ট্যাংক শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে বিশাল এক লৌহদানবের ছবি ভেসে ওঠে। যুদ্ধের ময়দানে এই সাঁজোয়া যানটি প্রতিপক্ষের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত রূপে আবির্ভাব হয়। লোহার চেইনের ওপর ভর করে চলা এই যুদ্ধযানটি আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৬ সালে প্রথমবারের মতো যুদ্ধে ট্যাংক ব্যবহার করে ব্রিটিশরা। তারপর থেকে ধাপে ধাপে ট্যাংকের উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, আরও আধুনিক শক্তিশালী ট্যাংক সামরিক বাহিনীগুলোতে যুক্ত হয়েছে। শতবছরের ট্যাংকের ইতিহাসে রয়েছে অনেকগুলো যুদ্ধ যেগুলোতে বৃহৎ পরিসরে ট্যাংক অবদান রেখেছিল। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব দেশই শক্তিশালী ট্যাংক ব্যবহার করে।
আধুনিক কালে পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধ, আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ থেকে শুরু করে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক অভিযান সব ক্ষেত্রেই ট্যাংক ছিল একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমান শতাব্দীতে একটি সামরিক বাহিনী ট্যাংক ছাড়া অসম্পূর্ণ। ভবিষ্যতে ট্যাংক আরও আধুনিক হবে, হয়তো বদলে যাবে এর চিরচেনা রূপ, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক আগের মতোই বিভীষিকা রূপে আবির্ভূত হবে। আজকে জানাব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ, ভয়ানক, বিধ্বংসী কয়েকটি ট্যাংকযুদ্ধের কথা।
ব্যাটল অভ কামব্রেই (২০ নভেম্বর-০৮ ডিসেম্বর, ১৯১৭)
প্রথমবারের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের ব্যবহার করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। ‘ব্যাটল অভ কামব্রেই’ নামে পরিচিত ব্রিটিশ বনাম জার্মানদের এক যুদ্ধে প্রথমবারের মতো বৃহৎ পরিসরে ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। প্রায় ৩৭৬ এর কাছাকাছি সংখ্যক মার্ক-৪ সিরিজের ট্যাংক ব্যবহার করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। ব্রিটিশ বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ করে জার্মান হিন্ডেনবার্গ লাইন ধ্বংস করে দেওয়া। এই লাইনটি ছিল ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই পয়েন্ট। হিন্ডেনবার্গ লাইনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে শুধু পদাতিক বাহিনী দিয়ে এটি জয় করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ১৯১৭ সালের অগাস্ট মাসের প্রথম দিকে এই আক্রমণের পরিকল্পনা শুরু করেন ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষরা। ট্যাংক কোরের সেকেন্ড জেনারেল স্টাফ অফিসার জে. এফ. সি. ফুলার এবং জেনারেল স্টাফ অফিসার এইচ. জে. এলিস প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক ব্যবহারের কথা চিন্তা করেন।
ব্রিটিশ থার্ড আর্মি’র জেনারেল স্যার জুলিয়ান বিং-এর অধীনে আক্রমণ পরিচালিত হয়। প্রায় ২,৫০,০০০ বৃটিশ সৈন্য প্রথমবারের মতো হিন্ডেনবার্গ লাইন ভেদ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ৫,০০,০০০ জার্মান সেনার মুখোমুখি হয়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন, পঞ্চম অশ্বারোহী বাহিনী ডিভিশন এবং তিনটি ট্যাংক ব্রিগেড নভেম্বরের ২০ তারিখ, সকালবেলা আচমকা হানা দেয় হিন্ডেনবার্গ লাইনের জার্মান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর। উদ্দেশ্য ছিল তারকাঁটা ভেদ করে জার্মান এরিয়ায় ঢুকে পড়া আর পদাতিক সৈনিকদের কাভার দেওয়া।
শুরুতে প্রত্যাশিত সাফল্য লাভ করে ব্রিটিশ বাহিনী। হঠাৎ আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় জার্মানরা। রাতের মধ্যে ব্রিটিশ বাহিনী দু-তিন মাইলের মতো জায়গা দখল করে নেয়। পরবর্তী নয় দিন ধরে সামনের দিকে এগোতে থাকে ব্রিটিশ ট্যাংকবহর। প্রায় ১০ কিলোমিটারের মতো অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর অবশেষে নভেম্বরের ৩০ তারিখ সফল প্রতিআক্রমণ চালায় জার্মান সেনাবাহিনী। জেনারেল জর্জ ভন মারউইৎজের অধীনে জার্মান রিজার্ভ ফোর্স ‘ব্লিৎজক্রিগ’ (জার্মান সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ যুদ্ধকৌশল) কৌশল অবলম্বন করে হারানো প্রায় সব অঞ্চল পুনর্দখল করে নেয়। জার্মান প্রতিঘাত সহ্য করতে না পেরে ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখের মধ্যে ব্রিটিশ ফোর্স পিছু হটতে হটতে আবারও তাদের আগের অবস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেহায়েত কম ছিল না। দু’পক্ষেরই প্রায় ৪৫,০০০ করে সৈন্য খরচের খাতায় চলে যায়। ট্যাংক ও আর্টিলারি সমন্বিত এই যুদ্ধ ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের ভূমিকা কতটা প্রয়োজনীয় ও ভয়াবহ হতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
ব্যাটল অভ রাসেইনিয়া (২৩-২৭ জুন, ১৯৪১)
১৯৪১ সালের ২২ জুন, জার্মানি ও অক্ষশক্তি মিলিতভাবে ‘অপারেশন বারবারোসা’ নাম দিয়ে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সৈন্যবাহিনী নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। জার্মানির দ্রুত অগ্রগতির মুখে স্তালিন লাইন থেকে সরে গিয়ে রাশিয়া লেনিনগ্রাদে জার্মান বাহিনীকে থামানোর পরিকল্পনা করে।
জার্মান আক্রমণের মুখে পড়ে রাশিয়ান নর্থওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের দশা তখন করুণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসেইনিয়ার যুদ্ধে একটিমাত্র রাশিয়ান কেভি সিরিজের ট্যাংক পুরো একদিনের জন্য জার্মান ৬ প্যানজার ডিভিশনকে থামিয়ে রাখে। ২২ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত চলা রাসেইনিয়ার যুদ্ধটি মূলত সংঘটিত হয়েছে লিথুয়ানিয়ার কোনাস শহর ও রাসেইনিয়া গ্রামের নিকটবর্তী নেমান ও ডাবিসা নদীর একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিং দখল করা নিয়ে।
রাসেইনিয়ার ট্যাংকযুদ্ধে রাশিয়ার ৭৪৯টি ট্যাংকের বিরুদ্ধে জার্মানি ২৪৫টি ট্যাংক ব্যবহার করে। অপারেশন বারবারোসার শুরুতেই জার্মান বিমানবাহিনী লুফতভাফে (Luftwaffe) আক্রমণে রাশিয়ান বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। রাসেইনিয়ার যুদ্ধেও লুফতভাফে সহায়তা করে। আর মনে করা হয়, বিমানবাহিনীর সহায়তা না পেলে হয়তো জার্মানি এই যুদ্ধে রাশিয়ান মেকানাইজড কোরের ভারী ট্যাংক কেভি-১ ও কেভি-২ এর বিরুদ্ধে বেশি সুবিধা করতে পারত না।
জার্মান বাহিনীর কাছে রাশিয়ান কেভি ট্যাংকের শক্ত আর্মার ভেদ করার মতো কোনো কামান ছিল না। কেভি ট্যাংকের খুব কাছে এসে কোনো জার্মান ট্যাংক গোলা (আর্মার-পিয়ার্সিং শেল) নিক্ষেপ করলেও সেগুলো ট্যাংকের গায়ে বাড়ি খেয়ে লাফিয়ে অন্যদিকে চলে যেত। ৩৭ মিলিমিটার অ্যান্টি-ট্যাংক গান কেভি ট্যাংকের গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারেনি। এমনকি যখন কেভি ট্যাংকের গোলা শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন সেগুলোর চালকরা জার্মান অ্যান্টি-ট্যাংক গানের ওপর নিজেদের ট্যাংক উঠিয়ে দিত। শেষ পর্যন্ত মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ গজ দূর থেকে বিশেষভাবে নির্মিত গোলা নিক্ষেপ করে রাশিয়ান ট্যাংকগুলো অচল করে জার্মানি। অবশ্য লুফতভাফের বোমারু বিমানগুলো কেভি ট্যাংক সফলভাবে ধ্বংস করতে পেরেছিল। এছাড়া ৮৮ মিলিমিটার অ্যান্টি-ট্যাংক গান ব্যবহার করে এবং রাশিয়ান ট্যাংকের চলার পথে বোমা রেখে কিছু ট্যাংক ধ্বংস করেছিল জার্মান বাহিনী।
২৪ জুনের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়, জার্মান বাহিনী পশ্চিম কোনাসের বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সেদিন সকালে জার্মান ৬ প্যানজার ডিভিশনের একটি কনভয় ডাবিসা থেকে আহত জার্মান সেনা ও বন্দী রাশান সেনা নিয়ে রাসেইনিয়া ফেরার সময় একটি রাশিয়ান কেভি ট্যাংকের সম্মুখীন হয়। রাশিয়ান ট্যাংক গোলাবর্ষণ শুরু করলে কনভয় পিছু হটে।
পরবর্তী একদিন ওই রাশিয়ান ট্যাংকটি রাসেইনিয়া গ্রামের বাইরে থেকে গ্রামের ভেতর আটকে পড়া জার্মান কনভয়ের দিকে একটানা গোলাবর্ষণ করতে থাকে। জার্মান সেনাপতি রাউস ৫০ মিলিমিটার ট্যাংক-বিধ্বংসী কামান, ১০৫ মিলিমিটার হাউতজার, ৮৮ মিলিমিটার বিমান-বিধ্বংসী কামান ব্যবহার করেও রাশিয়ান কেভি ট্যাংকটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হন। রাতের বেলা সৈন্যরা বিস্ফোরক দিয়ে ট্যাংকটি উড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস করলেও ট্যাংক ক্রুদের মেশিনগানের গুলির মুখে তা আর সম্ভব হয়নি। অনেকটা ‘ফিউরি’ সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো, একটি ট্যাংক জার্মানদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে।
পরদিন সকালে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করে জার্মান সেনারা। এবার তারা কিছুটা সফল হয়, প্রায় আধ ডজেনের মতো বিমানবিধ্বংসী গোলা নিক্ষেপ করে কেভির দিকে। এরপর কেভি ট্যাংকটির নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। দুরুদুরু বুকে জার্মান সেনারা রাশিয়ান ট্যাংকটির কাছে গিয়ে দেখতে পায় ট্যাংকের গায়ে বেশ কয়েকটি বড়সড় ছিদ্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তখনই। আশপাশে জার্মান সৈন্যের অস্তিত্ব টের পেয়ে যেন রাশিয়ান দানব আবার জেগে ওঠে। ট্যাংকের টারেট (যে ঘূর্ণায়মান অংশে মূল কামান বসানো থাকে) আবার ঘুরতে শুরু করে। পড়িমরি করে পালানোর আগে এক জার্মান সেনা ট্যাংকের গায়ের ছিদ্র দিয়ে একটি গ্রেনেড ছুড়ে দেয় ভেতরে আর তাতেই অবশেষে চূড়ান্তভাবে পরাভূত হয় রাশিয়ান প্রতিরোধ। ট্যাংকের ভেতর ছয়জন ক্রুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় পরে। জার্মানরা রাশিয়ান ট্যাংক ক্রুদের বীরত্বে অভিভূত হয়ে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করে।
রাসেইনিয়ার যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে নর্থওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে সোভিয়েত ইউনিয়নের মোতায়েন করা মেকানাইজড ইউনিট সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এই যুদ্ধে জয় জার্মান বাহিনীর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে তুলে দেয়।
ব্যাটল অভ ব্রডি (২৩-৩০ জুন, ১৯৪১)
কার্স্কের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ‘ব্যাটল অভ ব্রডি’ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটে যাওয়া সর্ববৃহৎ ট্যাংক যুদ্ধ। অপারেশন বারবারোসার শুরুর দিকে এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে অক্ষশক্তির ৮০০ ট্যাংক সাড়ে তিন হাজার রাশিয়ান ট্যাংকের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে জার্মান বাহিনী জয়লাভ করে আর রাশিয়ান বাহিনী পিছু হটে। ১৯৪১ সালের ৩০ জুন এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
এই যুদ্ধে জার্মান ট্যাংক প্রথমবারের মতো রাশিয়ান টি-৩৪ ট্যাংকের মুখোমুখি হয়। জার্মান বিমানবাহিনী লুফতভাফে প্রায় দু’শোর অধিক ট্যাংক ধ্বংস করে। সব মিলিয়ে রাশিয়া প্রায় ৮০০ ট্যাংক হারায়, যেখানে জার্মানির মাত্র ২০০ ট্যাংক ধ্বংস হয়। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, ব্যাটল অভ ব্রডি হচ্ছে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ট্যাংক যুদ্ধ।
এল আলামিনের দ্বিতীয় যুদ্ধ (২৩ অক্টোবর-০৫ নভেম্বর ১৯৪২)
মিশরের এল আলামিন শহরের কাছে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম এই ট্যাংকযুদ্ধটি ‘এল আলামিনের দ্বিতীয় যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ কমনওয়েলথ ফোর্স বনাম অক্ষশক্তির এই যুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুজন কিংবদন্তিতুল্য সেনাপতি মুখোমুখি হন। এদের একজন হচ্ছে ব্রিটেনের বার্নার্ড মন্টগোমারি এবং অপরজন ডেজার্ট ফক্স খ্যাত জার্মান সেনাধ্যক্ষ আরউইন রোমেল।
উত্তর আফ্রিকায় যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে দেয় এল আলামিনের দ্বিতীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জার্মানি মিশরের ওপর অধিকার তো হারায়ই, পাশাপাশি সুয়েজ খালও হিটলারের হাতছাড়া হয়ে যায়।
অক্টোবরের ২৩ তারিখ রাতে, মন্টগোমারি জার্মান প্রতিরক্ষা লাইনের ওপর একটানা গোলাবর্ষণের হুকুম জারি করেন। পাশাপাশি চারটি পদাতিক ডিভিশন এগোতে শুরু করে জার্মান বাহিনীর দিকে। রাত ২ টার দিকে ব্রিটিশ ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যান অগ্রসরমান পদাতিক সেনাদের সাথে যোগ দেয়। মেজর জেনারেল রিটার ভন থমার সহযোগিতায় জার্মান বাহিনী ব্রিটিশবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে ট্যাংকযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন বাহিনী প্রায় ২২ হাজার সৈন্য, ১০২৯টি ট্যাংক ও ৭৫০টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে, যেখানে অক্ষশক্তির কাছে মাত্র ৫৪৭টি ট্যাংক মজুদ ছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রোমেল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাকে জার্মানি ফেরত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটার মতো রোমেলের স্থলাভিষিক্ত জেনারেল জর্জ ভন স্টামি যুদ্ধকালীন সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। এখানেই শেষ নয়, জার্মান বাহিনীর সরবরাহ ফুরিয়ে যায়, বিশেষত জ্বালানি সংকট মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। অক্টোবরের ২৬ তারিখ মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমান একটি জার্মান ট্যাংকার ডুবিয়ে দিলে জ্বালানি সংকট আরও বৃদ্ধি পায়।
হতাশ রোমেল সুস্থ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এসে দেখেন জার্মানির আর জয়ের কোনো আশাই নেই। যে পরিমাণ জ্বালানি বাকি আছে তা দিয়ে জার্মান বাহিনী মাত্র তিনদিন চলতে পারবে। মিত্রশক্তির আক্রমণের কাছে বারবার পরাভূত হয়ে এবং প্রতি আক্রমণ করেও কোনো সুবিধা করতে না পেরে রোমেল অবশেষে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন। পরাজিত সেনানী রোমেল হিটলারের সাথে যোগাযোগ করে মিশর থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের অনুমতি চান। কিন্তু হিটলার তৎক্ষণাৎ এই আবেদন প্রত্যাখান করেন। এদিকে জার্মান বাহিনীর সাড়ে পাঁচশ ট্যাংকের মধ্যে তখন মাত্র ৫০টা ট্যাংক আস্ত আছে। কিন্তু মন্টগোমারির নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণে সেগুলোও একসময় অকেজো হয়ে পড়ে। উপায়ন্তর না দেখে রোমেল তার বাকি সেনা নিয়ে পশ্চিমদিকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
নভেম্বরের ৪ তারিখ ব্রিটিশ বাহিনীর ১ম, ৭ম ও ১০ম আরমার্ড ডিভিশন চূড়ান্ত আক্রমণ চালিয়ে অক্ষশক্তির প্রতিরক্ষা লাইন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। জেনারেল রোমেল তার জার্মান সেনাবাহিনীর সিংহভাগই হারান এই যুদ্ধে। পরাজিত রোমেল লিবিয়া আশ্রয় নেন। যুদ্ধে অক্ষশক্তির পাঁচশ ট্যাংক ধ্বংস হয়।
ব্যাটল অভ কার্স্ক (জুলাই ০৫-অগাস্ট ২৩, ১৯৪৩)
স্তালিনগ্রাদে সোভিয়েত রেড আর্মির কাছে হেরে যাওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিটাডেল’ ঘোষণা করেন। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে সোভিয়েত শহর কার্স্কে জার্মান আর রাশিয়ান সেনারা মুখোমুখি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইস্টার্ন ফ্রন্টে আধিপত্য বিস্তারের জন্য হিটলারের হাতে তখন এটাই একমাত্র সুযোগ।
১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন জার্মান সিক্সথ আর্মি ডিভিশন স্তালিনগ্রাদে পৌঁছলো, তখন তারা সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত রাশিয়ান রেড আর্মিকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে নভেম্বরের মধ্যে জার্মান সেনা ক্ষয় হতে হতে ন্যূনতম পর্যায়ে চলে গেল। তার ওপর মেডিকেল সাপ্লাই এবং খাবারেরও অপ্রতুলতা দেখা দিল। কিন্তু হিটলার তারপরও স্তালিনগ্রাদ থেকে এই আধমরা বাহিনী সরালেন না, বরং নির্দেশ দিলেন, “শেষ সৈনিকটি, শেষ বুলেটটি থাকা পর্যন্ত তোমরা তোমাদের অবস্থান ধরে রাখো।”
রাশিয়ার তীব্র শীত সম্পর্কে জার্মান সেনাবাহিনীর কোনো ধারণাই ছিল না। জমে যাওয়া তাপমাত্রা, সাথে রোগবালাই; একেবারে যাকে বলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া। সবমিলিয়ে রাশিয়ায় জার্মান সেনাবাহিনী এক ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো। অবশেষে, আর কোনো উপায়ন্তর না দেখে, জার্মান জেনারেল ফ্রেডরিক পাওলাস হিটলারের আদেশ অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখ, জেনারেল পাওলাস তার অর্ধমৃত বাহিনী নিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। হিটলার এই ঘটনাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে অ্যাখ্যায়িত করলেন।
স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে হেরে গিয়ে জার্মান সেনাবাহিনী আক্রমণাত্মক থেকে রক্ষণাত্মক হয়ে উঠলো। হিটলারের অহমিকা ছিল জার্মান বাহিনী অজেয় বলে, কিন্তু তার সেই দর্প চূর্ণ হয়ে গেল, তিনি অপমানিত বোধ করলেন। প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিটলার এবার একটা শেষ দেখেই ছাড়বেন এই মনোভাব নিয়ে পুনরায় সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কোডনেম ‘অপারেশন সিটাডেল’ নামক এই আক্রমণে জার্মান সেনাবাহিনী সামরিক কৌশলগত সুবিধাসম্পন্ন সোভিয়েত শহর কার্স্ক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। কার্স্কের রেললাইন আর রাস্তা দখল করতে পারলে বাড়তি সুবিধাও পাবে জার্মান সেনাবাহিনী। অপারেশন বারবারোসা (জার্মান কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণ), স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ ইত্যাদির কারণে প্রচুর জার্মান সেনা কমে গেলেও কার্স্কে জার্মানি প্রায় ২০ লাখের মতো সৈন্য সমাবেশ করল। আর এই বিশাল সংখ্যক সৈন্য জোগাড় করতে হিটলার অল্পবয়সী কিশোর থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভেটেরান, সবাইকে ব্যবহার করলেন।
কার্স্কে যুদ্ধপ্রস্তুতি হিসেবে জার্মানি প্রায় ১০ হাজার কামান ও মর্টার, ২৭০০ ট্যাংক এবং আড়াই হাজার যুদ্ধবিমান জড়ো করলো। প্রতিপক্ষ রাশিয়াও সৈন্য সমাবেশের দিক থেকে কম গেল না। প্রায় তের লক্ষ সৈন্য, বিশ হাজারের বেশি কামান ও মর্টার, ৩৬০০ ট্যাংক, আড়াই হাজারের বেশি যুদ্ধবিমান এবং রিজার্ভ হিসেবে আরও পাঁচ লক্ষ পদাতিক এবং ১৫০০ বাড়তি ট্যাংক নিয়ে জার্মান আক্রমণ প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত হলো রাশিয়া। দু’পক্ষই ভয়ংকর রণ সাজে প্রস্তুত প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে যুদ্ধের গতিপথ বদলে দেওয়ার জন্য।
কার্স্কের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত প্রোখোরোভকাতে আর্টিলারি বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হলে প্রায় ৫০০ সোভিয়েত ট্যাংক ও কামান জার্মান সেকেন্ড এসএস-প্যানজার কোরের ওপর আক্রমণ চালালো ১২ জুলাই। প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও সোভিয়েত বাহিনী জয় লাভ করল।
কার্স্কের যুদ্ধে জার্মানি অত্যন্ত শক্তিশালী ট্যাংক ব্যবহার করেছিল। টাইগার, প্যান্থার ও ফার্দিনান্দ সিরিজের ব্যবহৃত ট্যাংকগুলো অনেক দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারত। সেদিক থেকে রাশিয়ান ট্যাংকগুলো অনেক পিছিয়ে ছিল। আর রাশিয়া জানত, তাদের হাতে ঐ মুহূর্তে জার্মান ট্যাংকের সমমানের ট্যাংক বানানোর জন্য সময় ও প্রযুক্তি কোনোটাই ছিল না। তাই রাশিয়া মানের চেয়ে সংখ্যার দিকে নজর দিল, যুদ্ধে তারা বেশি সংখ্যক ট্যাংক ব্যবহারের পরিকল্পনা করল। তবে রাশিয়ান ট্যাংক ওজনের দিক থেকে তুলনামূলক হালকা হওয়ায় এগুলোর গতিও বেশি ছিল।
কিন্তু এত শক্তিশালী ট্যাংক নিয়েও সোভিয়েত প্রতিরক্ষা লাইন ভেদ করতে পারেনি জার্মান বাহিনী। কারণ, কিছু ট্যাংকের কাজ শেষ হওয়ার আগেই, এমনকি কোনো ফিল্ড টেস্ট ছাড়াই, যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে যুদ্ধের মাঝখানেই অনেক ট্যাংক যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অকেজো হয়ে পড়ে। বাকি ট্যাংক দিয়ে বহুস্তরা রাশিয়ান প্রতিরক্ষা লাইন ভেদ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে মিত্রশক্তির সিসিলি আক্রমণের খবর শুনে হিটলার ‘অপারেশন সিটাডেল’ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে জার্মানির রাশিয়া দখল করার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। বরং ১৯৪৫ সালের মে মাসের মধ্যে রাশিয়া বার্লিন দখল করে নিল।
অপারেশন গুডউড (১৮-২০ জুলাই, ১৯৪৪)
‘ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লড়া এযাবতকালের সবচেয়ে বড় ট্যাংকযুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত ‘অপারেশন গুডউড’ সংঘটিত হয় ফ্রান্সের কন শহরে। ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড মন্টগোমারির অধীনে, মাত্র ৩৭৭টি জার্মান ট্যাংকের বিরুদ্ধে, প্রায় ১১০০ ব্রিটিশ ট্যাংক অবতীর্ণ হয় কন শহর দখলে নেওয়ার জন্য। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে কানাডীয় বাহিনীও যোগ দেয়।
ব্রিটিশ বোমারু বিমান বোমা বর্ষণ করে জার্মান প্রতিরক্ষা লাইনকে দুর্বল করে দেবে এবং পদাতিক সেনা ও আর্টিলারির জন্য রাস্তা তৈরি করে দেবে- এটাই ছিল ‘অপারেশন গুডউড’ এর প্রাথমিক পরিকল্পনা। সেই অনুযায়ী ১৮ জুলাই ভোর সাড়ে পাঁচটায় যুদ্ধবিমান থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করে ব্রিটিশ বাহিনী। টানা তিন ঘন্টার এই এয়ার-টু-গ্রাউন্ড আক্রমণে জার্মান বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আর এই সুযোগে ব্রিটিশ বাহিনী সামনের দিকে এগোতে থাকে।
ছত্রভঙ্গ, বিধ্বস্ত জার্মান বাহিনী পুনরায় একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ পদাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিমান বিধ্বংসী কামান ব্যবহার করে ব্রিটিশ ট্যাংকের গতিরোধ করা হয়, পদাতিক বাহিনী তাদের বাকি থাকা বাংকারগুলোতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ চলমান রাখে।
পরবর্তী তিনদিন ব্রিটিশ বাহিনী জার্মান বূহ্য ভেদ করার জন্য অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যায়। যুদ্ধশেষে দেখা যায় মিত্রশক্তি সাড়ে পাঁচ হাজার সেনা আর তিনশ’ এর মতো ট্যাংক হারিয়েছে সংখ্যায় যা ছিল পুরো ফ্রান্স জুড়ে থাকা ব্রিটিশ আর্মির যুদ্ধযানের তিন ভাগের এক ভাগ।
জার্মানির কাছে ট্যাংক সংখ্যা কম থাকলেও তারা তাদের দুর্ধর্ষ টাইগার ট্যাংকের বদৌলতে এতগুলো ব্রিটিশ ট্যাংক ধ্বংস করে। ব্রিটিশ এয়ারস্ট্রাইকের কবলে পড়ে জার্মানি ৭৫টি ট্যাংক হারায়। ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড মন্টগোমারি এই অপারেশনটি সম্পূর্ণরূপে সফল হিসেবে অভিহিত করলেও ব্রিটিশ বাহিনী কন শহরের মাত্র সাত মাইল ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
ব্যাটল অভ ভ্যালি অভ টিয়ার্স (অক্টোবর ০৬-০৯, ১৯৭৩)
১৯৬৭ সালে মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার ওপর আক্রমণ চালিয়ে ইজরায়েল গোলান মালভূমি, সিনাই উপদ্বীপ ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। সেই হারানো আরব-ভূমি পুনর্দখলের উদ্দেশে ১৯৭৩ সালে মিশর ও সিরিয়া ইজরায়েল আক্রমণের (চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ) সিদ্ধান্ত নেয়। ইজরায়েলকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ঘায়েল করার জন্য সিরিয়ান ও মিশরীয় বাহিনী ইয়ম কিপুরের দিনে ইজরায়েল আক্রমণের চিন্তা করে। ইয়ম কিপুর হচ্ছে ইহুদী ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র দিন। বছরের এই একটা দিনে টিভি, রেডিও কিছু চলে না। দোকানপাট, যানবাহন সব বন্ধ রেখে ধর্মীয়ভাবে দিনটি উদযাপন করে ইহুদিরা। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বৈদেশিক নীতি পরিবর্তন করে দেওয়া এই যুদ্ধ আরবদের কাছে অক্টোবর যুদ্ধ এবং ইজরায়েলিদের কাছে ইয়ম কিপুরের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
তিয়াত্তর সালের ইয়ম কিপুরের দিনটি ছিল শনিবার, অক্টোবরের ০৬ তারিখ। দুপুর দুটোর পর অত্যাধুনিক রাশিয়ান অস্ত্রে সজ্জিত মিশরীয় ও সিরীয় বাহিনী উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে ইজরায়েলের ওপর দ্বিমুখী আক্রমণ শুরু করে। সিরিয়ান ট্যাংক ইজরায়েলি ফ্রন্টলাইন ধ্বংস করে গোলান মালভূমি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। প্রায় ৭০০ সিরীয় ট্যাংক মুখোমুখি হয় ১৭৫টি ইজরায়েলি ট্যাংকের বিরুদ্ধে। সিরিয়ান পদাতিক বাহিনী অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইল ব্যবহার করে ইজরায়েলি ট্যাংকবহরকে নাস্তানাবুদ করে জর্ডান নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
যুদ্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে ইজরায়েলি রিজার্ভ ফোর্স আরব বাহিনীর অগ্রগতি থামাতে সমর্থ হয়। প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়া আরও তীব্র আক্রমণ চালায়। চতুর্থ দিনে সিরিয়ান বাহিনী প্রচন্ড আক্রমণ শুরু করে কুনেইত্রা অঞ্চলের একটি উপত্যকা থেকে। প্রায় কয়েকশ অত্যাধুনিক আরব ট্যাংক উপত্যকা ছেড়ে মালভূমিতে উঠতে শুরু করে। ইজরায়েলি কমান্ডার আবিগদর কাহালানিকে পাঠানো হয় আরব বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য। কাহালানির ট্যাংক পাহাড়ের চূড়ায় তিনটি সিরিয়ান ট্যাংকের মুখোমুখি হয় এবং তিনটিই ধ্বংস করে। দিনব্যাপী এই যুদ্ধের একপর্যায়ে সিরিয়ান বাহিনী দারুণভাবে পরাজিত হয় ইজরায়েলি সমরবিদ্যার কাছে। প্রায় পাঁচশোর মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান পেছনে ফেলে রেখে যায় তারা। যুদ্ধক্ষেত্রটি পরবর্তী সময়ে ‘ভ্যালি অভ টিয়ার্স’ নামে পরিচিতি পায়।
সামগ্রিকভাবে ইয়ম কিপুরের যুদ্ধে ১,৭০০ ইসরায়েলি ট্যাংক ও ৩,৪৩০টি যৌথবাহিনীর ট্যাংক অংশগ্রহণ করে। সেদিক থেকে দেখলে, ১৯ দিন ব্যাপী ঘটা এই যুদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ একটি ট্যাংক যুদ্ধ। চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে ইসরায়েল জয়লাভ করে এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় অক্টোবরের ২৫ তারিখ।
ব্যাটল অভ ৭৩ ইস্টিং (ফেব্রুয়ারি ২৬-২৭, ১৯৯১)
পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনী ইরাক ও কুয়েতের মাটিতে পা ফেলার আগে থেকেই সেখানে বিমানবাহিনী তান্ডব চালিয়েছিল। মার্কিন উচ্চপ্রযুক্তির যুদ্ধবিমানগুলো বেশ ভুগিয়েছিল ইরাকি বাহিনীকে। কিন্তু যেই না স্থলবাহিনী সেখানে আক্রমণ চালানো শুরু করলো, ইরাকের মরুভূমিতে দু’পক্ষের দানবতুল্য ট্যাংকগুলো দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো, ২০ শতকের সর্বশেষ বড় ট্যাংকযুদ্ধ, ব্যাটল অভ ৭৩ ইস্টিং শুরু হলো। মিলিটারি ম্যাপের একটি স্থানাঙ্ক রেখার নামানুসারে এই যুদ্ধটির নামকরণ করা হয়েছে।
১৯৯১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে পুরোদমে আক্রমণ শুরু করলো। লক্ষ্য ছিল কুয়েত দখল করে থাকা ইরাকি বাহিনীর পিছু হটা রোধ করা এবং ইরাক-কুয়েত সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করা ইরাকি রিপাবলিকান গার্ডের পাঁচটি ডিভিশনকে ধ্বংস করে দেওয়া।
কর্নেল ডন হোল্ডারের নেতৃত্বে মার্কিন বাহিনীর সেকেন্ড আরমার্ড ক্যাভালরি রেজিমেন্ট (টুএসিআর)-কে দায়িত্ব দেওয়া হয় ইরাকি বাহিনী, বিশেষত ইরাকি রিপাবলিকান গার্ডের তাওয়াকালনা ডিভিশনের অবস্থান খুঁজে বের করে তা গুঁড়িয়ে দিয়ে পরবর্তী বাহিনীগুলোর জন্য রাস্তা তৈরি করে দেওয়া যাতে করে চরম আক্রমণ করা যায়। তাওয়াকালনা ডিভিশনের দায়িত্ব ছিল কুয়েতে মার্কিন আক্রমণ প্রতিরোধ করা।
২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলবেলা সামরিক মানচিত্রের ৭৩ পূর্ব (সেভেনটিথ্রি ইস্টিং) রেখায় মার্কিন বাহিনী ও ইরাকি বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। সেকেন্ড এসিআর নয়টি এমওয়ানএওয়ান আব্রাম মেইন ব্যাটল ট্যাংক, ১২টি এমথ্রি ব্রেডলি ফাইটিং ভেহিকল এবং দুটি ১২০ মিলিমিটার মর্টার ব্যবহার করে। রিপাবলিকান গার্ড যেসব ট্যাংক ব্যবহার করেছিল তার মধ্যে ছিল রাশিয়ার তৈরি টি-৫৫ ও টি-৭২ সিরিজের ট্যাংক। ইরাকের মরুভূমিতে সংঘটিত এই যুদ্ধে ইরাকি বাহিনী চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়। কারণ মার্কিন বাহিনী প্রযুক্তিগত দিক থেকে রিপাবলিকান গার্ডের চেয়ে অনেক অংশে এগিয়ে ছিল। মার্কিনীরা থার্মাল ইকুইপমেন্ট, জিপিএসের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল। এছাড়া আব্রাম ট্যাংকের কিল রেঞ্জ ছিল প্রায় আড়াই হাজার মিটার, যা ইরাকি ট্যাংকের চেয়ে ৫০০ মিটার বেশি। যুদ্ধশেষে দেখা গেল, ১৬০টি ইরাকি ট্যাংক ও এপিসি ধ্বংস হয়েছে, যেখানে আমেরিকা মাত্র একটি ট্যাংক হারিয়েছে।