শত্রুপক্ষকে বশে কত অস্ত্রই তো আবিস্কৃত হয়েছে। কত কৌশল কিংবা অপকৌশলের মাধ্যমে যে শত্রুদেশকে দমিয়ে রাখা যায়, তার হাজারও নজির রয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে। তেলকে অস্ত্র বানিয়েও প্রতিপক্ষকে যে নাস্তানাবুদ করা যায় তার ইতিহাস তৈরি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়। সেসময় তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলোর সংগঠন ওপেক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল পশ্চিম দেশগুলোর উপর। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদেশগুলোতে দেখা দেয় স্মরণকালের সবচেয়ে তীব্র তেল সংকট।
অবস্থা এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে সপ্তাহ কিংবা মাসে নেদারল্যান্ডের রাস্তায় দুই-একটার বেশি গাড়ি দেখা যেত না। অধিকাংশ পেট্রোল পাম্প বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তেলের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিল জার্মানির মানুষজন। চলুন আজ সেই ইতিহাস নিয়েই কিছুটা জানার চেষ্টা করা যাক।
১৯৬৭ সালে ছ’দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের বেশ কিছু ভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। স্বভাবতই ধারণা করা হচ্ছিল, এই ভূমি পুনরুদ্ধারে পুনরায় যুদ্ধে নামবে আরব বিশ্ব। হলোও তা-ই, হারানো ভূমি পুরুদ্ধারের জন্য সিরিয়া ও মিশর ইসরায়েলের সাথে আরেকটি যুদ্ধ বাধিয়ে ফেলে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে জেগে ওঠে আরব জাতীয়তাবাদ। ফলে সিরিয়া ও মিশরকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে অন্যান্য আরব দেশগুলো। ওদিকে ইসরাইলকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইসরায়েলকে সামরিক সাহায্য প্রদান করে। এজন্য আরবরা কোনোভাবেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফলতা লাভ করতে পারছিল না। সফল না হওয়ার পেছনে আরবরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহকেই প্রধানত দায়ী করে। তাই তারা একটি প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিল। আরব দেশগুলো একজোট হয়ে তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলোর ওপর তেল অবরোধ আরোপ করে।
১৯৬০ সালের পূর্বে সেভেন সিস্টার্স নামে খ্যাত সাতটি তেল কোম্পানি আরব বিশ্বের তেল উৎপাদনে নিয়োজিত ছিল। এ কোম্পানিগুলোর অধিকাংশ মালিকানা ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর হাতে। ফলে তারা সবসময় পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে চলত। অপরদিকে তেল উৎপাদনকারী দেশসমূহ তাদের ন্যায্য অধিকার পেত না। পানির দামে তেল সরবারহ করা হত পশ্চিমা দেশগুলোতে। স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়গুলো নিয়ে আরব দেশগুলোতে অসন্তুষ্টি ছিল।
এই অসন্তুষ্টি থেকেই ১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত এবং ভেনেজুয়েলা মিলে গঠন করলো তেল রফতানিকারক দেশগুলোর জোট “ওপেক বা অর্গানাইজেশন অফ আরব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ“। প্রতিষ্ঠাকালে কয়েকটি সদস্য-রাষ্ট্র থাকলেও শীঘ্রই মোট সদস্য দাঁড়াল ১৩-তে।
এ ঘটনায় আরব বিশ্বের দুজন ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেন। তাদের একজন ছিলেন সৌদি আরবের তৎকালীন তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি এবং অপরজন ইরাকের তেল মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট আন্ডার সেক্রেটারি ডক্টর ফাডহিল চালাবি। সে সময় ডক্টর চালাবি তেলের দাম ৭০% বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরের শুরুতে ভিয়েনায় আরব দেশগুলোর তেল মন্ত্রীদের নিয়ে একটি বৈঠক ডাকা হয়। সেখানে তেলের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হয়ে গেল আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যা সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বৈঠক শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই অবশ্য ধারণা করা হচ্ছিল যে, বড়সড় একটা যুদ্ধ এগিয়ে আসছে সামনে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে যে এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে সে কথা তখন কেউই ভাবেনি।
১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর শুরু হয়ে গেল ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ। সিরিয়া এবং মিশর আক্রমণ করে বসল ইসরায়েলে। ১৯৬৭ সালের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করতে এবং সেই যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতেই এই আক্রমণ। শুরুতে এই যুদ্ধে আরব সেনারা বেশ ভালই করছিল। যখন এই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তখন ভিয়েনায় তেল মন্ত্রীদের বৈঠকে দেখা দিল অচলাবস্থা। তারা দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাবে একমত হতে পারলেন না। ফলে বৈঠক সেখানেই মুলতবি করে রাখা হল এবং নতুন করে কুয়েতে আবার বৈঠক ডাকা হলো।
১৬ অক্টোবর ১৯৭৩ সাল, এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করল আরব বিশ্ব। ইতিহাসে এই প্রথম তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলো একত্রিত হয়ে তেল কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে একতরফা তেলের দাম নির্ধারণের ঘোষণা দিল। শুধু তা-ই নয়, ডক্টর ফাডহিল চালাবির প্রস্তাবানুযায়ী তেলের দাম ৭০% বৃদ্ধি করা হলো। তেলের দাম বৃদ্ধির খবর শুনে আঁতকে উঠল পশ্চিমা বিশ্ব। এদিকে ওপেক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই সেভেন সিস্টার্সের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। বরং সমস্ত ক্ষমতা চলে যায় ওপেক জোটভুক্ত আরব দেশগুলোর হাতে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়, আরব দেশগুলো শুধুমাত্র তেলের দাম ৭০% বৃদ্ধি করেই থেমে থাকল না। তারা বেশ আগে থেকেই তাদের তেলকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছিল। একত্রিত হয়ে যখন ওপেক গঠন করা হলো, তখন এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইল। এদিকে ততদিনে পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। তেল অস্ত্রকে কাজে লাগানোর জন্য এ যেন মোক্ষম সময়। অন্যদিকে যুদ্ধ শুরুর পর পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ড সরাসরি সামরিক সহায়তা দিয়ে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ালো। আবার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোও ইসরায়েলের সমর্থনে কাজ করে যাচ্ছিল। ফলে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথমদিকে ভালো করলেও কোনোভাবেই সফলতা লাভ করতে পারছিল না।
১৬ অক্টোবরের বৈঠকের পর ওপেকের তেল মন্ত্রীগণ কুয়েতেই থেকে গেলেন। পরদিন ১৭ অক্টোবর আবারও বসলেন এক টেবিলে। এই বৈঠকে সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি প্রস্তাব করলেন ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোতে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেবেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস এবং যারা সরাসরি অস্ত্র ও সেনা দিয়ে ইসরায়েলকে সাহায্য করছে। ইরাক অবশ্য আরও কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের প্রস্তাব ছিল, সমস্ত আরব দেশে সেভেন সিস্টার্সসহ পশ্চিমা যতগুলো তেল কোম্পানি আছে সব কোম্পানিকে যেন জাতীয়করণ করে নেয়া হয়।
ইরাকের দাবি ছিল, যদি তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা শিল্পোন্নত দেশের হয়তো খুব বেশি ক্ষতি হবে না। এতে করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ভুগবে। তাই যদি পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে জাতীয়করণ করে নেয়া হয়, তাহলেই কেবলমাত্র তারা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কিন্তু ইরাকের এই প্রস্তাব অন্যান্য আরব দেশ গ্রহণ করল না। ১৭ অক্টোবরের সেই বৈঠকে সৌদি আরব এবং কুয়েত সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রাখে। একমাত্র ইরাক ছাড়া সকল আরব দেশ সিদ্ধান্ত নিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। দিনে দিনে এই নিষেধাজ্ঞা কঠোর থেকে কঠোরতর হতে লাগল। নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলে আসলো পর্তুগাল ও দক্ষিণ আফ্রিকাও। ফলে তেলের বাজারে দেখা দিল ব্যাপক অস্থিরতা। নড়েচড়ে বসল বিশ্বরাজনীতির মঞ্চ।
কোনো কোনো দেশে তেলের দাম চারগুণ বৃদ্ধি পেল। আবার কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি। পশ্চিমা দেশগুলোতে শুরু হয়ে গেল তীব্র তেল সংকট। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হলো পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলো। পেট্রোল পাম্পের সামনে দেখা দিল দীর্ঘ লাইন। তেল রেশনিং করা শুরু হয়ে গেল। তেলের ব্যবহার হ্রাস করতে ঘন্টায় ৫০ কিলোমিটারের উপরে গাড়ি চালানোতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো যুক্তরাষ্ট্রে।
বিশ্বব্যাপী তেলকে অস্ত্র করে আরব দেশগুলো যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল এর মাধ্যমে আরব জাতীয়তাবাদ জেগে ওঠে। পশ্চিমা দেশগুলোকে নিষেধাজ্ঞা দিতে পেরে নিজেদের শক্তি এবং অবস্থান সম্পর্কে তারা সচেতন হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পানির দরে তেল কিনতো পশ্চিমা দেশগুলো। এবার যেন সেই যুগের অবসান ঘটল। তৎকালীন সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “ইসরাইল যদি আরব ভূমি থেকে তাদের সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, কেবলমাত্র তবেই এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হতে পারে। তারপরেই কেবলমাত্র বিশ্ব ১৭ অক্টোবরের পূর্বের দামে তেল পাওয়ার আশা করতে পারে।“
সে সময় একজন সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেন, যদি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০ ডলার করা হয়, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো ব্যাপকভাবে আর্থিক সংকটে পড়বে, শত কোটি ডলার লোকসান গুণতে হবে, এই বিষয়গুলো তিনি ভেবে দেখেছেন কি না। জবাবে আহমেদ জাকি ইয়ামানি বলেন,
তাহলে আপনি কী পরামর্শ দিতে চাচ্ছেন? আপনি কি আমাদেরকে বাজারমূল্যের চেয়েও কম দামে তেল বিক্রি করতে বলছেন? আপনি নিশ্চয়ই আমাদেরকে এমনটা করতে বলছেন না, আপাতত এটাই আমি ধরে নেব। আর আপনি যদি এই সংকট নিয়ে আমাদেরকে পশ্চিমা নেতাদের সাথে বৈঠকে বসতে বলেন, তার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।
রাতারাতি তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিল। শুধু তা-ই নয়, নাটকীয়ভাবে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের একটা পরিবর্তন চলে আসলো। শিল্পোন্নত পশ্চিমা দেশগুলো এতদিন তাদের যে ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী দেখিয়ে এসেছে তাতে যেন বড় ধরনের একটা ধাক্কা লাগল। তারা বুঝতে পারল তাদের দুর্বল অবস্থান সম্পর্কে। অন্যদিকে আরব দেশগুলো বেশ জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ল।
এই তেল নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল ১৯৭৪ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত। কিন্তু ওপেক তেলের দাম বাড়িয়েই রাখল। এরপর খুব দ্রুতই আরব দেশগুলো তেল বিক্রির মাধ্যমে সম্পদশালী হয়ে উঠল। মূলত, এরপর থেকেই আরব দেশগুলো তেলের ওপর নির্ভর করে উন্নত এবং আধুনিক দেশে পরিণত হতে শুরু করে।
এই ঘটনার পর থেকে তেল বাণিজ্যের এক বিশাল পরিবর্তন ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো শুরু করে দেয় তেলের মজুদ। একইভাবে নিজেদের দেশসমূহে তেল অনুসন্ধান শুরু করে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে তারা তেলের ভিন্ন উৎস খুঁজতে থাকে। ফলে অনেকাংশেই আরবদেশগুলোর উপর পশ্চিমা বিশ্বের তেল নির্ভরতা কমে আসে। যদিও এখনও তেলের জন্য বিশ্বের সিংহভাগ দেশকে আরব বিশ্বের উপরই নির্ভর করতে হয়।