হিল জুতার অজানা ইতিহাস

মেরিলিন মনরো এককালে বলেছিলেন, “আমি জানি না উঁচু হিলের জুতা কে উদ্ভাবন করেছে, তবে নারী জাতি তার নিকট অনেক কৃতজ্ঞ।” কথাটি যে তিনি একেবারেই ভুল বলেন নি, তা তো রাস্তাঘাটে আমাদের আশেপাশে তাকালেই বোঝা যায়। মজার ব্যাপার হলো, আজকের যুগে অনেক নারীরই ফ্যাশনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠা এ হিল জুতার আদি ব্যবহারকারী ছিলেন মূলত পুরুষেরাই! নারীদের জগতে হিল জুতার প্রবেশের ইতিহাস মাত্র পাঁচশ বছরের কাছাকাছি। অন্যদিকে পুরুষদের জগতে হিল জুতা রাজত্ব করে বেড়িয়েছে কয়েক হাজার বছর ধরে!
উঁচু হিলের জুতার অতীত ইতিহাস আমাদের অনেকেরই অজানা। অজানা সেই ইতিহাস সবাইকে জানিয়ে দেবার প্রয়াসেই আজকের এ লেখা।

প্রাচীন পৃথিবী

উঁচু হিলের জুতা ব্যবহারের প্রথম নজির খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রীসে। সেখানকার বিভিন্ন নাট্যাভিনেতারা উঁচু হিলের জুতা পরতেন যেগুলোকে বলা হতো কোথোরনি (Kothorni)। চার ইঞ্চি পুরুত্বের ফ্ল্যাট এ জুতাগুলোর নিচের অংশ তৈরি করা হতো কাঠ কিংবা কর্ক দিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, অভিনেতারা কিন্তু এগুলো মঞ্চের বাইরে কখনো পরিধান করতেন না। তৎকালে রচিত বিভিন্ন ড্রামা ও কমেডিতে অভিনয়ের সময় অভিনীত চরিত্রের সামাজিক মর্যাদার মানদন্ড হিসেবে কাজ করতো উঁচু হিল। যে অভিনেতার জুতার হিল যত উঁচু, তিনি তত উঁচু সামাজিক মর্যাদার চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলছিলেন অভিনয়ের মাধ্যমে।

প্রাচীন মিশরে উঁচু হিলের জুতা ব্যবহারের প্রমাণ (নিচে ডানদিকে)

গ্রীসের মতো উঁচু হিল ব্যবহারের নজির খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন মিশরেও। প্রায় ৩,৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কিছু ম্যুরালে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে লোকজনকে উঁচু হিলের জুতা পরিধান করতে দেখা গেছে। আবার তৎকালীন কসাইরা পশু জবাইয়ের পর রক্ত থেকে নিজেদের পা রক্ষার্থেও উঁচু হিলের জুতা ব্যবহার করতেন।

মধ্যযুগীয় পারস্য

সেই আদিকাল থেকে চলে আসলেও আধুনিক পৃথিবীতে কীভাবে উঁচু হিলের জুতা এত জনপ্রিয় হলো সেই সম্পর্কে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন কানাডার ‘বাটা জুতা জাদুঘর’-এর পরিচালক এলিজাবেথ সেমেলহ্যাক।

উঁচু হিলের জুতা একজন সৈনিককে ঘোড়ার রেকাবে পা যথাযথভাবে আটকে রাখতে সহায়তা করতো। ফলে তিনি তার লক্ষ্যের দিকে আরো কার্যকরভাবে তীর ছুঁড়তে পারতেন। এর প্রচলন ছিল মূলত পারস্যে (আধুনিক ইরান)। কারণ তখন একজন দক্ষ সৈনিককে অস্ত্রের পাশাপাশি অশ্বচালনাতেও দক্ষ হওয়া লাগতো। মধ্যযুগে পারস্যের বিভিন্ন চিত্রকলাতেও তাদের সৈনিকদের ঘোড়ায় চড়তে থাকাবস্থায় পায়ে উঁচু হিলের জুতা পরিধানরত অবস্থায় পাওয়া যায়।

অশ্বারোহীর উঁচু হুিলের জুতা

১৫৯৯ সালে পারস্যের শাহ প্রথম আব্বাস একটি কূটনীতিক মিশন পাঠিয়েছিলেন ইউরোপে। তখন পারস্যের সংস্কৃতি ও ফ্যাশন পশ্চিম ইউরোপে বেশ আলোড়ন তুলেছিলো। সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা সেই জুতাগুলো বেশ পছন্দ করেছিলো। এ জুতাগুলো তাদের পৌরুষ আরো সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলবে এবং সামাজিক মর্যাদাকে আরো ভালোভাবে সবার সামনে তুলে ধরবে বলেই মনে করেছিলো তারা।

সতের শতকে পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনীর উঁচু হিলের জুতা

অবশ্য একসময় আস্তে আস্তে সমাজের সাধারণ মানুষেরাও সেসব উঁচু হিসের জুতা পরা শুরু করলে বিপাকে পড়ে যায় অভিজাত শ্রেণীর সদস্যেরা। পরে নিজেদের সামাজিক মর্যাদানুযায়ী তারা তাদের জুতার উচ্চতা আরো বাড়িয়ে নিয়েছিলো!

নারী জগতে জনপ্রিয়তা

প্রাচীন গ্রীস ও মিশর কিংবা মধ্যযুগীয় পারস্য- সবখানেই উঁচু হিলের জুতার মূল ব্যবহারকারীরা ছিলো পুরুষ। বিস্ময়কর হলেও এ কথাটিই সত্য। আজকের দিনে নারীদের অতিরিক্ত উঁচু হিলের জুতা দেখে অনেকেই অনেক রকম মন্তব্য করে থাকেন। এবার তাহলে জানা যাক উঁচু হিলের জুতা কবে থেকে নারী জগতে প্রবেশ করলো সেই সম্পর্কে।

নারীদের মাঝে নিজেকে জনপ্রিয় করতে অনেক সময় লেগেছিলো উঁচু হিলের জুতা সম্প্রদায়ের। এর প্রথম নজির খুঁজে পাওয়া যায় পনের শতকের ভেনিসে। প্রায় চব্বিশ ইঞ্চি উঁচু ও কিছুটা বাঁকানো সেই জুতাগুলোকে বলা হতো চপিন (Chopine)। এগুলোর প্ল্যাটফর্ম ছিলো কিছুটা সংকীর্ণ।

চপিন – ১

চপিন – ২

চপিন – ৩

অবশ্য এত উঁচু জুতা ব্যবহারের অন্য কারণও ছিলো। মূল জুতাটি তৈরি করা হতো মূলত প্রাণীর চামড়া কিংবা সাটিন দিয়ে যা কাদার প্রভাবে সহজেই বিবর্ণ হয়ে যেতে পারতো। আর এ কাদার হাত থেকে সুন্দর জুতাগুলোকে রক্ষা করতেই এ কৌশলের দ্বারস্থ হতেন তৎকালীন নারীরা।

পনের শতকে ভেনিসে উঁচু হিলের জুতা জনপ্রিয় করতে মূল ভূমিকা রেখেছিলো সেখানকার প্রস্টিটিউটেরা। খদ্দের আকৃষ্ট করতে তারা তাদের প্রতিদ্বন্দীদের চেয়ে উঁচু জুতা পরতে চাইতো যাতে করে সহজেই লোকে তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে তার দিকে!

ইউরোপীয়দের চপিনের মতো জাপানীদেরও ছিলো উঁচু হিলের জুতা, তবে নাম ছিলো ভিন্ন। অনেকদিন ধরে তারাও সেগুলো ব্যবহার করে আসছিলো। তাদের ব্যবহারের উদ্দেশ্যও ছিলো একই- নিজেদের কিমোনোকে (কিমোনো হলো জাপানের একটি ঐতিহ্যবাহী পোষাক) ধূলাবালির হাত থেকে রক্ষা করা। সেই সাথে নিজেদের সামাজিক মর্যাদাকে আলাদা করে চেনানোর মানসিকতা তো ছিলোই।

বিয়েতে কিমোনো পরিহিতা এক জাপানী নারী

গেইশা (Geisha) পেশায় নিয়োজিত নারীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ভূরিভোজে উপস্থিত জনতাকে আনন্দদানের কাজটি করে থাকেন। তারাও বেশ উঁচু জুতা পরে থাকেন যেগুলোর নিচের অংশটি কাঠের তৈরি। এছাড়া গেটা (Geta) নামক আরেক প্রকার জুতার দেখাও মিলে যার নিচে ব্যবহার করা হয় একজোড়া কাঠের তক্তা। এসব জুতা ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত উঁচু হতে পারে।

গেইশা পেশায় নিয়োজিত একজন নারী

গেটা

ভেনিসের বিখ্যাত চপিন অবশ্য একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিলো ফ্রান্সে। প্রস্টিটিউটদের ট্রেডমার্ক হয়ে যাওয়াটা এর অন্যতম কারণ ছিলো। এছাড়া প্রায় সময়ই রাস্তায় পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে কখনো কখনো মিসক্যারিজের শিকারও হতে হয়েছিলো নারীদের। সমাজের অনেকের চোখেও এত উঁচু জুতা ছিলো ঔদ্ধত্যের নামান্তর।

এভাবে আস্তে আস্তে সময় গড়াতে থাকে। আগেকার জুতাগুলোতে সোল (Sole) আর হিল দুটোই থাকতো বেশ উঁচু। সময়ের সাথে সাথে এ ফ্যাশনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। নিচু সোল ও উঁচু হিলের রাজকীয় আগমন ঘটে ১৫৩৩ সালে, রাজপরিবারের এক বিয়েতে। সেই বছর ১৪ বছর বয়সী ক্যাথেরিন দ্য মেদিচি বিয়ে করেছিলেন অর্লিন্সের ডিউককে। চপিনের পরিবর্তে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিচু সোল ও বেশ উঁচু হিলের একজোড়া জুতা।

ক্যাথেরিন দ্য মেদিচি

কালের স্রোতে ভেসে চলে যার আরো প্রায় এক শতাব্দী। ততদিনে ছেলেদের বিভিন্ন ফ্যাশনকেই নিজেদের করে নেয়া শুরু করেছিলো নারীরা। চুল ছোট রাখা, পাইপে তামাক টানা কিংবা মাথায় হ্যাট চড়িয়ে নিজেদেরকে ছেলেদের মতো উপস্থাপনের একটা চল লক্ষ্য করা যায় তখন থেকেই। এরই অংশ হিসেবে তারা ব্যাপকভাবে বেছে নিয়েছিলো উঁচু হিলের জুতাকেও, যা তাদের ব্যবহৃত পোষাক-পরিচ্ছদকে আরো পুরুষালি ভাব এনে দিয়েছিলো!

রাজার খেয়াল

১৫৯৯ সালে প্রথম আব্বাসের কূটনীতিক দলের কাছ থেকে দেখা উঁচু হিলের জুতা যেন এক নবজাগরণের সৃষ্টি করেছিলো তৎকালীন অভিজাত শ্রেণীর পুরুষ সমাজে।

চতুর্দশ লুইস

১৬৪৩ থেকে ১৭১৫ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজার দায়িত্ব পালন করা চতুর্দশ লুইসের কথাই ধরা যাক। তিনি ছিলেন বেশ ফ্যাশন সচেতন এবং জুতার সমঝদার। অলঙ্কার দিয়ে সাজানো যেকোনো কিছুই তিনি বেশ পছন্দ করতেন। পারস্যের সংস্কৃতি থেকে আসা উঁচু হিলের জুতা যেন সেই পালে আরো হাওয়া দিলো। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার রাজা তাই নিজেকে লম্বা দেখাতে জুতার নিচে আরো ৪ ইঞ্চি উচ্চতার হিল লাগিয়ে নিলেন! শুধু তাই নয়। নিজের জুতাকে লাল রঙ করে একে একটি ট্রেডমার্কে পরিণত করলেন তিনি এবং সভাসদদের সবাইকে নির্দেশ দিলেন তাদের জুতাও এভাবে লাল রঙে রাঙিয়ে নিতে!

ভিক্টোরিয়ান যুগ (১৮৩৭-১৯০১)

উঁচু হিলের জুতার ক্রমবর্ধমান এ জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করে ফরাসি বিদ্রোহের পর। তখন মানুষ নিজেদেরকে সম্ভ্রান্ত হিসেবে দেখানো থেকে সরে আসতে শুরু করে। নতুন সমাজব্যবস্থাও ছিলো উঁচু হিলের বিপক্ষে। ম্যাসাচুসেটসের পিউরিটানরা যৌনাবেদনময় ও ডাকিনীবিদ্যার সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে একেবারে নিষিদ্ধই করে বসে উঁচু হিলের জুতা।

ভিক্টোরিয়ান যুগে এসে এ চিত্র আবার পাল্টাতে শুরু করে। নতুন সেলাই প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে তখনকার হিলগুলোর উচ্চতা নেমে এসেছিলো মাত্র কয়েক ইঞ্চিতে। তখন নজর দেয়া হতো একজনের পদপৃষ্ঠের দিকে। পদপৃষ্ঠের দিকে কিছুটা বাঁকানো ডিজাইন একজন নারীর নারীত্ব ও বিশুদ্ধতাকে ফুটিয়ে তুলতো।

ভিক্টোরিয়ান যুগের একজোড়া হিল জুতা

এই ছোট হিলের জুতাগুলো একইসাথে যৌনাবেদনময় আলোকচিত্রের সূচনালগ্নের সাথেও বেশ দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলো। বিবিসির এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, নারীদের একেবারে শুরুর দিককার বেশ কিছু নগ্ন ছবির এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ছিলো সেইসব উঁচু হিলের জুতো। যৌনাবেদনময় ফরাসি বিভিন্ন পোস্টকার্ডেরও এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ছিলো সেই জুতাগুলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পরবর্তী কাল

আমাদের আজকের সমাজে উঁচু হিলের জুতার এই যে জনপ্রিয়তা এর পেছনে শুরুর দিকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলো পর্নোগ্রাফি, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। তখন ইউরোপের নানা যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক সৈনিকের কাছে থাকা নারী মডেলদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে খুঁজে পাওয়া গেছে উঁচু হিলের জুতাকে।

এ সম্পর্কে যৌন নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশার জানান, “High heels thrust out the buttocks and arch the back into a natural mammalian courting — actually, copulatory — pose called ‘lordosis,’”।

১৯৫৪ সালে রজার ভিভিয়ারের হাত ধরে আগমন ঘটে স্টিলেটো হিলের। আগমনের অল্প কিছুদিনের মাঝেই যৌনতার প্রতীক হিসেবে হলিউড পাড়ায় সাড়া ফেলে দেয় এ হিল জুতাগুলো।

স্টিলেটো হিল – ১

স্টিলেটো হিল – ২

এভাবেই ক্রমে ক্রমে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উঁচু হিলের জুতার জনপ্রিয়তা। এককালে পুরুষদের দিয়ে শুরু হয়েছিলো যে জুতার যাত্রা, তা কালক্রমে নিজেদের স্থান পাকাপোক্ত করে নেয় নারীদের পদযুগলে। ওদিকে নিজেদের রুচির পরিবর্তনে পুরুষেরা আস্তে আস্তে নিজেদেরকে সাজসজ্জার আঙিনা থেকে দূরে সরাতে শুরু করে। সর্বশেষ ১৭৪০ সালের কাছাকাছি সময়েই পুরুষদের হিল জুতা পরতে দেখা গেছে!

তথ্যসূত্র

১) mentalfloss.com/article/48672/where-did-high-heels-come

২) nypost.com/2015/01/25/the-history-of-high-heels-from-venice-prostitutes-to-stilettos/

৩) bbc.com/news/magazine-21151350

৪) bustle.com/articles/126280-a-short-history-of-high-heels-from-ancient-greece-to-carrie-bradshaw

৫) ancient-origins.net/history/ancient-origins-high-heels-once-essential-accessory-men-002329

Related Articles

Exit mobile version