১. সাইবেরিয়ার ডেথ মাস্ক
২০১৫ সালের কথা, সাইবেরিয়ার কেমেরোভো অঞ্চলে একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষের সন্ধান পেয়ে যান একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ। সেখানে গবেষণা চালিয়ে তারা খুঁজে পান ২০টি ডেথ মাস্ক। সেই কবরস্থানটি ছিল আসলে দুর্ধর্ষ তাশ্তিক গোত্রের কিছু মানুষের। যোদ্ধা এ গোত্রটি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাইবেরিয়ার বিশাল একটি এলাকা নিজেদের দখলে রেখেছিল। ভূগর্ভস্থ সেই কক্ষের আড়ালে লুকনো কবরস্থানটি চারদিকে পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল, আর উপরে ছিল কাঠের ছাদ। পুরো এলাকাটি খনন করে পৃথিবীর আলোয় পুনরায় ফিরিয়ে আনতে প্রায় বছর দুয়েক সময় লেগে গিয়েছিল।
প্রত্নতত্ত্ববিদগণ সেই কবরস্থান থেকে সর্বমোট ৩০টি মৃতদেহের সন্ধান পেয়েছিলেন, যাদের সবগুলোই কাপড় ও চামড়া দিয়ে তৈরি ডামির ভেতরে ঢোকানো ছিল। ডামিগুলোর মুখে জিপসামের তৈরি ডেথ মাস্ক ব্যবহার করা হয়েছিল। এই ডেথ মাস্কগুলোর সাথে ইউরোপে ব্যবহৃত ডেথ মাস্কের অনেক মিল ছিল। কবরস্থানের বাইরে বেশ কিছু বাচ্চার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তবে তাদের কারোরই ডেথ মাস্ক ছিল না।
২. সুদানের সাত মমি
এবার চলে যাওয়া যাক ২০০৯ সালে। আজকের দিনে যে দেশটিকে আমরা সুদান বলে চিনি, এর মধ্যবর্তী স্থানেই মধ্যযুগে একটি রাজ্য ছিল, নাম তার মাকুরিয়া। এই মাকুরিয়ার রাজধানী পুরাতন ডঙ্গোলারই এক মঠের ভূগর্ভস্থ এক প্রকোষ্ঠে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল আনুমানিক ৯০০ বছরের পুরনো ৭টি মমি! সাতজনের সবাই পুরুষ, যাদের প্রত্যেকের বয়স চল্লিশ বছরের বেশি। ভূগর্ভস্থ সেই প্রকোষ্ঠটি আবার ইট ও কাদামাটি দিয়ে আটকানো ছিল, যাতে কেউ এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে না পারে।
ভেতরের দেয়ালে চারদিক জুড়ে ছিল নানা রকম মন্ত্র খোদাই করা। সাদা দেয়ালে খোদাইকৃত সেই মন্ত্র লিখতে ব্যবহার করা হয়েছিল সাহিদিক কপ্টিক ও গ্রিক ভাষা। সেখানে গস্পেল থেকে নেয়া বিভিন্ন বাণী যেমন ছিল, তেমনই ছিল জাদুবিদ্যার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নাম ও প্রতীক। ধারণা করা হয়, মৃত ব্যক্তিদেরকে পরজগতে সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যেই এসব মন্ত্র লিখে রাখা হয়েছিল।
এ প্রকোষ্ঠটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ১৯৩৩ সালেই। কিন্তু খননকার্য শুরু হয় ২০০৩ সালে। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, এখানে প্রাপ্ত মমিগুলোর একটি আর্চবিশপ জর্জিওসের, যিনি তৎকালীন মাকুরিয়ার খুব বিখ্যাত এক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
৩. গৌতম বুদ্ধের করোটির অংশবিশেষ
চীনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত জিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী নানজিং। এ নানজিংয়েই রয়েছে গ্র্যান্ড বাও’এন উপাসনালয়। এ উপাসনালয়ের ভেতরেই ভূগর্ভস্থ এক প্রকোষ্ঠে পাওয়া গিয়েছে প্রায় ১,০০০ বছরের পুরনো এক সিন্দুক। সেই সিন্দুকের ভেতরে পাওয়া একটি খুলির অংশকে বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করছেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের খুলির অংশ হিসেবেই!
গুরুত্বপূর্ণ এ নিদর্শনের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ম্যাকাও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, খুঁজে পাওয়া বৌদ্ধস্তূপের (Stupa) ফলকের গায়ে খোদাই করা ছিল এ কথাগুলো- “এ প্রাসাদে সংরক্ষিত রয়েছে ‘রাজা অশোকের সপ্ত-সম্পদের প্যাগোডা’, যাতে সোনা ও রুপার কফিনের ভেতরে রয়েছে শাক্যমুনির মধ্যকপালের হাড় এবং অন্য আরো ক’জন বৌদ্ধ সন্যাসীর দেহাবশেষ”। পরবর্তী এক মাস ধরে আরো খননকার্য চলার পরে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ পাথরের তৈরি একটি সিন্দুক খুঁজে পান, যার ভেতরে ছিল লোহার তৈরি একটি বাক্স।
বাক্সটি খোলার পর এর ভেতরে বিজ্ঞানীরা একটি বৌদ্ধস্তূপ খুঁজে পান যা ছিল দৈর্ঘ্যে ৪ ফুট এবং প্রস্থে আনুমানিক ১.৫ ফুট। এটি বানাতে ব্যবহার করা হয়েছে চন্দনকাঠ, সোনা ও রুপা। এছাড়া এর চারদিকে শোভাবর্ধনে ব্যবহৃত হয়েছে ক্রিস্টাল, কাচ, গন্ধর্বমণি এবং নীলকান্তমণি।
এটি তৈরি করা হয়েছে সং রাজবংশের রাজা ঝেংজংয়ের সময়কালে (৯৯৭-১০২২ খ্রিস্টাব্দ)। এ বৌদ্ধস্তূপটি নির্মাণে কে কে অর্থসাহায্য দিয়েছিল, তাদের নামও রয়েছে সেখানে খোদাইকৃত অবস্থায়। দ্য টেলিগ্রাফ থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করছেন, এ রেলিকটি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে সম্রাট অশোকের শাসনামলে নির্মিত ৮৪,০০০ প্যাগোডার একটি, যা গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল।
খুলির হাড়টি রয়েছে স্বর্ণের তৈরি ছোট একটি কফিনে, সেই কফিনটি রাখা আছে রুপোর তৈরি আরেকটি কফিনের ভেতরে। রুপার এ কফিনটি আবার রাখা বৌদ্ধস্তূপের ভেতরে। কফিনের চারদিকে পদ্মফুল, ফিনিক্স পাখি এবং শবাধারটিকে প্রহরারত অবস্থায় দেবতাদের চিত্র অঙ্কিত রয়েছে।
৪. ক্যান্সারে আক্রান্ত মমি
১৯৯৫ সালে হাঙ্গেরির পেস্ট প্রদেশের ভাক শহরে অবস্থিত ডমিনিকান চার্চের এক বদ্ধ ভূগর্ভস্থ কক্ষে অভিযান চালান একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ। সেখান থেকে তারা খুঁজে পেয়েছিলেন আঠারো শতকের এক হাঙ্গেরীয় ব্যক্তির মমি, যিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সেদিন আসলে সব মিলিয়ে ২৬০টি মমির দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। একদল ইসরায়েলি বিজ্ঞানী সেই দেহাবশেষগুলো পরীক্ষা করে জানতে চাইছিলেন যে, তাদের দেহে ক্যান্সারবাহী কোনো জিন আছে কিনা। অবশেষে একটি মমি খুঁজে পাওয়া যায়, যার দেহে এপিসি জিনের মিউটেশনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এটি কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।
৫. প্রাগের গোপন মাস্টারপিস
এবার চলে যাওয়া যাক চেক প্রজাতন্ত্রে। দেশটির রাজধানী এবং একইসাথে সবচেয়ে বড় শহর হলো প্রাগ। এই প্রাগেই অবস্থিত চার্চ অফ দ্য ন্যাটিভিটি অফ আওয়ার ল্যান্ড এর এক ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে চিত্রবিশারদগণ এমন সব ছবির সন্ধান পেয়েছেন, যেগুল বিগত দীর্ঘকাল ধরে আলোর মুখ দেখেনি।
আনুমানিক ১৬৬৪ সালে আঁকা এ ছবিগুলোতে মূলত কালো ও ধূসর বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে। মৃত্যু, পুনরুত্থান, সময়ের বহমানতা ইত্যাদি বিষয়গুলোকেই সেখানে ছবির সাহায্যে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
২০১১ সালে এ ছবিগুলোর খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। এগুলোর মাঝে অনেকগুলোই ডাচ চিত্রকর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আঁকা। এর মাঝে ডাচ চিত্রশিল্পী রেম্ব্রেন্ডট হার্মেন্সজুনের আঁকা ছবিও ছিল। তবে এ ছবিগুলোর প্রকৃত আঁকিয়ে যে কে তা আজও এক রহস্যই রয়ে গেছে। কারো কারো মতে কসমাস অফ অস্ট্রিয়া, আবার কারো মতে ভিয়েনার চিত্রশিল্পী টোবিয়াস পক ছবিগুলো এঁকেছিলেন। কারণ তাদের দুজনেরই কাপুচিন সন্তদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। আবার ছবির বিষয়বস্তুগুলো কি শিল্পীরাই ঠিক করেছিলেন নাকি ভূগর্ভস্থ কক্ষটির পৃষ্ঠপোষক কাউন্টেস এলিজাবেথ অ্যাপোলোনিয়া অফ কলোরাট ঠিক করেছিলেন সেটাও নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।
৬. হৃদপিণ্ডের সমাধি
এখন আমরা থাকবো ইউরোপেই, তবে যাবো ফ্রান্স নামক দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত রেঁনে নামক শহরে। ২০১৫ সালে এ শহরেই অবস্থিত জ্যাকোবিনদের মঠ থেকে আনুমানিক ৪০০ বছরের পুরনো ৫টি হৃদপিণ্ড খুঁজে পান মাটির নিচে অবস্থিত একটি কক্ষ থেকে। হৃদপিণ্ডগুলো সীসার তৈরি হৃদপিণ্ডের আকৃতির ভস্মাধারেই রাখা ছিল। ভস্মাধারগুলোর গায়ে আবার হৃদপিণ্ডের মালিকদের পরিচয়ও লিখে রাখা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, হৃদপিণ্ডগুলো ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে ঘুরে বেড়ানো কয়েকজন মানুষেরই হবে।
খুঁজে পাবার পর এগুলোকে মমি করার কাজে ব্যবহৃত উপাদানগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর এদের এমআরআই ও সিটি স্ক্যান করা হয়, যাতে করে কয়েকশ বছর আগেকার সেই মানুষগুলোর হৃদপিণ্ডের অবস্থা কেমন ছিল তা বোঝা যায়। দেখা যায়, একটি হৃদপিণ্ডের মালিক পুরোপুরি সুস্থ-সবলই ছিলেন। তবে বাকি তিনজনের হৃদপিণ্ডে ভালোই ব্লক ধরা পড়েছিল। সেই সাথে প্লাক ও অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসও ছিল।
গবেষকগণ লেডি অফ ব্রেফেইলাক লুইস ডি কুইঙ্গোর কবরে একজন নাইটের হৃদপিণ্ডও খুঁজে পেয়েছিলেন। এটা আসলে তার স্বামী টোসাইন্ট পেরিয়েনের হৃদপিণ্ড ছিল। তৎকালে এভাবে স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের (যদি সে আগেই মারা গিয়ে থাকে) হৃদপিণ্ড নিয়ে কবরে যাওয়ার রীতিটা বেশ প্রচলিত ছিল।
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons