনি পরাজিত করেন এবং আর্মেনিয়ার সাথে মৈত্রী সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। ককেশাসে কিছু বিচ্ছিন্ন অভিযান শেষে তিনি পন্টাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে রোমান প্রদেশভুক্ত করলেন। ৬৪/৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পম্পেই নজর দিলেন সিরিয়ার দিকে। এখানে তিনি রোমান প্রভুত্ব কায়েম করেন। তার সেনাদল জুডিয়া (Judaea) রাজ্যে অভিযান পরিচালনা করে এবং জেরুজালেমের তৎকালীন টেম্পলে ঢুকে লুটপাট করে। জুডিয়া পরিণত হয় রোমান অঞ্চলে। ৬২/৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পম্পেই রোমে ফিরে এলেন।
জুলিয়াস সিজার
সিজারের জন্ম ১০০, মতান্তরে ১০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তার বাবার নামও ছিল সিজার, এবং তিনি একসময় এশিয়াতে প্রিটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তার মা অরেলিও কটা ছিলেন অভিজাত বংশীয়। বাবা-মা দুজনেই পপুলেয়ারপন্থী ছিলেন। সিজারের বয়স যখন ষোল তখন তার বাবার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে সিজার প্রভাবশালী মারিয়ান সিনার মেয়ে কর্ণেলিয়াকে বিয়ে করেন। ফলে সুলা যখন ক্ষমতা দখল করলেন তখন সিজার তার রোষানলে পড়েন। সৌভাগ্যক্রমে তার প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজনেরা সুলার কাছে তার প্রাণভিক্ষা মঞ্জুর করতে সমর্থ হন। তবে সিজারের সম্পত্তি ও সামাজিক মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিজার রোডসে চলে যান। বলা হয়, এসময় তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং এশিয়া মাইনরে বেশ কিছু সমরাভিযানে অংশ নেন। যা-ই হোক না কেন, সুলার মৃত্যুর পরে তিনি রোমে ফিরে আসেন বিতার্কিক হিসেবে নিজের দক্ষতা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে কাজে লাগান।
জলদস্যুদের হাতে জিম্মি: ৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কোনো কাজে গ্রিসে যাবার সময় সিজার জলদস্যুদের হাতে অপহৃত হন। তিনি তাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন ছাড়া পেয়ে প্রত্যেককে তিনি খুঁজে বের করে হত্যা করবেন। দস্যুরা তার কথা হেসে উড়িয়ে দেয়, তবে তারা সিজারের সাথে নমনীয় আচরণ করে। মোটা অঙ্কের মুক্তিপণের বিনিময়ে আত্মীয়রা সিজারকে ছাড়িয়ে নেয়। এরপর সিজার তার কথা রাখেন। তিনি দস্যুদের খুঁজে বের করেন। তার সাথে ভাল আচরণের জন্য তিনি দস্যুদের সরাসরি ক্রুশবিদ্ধ না করে প্রথমে তাদের গলা কেটে হত্যা করে তারপর তাদের দেহ ক্রুশে টাঙিয়ে দেন।
রাজনীতিতে সিজারের উত্থান: ৬৯/৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিস্পানিয়াতে সিজার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। রোমে এসে তিনি এডিলের দায়িত্ব নেন। সিজার সাধারণ নাগরিকদের জন্য নিজ অর্থে আমোদ-প্রমোদ এবং ভোজের ব্যবস্থা করতেন। যেকোনো উৎসবে জনগণের জন্য তিনি কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করতেন। ফলে দ্রুতই তিনি রোমান নাগরিকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করতেন ক্রাসুস, তিনি পম্পেইয়ের ক্রমাগত ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল সিজারকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। এদিকে সিজার ক্রমেই দেনার দায়ে নাক পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছিলেন। সামরিক বিজয় ছাড়া দ্রুত অঢেল অর্থ আদায় করার আর কোনো পথ তার সামনে ছিল না।
ক্যাটিলিনারিয়ান ষড়যন্ত্র
রোমে ক্রমশই এক অশুভ শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। এর মধ্যে ছিল সেসব মারিয়ান যাদের সম্পত্তি সুলার সময় বাজেয়াপ্ত হয়েছে, আর তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা ৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পম্পেই ও ক্রাসুসের সংস্কারের সময় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বাদ পড়েছে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যেই ক্ষমতা ও সম্পদের লোভ ছিল। এদেরই একজন প্যাট্রিশিয়ান ক্যাটিলিন (Lucius Sergius Catilina)। প্রচণ্ড রকম নীচ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ক্যাটিলিন সুলার আমলে বহু মারিয়ানের সহায়-সম্পদ দখল করে নিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত গুন্ডাবাহিনী পুষতেন এবং তাদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে প্রায়ই হয়রানি করতেন।
৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কন্সাল নির্বাচনে তিনজন প্রার্থী ছিলেন খ্যাতনামা আইনজ্ঞ সিসেরো, অ্যান্টোনিয়াস আর ক্যাটিলিন। ক্রাসুস দ্বিতীয়জনকে আর সিজার শেষোক্তজনকে তলে তলে সমর্থন দিচ্ছিলেন। অপ্টিমেটরা ক্যাটিলিনের তীব্র বিরোধী ছিল। কাজেই সিসেরো আর অ্যান্টোনিয়াস নির্বাচিত হন। সিসেরো দায়িত্ব নিয়েই ট্রিবিউন রুলাসের (Servilius Rullus) প্রস্তাবিত জমি পুনর্বন্টন সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। মূলত এই আইন প্রস্তাব করা হয় সিজার ও ক্রাসুসের চাপে, যেখানে দশ সদস্যের এক কমিটি করার কথা ছিল যারা ইতালি ও পম্পেইয়ের দখলকৃত সমস্ত এলাকাতে ভূমি বেচাকেনা ও বিলিবন্টনের অভূতপূর্ব ক্ষমতা লাভ করবে। পম্পেইকে আইনের সূক্ষ্ম ফাঁদে ফেলে কমিটির বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবের বিপক্ষে প্রবল জনমত তৈরি হলে সিজার ও ক্রাসুস একে ভোটে তোলার সাহস পাননি। এতসবের মধ্যেই সিজার একদিক থেকে সুসংবাদ পেলেন। রোমের প্রধান পুরোহিত, বা পন্টিফ্যাক্স ম্যাক্সিমাসের পদ, যা সুলা রহিত করে দিয়েছিলেন, পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল। সেই পদে সিজার সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হন।
৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের জুলাই মাসে পরবর্তী বছরের কন্সাল নির্বাচনের সময় হলো। ক্যাটিলিন আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন, কিন্তু এবার আর সিজার তার পেছনে ছিলেন না। অনুমিতভাবেই অপ্টিমেটরা আবারও তার বিপক্ষে দাঁড়ালে তিনি হেরে যান। এবার ক্যাটিলিন ও তার সমর্থকেরা জোর করে ক্ষমতা দখল করতে চাইলেন। ক্যাটিলিন শহর ত্যাগ করে ইট্রুরিয়া চলে যান, যেখানে গোপনে তার অনুসারীরা একটি সৈন্যদল গড়ে তুলেছিল। পরিকল্পনা হয় ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ ক্যাটিলিনের সমর্থকেরা রোমে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করবে যার সুযোগে কন্সালদের হত্যা করে ক্যাটিলিন ক্ষমতা দখল করবেন।
সৌভাগ্যক্রমে সিসেরো এই ভয়াবহ চক্রান্তের সংবাদ পেয়ে যান। অবিলম্বে সিনেটের দ্বারা অর্পিত ক্ষমতার জোরে সিসেরো রোমে ক্যাটিলিনের সকল অনুসারীদের গ্রেফতার করেন। তদের সকলকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সিজার যদিও লঘু শাস্তির পক্ষে মত দেন, তবে আদর্শবান তরুণ সিনেটর কাটো (Marcus Porcius Cato) সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে অটল ছিলেন। সিজার এখানে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে নেন। তিনি জানতেন শেষ পর্যন্ত এদের মৃত্যুদণ্ড হবে, কিন্তু নিজে এর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি কিছুটা উদার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন এবং ক্যাটিলিনের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকেই তার পক্ষে চলে আসে।
এদিকে অপর কন্সাল অ্যান্টোনিয়াস ইট্রুরিয়ার দিকে যাত্রা করলেন। ক্যাটিলিন রোমে বিপর্যয়ের সংবাদ পেয়ে সিসাল্পাইন গল অঞ্চলে প্রবেশ করেন। এখানে পিস্টোরিয়াতে সংঘর্ষে ক্যাটিলিন আর তার সমর্থকেরা নিহত হন। এরপর ৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার হিস্পানিয়াতে প্রিটর হিসেবে চলে যান এবং পরের বছর সেখানেই গভর্নর হিসেবে কাজ করেন।
দ্য ফার্স্ট ট্রায়াম্ভিরেট
সিরিয়া থেকে রোমে ফিরে পম্পেই তার সেনাদল ভেঙে দেন। ৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সেপ্টেম্বরে তিনি এক জাঁকজমকপূর্ণ ট্রায়াম্ফ উদযাপন করলেন। তিনি তার সেনাদের জন্য জমি দাবী এবং এশিয়া মাইনরে করা প্রশাসনিক সংস্কার সিনেটকে অনুমোদন করতে বলেন। কিন্তু তার এবার সিনেট বেঁকে বসে। তারা দেখছিল যে পম্পেই এখন আর কোনো সেনাবাহিনী কম্যান্ড করছেন না, ফলে তার কাছ থেকে ভয় পাবার কিছু নেই। সুতরাং তারা পম্পেইকে জানায় তার কাজ পরিপূর্ণভাবে পরীক্ষা করে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। একই সময় এশিয়ার রাজস্বের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ইকুইটদের সাথে অপ্টিমেটদের ঝামেল তৈরি হয়। ফলে সিনেট পম্পেই এবং ইকুইট দুই দলকেই দূরে ঠেলে দেয়।
এদিকে হিস্পানিয়াতে সিজার বেশ কিছু যুদ্ধে জয় পান এবং সেখানে রোমের ক্ষমতা পূর্বের থেকে অধিক শক্তিশালী করেন। ৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে ফিরে এসে তিনি দুটি দাবী করেন: ট্রায়াম্ফ এবং পরের বছর কন্সাল নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতি। সিনেট গড়িমসি করতে থাকলে তিনি ট্রায়াম্ফের দাবী তুলে নেন, কিন্তু কন্সাল হবার আশা ছাড়লেন না। এই পর্যায়ে তৎকালীন রোমের সবচেয়ে ক্ষমতাধর তিন ব্যক্তি একবিন্দুতে মিলে গেল। সিজার, পম্পেই ও ক্রাসুস গোপনে এক কোয়ালিশন গঠন করলেন, যা ইতিহাসে দ্য ফার্স্ট ট্রায়াম্ভিরেট নামে সুপরিচিত। পম্পেই তার পুরোনো সেনাদের ডেকে পাঠালেন। এই সময় থেকে রোমের সর্বময় ক্ষমতা চলে যায় ট্রায়াম্ভিরেটের হাতে।
কন্সাল সিজার
পম্পেই ও ক্রাসুসের পৃষ্ঠপোষকতায় সিজার কন্সাল নির্বাচিত হন, অপর কন্সাল হলেন অপ্টিমেট বিবুলাস (Calpurnius Bibulus)। সিজার প্রথমে সিনেটের মাধ্যমে তার আইন পাশের চেষ্টা করেন, কিন্তু বিবুলাস তাকে ব্যর্থ করে দেন। ফলে সিজার সরাসরি ট্রিবিউনদের সহায়তা নিয়ে আইন প্রণয়ন করেন। বিবুলাস ও কাটো বাধা দিতে চেষ্টা করলে পম্পেইয়ের সেনারা তাদের নিষ্ক্রিয় করে দেয়। প্রতিবাদে বিবুলাস নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে ফেলেন। এদিকে সিজার সমস্ত আইন অনুমোদন করিয়ে নেন। পম্পেইয়ের সেনাদের জমি দেয়া হয় এবং এশিয়া মাইনরে তার সমস্ত সংস্কার বৈধতা পায়। ক্রাসুসের সমর্থিত ইকুইটরাও এশিয়া থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের ভাগিদার হলো। কিন্তু সিজার জানতেন, তার মেয়াদ শেষ হওয়ামাত্র সিনেট তাকে বিচারের মুখোমুখি করবে। এদিকে ক্রাসুসে কাছেও তার দেনার পরিমাণ পাহাড় সমান হয়ে পড়েছিল। এমন সময় তার সামনে নতুন সুযোগ ধরা দিল।
ভ্যাটিনিয়ান আইন: গল অঞ্চল তখন পর্যন্ত পুরোপুরি রোমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সিসাল্পাইন গল রোমের প্রদেশের মধ্যে ছিল, কিন্তু ট্রান্সাল্পাইন গল সরাসরি রোমের অধিভুক্ত ছিল না। এখানে রোম বিভিন্ন গোত্রের সাথে মৈত্রীচুক্তির মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বজায় রেখেছিল। কিন্তু এই এলাকাতে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। এমন সময় ৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ফেব্রুয়ারিতে সিসাল্পাইন গলের প্রো-কন্সাল মেটেলাস মারা গেলে সেখানে নতুন কাউকে পাঠানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ট্রিবিউন ভ্যাটিনিয়াস (Vatinius) সিজারের নাম প্রস্তাব করলেন। মার্চ, ৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের জন্য সিজারকে সিসাল্পাইন আর ট্রান্সাল্পাইন অঞ্চলের দায়িত্ব প্রদান করা হল।
ট্রায়াম্ভিরের ক্ষমতা সুসংহতকরণ: সিজার, পম্পেই আর ক্রাসুস কেউই তাদের ক্ষমতা বিসর্জন দিতে আগ্রহী ছিলেন না। তারা নিজেদের কোয়ালিশন বজায় রাখলেন এবং তাদের সমস্ত প্রতিপক্ষকে দমন করার পরিকল্পনা নিলেন। ৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কন্সাল হিসেবে তাদের দুই সমর্থককে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলো। সম্পর্ক মজবুত করার স্বার্থে সিজার নিজ কন্যা জুলিয়াকে বিয়ে দেন পম্পেইয়ের সাথে, আর নিজে পরের বছরের কন্সাল পিসোর এক মেয়েকে বিয়ে করেন।
ট্রায়াম্ভিরের মূল হুমকি ছিলেন সিসেরো আর কাটো। সিসেরোর বিরুদ্ধে ট্রিবিউন ক্লডিয়াসকে কাজে লাগানো হয়। ক্যাটিলিনের সমর্থকদের মৃত্যুতে সিসেরোর ভূমিকা মাথায় রেখে ক্লডিয়াস আইন করেন যে, কোনো রোমান যদি যথাবিহিত আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া আর কোনো রোমানের মৃত্যুর জন্য দায়ী হয় তাহলে তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। সিসেরো আইনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পালিয়ে গেলেন। মেসিডোনিয়ার গভর্নর তাকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন। তার অনুপস্থিতিতেই তাকে রোমে থেকে নির্বাসন দেয়া হলো। তার সম্পত্তি রাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করে নেয়।
কাটোর জন্য ট্রায়াম্ভির ভিন্ন রাস্তা অবলম্বন করল। তারা জানতেন আদর্শবান কাটো রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। সবেমাত্র সাইপ্রাস রোমান রাজ্যভুক্ত হয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও অন্যান্য পরিবর্তন দরকার। সেই দায়িত্ব দেয়া হলো কাটোকে। ফলে পথের কাঁটা সিসেরো ও কাটো দুজনেই রোম থেকে বিতাড়িত হয়ে গেল। সিজার নিশ্চিন্ত মনে গলের পথ ধরলেন।