[১ম পর্ব পড়ুন]
ইভিলিন ওয়ালশ ম্যাকলিন
ধনী বাবার সন্তান ইভিলিন ওয়ালশ ম্যাকলিন ওয়াশিংটনের অভিজাত সমাজের পরিচিত মুখ। আক্ষরিক অর্থেই তার বাবা ছিলেন সোনার খনির মালিক, ফলে টাকাপয়সা উপচে পড়ছিল তাদের। এই ইভিলিনই ছিলেন পিয়েরের কার্টিয়েরের নিশানায়।
১৯০৮ সালে ২২ বছরের ইভিলিন বিয়ে করেন ১৯ বছরের নেড ম্যাকলিনকে। নেডের পরিবার ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার মালিক, সমাজে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট। জলের মতো টাকা খরচ করতো এই দম্পতি। ইভিলিনের বিশেষ আগ্রহ ছিল গহনার প্রতি। এজন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন তিনি।
হোপ ডায়মন্ড বিক্রির চেষ্টা
মধুচন্দ্রিমায় নেড-ইভিলিন দম্পতি ১৯০৮ সালে প্যারিস ঘুরে গিয়েছিলেন। সেই সূত্রে নবদম্পতির সাথে পরিচয় ছিল পিয়েরের। ১৯১০ সালে নেড আর ইভিলিন আবার প্যারিসে এলে তাদের নিজ হোটেলে আমন্ত্রণ জানান তিনি। ইভিলিনকে হীরা গছিয়ে দিতে প্রথমে তাকে টোপ গেলানোর প্ল্যান করেন তিনি। সেজন্য হীরে দেখানোর আগে ফেঁদে বসেন অভিশাপের গল্প। কিংবদন্তীর সাথে আরো অলংকরণ যুক্ত করেন তিনি।
পিয়েরে হোপ ডায়মন্ডের উৎস থেকে শুরু করে তার হাতে কীভাবে সেটা পড়লো পুরো ঘটনার বিবরণ দেন। জায়গায় জায়গায় অভিশাপের কথা বিশ্বাসযোগ্য করতে জনশ্রুতিও জুড়ে দেন।
পিয়েরে জানান, ট্যাভার্নিয়ের নাকি ভারতভ্রমণে গিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক দেবীমূর্তির কপাল থেকে এই হীরে খুলে নিয়েছিলেন। ভিন্ন আরেক মতে অবশ্য বলা হয়, এক অসৎ পুরোহিত এই দেবীর থেকে রত্ন খুলে তার কাছে বিক্রি করেন। যা-ই হোক না কেন, পিয়েরে দাবি করেন- এরপর থেকেই দেবীর অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে আছে হোপ ডায়মন্ড।
ট্যাভার্নিয়েরের পরিণতি নিয়েও রঙচঙে বর্ণনা দেন তিনি। ফরাসি এই ব্যক্তি রাজার কাছে হীরে বিক্রির পর রাশিয়া অভিযানে যান। সেখানে প্রবল জ্বরে মারা পড়েন তিনি। তার মৃতদেহ নাকি খুবলে খেয়েছিল বুনো কুকুর বা নেকড়ের দল।
পিয়েরে এরপর তুলে ধরেন নিকোলাস ফুকেটের গল্প। এই ফরাসি মন্ত্রী চতুর্দশ লুইয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। রাজা তাকে বিশ্বাস করে কিছুদিনের জন্য রত্নটি রাখতে দিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার হন, নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। বলা হয়, জীবনের বাকি সময় সেখানেই কাটান তিনি। অবশ্য কেউ কেউ দাবি করেন- তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
হোপ ডায়মন্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেক দুর্ভাগা মেরি থেরেসা অব স্যাভয়, প্রিন্সেস অব লাম্বালের কথাও ম্যাকলিনদের জানান পিয়েরে। মেরি অ্যান্তোনেটের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন তিনি, যার গলায় শোভা পেত হোপ ডায়মন্ড। ফরাসি বিপ্লবের পর অনেকের সাথে তাকেও আটক করা হয়। ১৭৯২ সালে বিপ্লবীদের উগ্রপন্থী অংশ পরিকল্পিতভাবে প্যারিসের জেলখানায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর শিকার হন মেরি থেরেসা।
পিয়েরে এরপর বর্ণনা করেন সর্বশেষ উসমানী সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের কথাও। ১৯০৮ সালে তার অর্থায়নে কিনে নেয়া হয় এই হীরে। কিন্তু সুলতান শীঘ্রই তার সিংহাসন হারান। তার প্রিয় যে স্ত্রী সুবায়াকে হীরেটি পরতে দিয়েছিলেন, তাকেও হত্যা করা হয়।
গ্রীক গহনা ব্যবসায়ী সাইমন মনথ্রাডিস বলে একজনের প্রসঙ্গ টেনে আনেন পিয়েরে। হোপ ডায়মন্ড নিয়ে নাকি কাজ করেছিলেন তিনি। সাইমন তার স্ত্রী-সন্তানসহ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা পড়েন। হেনরি থমাস হোপের নাতি ফ্রান্সিস, যিনি পারিবারিক হীরে বিক্রি করে জুয়ার দেনা মেটাতে চেয়েছিলেন, তিনি মারা যান কপর্দকশূন্য অবস্থায়। বিংশ শতকের শুরুতে এক রাশিয়ান কাউন্ট আর তার প্রেমিকা এক অভিনেত্রী এই হীরের মালিক ছিলেন বলেও পিয়েরে গল্প করেন, যারা ভয়াবহ দুর্ভাগ্যের শিকার হন।
পিয়েরে যা চাইছিলেন তা-ই হলো। টান টান উত্তেজনা সৃষ্টি হয় হীরে দেখানোর আগেই। কিন্তু যখন হোপ ডায়মন্ড প্রদর্শন করা হলো, তখন বেলুন ফুটো হয়ে গেলো, কারণ ইভিলিন রত্নটি পছন্দ করলেন না। পিয়েরেকে মানা করে তারা ওয়াশিংটনে ফিরে যান।
পিয়েরের সফলতা
প্রথমবার ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়লেন না পিয়েরে। তিনি হোপ ডায়মন্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। এখানে কেটেকুটে ছোট করা হয় হীরে, চারদিকে ছোট ছোট হীরের মাঝখানে বসিয়ে তৈরি হয় নেকলেস। নতুন রূপে এবার ইভিলিনের সামনে হোপ প্রদর্শন করেন তিনি।
ইভিলিনের আগ্রহ বাড়লেও কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না তিনি। ফলে নতুন ফন্দি আঁটলেন পিয়েরে। প্রস্তাব দিলেন- সপ্তাহখানেক নেকলসেটি ব্যবহার করুক ইভিলিন, এরপর পছন্দ না হলে ফেরত দিয়ে দেবেন।
মোক্ষম চাল চেলেছিলেন পিয়েরে। তিনি জানতেন, ইভিলিনের মতো নারীরা এক সপ্তাহ ধরে এই নেকলেস বন্ধুবান্ধবদের দেখিয়ে বেড়ানোর পর কিছুতেই আর তা ফিরিয়ে দিতে চাইবেন না।
ইভিলিন টোপ গিললেন, এবং পিয়েরে ঠিক যা ভেবেছিলেন তা-ই হলো। পিয়েরেকে জানানো হয়, ম্যাকলিনরা হীরে কিনতে আগ্রহী। তিনি দাম ধরলেন ১,৮০,০০০ মার্কিন ডলার, আজকের বাজারে যা প্রায় ৫ লক্ষ ডলারের সমান। কিস্তিতে দাম পরিশোধের কথা ঠিক হয়, প্রথম কিস্তি ধার্য হয় ৪০,০০০ ডলার।
ইভিলিনের গড়িমসি
তবে সবকিছু খুব সহজ হয়নি। ইভিলিনের শাশুড়ি অভিশাপে ভয় পেয়েছিলেন। তিনি পুত্রবধুকে পরামর্শ দেন হীরে না কিনতে। হীরের এককালের মালিক থমাস হোপের স্ত্রী মেরিও তাকে সতর্ক করেন। ফলে প্রথম কিস্তি দেয়ার সময় সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেলেও এক পয়সাও জমা হয়নি কার্টিয়েরদের অ্যাকাউন্টে। একপর্যায়ে ইভিলিন হোপ ডায়মন্ড ফেরত পাঠাতেও চেষ্টা করেন, তবে পিয়েরে তা গ্রহণ করেননি।
পিয়েরে কঠোর হলেন। ১৯১১ সালের মার্চে বিক্রির চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার দু’মাস পর পিয়েরে ম্যাকলিনদের বিরুদ্ধে আদালতে যান। ইভিলিন বুঝতে পারলেন- হীরে তাকে কিনতে হবেই। যদিও অভিশাপে তার বিশ্বাস ছিল না, তারপরও শাশুড়িকে শান্ত করতে হোপ ডায়মন্ড নিয়ে চার্চে যান তিনি। সেখানে পাদ্রি একে আশীর্বাদ করেন। তার ধারণা ছিল- এর ফলে কেটে যাবে অশুভ প্রভাব।
১৯১২ সালে অবশেষে বিনিময় সম্পন্ন হয়। ম্যাকলিনরা তাদের মালিকানায় থাকা মূল্যবান একটি পান্না কার্টিয়ের ভাইদের দিয়ে দামের একাংশ পরিশোধ করে।
সব চুকেবুকে গেলে কার্টিয়েরদের বোর্ড অব ডিরেক্টররা হিসেব করে দেখলেন, আদালতের খরচ ধর্তব্যে নিলে উল্টো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তাদের। তবে পিয়েরে ঝানু ব্যবসায়ী, টাকা-পয়সার থেকে তার কাছে বেশি জরুরি ছিলো প্রচারণা। ফ্রান্সে বড় নাম হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারা নতুন। হোপ ডায়মন্ড আর ম্যাকলিনদের ঘিরে তাদের নাম ছাপা হয়েছিল সব সংবাদপত্রে। ট্যাবলয়েডগুলো গিলে খাচ্ছিল অভিশাপের গল্প। সব মিলিয়ে বড় বিজ্ঞাপনই হয়ে যায় কার্টিয়েরদের।
ইভিলিনের পরিণতি
অভিশপ্ত হোপ ডায়মন্ড ইভিলিনের জন্য ছিল গর্বের বিষয়। সব অনুষ্ঠানে তিনি পরে যেতেন এই হীরে, সবার সামনে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করতেন এর কুখ্যাতির কাহিনী। কখনো কখনো তার কুকুর মাইকের গলায় ঝুলিয়ে দিতেন নেকলেস। নিজের বাসার পার্টিতে হীরে খোঁজার খেলাও খেলতেন ইভিলিন, যেখানে ঝোপের আড়ালে হোপ ডায়মন্ড লুকিয়ে অতিথিদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন খুঁজে আনার জন্য।
ইভিলিনের পারিবারিক জীবনে একসময় বিপর্যয় নেমে আসে। তার স্বামী নেড আরেক নারীর হাত ধরে পালিয়ে যান, শেষপর্যন্ত তার মৃত্যু হয় মানসিক হাসপাতালে। স্বামীর পারিবারিক পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টও দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইভিলিনের ছেলে মারা যায় গাড়ি দুর্ঘটনায়, মেয়ের মৃত্যু হয় ড্রাগ ওভারডোজে।
১৯২৯ থেকে শুরু হওয়া মহামন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেশনে আর্থিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হন ইভিলিন। বাড়ি ব্যাঙ্কের হাতে চলে যাওয়া ঠেকাতে তিনি বাধ্য হন হোপ ডায়মন্ড বন্ধক রাখতে। নিউ ইয়র্কের একটি দোকান থেকে হীরের বিনিময়ে ৩৭,৫০০ ডলার ধার করেন তিনি। পরবর্তীতে একাকী ট্রেনে চেপে ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইয়র্ক যান তিনি, অর্থ পরিশোধ করে ফিরিয়ে আনেন তার সাধের হোপ।
স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম
১৯৪৭ সালে মারা যান ইভিলিন। তার সহায়সম্পত্তি নিলামে তোলা হলে হ্যারি উইনস্টন ইনকর্পোরেট নামে নিউ ইয়র্কের এক কোম্পানি সব গহনা কিনে নেয়। এর মধ্যে ছিল হোপ ডায়মন্ড। পরবর্তী এক দশক তাদের তত্ত্বাবধানে হোপ ডায়মন্ড সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়। ১৯৫৮ সালের ১০ নভেম্বর কোম্পানির মালিক উইনস্টন হীরেটি দান করে দেন ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে। এখনও সেখানেই আছে তা।
এখন অবধি মাত্র চারবার মিউজিয়াম থেকে বের করা হয়েছে হোপ ডায়মন্ড। ১৯৬২ সালে এক মাসের জন্য লুভর মিউজিয়ামে জায়গা হয় তার। এরপর ১৯৬৫ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে এক উৎসবে প্রদর্শিত হয় এটি। ১৯৮৪-তে হ্যারি উইনস্টন ইনকর্পোরেটের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে সাময়িকভাবে তাদের ধার দেয়া হয় হীরে। এর এক যুগ পর আবারও সেই কোম্পানির কাছে দেয়া হয় হোপ, উদ্দেশ্য ছিল ঘষেমেজে চকচকে করে তোলা।
অভিশাপের অনুসন্ধান
সত্যি কথা বলতে কী, হোপ ডায়মন্ডের অভিশাপের গল্পের বড় অংশই ১৮০০ সালের পরে উদ্ভুত। অনেক সাংবাদিক পত্রিকার কাটতি বাড়াতে হীরের অভিশাপের জমজমাট গল্প রচনা করতেন। কিছু কিছু গল্পে সত্যতা থাকলেও বাকিগুলোর উৎস ছিলো গুজব বা জনশ্রুতি।
স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউট, যাদের একটি অঙ্গ স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম, তাদের অন্যতম একজন গবেষক রিচার্ড কিউরিনের মতে, হোপ ডায়মন্ডের দুর্ভাগ্যের বহু কাহিনীই মিথ্যে। তিনি পিয়েরে কার্টিয়েরকে এজন্য দায়ী করেন। বেশি দামে হীরে বিক্রি করার জন্যই নাকি তিনি বেশ কিছু ভুয়া কাহিনির অবতারণা করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হীরের উৎস আর ট্যাভার্নিয়েরের মৃত্যু নিয়ে যা বলা হয়, তা রেকর্ডপত্রের সাথে মেলে না। ট্যাভার্নিয়ের কোনো দেবীমূর্তি থেকে হোপ খুলে নেননি, বরং ভারতের কোনো গয়নার বাজার থেকে কিনেছিলেন এই রত্ন। তার মৃত্যু নিয়ে প্রচলিত গল্পও ভুল। তিনি রাশিয়াতে মারা যান ঠিকই, তবে তা রাজার কাছে হীরে বিক্রির বহু পরে। এই সময়ের মধ্যে তিনি অভিজাত উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন, আত্মজীবনী লিখেছেন কয়েক খণ্ডে। শেষ পর্যন্ত ৮৪ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে তার জীবনাবসান হয়। কোনো কুকুর বা নেকড়ে তার দেহ খুবলে খায়নি।
চতুর্দশ লুইয়ের যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুর সাথেও হীরের কোনো সম্পর্ক নেই। সেই আমলে তো আর অ্যান্টিবায়োটিক ছিল না, ফলে ইনফেকশন বা সংক্রমণ থেকে গ্যাংগ্রিনের ঘটনা দুর্লভ নয়। আবার তখন শিশুমৃত্যুর হারও ছিল অনেক বেশি, ফলে লুইয়ের বড় সংখ্যক সন্তানের মৃত্যুও আশ্চর্যজনক নয়।
খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, হোপ ডায়মন্ডের মালিকের আত্মীয়স্বজনের, তা সে যত দূরেরই হোক না কেন, যেকোনো দুর্ভাগ্যের দায় ফেলা হতো এই হীরের উপর। আমরা নিজেদের আত্মীয়দের দিকেই যদি দেখি, তাহলে কি একটা হলেও কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যের হদিস পাওয়া যাবে না? সমস্যা হলো, সবকিছুই হীরের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছিল, যদিও এই সবকিছু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে থাকে।