একসময় যুদ্ধ বলতে শুধুমাত্র স্থলযুদ্ধই বোঝাত। নৌবাহিনী আসার পর যুদ্ধের ব্যাপ্তি সাগরেও ছড়ায়। কিন্তু ১৯০৩ সালে বিমান আবিষ্কারের পরই ১৯১১ সালে যুদ্ধে বিমানের ব্যবহার শুরু হওয়ার মাধ্যমে আকাশেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পুরোদমে চলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল এভিয়েশন ইতিহাসের উন্নতির যুগ। ফলে আকাশে সংঘটিত হয় ভয়াবহ সব লড়াই, যেখানে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন অসংখ্য পাইলট। আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে সেসময়ের বিখ্যাত ক’জন পাইলটকেই।
প্রথমেই একটি শব্দের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক। যেসব পাইলট সারাজীবনে কমপক্ষে ৫টি শত্রুবিমান ভূপাতিত করেছেন, তাদের ACE নামে ডাকা হয়। মূলত নির্দিষ্ট শ্রেণীর যুদ্ধে সর্বোচ্চ দক্ষতার প্রদর্শনী দেখানো সৈনিকদের সম্মান করে এইস বলা হয়। এজন্য ট্যাংক কমান্ডারদের মধ্যেও এইস প্রথাটি বিদ্যমান।
ট্যাংক এইসদের নিয়ে জানতে পড়ুন এই লেখাটি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকজন দুর্ধর্ষ ট্যাংক কমান্ডার
প্রথমেই আপনাদের একটি পরিসংখ্যান দেখান যাক। এই ছবিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বোচ্চ কিল রেকর্ডধারী সেরা ৩০ জন পাইলটের নাম ও কিল রেকর্ড দেখতে পাবেন। অবাক হচ্ছেন? লিস্টের সবাই দেখি জার্মান পাইলট!
আসলে অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তির পলিসির ভিন্নতা ছিল। মিত্রবাহিনী তাদের অভিজ্ঞ ভেটেরান পাইলটদের পুরস্কার হিসেবে দেশে পাঠিয়ে ট্রেইনারের কাজ লাগিয়ে দিত। এতে তাদের কিল রেকর্ড আর না বাড়লেও তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নবীন পাইলটদের সাথে শেয়ার করার করার সুযোগ পেতেন। অন্যদিকে অক্ষশক্তির দেশগুলো তাদের অভিজ্ঞ পাইলটদের একটানা যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন রাখতো যতক্ষণ না তারা মারা যায় বা আহত হয়। এতে তাদের কিল রেকর্ডের সংখ্যা ঠিকই বাড়তে থাকে, কিন্তু একসময় তাদের আহত/নিহত হওয়ার ফলে দক্ষ ট্রেইনারের অভাব সৃষ্টি হয়। যার সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া যুদ্ধের শেষদিকে দেখা গেছে। ক্রমাগত অভিজ্ঞ পাইলটদের মৃত্যুর কারণে অক্ষশক্তির দক্ষ পাইলটের অভাব সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর মোটামুটি মানের দক্ষ পাইলটের বিশাল পাইপলাইন গড়ে ওঠে। ফলে বদলে যেতে থাকে আকাশ যুদ্ধের গতিপথ।
জার্মান কিলিং মেশিন
পরিসংখ্যানের প্রথমেই জার্মান পাইলট এরিখ হার্টম্যানের উনার নাম দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু পাশের কিল রেকর্ডের সংখ্যাটি দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, তাই না? জ্বি, এরিখ হার্টম্যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বোচ্চ সংখ্যক শত্রুবিমান ধ্বংস করেছেন। তিনি একাই মোট ৩৫২টি বিমান ভূপাতিত করেছেন, কিন্তু নিজে একবারও শত্রুর হাতে ভূপাতিত হননি! এজন্য তাকে সর্বকালের সেরা এয়ার কমব্যাট পাইলট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বিমানবাহিনী ‘লুফটওয়াফে’র হয়ে ইস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন। তিনি ছিলেন জার্মানির সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও অন্যতম সফল স্কোয়াড্রন জেজি-৫২ এর পাইলট। ১৯৪২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত আড়াই বছরে একটানা যুদ্ধ করেছেন এরিখ। তিনি মোট ১,৪০৪টি কমব্যাট ফ্লাইট পরিচালনা করেন যার ৮২৫টিতেই শত্রুবিমানের সাথে ডগফাইটে (বিমানযুদ্ধকে ডগফাইট বলে) লিপ্ত হন। তিনি তার বিখ্যাত বিএফ-১০৯ মডেলের বিমান দিয়ে সব মিলিয়ে ৩৪৫টি সোভিয়েত ও ৭টি মার্কিন বিমান মিলিয়ে মোট ৩৫২টি বিমান ভূপাতিত করেন! এমনকি ১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মানির আত্মসমর্পণের দিনও একটি শত্রুবিমান ভূপাতিত করে তারপর আত্মসমর্পণ করেন। সোভিয়েতরা তাকে ‘দ্য ব্ল্যাক ডেভিল’ নামে ডাকত। এজন্য এরিখ হার্টম্যানকে কেউ ভূপাতিত করতে পারলে তার জন্য ১০ হাজার রুবল পুরস্কার ঘোষণা দিয়েছিল সোভিয়েত বিমানবাহিনী।
এসব মিশনে ১৬ বার তাকে অবশ্য ক্রাশ ল্যান্ডিং করতে হয়েছে। তবে এর কোনোটাই শত্রুর গুলিতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণে নয়! কখনো ফুয়েল শেষ হয়ে যাওয়া বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অথবা কখনো ভূপাতিত হতে যাওয়া শত্রুবিমানের সাথে সংঘর্ষ হওয়ার কারণে এসব ক্রাশ ল্যান্ডিং সংগঠিত হয়েছিল। এর কারণ ছিল তার একটি বদস্বভাব। তিনি কখনোই দূর থেকে গুলি ছুড়ে শত্রুবিমান ভূপাতিত করতেন না। খুবই কাছে এসে গুলি ছুড়তেন। এজন্য তার গুলি মিস হতো কম, আবার তার গুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিমান বেঁচে গেছে এমন ঘটনাও একেবারে কম।
হার্টম্যানের আরেকটি দুর্লভ রেকর্ড হচ্ছে- তিনি যতবার আকাশ যুদ্ধে ফরমেশন লিডার (একঝাঁক বিমানের নেতৃত্ব দানকারী) হিসেবে যুদ্ধে জড়িয়েছেন, তখন নিজে তো বটেই, তার ফরমেশনের কোনো উইংম্যান (সহযোদ্ধা পাইলট) কখনোই ভূপাতিত হননি। এ কারণে সহযোদ্ধারা তাকে ভালোবেসে ‘বুবি’ (লিটল বয়) নামে ডাকত।
আকাশযুদ্ধের নেতৃত্বে তিনি ছিলেন বেশ পটু। তবে বেশ কয়েকবার আকাশযুদ্ধে নিয়ম ভঙ্গ করে বেপরোয়া আক্রমণের জন্য তাকে শাস্তি পেতে হয়েছে। জার্মান বিমানবাহিনীতে এরিখ হার্টম্যান ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। নবীন পাইলটরা তাকে আদর্শ মানতো। অল্প বয়সেই তিনি একাধিক সামরিক পদক পেয়েছিলেন। এর মধ্যে মাত্র বাইশ বছর বয়সে ৩০১ তম কিলরেকর্ডের জন্য হিটলারের কাছ থেকে Knight’s Cross of the Iron Cross with Oak Leaves, Swords and Diamonds পদক গ্রহণ করেন, যা ছিল তৎকালীন জার্মানির সর্বোচ্চ সামরিক পদক।
এরিখ হার্টম্যান মার্কিন বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেও তাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুরোধে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সোভিয়েতরা তার প্রতি ব্যাপক ক্ষিপ্ত ছিল। তবে তাকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট ইস্ট জার্মান ন্যাশনাল পিপলস আর্মিতে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু নিজেকে নাৎসি হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করায় কমিউনিস্ট হওয়ার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তাকে যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে ২৫ বছর কারাদণ্ড দিয়ে কুখ্যাত সোভিয়েত কারাগার গুলাগে পাঠানো হয়। ১০ বছর পর তিনি মুক্তি পান। ১৯৪৪ সালে তার কৈশোরের প্রেমিকা উরসূলা পেইচসচকে বিয়ে করেছিলেন। গুলাগে বন্দী অবস্থায় ১৯৪৫ সালে তার এক ছেলে হয়, যে আবার ১৯৪৮ সালে মারা যায়। অর্থাৎ এরিখ তার ছেলেকে কোনোদিনও দেখেননি।
পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে তার এক মেয়ে হয়। এর আগে ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পর মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম জার্মানিতে ফিরে তিনি আবার বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। এখানে এফ-৮৬ স্যাবর ও এফ-১০৪ স্টারফাইটারের স্কোয়াড্রন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এরপর তিনি সিভিল এয়ারক্রাফটের ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯৭ সালে রাশিয়ান সরকার জানায়, এরিখ হার্টম্যানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধের যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছিল তার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। অর্থাৎ তিনি নির্দোষ ছিলেন।
পাখি যখন আকাশে উড়তে ভয় পায়
তালিকার দ্বিতীয় ব্যক্তি জেরহান্ড বার্খরন। তিনি এরিখ হার্টম্যানের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ৩০০+ কিল রেকর্ডের অতি-অভিজাত ক্লাবে নাম লেখান। তবে হার্টম্যানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তার ছিল। ১৯৪৪ সালের ৩০ মে তার ২৭৩ তম এরিয়াল ভিক্টরির পরপরই তার বিমানটি শত্রুবিমানের মেশিনগানের বুলেটে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তিনি ক্রাশ ল্যান্ডিং করেন। এ সময় তিনি ডানহাত ও পায়ে গুলি খেয়ে আহত হন এবং চার মাস হাসপাতালে থাকেন। সেটি ছিল সেদিনের তার ষষ্ঠ ফ্লাইট। সম্ভবত ক্লান্তির কারণে আকাশযুদ্ধে মনোযোগ হারিয়েছিলেন। এ সময় তিনি ক্রাচে ভর দিয়েই সহকর্মী এরিখ হার্টম্যানের বিয়েতে যোগ দেন।
সেই বছরের অক্টোবর মাসে তিনি বাহিনীতে ফিরে আসলেও ব্যাপক মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন। অনেক সময় অস্থিরতা কমাতে তিনি ককপিটে বসে থাকতেন। নিজেদের পক্ষের বিমানের সাথে ফর্মেশনে ওড়ার সময়ও তার ভূপাতিত হওয়ার স্মৃতি তাড়া করে বেড়াত। দেখা গেছে, আকাশযুদ্ধের অনুশীলন করতে কোনো জার্মান বিমান তার পেছনে গানফায়ার পজিশনে আসলেই তিনি নার্ভাস ব্রেকডাউনের শিকার হয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলতেন। কয়েক সপ্তাহ এভাবে তিনি আকাশে উড়তে ভয় পেতেন। তার মতো ভেটেরান পাইলটের বেলায় বিষয়টি পাখি আকাশে উড়তে ভয় পাওয়ার মতোই। কয়েক দফা চিকিৎসা নেয়ার পর ভয়কে জয় করতে সমর্থ হন। সেই বছর ১৫ নভেম্বর তিনি ২৭৪ ও ২৭৫ তম কিল সম্পন্ন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। ৫ জানুয়ারি, ১৯৪৫ পর্যন্ত মোট ৩০১টি এরিয়াল ভিক্টরি অর্জন করেন। এরপরই তাকে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেয়া হয় রাজধানীর প্রতিরক্ষার জন্য। তা না হলে হয়তো হার্টম্যানের রেকর্ড ভেঙে দিতে পারতেন।
একজন সৃজনশীল পাইলট
জোসেফ জুয়ার্নম্যান ১৯৩৬ সালে লুফটওয়াফেতে যোগ দেন। তাকে বলা হতো জার্মান বাহিনীর সবচেয়ে সৃজনশীল পাইলট। অন্য ক্যাডেটরা যেখানে প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে যুদ্ধের কৌশল শিখত, সেখানে জুয়ার্নম্যান নিজেই যুদ্ধবিমানের ডগফাইটের বিভিন্ন নতুন কৌশল বের করতেন। তার উদ্ভাবিত কৌশল পরবর্তীতে একাডেমির সিলেবাসে স্থান পায়। এরিখ হার্টম্যান ছিল তারই ছাত্র। তিনি ব্রিটিশ স্পিটফায়ার যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা প্রথম জার্মান। এছাড়া মাত্র ১ মিনিটের মধ্যে ৬টি আমেরিকান B-24 লিবারেটর বোম্বার ও এর এসকর্ট পি-৫১ মাসটাং যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার বিরল রেকর্ড তার দখলে। তিনি ৬০০টি এয়ার কমব্যাট মিশনে মোট ১২৬টি শত্রুবিমান ধ্বংস করেন। ১৯৪৪ সালের ৮ এপ্রিল আবারও মার্কিন বোমারু বিমান ধ্বংস করতে গিয়ে তিনি পি-৫১ মাসটাং যুদ্ধবিমানের হাতেই নিহত হন।
দ্য আল্টিমেট ট্যাংক কিলার
এতক্ষণ ধরে যাদের কথা বলা হলো তাদের সবাই আকাশযুদ্ধে কৃতিত্ব দেখানো পাইলট। এখন বলা হবে গ্রাউন্ড অ্যাটাকের জার্মান কিংবদন্তি হ্যান্স উলরিচ রুডেলের কথা। তিনি পুরো ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় একাই ৫১৯টি ট্যাংকসহ ২ হাজারের বেশি গ্রাউন্ড টার্গেট ধ্বংস করেছেন! তিনি ২,৫৩০টি কমব্যাট মিশন পরিচালনা করেন এবং ৩০ বার প্রতিপক্ষের বিমান/এন্টি এয়ারক্রাফট গান দ্বারা শুটডাউন হন এবং প্রত্যেকবারই বেঁচে যান!
তিনি একটি ব্যাটলশিপ, একটি ক্রুজার, একটি ডেস্ট্রয়ার, ৭০টি ল্যান্ডিংক্রাফট (সেনা পরিবহন) শ্রেণীর জাহাজ ডুবিয়েছেন। এছাড়া ভূমিতে প্রায় ৮০০ মিলিটারি ভেহিকেল, ১৫০টি মেশিনগান বাংকার, ৫১৯টি ট্যাংক ধ্বংস করেছেন। আকাশযুদ্ধে তিনি ৯টি বিমান ধ্বংস করায় এইসদের সাথে তার নামও উচ্চারিত হবে। তবে এয়ারক্রাফট সংখ্যা কম দেখে আবার ভাৱবেন না যে তিনি ডগফাইটে দক্ষ নন। আসলে হ্যান্স রুডেল ছিলেন গ্রাউন্ড অ্যাটাক বিমানের পাইলট। একান্ত বাধ্য হয়ে শত্রুর ইন্টারসেপ্টর বিমান ভূপাতিত করেছেন। বেশিরভাগ সময় তিনি বিখ্যাত জার্মান ফাইটার বোম্বার Junkers Ju 87 চালাতেন যা Stuka ডাইভ বোম্বার নামে পরিচিত ছিল।
হিটলারের পরামর্শে এই বিমানে একটি অন্যরকম ফিচার যোগ করা ছিল যা সমসাময়িক অন্য কোনো বিমানে ছিল না। এটি যখন ঈগলের মতো ডাইভ দিয়ে বোম্বিং করতে আসত, তখন বিকট শব্দে সাইরেন বাজতো। এই সাইরেনের শব্দ শুনেই প্রতিপক্ষের সেনারা কুপোকাত। এমনও দেখা গিয়েছে যে ভয় পেয়ে এন্টি এয়ারক্রাফট গানের ক্রুরা পালিয়ে গেছে। হ্যান্স রুডেল প্রায় ৪০০ এর মতো মিশনে অংশ নেন। তবে পাইলট জীবনের প্রথমদিকে তিনি রিকনসিস (গোয়েন্দা) বিমানের কো-পাইলট ছিলেন, যা তার ভালো লাগত না। তিনি চাইতেন কমব্যাট মিশন, যেখানে থাকবে রোমাঞ্চ আর মৃত্যুর হাতছানি।
ছোটবেলা থেকেই রুডেল ছিলেন খুবই দুরন্ত। ৮ বছর বয়সে ছাতাকে প্যারাসুট বানিয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পা ভাঙেন। মিলিটারি একাডেমিতে তার সম্পর্কে তার ইন্সট্রাক্টর বলেন,
“He doesn’t smoke, drinks only milk, has no stories to tell about women and spends all his free time playing sports. Senior Officer Cadet Rudel is a strange bird”
১৯৪১ সালে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে অপারেশন বারবারোসা চলাকালে পাইলটের অভাব থাকায় তিনি তার অভিজ্ঞতার কারণে ফাইটার বোম্বার স্কোয়াড্রনে নিয়োগ পান। তিনি তার স্টুকা বিমান নিয়ে সোভিয়েত ব্যাটেলশিপ ‘মারাত’ এর উপর আক্রমণ করেন। তার ফর্মেশন লিডার ক্যাপ্টেন আর্নেস্ট সেইগফ্রিডের ফেলা প্রথম বোমাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ফরমেশন সিরিয়ালের দ্বিতীয় পজিশনে থাকা অনুযায়ী হ্যান্স রুডেল প্রথম যে এক হাজার পাউন্ডের আর্মার প্রিয়ারসিং বোমাটি ফেলেন সেটি ডেকের উপর বিস্ফোরিত হয় এবং ২য় বোমাটি ব্যাটলশিপের অ্যামুনিশন গোডাউনে বিস্ফোরিত হয়! ফলে জাহাজটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে ডুবে যায়।
পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন আর্নেস্ট ব্যাটলশিপ মারাতকে ডোবানোর একক কৃতিত্ব তাকেই দেন। তখনকার ব্যাটেলশিপ মানেই কয়েকশত সাইজের এন্টি এয়ারক্রাফট গানসমৃদ্ধ একটি জাহাজ। সেগুলোকে ফাঁকি দিয়ে বোমা ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথম কমব্যাট মিশনে এত বড় সাফল্য দেখে তার কমান্ডিং অফিসাররা পর্যন্ত অবাক হয়ে যান। তাকে স্থায়ীভাবে বোম্বার ডিভিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৩ সালে তিনি ট্যাংক ব্লাস্টার ব্রিগেডে জয়েন করার নির্দেশ পান। তার নিখুঁতভাবে বোমা ফেলার ক্ষমতা এবং ট্যাংকের অত্যন্ত কাছে গিয়ে গুলি করার সাহস আর তেমন কারো ছিল না। এই ডিভিশনে যেদিন যোগ দিয়েছিলেন সেদিন ৪টি ট্যাংক এবং ১৯৪৪ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যেই ১০০ ট্যাংক ধ্বংস করেন, যেটা ঐ ব্রিগেডের পাইলটদের আর কারো ছিল না।
ইতিহাস বিখ্যাত ট্যাংক যুদ্ধ ব্যাটল অফ কুরস্কে তিনি প্রথমবারের মতো ভূপাতিত হন। ক্রাশ ল্যান্ড করার পর হেঁটেই নিজের ঘাঁটিতে চলে আসেন। ১৯৪৪ সালের শুরুতে ৩০০ ট্যাংক কিলিংয়ের রেকর্ড তার পকেটে জমা হয়। ট্যাংক কিলার স্পেশালিস্ট এই পাইলট জীবনে বহু পুরস্কার পান, যার মধ্যে অনেকগুলো হিটলার নিজে দেন। যুদ্ধের শেষে আত্মসমর্পণ করেন এবং ১৯৮২ সালে ৬৬ বছর বয়সে মারা যান।
একজন পা-বিহীন পাইলট
মাত্র ২০টি কিল রেকর্ডের মালিক ডগলাস ব্যাডার কেন এই লিস্টে এসেছেন সেই প্রশ্ন নিশ্চয়ই পাঠকের মনে এসেছে। ব্রিটিশ এই পাইলট চারজন অন্য পাইলটের সাথে মিলে শেয়ার কিল ও ১১টি প্রবাবল কিল (বিমান ক্ষতিগ্রস্ত করা) এর মালিকও বটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ৮ বছর আগেই ডগলাস তার একটি পা হারান। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মেডিকেল ডিসচার্জ হওয়াই একমাত্র পরিণতি। কিন্তু ডগলাসের মতো অভিজ্ঞ পাইলটকে এভাবে হাতছাড়া করতে চায়নি রয়্যাল এয়ারফোর্স। যুদ্ধকালে পাইলটের অভাব থাকায় তিনি কমব্যাট মিশনে যাওয়ারও সুযোগ পান। জার্মানরা ১৯৪১ সালে তার বিমান ভূপাতিত করে গ্রেফতার করার পর শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়ে। এমনকি তার কৃত্রিম পা পাঠিয়ে দিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধও করে!
একজন জেনারেলের গল্প
অ্যাডলফ গ্যাল্যান্ডের কিল রেকর্ড ১০৪টি। তিনি টপ এইসদের লিস্টে ৯২ তম অবস্থানে আছে। আশা করি বুঝে গেছেন যে এরিখ হার্টম্যান থেকে গ্যাল্যান্ড পর্যন্ত কত পাইলট রয়েছে! প্রত্যেকের গল্প তো একদিনে বলা সম্ভব নয়। তাকে বেছে নেয়ার কারণ তিনিই যুদ্ধকালীন একমাত্র এইস যিনি জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি এবং বরখাস্ত দুটোই পেয়েছেন!
তিনি মোট ৭০৫টি মিশন পরিচালনা করেন। কমান্ডিং অফিসারের মৃত্যুর পর তিনি হঠাৎ করেই পদোন্নতি পেয়ে লুফটওয়াফের জেনারেল হন। নৌবাহিনীর বেশ কিছু অপারেশনে এয়ার কাভার দিয়ে এডমিরালদের প্রশংসা কুড়ান। এরই মধ্যে ব্রিটিশদের বিমান হামলা ঠেকাতে না পেরে হিটলারের অন্যতম সহযোগী হারমান গোয়েরিংয়ের সঙ্গে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। পরে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে জার্মান পাইলটদের বিদ্রোহের অংশ নেয়ার অভিযোগে গৃহবন্দী করা হয়। তিনি প্যারাসুটে থাকা ভূপাতিত বিমানের পাইলটদের উপর গুলি না চালানোর কারণে বিখ্যাত ছিলেন। তার সাথে ডগলাস ব্যাডারসহ ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের অনেক পাইলটের বন্ধুত্ব ছিল।
জাপানের টপ এইস
ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভির পাইলট তেতসুযো ইয়ামোতো ১৯৩৮ সালের সিনো-জাপানিজ ওয়ারে ১৪টি কিল করে জাপানের টপ এইস হন। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর স্কোয়াড্রন কমান্ডার ছিলেন। ব্যাটল অফ কোরাল সিসহ একাধিক যুদ্ধে তিনি সব মিলিয়ে ৮০টি এরিয়াল ভিক্টরি অর্জন করেন। তবে গবেষকগণ ১৯৭১ সালে জানিয়েছেন যে এই সংখ্যাটি ৮৭ হবে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর প্রাপ্ত ডায়েরি থেকে ২০২টি কিলের কথা জানা যায়। এতকিছুর পরও জাপানের টপ এইসকে সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ হিরিয়োশি নিশিযাজাওয়কে এই খেতাব দিয়ে থাকেন যার কিল রেকর্ড ১০৩ অথবা ১৪৭টি। অর্থাৎ তিনিও বিতর্কিত। তেতসুযো ইয়ামোতো জাপানের কামিকাজি (আত্মঘাতি) পাইলটদের ট্রেইনার ছিলেন।
জার্মানির বাইরে সর্বোচ্চ কিল রেকর্ডধারী পাইলট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফিনল্যান্ড জার্মানির সাথে অক্ষশক্তিতে যোগ দিয়েছিল। ফিনিশ এয়ারফোর্সের পাইলট লুমারী যুটিলাইনেন ৪৩৭টি মিশনে ৯৪টি শত্রু বিমান ভূপাতিত করে জার্মানির বাইরে সর্বোচ্চ কিল রেকর্ডধারী পাইলট হিসেবে নাম লেখান। তিনি নিজে কখনো ভূপাতিত হওয়া তো দূরের কথা, গোটা যুদ্ধে তার বিমানে একটি গুলিও কেউ লাগাতে পারেনি।
স্টার অফ দ্য আফ্রিকা
এতক্ষণ যেসব জার্মান পাইলটের কথা বলা হলো তারা সবাই ইস্টার্ন ফন্ট তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে যুদ্ধ করে এত সংখ্যক কিল রেকর্ড গড়েছেন। হ্যান্স জোয়াকিম মার্সেইলে হচ্ছেন ইস্টার্ন ফন্টের বাইরে টপ জার্মান এইস। তাকে ‘স্টার অফ দ্য আফ্রিকা‘ নামে ডাকা হয়। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন যে তিনি উত্তর আফ্রিকায় যুদ্ধ করেছেন। তার আরেকটি দুর্ধর্ষ রেকর্ড হলো তিনি একদিনে ‘ট্রিপল এইস’ হয়েছেন। ১৯৪২ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি এক মিশনে একাই মিত্রবাহিনীর ১৭টি বিমান ধ্বংস করেন! তবে ট্রিপল এইসের সর্বোচ্চ রেকর্ডটি কিন্তু তার নয়।
একদিনে সর্বোচ্চ কিল ও ট্রিপল এইস
শুরুতেই বলা হয়েছে যে কমপক্ষে পাঁচটি বিমান ধ্বংস করলে তাকে এইস বলা হয়। কিন্তু যিনি একদিনে এর তিনগুণ বিমান ধ্বংস করেন, তাকে কী বলা হবে? জ্বি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একদিনে ১৫ বা তার বেশি সংখ্যক বিমান ধ্বংসকারী পাইলটদের ট্রিপল এইস বলা হয়। এ ধরনের মোট পাঁচজন পাইলট আছেন যারা সবাই জার্মান লুফটওয়াফের হয়ে এই কীর্তি গড়েছেন। আর এদের মধ্যে সর্বোচ্চ কিল রেকর্ড এমিল ল্যাংয়ের। ৩ নভেম্বর, ১৯৪৩ সালে তিনি ১৮টি বিমান ধ্বংস করেন। একদিনে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক বিমান আর কেউ ধ্বংস করেনি। ট্রিপল এইস লিস্টে আরো আছেন জোয়াকিম মার্সেইলে (উপরে বর্ণিত), অগাস্ট ল্যাম্বার্ট (১৭টি), হুবার্ট স্ট্রাসল (১৫টি) ও উইলহেম বাটজ (১৫টি)।
ডাবল এইস ইন অ্যা ডে
একদিনে দশ বা তার বেশি বিমান ধ্বংস করেছেন এমন পাইলটদের ‘ডাবল এইস’ বলা হয়। এ ধরনের মোট ১২ জন পাইলট আছেন। এদের মধ্যে আবার তিনজন এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার ডাবল এইস খেতাব অর্জন করেন। ডাবল এইসদের বেশিরভাগ জার্মান পাইলটের নাম উপরে দেয়া সেরা ত্রিশজনের লিস্টে রয়েছে।
১) হিরোমিচি শিনোহারা – ১১ টি বিমান ভূপাতিত করে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিমান ভূপাতিত করা ‘নন-জার্মান’ পাইলটদের শীর্ষে আছেন এই জাপানি পাইলট।
২) এডলফ ডিকফেল্ড (১১টি)।
৩) হেরমান গ্রাফ (১০টি) – তিনিই সর্বপ্রথম ২০০ এরিয়াল ভিক্টরির মাইলফলক অতিক্রম করেন।
৪) ম্যাক্স স্টটজ (১০টি)।
৫) ওয়াল্টার নৌটনি (১০+১০টি) – আড়াইশো এরিয়াল ভিক্টরির মাইলফলক সবার আগে অতিক্রম করা এই জার্মান পাইলট দুবার করে দশটি করে সোভিয়েত বিমান ভূপাতিত করেন।
৬) এরিখ রুডর্ফার (১১টি) – একক উড্ডয়নে সর্বোচ্চ সংখ্যক (১১টি) বিমান ধ্বংসের রেকর্ডটি তার দখলে।
৭) জোহানেস ওইজ (১২টি)
৮) ওয়াল্টার ওলফার্ম (১১+১০টি)।
৯) ওয়াল্টার শচুক (১১টি)।
১০) এরিখ হার্টম্যান (১১টি) – তার কথা প্রথমেই আলোচনা করা হয়েছে। ৩০০ এরিয়াল ভিক্টরির ক্লাবে পা দেয়া প্রথম সদস্য তিনিই।
১১) ফ্রাঞ্জ স্ছাল (১১+১৩টি), যা ডাবল এইসদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর।
১২) হেইঞ্জ উলফগ্যাং (৯টি) – তার ব্যাপারটি খুবই অদ্ভুত। তিনি দাবি করেছেন যে নয়টি বিমান ধ্বংস করেছেন। কিন্তু মিত্রবাহিনীর ওয়্যার লগ ঘাঁটলে জানা যায় সেদিন দশটি ব্রিটিশ বোম্বার ধ্বংস হয়েছে। এজন্য তাকে ডাবল এইস খেতাব দেয়া হয়। তার চেয়ে বড় কথা হলো, তিনি ‘নাইট ফাইটার এইস’দের মধ্যে সর্বোচ্চ কিল রেকর্ডধারী পাইলট। উল্লেখ্য, সব বাহিনীতেই রাতে যুদ্ধ করতে পারদর্শী পাইলটদের আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হতো।
এইস ইন অ্যা ডে
একদিনেই কমপক্ষে ৫টি বিমান ধ্বংস করেছেন এমন পাইলট আছে মোট ১৬৭ জন! তাদের সবাইকে নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। তবে ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান দেয়া যায়। এই কৃতিত্ব ২ বার (১৬ জন), ৩ বার (১২ জন), ৪ বার (৭ জন), ৫ বার (৪ জন), ৬ বার (৪ জন), ৭ বার (০ জন), ৮ বার (১ জন), ৯ বার (১ জন), এবং ১০ বার (১ জন) পাইলট দেখিয়েছেন। বাকিরা সবাই একবার করে ৫ বা তার বেশি বিমান একদিনে ভূপাতিত করেছেন। আট, নয় ও দশবারের ‘এইস ইন অ্যা ডে’ পাইলটদের নাম ও মোট এরিয়াল ভিক্টরি যথাক্রমে অটো কিটেল (২৬৭টি), হ্যান্স ডোর (১২৮টি) ও হ্যান্স ফিলিপ (২০৬টি)।
মিত্রবাহিনীর সর্বোচ্চ কিল রেকর্ড কার?
সোভিয়েত ইউনিয়নের পাইলট ইভান কজহেডাব মিত্রবাহিনীর সর্বোচ্চ কিল রেকর্ডধারী পাইলট। তিনি ৬০টি সলো কিল (একক) সহ মোট ৬৬টি এরিয়াল ভিক্টরি অর্জন করেছেন। তিনি একবার-দুবার নয়, তিন-তিনবার ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত হন।
ব্রিটেনের টপ এইস
দক্ষিণ আফ্রিকান বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে ব্যর্থ হওয়া প্যাট প্যাটেল পরবর্তীতে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের হয়ে ৪১টি বিমান ধ্বংস করেছেন। তবে ব্রিটিশ পাইলটদের মধ্যে এই রেকর্ড জেমস এডগার জনসনের (৩৮টি)।
যুক্তরাষ্ট্রের সেরা পাইলট
মেজর রিচার্ড বংয়ের ক্যারিয়ারের শুরুর ইতিহাস বেশ মজার। সদ্য বিয়ে করা এক সহকর্মী পাইলটের বাড়ির উপর দিয়ে খুব নিচু হয়ে ফ্লাইপাস দেয়ার অভিযোগে সতর্ক করা হয়। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গোল্ডেন গেট ব্রিজের নিচ দিয়ে সহকর্মীদের সাথে পি-৩৮ বিমান নিয়ে বিপদজনক ফ্লাইপাস দিয়ে গ্রাউন্ডেড (উড্ডয়ন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত) হন। পরে আবার স্যান ফ্রান্সিসকোর স্ট্রিট মার্কেটের উপর দিয়ে লো ফ্লাইপাস দিয়ে ক্রেতা মহিলাদের কাপড়চোপড় উড়িয়ে দিয়ে আবার গ্রাউন্ডেড হন। তার কমান্ডিং অফিসার জেনারেল জর্জ কেনি বলেন,
“If you didn’t want to fly down Market Street, I wouldn’t have you in my Air Force, but you are not to do it any more and I mean what I say.”
শেষ পর্যন্ত জেনারেল তার রিচার্ডের মতো পাগলাটে পাইলটকে বাহিনীতে রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাকে অস্ট্রেলিয়া ও প্যাসিফিক আইল্যান্ডে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়। তিনি মোট ৪০টি শত্রুবিমান ধ্বংস করে যুক্তরাষ্ট্রের টপ এইস হন। পরে জেনারেল কেনির সুপারিশে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘মেডেল অব অনার’ লাভ করেন। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট মাত্র ২৪ বছর বয়সে মেজর রিচার্ড একটি নতুন বিমানের টেস্ট ফ্লাইট করতে গিয়ে নিহত হন। তার মৃত্যুর খবর যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকায় জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলার খবরের ঠিক নিচেই বড় হেডলাইনে জায়গা করে নিয়েছিল।
খুচরো কিল রেকর্ড
টপ এইসদের লিস্টের নিচের দিকে গেলে এমন কিছু এইসের নাম পাওয়া যায় যাদের কিল সংখ্যায় ভগ্নাংশ রয়েছে। যেমন- জার্মান জেট ফাইটার Me-262 প্রথমবারের মতো নিজের প্রপেলার ফাইটার দিয়ে ভূপাতিত করে বিখ্যাত হওয়া মার্কিন পাইলট চাক ইয়াগারের কিল রেকর্ড মোট ১১.৫টি। তিনি আকাশে সংঘর্ষ হওয়া দুটো শত্রুবিমানকে একসাথে গুলি করে ধ্বংস করায় ভগ্নাংশ পেয়েছেন। অন্যদিকে মার্কিন ফাইটার এইস এসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হভডে এর কিল রেকর্ড ১০.৫টি। এর মানে এই নয় যে তিনিও সাড়ে দশটি বিমান ভূপাতিত করেছেন।
আসলে এতক্ষণ যে বিমান ধ্বংসের যত রেকর্ডের কাহিনী জানানো হলো তা শর্ত ও নিয়মাবলী একেক দেশে একেক রকম ছিল। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই ভূমিতে থাকা এয়ারক্রাফট ধ্বংসের ক্রেডিট পাইলটদের ভাগ করে দিত। যেমন- সুইডেনে ক্রাশ ল্যান্ডিং করে বিমান চালানোর যোগ্যতা হারানো (কারণ দেশটি নিরপেক্ষ) মার্কিন পাইলট নিকোলাস মেগুরার কিল রেকর্ড ১১.৮৪টি। তার গ্রাউন্ড কিল ছিল ৩.৪টি।
আবার আকাশযুদ্ধের একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশলের কথাই বলা যাক। ধরুন, একজন জার্মান পাইলট শত্রুবিমানকে নিজের পিছু নিতে প্রলুব্ধ করেছে। এই সুযোগে আরেকজন শত্রুর পেছনে এসে গুলি করে তাকে ভূপাতিত করল। জার্মানির ক্ষেত্রে যে পাইলট ভূপাতিত করেছে এককভাবে তাকেই কৃতিত্ব দেয়া হতো। যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রলুব্ধ করেছেন তাকে নয়। আবার ফরাসিরা একজনের ক্রেডিট ঐ ফর্মেশনে থাকা সব পাইলটকে ফুল ক্রেডিট হিসেবে দিত। কিন্তু ব্রিটিশ, ফিনিশ, মার্কিনরা এয়ার কিলকে ভগ্নাংশ আকারে ভাগ করে দিত। অর্থাৎ উইলিয়াম হভডের কিল রেকর্ডের কোনো একটি বিমান তিনি ও তার সঙ্গী মিলে ভূপাতিত করেছেন বিধায় দশমিক পাঁচ পেয়েছেন। সোভিয়েত-জাপানিরা শুধুমাত্র একক কিল হিসাব করত, কিন্তু ফরাসিদের মতো গ্রুপ কিলের ক্রেডিট সবাইকে না দিয়ে সেটি আলাদা পরিসংখ্যানে হিসাব করত। আবার ইতালি অনেকটা ফ্রান্সের মতোই। তবে তারা একজনের ক্রেডিট ঐ ফর্মেশনের ৫/৬টি বিমানকে না দিয়ে পুরো ইউনিটে যত পাইলট আছে সবাইকে এক ক্রেডিট করে দিত! এজন্য লিস্টে এমন কয়েকজন ইতালিয়ান আছেন যারা আসলে একক যোগ্যতায় এইস লিস্টে নাম লেখাননি।
তবে প্রত্যেক এয়ারফোর্সের মধ্যে কমন বিষয় হলো Probable kills গুলোকে হিসাবে আনত না। অর্থাৎ ধরুন, একটি শত্রুবিমান খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছে। সেটি ঘাঁটিতে ফিরে যেতে পারুক বা না পারুক, তাকে পাইলটের লগবুকে এরিয়াল ভিক্টরি হিসেবে যোগ করা হবে না। পাইলটের নিজের বক্তব্য ছাড়াও সহকর্মী পাইলটদের (উইংম্যান) সত্যায়ন ও সম্ভব হলে মেশিনগান ক্যামেরার ভিডিও পর্যালোচনা করে পাইলটদের ক্রেডিট দেয়া হয়। তাই অতিমানবীয় এরিয়াল ভিক্টরি সংখ্যা দেখে এর সত্যতা সন্দেহ করার তেমন বেশি অবকাশ নেই। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান পাইলটরা যে অন্য সবার চেয়ে তুলনামূলক বেশি দক্ষ ছিল তা প্রত্যেকেই স্বীকার করে। এছাড়া অক্ষশক্তির পাইলটদের একটানা যুদ্ধ করার নীতির কথা লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে। এজন্য এইস লিস্টে জার্মানির জয়জয়কার।
শেষ করার আগে দুটো অদ্ভুত ও মজার কাহিনী শোনানো যাক। লুইস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একমাত্র পাইলট যিনি ভুলক্রমে নিজের দেশের সর্বোচ্চ (চারটি) বিমান ভূপাতিত করেন। অন্যদিকে মার্কিন পাইলট ওয়েইন জে. ব্যাগেট পিস্তল দিয়ে বিমান ভূপাতিত করার দাবি করেন। জাপানিদের বদস্বভাব ছিল যে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান থেকে জান বাঁচাতে প্যারাসুট নিয়ে লাফ দেয়া পাইলট-ক্রুদের উপর গুলি চালাত, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল। তিনি একবার এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্যারাসুট নিয়ে জাম্প করার পর মরার ন্যায় বাতাসে ভাসতে থাকেন। জনৈক জাপানি পাইলট তার পাশ দিয়ে উড়ে যাবার সময় আদৌ মরেছে কিনা সেটি ভালোভাবে দেখার জন্য বিমানের ককপিট ক্যানোপি খুলে তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিষয়টি টের পেয়ে হঠাৎ নিজের কোল্ট ১৯১১ পিস্তল (পাইলটরা সঙ্গে পিস্তল রাখেন সবসময়) বের করে গুলি শুরু করেন। এতে পাইলট আহত হন এবং বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে যেতে দেখেন।
পিস্তল দিয়ে বিমানের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ার আরো কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে তাদের কেউই ব্যাগেটের মতো বিমান ফেলে দেয়ার দাবি করেননি। তবে তার দাবির স্বপক্ষে সত্যতা পাওয়া যায়নি। কেননা জাপানি ওয়্যার লগ অনুযায়ী সেদিন ঐ অঞ্চলে কোনো জাপানি বিমান ভূপাতিত হয়নি! হয়তো ব্যাগেট মিথ্যা বলছেন, কিংবা সত্য বললেও পাইলট শেষপর্যন্ত বিমানটি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তাই ঘটনার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডগফাইটগুলো যে খুবই বিচিত্র এবং ভয়াবহ ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই টপ এইসদের রেকর্ড শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্ষুণ্ন থাকবে। কেননা আজকের উন্নত মিসাইলের যুগে একজন পাইলট কতক্ষণ আকাশযুদ্ধে টিকে থাকবেন সেটি বলাই মুশকিল।