ফরাসি-বাভারিয়ান এবং অস্ট্রিয়ান সংঘর্ষ
ফ্রেডেরিকের সিলিসিয়া আক্রমণের মাধ্যমেই অস্ট্রিয়ান সাকসেশন ওয়ারের সূচনা। তার সাফল্য দেখে ফরাসিরা তড়িৎ বাভারিয়া আর স্পেনের সাথে জোট বাঁধে। ১৭৪১ সালের মে মাসে মিউনিখের নিম্ফেনবার্গ প্রাসাদে তিন পক্ষের মধ্যে সাক্ষরিত হয় নিম্ফেনবার্গ চুক্তি (Treaty of Nymphenburg)। ফ্রান্স আর স্পেন প্রকাশ্যে হাবসবুর্গ সিংহাসনে চার্লস আলবার্টের দাবিকে সমর্থন দেয়। রফা হলো- বিনিময়ে ফ্রান্স পাবে বেলজিয়াম আর স্পেন পাবে ইটালির লম্বার্ডি। পরে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় প্রুশিয়া, স্যাক্সোনি আর স্যাভয়।
জুন মাস থেকে ফরাসি-বাভারিয়ান সম্মিলিত বাহিনী অস্ট্রিয়ার উত্তরে জার্মানি এবং বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করল। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ফরাসি জেনারেল চার্লস লুই অগাস্ট। তিনি বোহেমিয়া দখল করে প্রাগে ঢুকে পড়লেন।
প্রাগের পতনে ভিয়েনার পরিস্থিতি সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। যেকোনো সময় শত্রুরা হামলা চালিয়ে বসতে পারে বলে মারিয়া থেরেসা পালিয়ে গেলেন ভিয়েনা থেকে, উদ্দেশ্য হাঙ্গেরি। তাকে অনেকে পরামর্শ দিলেন এ-বেলা ক্ষান্ত দিতে। কিন্তু মারিয়া থেরেসা ভিন্ন ধাতুতে গড়া। হাঙ্গেরির ব্রাতিস্লাভাতে তিনি অভিজাতদের সামনে অনুপ্রাণিত করে বক্তব্য রাখলে তারা সম্রাজ্ঞীকে সমর্থন জানায়। অবিলম্বে ২০,০০০ সেনা সমবেত হলো লড়াই করতে। তবে মারিয়া থেরেসা পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করলেন। ক্লেন স্নেলেনডর্ফ চুক্তি করে সিলিসিয়ার যুদ্ধ থামিয়ে পুরো মনোযোগ দিলেন ফরাসিদের দিকে। পাল্টা হামলা চালিয়ে তাদের তাড়িয়ে অস্ট্রিয়ানরা ১৭৪২ সালে প্রবেশ করল বাভারিয়ার রাজধানী, মিউনিখে। প্রাগ পুনরুদ্ধার করতে করতে ডিসেম্বর চলে আসল। এর মধ্যে অবশ্য ফরাসি মদদে আর ফ্রেডেরিকের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বাভারিয়ার চার্লস আলবার্ট ১৭৪২ এর জানুয়ারিতে হলি রোমান এম্পেরর সপ্তম চার্লস হিসেবে নির্বাচিত হলেন। যুদ্ধ চলতে থাকল। ১৭৪৫ সালে সপ্তম চার্লসের মৃত্যুর পর অস্ট্রিয়ান সেনারা সম্পূর্ণ বাভারিয়া অধিকার করে নেয়।
ফরাসি-ব্রিটিশ যুদ্ধ
ব্রিটিশরা মারিয়া থেরেসাকে পেছনে সমর্থন দিলেও ১৭৪৩ সাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসিদের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। যদিও এর মধ্যে ডেটিংটনে ব্রিটিশ এবং ফরাসি সেনাদের সরাসরি সংঘর্ষ হয়।
ডেটিংটন: বেলজিয়ামে ব্রিটিশ, অস্ট্রিয়ান আর হ্যানোভারের একটি মিলিত প্রতিরক্ষা বাহিনী মজুত ছিল। মেঞ্জের আর্চবিশপ নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থীর পেছনে শক্তির প্রদর্শনী দেখাতে দ্বিতীয় জর্জ সেনাবাহিনীকে সেখানে পাঠালেন। ইত্যবসরে ফরাসি জেনারেল নোয়ালিস মেইন নদীর দক্ষিণ তীর ঘাঁটি করলেন। ফরাসি সেনারা এরপরে পার্শ্ববর্তী ছোট্ট গ্রাম ডেটিংটনে কম্যান্ড পোস্ট স্থাপন করল।
জুনের ৮ তারিখ দ্বিতীয় জর্জ নিজেই মেইঞ্জে পৌঁছেন। তার সাথে রাজপুত্র, ডিউক অফ কাম্বারল্যান্ড। নানা আনুষ্ঠানিকতা চলাকালে জানা গেল ফরাসিরা কাছাকাছিই আছে। ইতিহাসে শেষবারের মতো ব্রিটিশ রাজা সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে রণক্ষেত্রে রওনা হলেন। ডেটিংটনে দুই বাহিনী মুখোমুখি হলো। নোয়ালিসের পরিকল্পনা ছিল একদল সেনা গ্রামে শক্ত হয়ে বসে থাকবে, তাদের দায়িত্ব হবে ব্রিটিশ সেনাদের অগ্রযাত্রা যতটা সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা। আর দুই দিল সৈন্য দুই দিক দিয়ে ব্রিটিশদের ঘিরে ফেলবে। রাজা জর্জকে বন্দি করার নির্দেশও তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু লড়াই শুরু হলে নোয়েলিসের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। জেনারেলদের ভেতর যোগাযোগের ঘাটতিতে ফরাসিরা আগ বেড়ে শত্রুবাহিনীকে আক্রমণ করে বসে। বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশরা তীব্র বেগে প্রতি আক্রমণ করলে শেষ পর্যন্ত ফরাসিরা পালিয়ে যায়।
এদিক জ্যাকোবাইটরা নিজেদের নেতা চার্লস এডওয়ার্ডকে (ব্রিটিশরা তাকে বলত দ্য ইয়াং প্রিটেন্ডার) রাজা বানাতে ফরাসিদের সহযোগিতা চাইলে তারা রাজি হয়। ১৭৪৪ সালের মার্চে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নৌবহর প্রস্তুত হলো ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ব্রিটেনের হৃদপিণ্ডে আঘাত হানতে। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তারা অভিযান বাতিল করে।
ব্রিটেন থেকে চোখ ফিরিয়ে জেনারেল স্যাক্সের (Maurice Saxe) অধীনে ফরাসি সেনাদল ১৭৪৫ সালে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে নতুন ফ্রন্ট তৈরি করল। মে মাসে ফন্টেনার (Fontenoy) লড়াইতে তারা ব্রিটিশ, অস্ট্রিয়ান, ডাচ এবং হ্যানোভারের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে, যাদের প্রধান ছিলেন ডিউক অফ কাম্বারল্যান্ড। ১৭৪৬ সালের ভেতরে পুরো অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস চলে এলো ফরাসিদের হাতের মুঠোয়। ব্রিটিশরা তেমন কোন প্রতিরোধ গড়তে পারেনি কারণ আগের বছরের অক্টোবরে স্কটল্যান্ডে জ্যাকোবাইট বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে তাদের বেশিরভাগ সেনাকেই ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফরাসিদের সাথে সাথে ইতালির কিছু অঞ্চল, সার্ডিনিয়া, জেনোয়া এবং স্পেনও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে মূল লড়াই হচ্ছিল ব্রিটিশ আর ফরাসিদের মাঝেই।
সাগরে অবশ্য ইংল্যান্ড ফরাসিদের বিরুদ্ধে এগিয়ে ছিল। ১৭৪৪ সাল থেকেই ফরাসি বাণিজ্য জাহাজ প্রায়শই ব্রিটিশ হামলার শিকার হতে থাকে। ফরাসি বন্দরগুলোর কাছাকাছিও ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ টহল দিচ্ছিল। ফলে ফ্রান্সের আমদানি-রপ্তানি প্রচণ্ডভাবে বিঘ্নিত হয়।১৭৪৫ সালে ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকার মিলিশিয়া বাহিনী সেন্ট লরেন্স উপসাগরের মুখে লুইজবার্গ (Louisbourg) বন্দর ছিনিয়ে নেয়। ওদিকে আবার ১৭৪৬ সালে ভারতে ব্রিটিশ মাদ্রাজ ফরাসিরা দখল করল।
জ্যাকোবাইট বিদ্রোহ
অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে ফরাসি সাফল্যে জ্যাকোবাইট নেতা চার্লস এডওয়ার্ড উৎসাহিত হয়ে ১৭৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে এডিনবার্গে ঢুকে পড়েন। তার পরদিন তিনি নিজের বৃদ্ধ পিতাকে স্কটল্যান্ডের রাজা সপ্তম জেমস ঘোষণা দেন। তিনি আশা করছিলেন ইংল্যান্ডে তার সফলতা দেখলে পঞ্চদশ লুই সেনা পাঠাবেন। ২১ তারিখে একটি ব্রিটিশ সেনাদল তার হাতে পরাস্ত হয়। এডওয়ার্ড আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর হয়ে ইংল্যান্ডে আগ্রাসন চালাবেন বলে ঠিক করলেন। দ্বিতীয় জর্জ তৎক্ষণাৎ অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস থেকে ডিউক অফ কাম্বারল্যান্ডকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু কাম্বারল্যান্ড আসতে আসতে এডওয়ার্ড ডার্বি পর্যন্ত চলে আসেন।
কিন্তু প্রত্যাশিত ফরাসি সেনা সহায়তা এসে পৌঁছানোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। তাছাড়া স্কটল্যান্ড থেকেও তিনি অনেক দূরে চলে এসেছেন। ফলে তার সমর্থকেরা চাপ দিতে থাকে আর না এগিয়ে ফিরে যাবার জন্য। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে এডওয়ার্ড ফিরতি পথ ধরলেন। ইতোমধ্যে ডিউক অফ কাম্বারল্যান্ডও ইংল্যান্ডে অবতরন করেছেন। তিনি তার পিছু নেন। ১৭৪৬ সালের ১৬ এপ্রিল স্কটল্যান্ডের ক্যালোডেন (Culloden) গ্রামে সংঘর্ষে জ্যাকোবাইটরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মাত্র এক ঘণ্টার লড়াইয়ে তাদের বেশিরভাগ লোক মারা পড়ে। এডওয়ার্ডের মাথার উপর ইংল্যান্ড ৩০ হাজার পাউন্ডের পুরস্কার ঘোষণা করে। তবে ফ্লোরা ম্যাকডোনাল্ড নামে এক তরুণীর সহায়তায় তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি আর কখনোই ইংলিশ মুকুটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি।
দ্বিতীয় সিলিসিয়ান যুদ্ধ
ফ্রেঞ্চ এবং বাভারিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ানদের সাফল্যে ফ্রেডেরিক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন মারিয়া থেরেসা হয়তো এবার তাকে আক্রমণ করবেন। ফলে ১৭৪৪ সালের অগাস্টে ফ্রেডেরিক স্যাক্সোনির ভেতর দিয়ে বোহেমিয়াতে প্রবেশ করেন। শুরু হলো দ্বিতীয় সিলিসিয়ান লড়াই।
ফ্রেডেরিক সেপ্টেম্বর মাসে প্রাগ দখল করেন। অস্ট্রিয়ানরা তখন ফরাসিদের ঠেকাতে ব্যস্ত। প্রুশিয়ান অভিযানের খবরে তারা বোহেমিয়াতে ফিরে আসল। স্যাক্সোনি ফ্রেডেরিকের দল ছেড়ে তাদের সাথে গাঁটছড়া বাধে। অস্ট্রিয়ান সেনারা প্রুশিয়ানদের সাথে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে বেদখল হয়ে যাওয়া শহরগুলো পুনর্দখল করতে থাকে। ডিসেম্বরে ফ্রেডেরিক প্রাগ থেকে পিছিয়ে যান। প্রায় ১৫,০০০ হতাহত ফেলে তিনি সিলিসিয়াতে সরে গেলেন।
ব্যাটল অফ হনফ্রিদবিয়োর্গ
১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রায় অস্ট্রিয়ান আর স্যাক্সোনির ৬০,০০০ সৈন্যের মিলিত বাহিনী সিলিসিয়াতে হামলা করল। এখানে হনফ্রিদবিয়োর্গ এলাকায় ফ্রেডেরিক তাদের বিরুদ্ধে তার অন্যতম সেরা জয় লাভ করেন। সেনাধ্যক্ষ প্রিন্স চার্লসের নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনী তেসরা জুন এই এলাকাতে প্রায় চার মাইল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্যাম্প করেছিল।
রাতের আঁধারে ফ্রেডেরিক তার সেনাদের নদী পার করিয়ে ৪ তারিখে অতর্কিতে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অস্ট্রিয়ানদের বাম বাহুতে ছিল স্যাক্সোনির সেনারা। তাদের সাথে প্রুশিয়ান অশ্বারোহী বাহিনীর তুমুল লড়াই চলার সময় নদী পার হয়ে ফ্রেডেরিকের ইনফ্যান্ট্রি স্যাক্সোনি সেনাদের ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এরপর ফ্রেডেরিক সর্বশক্তি নিয়োগ করেন অস্ট্রিয়ানদের বিরুদ্ধে। তার সেনারা কামান আর বন্দুকের গুলির মাঝে অস্ট্রিয়ানদের লাইনে চার্জ করল। বেসামাল অস্ট্রিয়ানরা পালিয়ে যায় বোহেমিয়ার দিকে। ফ্রেডেরিক পিছু ধাওয়া করলেন না। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন এত বড় পরাজয়ের পর অস্ট্রিয়ানরা তার শর্তে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হবে। কিন্তু তাকে হতাশ করে তারা লড়াই চালিয়ে যায়।
ব্যাটল অফ সুর
প্রিন্স চার্লস পুনরায় সেনাদের সংগঠিত করলেন। তিনি খবর পেলেন ফ্রেডেরিক সুর (Soor; বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত) এলাকার কাছে ছাউনি ফেলে আবার বোহেমিয়া আক্রমণের ছক কষছেন। ২৯ সেপ্টেম্বর চার্লস রাতের আঁধারে আশেপাশের পাহাড়ে কামান স্থাপন করলেন। এদিকে শত্রুদের উপস্থিতি ফাঁস হয়ে গেলে ফ্রেডেরিক দ্রুত সেনাদের প্রস্তুত করলেন। ৩০ তারিখ অস্ট্রিয়ান আর স্যাক্সোনির সেনারা পাহাড় থেকে কামান দাগা শুরু করল। ফ্রেডেরিকের আদেশে একদল অশ্বারোহী চলে গেল পাশ থেকে পাহাড়ের নিচে থাকা প্রহরীদের আক্রমণ করতে। আর একদল পদাতিক সেনা পাঠানো হলো কামানের অবস্থানের দিকে হামলা করতে। বাকি সেনাদের দায়িত্ব ছিল শত্রুদের ব্যস্ত রাখা যাতে অন্য দুই দল সফল হতে পারে। এই কৌশলে প্রুশিয়ানদের অনেক হতাহত হলেও তারা পাহাড়ের চুড়ায় শত্রুদের উপর আঘাত করতে সক্ষম হয়। অস্ট্রিয়ানরা প্রথম হামলা ঠেকিয়ে দিলেও দ্বিতীয়বার আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
ব্যাটল অফ কেসেলসডর্ফ
কেসেলসডর্ফ (Kesselsdorf) ছিল স্যাক্সোনির একটি শহর। ১৫ ডিসেম্বর ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের পুরনো বন্ধু অভিজ্ঞ সেনা কম্যান্ডার আনহাউটের প্রিন্স লিওপোল্ড প্রুশিয়ান বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে শহর আক্রমণ করেন। প্রতিরক্ষার কাজে ছিল স্যাক্সোনির সেনারা। অস্ট্রিয়ানরা কাছেপিঠেই ছিল, তবে তারা লড়াইয়ে অংশ নেয়নি। লিওপোল্ড দুবার সরাসরি হামলা চালালেও প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেদ করতে পারেননি। কিন্তু দ্বিতীয়বার প্রুশিয়ানরা পিছু হটে গেলে শহরের সেনারা মনে করল শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা ধাওয়া করতে বেরিয়ে এলো। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে লিওপোল্ডের অশ্বারোহী সেনাদল তাদের কচুকাটা করে ফেলে। ফ্রেডেরিকের কাছে বিজয়ের সংবাদ পৌঁছে দেয়া হলো। তিনি এরপর যখন লিওপোল্ডের সাক্ষাৎ পেলেন বলা হয় রাজা ঘোড়া থেকে নেমে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কিন্তু ততদিনে প্রুশিয়ার শক্তিও তলানিতে এসে ঠেকেছে। ফ্রেডেরিক তাই শান্তিচুক্তির রাস্তা খুঁজতে থাকলেন।
এদিকে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে ফরাসিদের হাতে মার খেয়ে দ্বিতীয় জর্জও শান্তির কথা ভাবছিলেন। এর মাঝে কেসেলসডর্ফের সংঘর্ষের পর মারিয়া থেরেসা ফ্রেডেরিকের সাথে শান্তি স্থাপনের সিদ্দান্ত নিতে বাধ্য হন। জর্জের মধ্যস্থতায় ১৭৪৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ড্রেসডেন চুক্তি (Treaty of Dresden)। শূন্য হলি রোমান এম্পেররের আসনে মারিয়া থেরেসার স্বামী স্টেফানকে পরবর্তীতে সমর্থন দিতে ফ্রেডেরিক সম্মত হলেন। মারিয়া থেরেসা সিলিসিয়ার উপর প্রুশিয়ার চিরন্তন অধিকার মেনে নেন। জর্জ আশ্বাস দিলেন সিলিসিয়ায় ফ্রেডেরিকের কর্তৃত্ব ইউরোপিয়ান রাজন্যবর্গ যাতে স্বীকার করে নেয় তা তিনি নিশ্চিত করবেন।
শান্তিচুক্তি
অনেক রক্ত ঝরবার পর ১৭৪৬ সাল থেকে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মাঝে আরম্ভ হল শান্তি আলোচনা। ইউরোপিয়ান শক্তিদের এই সংঘাতে রাশিয়া সরাসরি অংশ না নিলেও ১৭৪৭ সালের সেন্ট পিটার্সবার্গ চুক্তির আলোকে ব্রিটিশদের জন্য ভাড়াটে যোদ্ধার ব্যবস্থা করেছিল। ফলে ফ্রান্স আলোচনার টেবিলে রাশিয়াকে কোনো জায়গা দিতে ভেটো প্রদান করে এবং পরবর্তীতে ১৭৪৮ সালে এই সূত্র ধরে ফ্রান্স-রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কাজেই শান্তিচুক্তিতে রাশিয়ার কোনো ভূমিকাই ছিল না। ১৭৪৮ সালের ১৮ অক্টোবর হলি রোমান এম্পায়ারের অন্তর্গত আখেন (Aachen) শহরে বহুল প্রতিক্ষিত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বিবাদমান পক্ষগুলো। একে বলা হয় ইক-লা-শ্যাপেল চুক্তি (The peace of Aix-la-Chapelle) বা ট্রিটি অফ আখেন। ফরাসি আর ইংলিশ প্রতিনিধিরা অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে জানিয়ে দেন কেউ যদি লড়াই জারি রাখতে চায় নিজ উদ্যোগে রাখতে হবে, ব্রিটেন বা ফ্রান্স তাদের সহায়তা করবে না। ফলে সব পক্ষই স্বাক্ষর করে।
চুক্তির শর্তমতে সমস্ত পক্ষ যুদ্ধ শুরুর আগের নিজ সীমান্তকে চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়। বাভারিয়া ছিল অস্ট্রিয়ার দখলে, তারা সেখানকার ইলেক্টরের কাছে বাভারিয়া ফিরিয়ে দিল। অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস ফরাসিরা অস্ট্রিয়ার কাছেই ছেড়ে দেয়। ব্যতিক্রম ছিল একটি। সিলিসিয়া আগেই প্রুশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার আলাদা চুক্তির মাধ্যমে ফ্রেডেরিকের হস্তগত হয়েছে। মারিয়া থেরেসাকে সবাই মেনে নিল হাবসবুর্গ সম্রাজ্ঞী বলে। তার স্বামী নির্বাচিত হলেন হলি রোমান এম্পেরর প্রথম ফ্রান্সিস।
অস্ট্রিয়ান সাকসেশন ওয়ারে দুটি পক্ষ সবচেয়ে বেশি লাভবান হলো। ফ্রেডেরিক সিলিসিয়ার মতো বিরাট এবং জনবহুল অঞ্চল ছিনিয়ে নিয়ে এক ধাক্কায় প্রুশিয়ার আয়তন বিশাল বাড়িয়ে ফেললেন। ইউরোপিয়ান নৃপতিরাও তার সামরিক সক্ষমতাকে হিসেবে আনতে বাধ্য হন। অন্যদিকে সিলিসিয়া হারালেও মারিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য মোটামুটিভাবে অক্ষত রাখতে পেরেছিলেন। উপরন্তু তার স্বামীকে হলি রোমান এম্পেরর বানানোর লক্ষ্যও পূরণ হলো। তবে সিলিসিয়ার হারানোর দুঃখ তিনি কখনো ভোলেননি। দৃঢ় শপথ নিলেন ফ্রেডেরিক নামের এই আপদকে তাড়িয়ে শিগগিরি তিনি সিলিসিয়াতে হাবসবুর্গ শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন।