মালয়েশিয়া, একটি বনচারী জাতি এবং জনৈক সুইস নাগরিক

হান্টার গ্যাদারার’ শব্দটার সাথে পরিচয় আছে? বলুন দেখি আমাদের পূর্বপুরুষেরা কী করতেন? তারা অনেকটা যাযাবর জীবন যাপন করতেন। চাষাবাদের বালাই ছিল না। এখনো আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এই জাতীয় জীবনধারায় অভ্যস্ত মানুষের দেখা পাওয়া যায়।

এবার আসা যাক মালয়েশিয়ায়। পূর্ব মালয়েশিয়ার সারওয়াক প্রদেশে আছে/ ছিল মস্ত মস্ত সব বন। এই বনে বাস করে পেনান নামের এক হান্টার গ্যাদারার জাতিগোষ্ঠী। আধুনিক মালয়েশিয়ার যন্ত্রসেনাদের উৎপাতে তখন হাজার হাজার হেক্টর বন সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। তৈরী হচ্ছে পামওয়েল প্ল্যান্টেশন। পেনানদের নিজস্ব জীবনধারা খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।

সাফ হয়ে যাচ্ছে সারওয়াকের বন; ছবিসূত্র: sciencenews.org

পেনানদের এই দুরবস্থায় সাড়া দিয়েছেন সুদূর সুইজারল্যান্ডের এক মানুষ। হাজার মাইল দূরের আর্তনাদ তার কানে পৌঁছেছিলো। বিশ্বব্যাপী বন উজাড়ের বিরুদ্ধে জবরদস্ত আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, থেকেছিলেন জঙ্গলের বাসিন্দা এসব মানুষের সাথে। এতে করে বাধাও কম পাননি। লড়াইয়ে নামতে হয়েছে খোদ মালয়েশিয়া সরকারের সাথে। তারপরে কোনো এক অশুভ সন্ধ্যায় বনবনানী তাকে চিরদিনের জন্য নিজের কোলে টেনে নেয়।

মানুষটির নাম ব্রুনো মানসের।

কে এই ব্রুনো মানসের?

১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলে ব্রুনো মানসেরের জন্ম হয়। ডাক্তারি পাস করলেও সে বিদ্যা ফলানোর কোনো দরকার বোধ করেননি তিনি। চলে যান আল্পস পর্বতমালায়। সেখানে ভেড়া চরাতেন, নিজেই নিজের সব কাজ করতেন। পাশাপাশি পাহাড় বাইতেন। হাত মকশো করতেন নিজে নিজেই কিভাবে প্রকৃতিতে টিকে থাকা যায় সে সংক্রান্ত বিদ্যা গ্রহণে।

মহাত্মা গান্ধীর মতবাদের কড়া ভক্ত ব্রুনো মানসের ১৯ বছর বয়সে জেলে যান। কারণ তিনি সুইজারল্যান্ডের আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে ৩০ বছর বয়সে তিনি ইউরোপ থেকে চলে যান বোর্নিও দ্বীপের মালয়েশিয়া অংশে।

পেনান জাতির খোঁজ

মালয়েশিয়াতে আসার পর ব্রুনো মানসের প্রথম পেনান নামক জাতিটির কথা জানতে পারেন। গহীন বনের এই বাসিন্দারা শিকার করে আর ফলমূল, লতাপাতা কুড়িয়ে জীবনধারণ করেন। সংখ্যায় মাত্র কয়েক হাজার। অন্তত ১৯৫০ এর দশকের আগ পর্যন্ত পেনানদের কেও তেমন ঘাটায়নি। তাদের নিরুপদ্রব জীবনে ছেদ পড়তে শুরু করে ১৯৬০ এর দশক থেকে। মালয়েশিয়া সরকারের নির্দেশে তখন বিপুল বন উজাড় হয়ে যেতে থাকে। আধুনিকায়নের চাপে পেনানরা বিপন্ন হয়ে পড়ে। হারিয়ে যেতে থাকে তাদের নিজস্ব জীবনধারা।

এসব জেনে ব্রুনো মানসের বেজায় আগ্রহী হয়ে পড়লেন পেনানদের ব্যাপারে। ব্রিটিশ একটি দলের সাথে গেলেন পূর্ব মালয়েশিয়ার সারওয়াকে। সেখানে বিস্তর ঘোরাঘুরি করবার পর অবশেষে লিম্বাং নদীর তীরে ১৯৮৪ এর মাঝামাঝি সময়ে পেনানদের দেখা পেলেন। শুরুতে পেনানেরা তাকে অবিশ্বাস করলেও ক্রমেই দুই পক্ষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব।

জনৈক পেনানের সাথে ব্রুনো; ছবিসূত্র; Swissinfo

ব্রুনো মানসেরের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিলো। কিন্তু তার তখন ইচ্ছা মালয়েশিয়াতেই থাকা। তিনি ইন্দোনেশিয়াতে গেলেন। সেখান থেকে আবার সীমান্ত পার হয়ে নজরদারি এড়িয়ে মালয়েশিয়াতে ঢুকে পড়লেন। এতে করে মালয়েশিয়া সরকারের আর জানা থাকলো না একজন ভিসা উত্তীর্ণ নাগরিক তাদের সীমানার মধ্যে রয়েছেন।

পেনানদের সাথে ব্রুনো মানসের ছিলেন ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে তার এই খবর অজানা ছিল না। যদিও সবাই তাকে ‘সাদা টারজান’ বলে উপহাস করতো, পেনানেরা কিন্তু এই খ্যাপাটে মানুষটিকে আপন করে নিয়েছিলো নিজেদের একজন ভেবে। ব্রুনো পেনান শিকারীদের সাথে জঙ্গলে ব্লো পাইপ দিয়ে পশুপাখি মারতেন, নানা রকম টোটকা দাওয়াই, পেনান ভাষা, পেনান লোকগাথা শিখে সেগুলো নোটবুকে টুকে রাখতেন। ১০ হাজারের ওপর কেবল ছবিই তুলেছিলেন তিনি। আর সংগ্রহ করেছিলেন প্রচুর অডিও রেকর্ড, যেগুলোতে ছিল পেনান মুরুব্বীদের মৌখিক আলাপ আর ইতিহাস। ছয় বছরব্যাপী সেই জঙ্গলজীবনে বহুবার বিপদে পড়েছেন তিনি। সাপের কামড় খেয়েছেন, পাহাড় বাইতে গিয়ে আটকা পড়েছেন, ম্যালেরিয়ায় ভুগেছেন, কিন্তু বনচারী লোকগুলোর সরল জীবনধারা দেখে সেই যে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি, সেটা আর কাটেনি।

আন্দোলন

১৯৯০ সালে ব্রুনো মানসের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন। পরের এক বছর ধরে তিনি সুইজারল্যান্ড সহ বিশ্বের নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দেন। বন রক্ষার প্রতি জনমত গঠন করেন। যোগাযোগ করেন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সংস্থার মানুষদের সাথে। বছরখানেক এভাবেই কাটলো।

১৯৯১ সালে পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সংগঠন জি সেভেন এর মিডিয়া সেন্টারের সামনে এক ৩০ ফুট লম্বা ল্যাম্প পোস্টের মাথায় চড়ে বসেন এই সুইস নাগরিক। আড়াই ঘন্টা ধরে সেখানে সারওয়াকের বন রক্ষার আহ্বান জানিয়ে একটা ব্যানার নিয়ে ঝুলে ছিলেন এই ব্যক্তি। পরের বছর রিও ডে জেনিরোর আর্থ সামিটে প্যারাসুট নিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেন সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। ১৯৯৩ সালে সুইজারল্যান্ড সরকারকে উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলো থেকে কাঠ আমদানীর ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাধ্য করবার উদ্দেশ্যে তিনি ৬০ দিনের অনশন ব্রত পালন করা শুরু করেন। যদিও পরে মায়ের অনুরোধে আগেভাগেই অনশন ভেঙ্গে ফেলেন।

ট্রাকে করে আনা হচ্ছে সদ্য কাটা কাঠ; ছবিসূত্র: chathamhouse.org

ইউরোপে হৈ চৈ ফেলে দেওয়ার পর ব্রুনো আবার নজর ফেরান মালয়েশিয়াতে। ১৯৯৮ এর কমনওয়েলথ গেমস আয়োজিত হচ্ছিলো মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। মানসের চেষ্টা করেন সেখানে একটা হাঙ্গামা পাকানোর। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকার তাকে দেশের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলে তো! তবে ব্রুনো মানসের নাছোড়বান্দা। আবার ইন্দোনেশিয়া থেকে বেআইনিভাবে ঢুকে পড়লেন মালয়েশিয়াতে। সাঁতরে পাড়ি দিলেন ৩০০ ফুট প্রশস্ত নদী। তিনি মালয়েশিয়াতে ৪ টন পেরেক জোগাড় করবার একটা ব্যর্থ চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পেনানদের বনের গাছগুলির গুড়িতে এসব পেরেক গেথেঁ রাখা। এতে করে যখন কাঠুরেরা বৈদ্যুতিক কুঠার ব্যবহার করে গাছগুলি কাটার চেষ্টা করবে তখন মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার একটা ঝুঁকি থেকে থাকে।

ব্রুনো মানসেরের এত পরিশ্রমের ফল ফলতে শুরু করেছিলো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা তাকে সমর্থন জানান। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এবং বিবিসি পেনানদের ওপরে কাজ করা শুরু করে। শীর্ষস্থানীয় সব পত্র পত্রিকাতে ব্রুনো মানসের, মালয়েশিয়ার বন উজাড় এবং পেনান জাতিকে রক্ষা করা নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়ে যায়।

একজন আব্দুল তাইব মাহমুদ

মালয়েশিয়ার সরকারের নেতৃত্বে তখন মাহাথির মোহাম্মদ। উন্নয়নের থেকে আর কোনো কিছুকেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি ছিলেন না। পরিবেশ চুলোয় গেলে তা-ও সই। ১৯৯১ সালে মালয়েশিয়া সরকার ব্রুনো মানসেরকে ‘এক নম্বর জাতীয় শত্রু’ হিসেবে আখ্যা দেয়। এই ব্যাপারে মাহাথির মোহাম্মদের যোগ্য ডানহাত ছিলেন আব্দুল তাইব মাহমুদ নামের একজন মেলানাউ জাতীয় মানুষ।

তুন আব্দুল তাইব মাহমুদ; ছবিসূত্র: BorneoPost Online

তুন মাদ্য দাতো সেরি দিরাজা পেহিন শ্রী তান শ্রী হাজি আব্দুল তাইব বিন মাহমুদ ১৯৮১ থেকে ২০১৪; এই ৩৩ বছর ধরে সারওয়াক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সারওয়াকের আদিম বনাঞ্চলকে সম্পূর্ণরূপে সাফ করে দেওয়ার জন্য এই লোকটি সর্বতোভাবে দায়ী। তার শাসনামলেই কাঠ ব্যবসায়ীদেরকে গুণ্ডাবাহিনী গড়ে তোলবার সুবিধা করে দেওয়া হয়। বন ধ্বংসের প্রতিবাদে আদিবাসীরা কোনো রকম আন্দোলন যাতে গড়ে তুলতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করাই ছিল এসব বাহিনীর কাজ।

ব্রুনো মানসের এই লোভী লোকটিকে নানা পরিবেশবাদী কাজে যোগ দিতে উৎসাহ দিলেও কোন ফললাভ হয়নি। ১৯৯৯ সালে তিনি লুকিয়ে মালয়েশিয়াতে প্রবেশ করেন, একখানা খেলনা ভেড়া নিয়ে একটা হালকা গ্লাইডার জাতীয় বিমানে করে তাইব এর বাসার ওপরে বেশ খানিকক্ষণ ওড়াউড়ি করে শেষে মাটিতে নেমে আসেন। মালয়েশিয়া সরকার তাকে সাথে সাথে জেলে পুরে ফেলে এবং পরে দেশ থেকে বের করে দেয়। সারওয়াকের বন রক্ষায় বছরের পর বছর ধরে আন্দোলন করে গেলেও খুব একটা লাভ হয়নি। ২০১৩ সালের মধ্যে দেখা যায় সারওয়াকের মোট বনের ৮০ শতাংশই আব্দুল তাইব এবং তার অনুগ্রহপুষ্ট কাঠ ব্যবসায়ীদের প্রচেষ্টায় বিলীন হয়ে গিয়েছে। সারওয়াকের বন রক্ষার জন্য গঠিত ব্রুনো মানসের ফন্ড মাঝে মধ্যেই নানা প্রজেক্টের কথা বললেও তাইবের সরকার সারওয়াকে সেগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেয়।

মৃত্যু

২০০০ এর মে মাসে ব্রুনো মানসেরকে আবার দেখা গেলো মালয়শিয়া-ইন্দোনেশিয়া সীমান্তে। সেখান থেকে এক পেনান বন্ধুর সাথে তিনি গোপনে ঢুকে পড়েন মালয়েশিয়া। ২০০০ মিটার উচুঁ বুকিত বাতু লাউই নামের এক চুনাপাথরের পাহাড়ের কাছে এসে তারা যাত্রাবিরতি করেন। এখানেই তিনি তার পেনান বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেন।

কেউ জানে না কী ঘটেছিলো তার ভাগ্যে; ছবিসূত্র: Swissinfo

ব্রুনো মানসেরকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পেনান আদিবাসীরা, ব্রুনো মানসের ফন্ড আর সুইজারল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে অনেকগুলো নিস্ফল অভিযান চালানো হয় ব্রুনো মানসেরের খোঁজে। ২০০৫ সালে সুইজারল্যান্ড সরকার তাকে মৃত ঘোষণা করে। তার ভাগ্যে ঠিক কি ঘটেছিলো তা হয়তো আর কোনদিনই জানা যাবে না। রহস্যময় বন চিরদিনের জন্য খ্যাপাটে মানুষটিকে আড়াল করে ফেলেছে।

ব্রুনো মানসের মৃত ঘোষিত হওয়ার বহু পরে, ২০১১ সালে সুইস সরকার ঊষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের কাঠ আমদানির ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মালয়েশিয়াতেও এখন বন উজাড়ের ব্যাপারে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা কঠোর হয়েছে।

ফিচার ইমেজ: Bruno Manser Fond

Related Articles

Exit mobile version