১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হওয়ার পর বিশ শতকের পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্র অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিলো। শ্রমজীবীদের এই সফল আন্দোলন ইউরোপসহ অন্যান্য মহাদেশেও বিপ্লবের চেতনা নিয়ে আসছিলো। বিশেষ করে ইউরোপের পূর্বাঞ্চল নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিকভাবে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। তদুপরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি আক্রমণ ও সোভিয়েত বাহিনীর প্রতিরোধ এই প্রবণতাকে আরো তীব্র করে তুলেছে।
এজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো নিরাপত্তা ও আদর্শিক বিভিন্ন কারণে সোভিয়েত বলয়ে চলে যেতে থাকে। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন না, কঠোরতার মাধ্যমে নিজের দেশে হত্যাকাণ্ডের রাজনীতি প্রতিষ্ঠারও অন্যতম নায়ক ছিলেন। পূর্ব ইউরোপের অনেক শাসকই আদর্শ হিসেবে তাকে মেনেছেন। ফলে রক্তপাতকে তারা রাজনীতির জন্য রীতিমতো দরকারী করে তুলেছিলেন।
রোমানিয়ার নিকোলাই চাসেস্কু ছিলেন এমনই একজন শাসক। অনেকে তাকে ‘কার্পেথিয়ানের কসাই’ও বলে, তবে ‘বলকানের কসাই’এর মতো এই উপাধি কিছুটা কম প্রচলিত। তার আমলে রোমানিয়ার লেবার ক্যাম্প, গুপ্তহত্যা ও প্রহসনের বিচারে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো।
১৯১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি চাসেস্কু রোমানিয়ার স্করনিসেৎসি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। খুবই দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। ১৯২৯ সালে ১১ বছর বয়সে তিনি কাজের সন্ধানে বুখারেস্টে আসেন। এখানে তিনি জুতা তৈরির কারখানায় নবিশ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩২ সালে তিনি স্থানীয় ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দেন। ত্রিশের দশকে তিনি পার্টির কাজে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে বেশ সক্রিয় হবার কারণে কয়েকবার জেলের ঘানিও টানেন। ১৯৪০ সালে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকার সময় কমিউনিস্ট নেতা জর্জি জর্জুদেজের সাথে পরিচিত হন। এই রাজনীতিবিদের ব্যক্তিত্বে চাসেস্কু বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। উল্লেখ্য, ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকার সময়ই তিনি পড়াশোনা করেন এবং বুখারেস্ট একাডেমি অব ইকোনমিক্স থেকে ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
১৯৪৪ সালে মুক্তির পর তাকে ‘ইউনিয়ন অব কমিউনিস্ট ইউথ’ এর সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৬ সালে অল্টেরিয়া কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক সম্পাদক হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এ বছর তিনি ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি’ নামে পরিচিত রোমানিয়ার পার্লামেন্টের সদস্যও নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, ১৯৩৯ সালে পরিচিত হওয়ার পর এলেনা পেত্রুস্কাকে এ বছরই বিয়ে করেন।
নিকোলাই চাসেস্কু ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। পার্লামেন্টের সক্রিয় সদস্যপদ ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তার হাতে ন্যস্ত ছিলো। ওয়ার্কার্স পার্টির দলীয় পদেও ধীরে ধীরে তিনি উচ্চ স্থানে আরোহণ করতে লাগলেন। ১৯৫৫ সালে পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হন। এ সময় দলীয় পর্যায়ে তার মর্যাদা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরেই দ্বিতীয় স্থানে ছিলো। ১৯৬৫ সালের ২২ জুলাই জর্জি জর্জুদেজ মৃত্যুবরণ করেন। চাসেস্কু রোমানিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এ বছরই দেশটিতে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়- এর নতুন নাম হয় ‘সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব রোমানিয়া’।
ধীরে ধীরে তার ক্ষমতার পরিধি বেড়ে চলল। এর সাথে বেড়ে চলল সেই ক্ষমতার ব্যবহারের মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ তৈরির আকাঙ্ক্ষা।
১৯৬৬ সালে রোমানিয়ার জনসংখ্যায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হন। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিলো শিশু ও মায়ের মৃত্যুহার কমানো, জন্মহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করে দ্বিগুণের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, অনাথ ও পঙ্গু শিশুদের সংখ্যা কমানো! দুস্থ ও রুগ্ন শিশুদের জন্য জনপদ থেকে ভিন্ন আবাস তৈরি করা হয়- যেখানে এসব শিশুদের অমানবিক ও নিষ্ঠুর পরিবেশে রাখা হতো।
ষাটের দশকে চাসেস্কু ‘আরবান অ্যান্ড রুরাল সিস্টেমাইজেশন’ নামে এক বড় প্রকল্প হাতে নেন। এর উদ্দেশ্য ছিলো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নতুন প্রকল্প ‘এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেন্টার’ এর জন্য জনশক্তি সংগ্রহ করা। এজন্য বেশ অভিনব ও নৃশংস পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষকে ছিন্নমূল করে জোরপূর্বক অন্যত্র কাজ করতে বাধ্য করা হয়, যা হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ও স্ট্যালিনের লেবার ক্যাম্পের কথা মনে করিয়ে দেয়।
১৯৬৭ সালে চাসেস্কু এক নতুন বৈপ্লবিক পথ অবলম্বন করেন। রোমানিয়াতে নতুন ‘স্টেট সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট’ খোলা হয়। এই সরকারী সংস্থার এজেন্টদের সারা দেশে সাধারণ ও নিরীহ নাগরিকদের উপরে গোপন নজরদারি ও তৎপরতা চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হলো। যেকোনো প্রকারের বৈদেশিক সম্পর্ক রাখার কারণে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গ্রেফতার করা হতো। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের মিথ্যা প্রমাণের অজুহাতে অসংখ্য মানুষ জেলহাজতে অত্যাচার ও অঙ্গহানির শিকার হয়।
১৯৬৯ সালে চাসেস্কু রোমানিয়ার সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। এর ফলে দেশটির সামরিক শক্তির উপরে তার অদম্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ১৯৭৪ সালের ২৮ মার্চ নিকোলাই চাসেস্কুর জন্য ‘প্রেসিডেন্ট অব দ্য রিপাবলিক’ পদ তৈরি করা হয়। তিনি এই পদের আজীবন অধিকারী হিসেবে ঘোষিত হন। ফলে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের আত্মীয়স্বজন ও একান্ত অনুগত লোকজনকে নিয়োগ করা একরকম বাধাহীন হয়ে যায়। অন্ধ ব্যক্তিপূজার বাড়াবাড়ি ও বিরোধী মতকে কঠোরভাবে দমন করা নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেলো।
১৯৮২ সালে রাষ্ট্রের বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমানোর জন্য নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপের অধীনে সাধারণ নাগরিকদের উপর করের বোঝা বেড়ে গেলো। এছাড়া রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের সিংহভাগ রপ্তানি খাতে চলে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব দেখে দিয়েছিলো। জীবনযাত্রার মান আশঙ্কাজনক হারে নেমে যাচ্ছিলো। বলা হয়, খাদ্যের অভাবে সেসময় ফি বছর প্রায় ১৫,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় এসব খবর চেপে যাওয়া হয়।
আশির দশকের শেষের দিকে পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক আবহাওয়া পরিবর্তিত হতে থাকে। কঠোর একনায়কদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশগুলোতে বিরোধীদের সশস্ত্র আবির্ভাব দেখা যাচ্ছিলো। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে চাসেস্কু রোমানিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। এ বছরের ১৬ ডিসেম্বরে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে সরকার-বিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো। ১৭ ডিসেম্বর দাঙ্গার নেতারা পার্টির সেন্ট্রাল অফিসের দিকে সমবেত হবার ঘোষণা দেয়। চাসেস্কু সমবেত বিদ্রোহীদের উপর গুলি চালানোর হুকুম দেন। প্রায় ৪,০০০ বিদ্রোহীর মৃতদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সরকারি হিসেবের নীতি অনুযায়ী চেপে যাওয়া হলো হতাহতের আসল সংখ্যা।
কিন্তু বিরোধীদের আন্দোলন থেমে থাকলো না। নৈরাজ্য আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো। অস্ত্র ব্যবহার করেও জনমনে জন্মানো ক্ষোভ দমন করা যাচ্ছিলো না। ২০ ডিসেম্বর উত্তেজিত জনতা কার্যত শহরের দখলদার হয়ে উঠলো। দলত্যাগী অনেক সামরিক সদস্যও তাদের সাথে যোগ দিলো। পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের একক রাজত্বের দিন বুঝি শেষ হয়ে আসছিলো।
চাসেস্কু ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার শেষ চেষ্টা করলেন। পার্টির উপর জনগণের অসীম আস্থা প্রমাণে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষের সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিলো। বুখারেস্টে কম্যুনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল অফিসের সামনে দেওয়া চাসেস্কুর ভাষণ জাতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিলো। সেখানেও জনরোষ ঠেকানো গেলো না। পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলো। এমনকি রোমানিয়ার সামরিক বাহিনীও নিকোলাই চাসেস্কুর উপর থেকে সমর্থন উঠিয়ে নিচ্ছিলো।
পরিস্থিতি আর বিদ্রোহ দমন করার মতো নয়- শাসকের নিজের প্রাণ বাঁচানোর মতো হয়ে গিয়েছিলো। ২২ ডিসেম্বর চাসেস্কু তার স্ত্রীকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে বিদেশে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। রাজধানী থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে চাসেস্কু দম্পতি গ্রেফতার হলেন। ২৫ ডিসেম্বর বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হলো। তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, জনবিরোধী নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা তৈরির অভিযোগ আনা হলো।
বিচার চলাকালে চাসেস্কু আদালতের বৈধতা মানতে অস্বীকার করলেন। কোনো রকম জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দিলেন না। পুরো বিচারপ্রক্রিয়াটি ৫৫ মিনিট ধরে চলেছিলো। সংক্ষিপ্ত এই বিচারে নিকোলাই চাসেস্কু ও তার স্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
রায় ঘোষণার কয়েক ঘন্টার ভেতরেই নিকোলাই চাসেস্কু দম্পতির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সেদিন ছিলো ২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৯। নিপীড়িত মানুষের এক বড় অংশ সেদিন এই ঘটনাকে বড়দিনের সেরা উপহার হিসেবে বিবেচনা করেছিলো।