দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি রাশিয়াতে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেটার ক্ষয় থেকে রাশিয়া যুদ্ধের পর পর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের মনে, অর্থাৎ রাশিয়ার প্রধান স্তালিনের মনে দুঃখ এবং ক্ষোভ ছিল যে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় যখন সে তাদের বিপক্ষে আওয়াজ তুলেছিল তখন কোনো রাষ্ট্রই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। এমনকি তার মিত্রবাহিনী পক্ষেরও কেউ এগিয়ে আসেনি। জার্মানিকে হারিয়ে রাশিয়া যদিও কিছু প্রতিশোধ নিতে পেরেছিল কিন্তু পুরোপুরি পারেনি। স্তালিনের ভয় ছিল যে রাশিয়া হয়তো আবারও কোনো শত্রুপক্ষ দ্বারা আক্রমণের শিকার হবে, তাই তিনি রাশিয়াকে সামরিক শক্তিতে উন্নত করার চেষ্টা করছিলেন এবং একে একে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের দখলে আনতে চেয়েছিলেন। “দখল”- শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এই কারণে যে, রাশিয়া এমনভাবে তখন এগিয়ে যাচ্ছিলো যে যেসব দেশ তারা নিতে চায় সেখানকার মানুষ স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে এবং নিজেদের সরকার গঠন করতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে রাশিয়ার আনুগত্য স্বীকার করে নিতে হবে।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে তিন দেশের তিন রাষ্ট্র প্রধান রুজভেল্ট, স্তালিন এবং চার্চিল- ইয়ালটাতে একসাথে একটি বৈঠকে বসেন। এটা ছিল ১৯৪৫ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। তখন তাদের সামরিক বাহিনী জার্মানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রুজভেল্ট এবং চার্চিল Atlantic Charter এ যুদ্ধের সময় তাদের করণীয় নিয়ে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। এমনকি তারা জাতিসংঘকেও সমর্থন করেছেন সারা বিশ্বে শান্তিবার্তা নিয়ে আসার জন্য। স্তালিন এ ধরনের বৈঠকে অংশগ্রহণ করেননি। আমেরিকানরা অনেক বেশী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল এবং কমিউনিস্টদের প্রতি তাদের বৈরি মনোভাবও লক্ষণীয় ছিল। যুদ্ধের শেষের দিকে আসতে আসতে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যকার মতবিরোধ এবং মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। পরে গিয়ে এগুলো তাদের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ হয়।
স্তালিনের তার বাকি দুই মিত্রের বিষয়ে ধারণা ছিল একটু অন্যরকম। হয়তো বাইরে থেকে আমাদের মনে হতে পারে যে এই তিন বৃহত্তর দেশ একে অপরের বন্ধু। কিন্তু স্তালিন কখনোই ইংরেজদের তথা চার্চিলকে বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি একবার বলেছিলেন, “আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না যে ইংরেজরা কেমন। ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থে তাদের মিত্রবাহিনীর সাথেও চালাকি করতে ছাড়বে না।” এ থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার দিকে কোনো সাহায্যের হাত না বাড়ানোর কারণে স্তালিনের মনে ক্ষোভ ছিল।
ক্রিমিয়ার ইয়ালটা এবং জার্মানির পটসডামে অনুষ্ঠিত দুটি বৈঠকের কথা বর্ণনা করলে যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা এবং রাশিয়ার সুপার পাওয়ার হয়ে যাওয়ার গল্প অনেকটাই বোঝা যায়। ১৯৪৫ সালের ইয়ালটার বৈঠকে যখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান একসাথে বসে তখন তারা জাতিসংঘ নিয়ে কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য জাতিসংঘের পক্ষে গেলেও রাশিয়া মন থেকে এই পক্ষ নেয়া মেনে নিতে পারেনি। রাশিয়ার প্রধান স্তালিন যদিও জাতিসংঘের সদস্য হতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু তাদের এদিকে আগ্রহ একদমই ছিলো না। স্তালিন তখন পোল্যান্ড চাচ্ছিলেন। অন্তত পোল্যান্ডের পূর্বভাগ তারা বেশী বেশী করে চাচ্ছিলো। অন্যদিকে আবার পূর্ব জার্মানি পোল্যান্ডের ক্ষতিপূরণ দিতে চাচ্ছিলো, যেটা রুজভেল্টের পছন্দ হয়নি। কিন্তু চার্চিল সেটা মেনে নিতে রাজি ছিলেন, যদি রাশিয়া গ্রিসে ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব দিতে রাজি থাকে।
এরপর সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, পুরো জার্মানিকে সাময়িকভাবে চার ভাগে ভাগ করতে হবে। ভাগগুলোর অংশীদারিত্ব হবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং ফ্রান্সের। চার্চিলের রুজভেল্টকে নিয়ে ভয় ছিল যে, রুজভেল্ট অনেক বেশি Pro-Soviet, অর্থাৎ পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং সেগুলোর পক্ষে। তাই চার্চিল নিজেই অনেকটা জোর করেই চতুর্থ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তি করে এই বিভাজনে। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য, চার্চিলের এমন সিদ্ধান্তে কিন্তু সোভিয়েত বিরোধী গন্ধ পাওয়া যায়। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কিন্তু তখনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি যে জার্মানিকে স্থায়ীভাবে বিভাজিত করে হবে কি না। তখনও পর্যন্ত এই বিভাজন সাময়িকই ছিল।
এরপর এই তিন দেশের প্রধান আবার একত্রিত হয় জার্মানির পটসডামে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। যুদ্ধের পুরোটা সময় নিজেদের আধিপত্য এবং অত্যাচার বজায় রাখা জার্মানি সেখানে পরাজিত। এরপর আগের সেই তিন মিত্র রাষ্ট্র আবারও একত্রিত হয়। এই ঘটনা ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝিতে। ততদিনে রুজভেল্ট মারা গিয়েছেন, চার্চিল ব্রিটিশদের সাধারণ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। রাশিয়ার প্রধান তখনও অপরিবর্তিত। স্তালিন তখন দুই দেশের নতুন দুই রাষ্ট্রপ্রধান ট্রুম্যান এবং এটেলের সাথে বৈঠক করে।
যুদ্ধে পরাজিত নাৎসি বাহিনীর হিটলারের সহকর্মী এবং সহ-কাণ্ডারিদের অনেকেই তখন মিত্রবাহিনীর কাছে আটক। তাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এই বৈঠক হয়। আটককৃত আসামীদের মধ্যে ছিল গোয়েরিং, হেস, পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ, গেস্টাপো কালটেন ব্রুনার, জেনারেল ক্যটেল, এডমিরাল রেইডার এবং ডোনিজ। বৈঠকের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে এদের মধ্যে অনেককে মৃত্যুর আদেশ দেয়া হয়, অনেককে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় এবং অন্যান্যদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেয়া হয়। তবে গোয়েরিং এর কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার আগেই সে আত্মহত্যা করে। তাই তার কোনো বিচার হয়নি। তবে এদের মধ্যে সোভিয়েতদের কাছে যাদের মনে হয়েছে পরে গিয়ে উপকারে লাগতে পারে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু বাকিদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হয় তখন। জার্মানির পশ্চিমদিকের অঞ্চলে যারা ছিল, তাদের প্রত্যেককে একটি জরিপ প্রশ্নমালা দেয়া হয়, যেখানে তাদেরকে গত ১৫ বছরের জীবনবৃত্তান্তের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
মিত্রবাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ক দিন দিন খারাপের দিকেই যেতে থাকে। এর অন্যতম কারণ ছিল রাশিয়া। রাশিয়া তাদের অধীনের ভূখণ্ড বাড়িয়েই চলছিলো। পোল্যান্ড-রাশিয়ার সীমানা পশ্চিম দিকে আরও বেড়ে গিয়েছিলো। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়া ইউরোপের অন্যান্য দেশেও নিজেদের অধীনস্থ এলাকা বর্ধিত করেছিলো। এই দেশগুলো হচ্ছে ফিনল্যান্ড, লিথুনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া এবং রোমানিয়া। এই সময়ের মধ্যে রাশিয়ার অধীনস্থ এলাকা পশ্চিম দিকে প্রায় চারশো আশি কিলোমিটার পর্যন্ত বর্ধিত হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় ২২ মিলিয়ন মানুষকে তারা তৎকালীন ইউএসএসআর এর অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলো, যারা হয়তো ১৯৩৯ সালের দিকে অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
পরে গিয়ে ট্রুম্যান এবং এটেলকে রাশিয়ার এমন কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিলো। তাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছিলো, কেন তারা এমনটি হওয়ার সময় রাশিয়াকে বাঁধা দেয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারা রাশিয়াকে কিছু বললেও রাশিয়া সেটায় আমল দিতো বলে মনে হয় না, কারণ তারা তাদের সামরিক বাহিনী নিয়ে পুরো পশ্চিম ইউরোপ নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছিলো। এখানে বাকি দুই রাষ্ট্রের কিছু করার ছিল না। রাশিয়া শুধু এখানেই থেমে থাকেনি। তারা যুদ্ধের পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে ইউরোপের পূর্বাংশও নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। তাদের কমিউনিস্ট সরকার বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং হাঙ্গেরিকে নিজেদের দখলে নেয়। তখন ইউরোপের এই দুই অংশ মস্কো থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলো। এমনকি স্তালিন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে তাদের স্যাটেলাইটের ভিতর অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
তথ্যসূত্র
[১] Making History – World History from 1914 to the Present – Christopher Culpin
[২] We Now Know: Rethinking Cold War History – John Lewis Gaddis
[৩] The Cold War: A World History – Odd Arne Westad
ফিচার ইমেজ সোর্সঃ Anarkismo.net