বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যেসকল ওলী-আউলিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে স্মরণীয় একটি নাম হযরত খান জাহান আলী (র)। একাধারে তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা, সাধক, ধর্ম প্রচারক ও সুশাসক। জীবনের একটা বিশাল সময় তিনি ব্যয় করেন ইসলামের সেবায়। দক্ষিণবঙ্গে খান জাহান আলী একটি অতি পরিচিত নাম। অর্ধসহস্র বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সেই নাম এতটুকু ম্লান হয়নি। বাগেরহাটের বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ (ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান) এর প্রতিষ্ঠাতা এই খান জাহান আলী (র)।
হযরত খান জাহান আলী (র), পুরো নাম উলুঘ খানুল আজম খান জাহান। তাঁর প্রকৃত নাম খান জাহান। ‘উলুঘ’ ও ‘খান উল আজম’ বা ‘খান ই আজম’ তাঁর সম্মানসূচক উপাধি। ‘উলুঘ’ তুর্কি শব্দ, এর অর্থ নেতা বা সরদার। দলপতি ও আঞ্চলিক শাসনকর্তাদের জন্য এই উপাধি ব্যবহৃত হয়। ‘খান উল আজম’ তুর্কি ও ফার্সি ভাষায় ‘উলুঘ’ এর সমার্থবোধক। সাধারণ মানুষের মধ্যে খান জাহান আলী, খাঞ্জালী পীর, পীর খাঞ্জা, খান জাহান খান ইত্যাদি নামে তিনি পরিচিত ছিলেন।
খান জাহান আলীর প্রকৃত জন্ম তারিখ জানা যায় না। তিনি প্রায় ৪০ বছর দক্ষিণবঙ্গে ইসলাম প্রচার ও শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার মাজারে লিখিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, তিনি তুরস্কের খাওয়ারিজমে জন্মগ্রহণ করেন, যার বর্তমান নাম খিবা।
ঐতিহাসিকদের মতে, তার বাল্যনাম ছিল কেশর খান। বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের অনেক পরে চৌদ্দ শতকের শেষের দিকে খান জাহান বাল্যাবস্থায় পিতা-মাতার সাথে গৌড়ে আগমন করেন। খান জাহান আলীর পিতা আজর খান কোনো প্রখ্যাত ব্যক্তি না হলেও বিদ্বান ছিলেন। গৌড়ের নিকটবর্তী নবীপুর নামক জায়গায় তার বাড়ি ছিল। তিনি তার পুত্র খান জাহানকে সুশিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে বিখ্যাত ওলী হযরত নূর কুতুবুল আলমের মাদ্রাসায় পাঠান। এখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় আজর খান মৃত্যুবরণ করেন।
মা আঙিনা বিবি বহু কষ্টে তার লালন পালন করতে থাকেন। এরই মধ্যে একদিন বাদশাহ হোসেন শাহের সুদৃষ্টিতে পড়েন। বাদশাহ তার প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজ দরবারে জায়গা দেন। এখানেই প্রতিপালিত হতে থাকেন খান জাহান আলী। বাদশাহর মৃত্যুর পর দরবারের লোকেরা খান জাহান আলীর সাথে বিদ্রূপাত্মক আচরণ শুরু করে। এমনকি তার মায়ের জন্য নির্ধারিত শাহী বেতন-ভাতাও বন্ধ করে দেয়া হয়। নিরুপায় খান জাহান তার ওস্তাদ নূর কুতুবুল আলমের কাছে পরামর্শ চান। ওস্তাদ তার কষ্ট অনুধাবন করে জৌনপুরের প্রতাপশালী সুলতান ইব্রাহীম শর্কির কাছে তাকে চিঠিসহ প্রেরণ করেন। চিঠিতে তিনি খান জাহানের সচ্চরিত্র ও প্রতিভার কথা উল্লেখ করেন।
সুলতান ইব্রাহীম শর্কি নূর কুতুবুল আলমকে শ্রদ্ধা অনেক করতেন ও তার প্রতিটি কথার গুরুত্ব দিতেন। তাই চিঠি পাওয়া মাত্রই তিনি খান জাহানকে একজন সাধারণ সৈনিকের চাকরি প্রদান করেন। এখান থেকে খান জাহান আলীর সৈনিক জীবনের শুরু। নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে তিনি কিছুদিনের মধ্যেই একজন সাধারণ সৈনিক থেকে প্রধান সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত হন।
এ সময় গৌড়ের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা বড় করুণ ছিল। গৌড়ের শাসনকর্তার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন রাজা গণেশ। মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর রাজা গণেশ সর্বদা খড়গহস্ত ছিলেন। গণেশের অত্যাচার যখন মাত্রা ছাড়ায় তখন নূর কুতুবুল আলম ইব্রাহীম শর্কির নিকট পত্র লিখে ইসলাম ও মুসলিমদের রক্ষার্থে রাজা গণেশকে দমন করার আহবান জানান। সুলতান তার বিশ্বস্ত সেনাপতি খান জাহান আলীর নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক সৈন্য রাজা গণেশের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে গণেশ পরাজিত হয়ে প্রাণভিক্ষা চান এবং কুতুবুল আলমের পরামর্শে সুলতান তাকে জীবিত ছেড়ে দেন। যুদ্ধ শেষে খান জাহান আলী সুলতানের কাছে অনুমতি নিয়ে তার ওস্তাদ কুতুবুল আলমের কাছে কিছুদিন থাকার জন্য যান। কিন্তু সেই ছুটি শেষ করে তিনি আর ফেরেননি। পরবর্তীতে সুলতানের বারবার আহবান সত্ত্বেও খান জাহান জৌনপুরে ফিরে না গিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দেন। শেষ হয় তার সৈনিক জীবন।
হযরত নূর কুতুবুল আলম তার প্রিয় শিষ্যকে ফিরে পেয়ে অনেক খুশি হন। তিনি তাকে কামিলিয়াৎ ও বেলায়তি সম্পর্কে শিক্ষা দেন। খান জাহানের সততা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তার সাথে নিজ কন্যার বিয়েও দেন। কিছুদিন স্বাচ্ছন্দ্যে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন খান জাহান আলী। কিন্তু চারিদিকে ইসলাম ও মুসলিমদের দুরবস্থা দেখে বেশিদিন স্থির থাকতে পারেননি তিনি। স্ত্রীকে শ্বশুরের খিদমতে রেখে সমাজ সেবা, ইসলাম রক্ষা ও ইসলাম প্রচারের কাজে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
খান জাহান আলী ঠিক কত সালে দক্ষিণবঙ্গে আসেন, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এটা জানা যায় যে তিনি যখন বঙ্গে আসেন, তখন গৌড়ের সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ। এ সময় দক্ষিণবঙ্গে আগমনের একমাত্র পথ ছিল ভৈরব নদী। খান জাহান আলী গৌড় হতে পদ্মা নদী ধরে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের নিকটবর্তী ভৈরব নদীতে আসেন। সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ হয়ে যশোরের বারোবাজারে উপনীত হন তিনি। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচারের কাজ করেন খান জাহান। ১১ জন আউলিয়া নিয়ে তিনি যশোরের বারোবাজারে কিছুকাল অবস্থান করেন। এখান থেকেই তার দক্ষিণবঙ্গ জয়ের সূচনা।
বারোবাজারে কিছুকাল অবস্থান করার পর খান জাহান আলী চলে যান মুরলী, যেখানে বর্তমান আধুনিক যশোর শহর। এখান থেকে তার সহচরদের একদলকে তিনি সুন্দরবন অঞ্চলে পাঠান। আরেক দল, যার নেতৃত্বে তিনি নিজে ছিলেন, সেটি নিয়ে ভৈরব তীরের পায়গ্রাম কসবায় গিয়ে পৌঁছান তিনি। এখানে অল্প কিছুদিন অবস্থানের পর ভৈরবের তীর ধরে সুন্দরঘোনা পৌঁছান খান জাহান আলী। এই স্থানে এক নতুন শহরের পত্তন করেন তিনি, নাম দেন খলিফাতাবাদ। এরই বর্তমান নাম বাগেরহাট। তার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শহর। যাত্রাপথের প্রতিটি এলাকায় খান জাহান আলী ইসলাম প্রচার করেন ও একজন করে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। এভাবে তার অনুসারী বাড়তে থাকে।
খান জাহান আলীর আগমনকালে দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গা ছিল বনাঞ্চল। বন-জঙ্গল সাফ করে তিনি ও তার অনুসারীরা দক্ষিণবঙ্গকে বসবাসের উপযোগী করে তোলেন। পুরো দক্ষিণাঞ্চল একরকম তার রাজ্য ছিল। কোনো বাধা ছাড়াই এই এলাকা তিনি শাসন করতে থাকেন। জনগণও তার নেতৃত্ব মেনে নেয়। তবে আঞ্চলিক শাসক হলেও প্রকট শাসকসুলভ জীবনযাপন কখনোই করেননি খান জাহান আলী। স্বাধীন বাদশাহদের মতো তিনি চলতেন না। এমনকি নিজের নামে কোনো মুদ্রার প্রচলনও তিনি করেননি। এছাড়া গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের সময় তার সনদ নিয়ে দক্ষিণবঙ্গ শাসন করেছেন তিনি। খান জাহান আলীর মৃত্যুর পরে তার প্রতিষ্ঠিত খলিফাতাবাদেই গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক টাকশাল। পরবর্তী ৪০/৫০ বছর এই টাকশাল থেকেই বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা তৈরি হতো। বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ ছিল তার দরবারগৃহ। ষাট গম্বুজ মসজিদ হতে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ছিল খান জাহান আলীর বসতবাড়ি। এখন সেটির কোনো অস্তিত্বই নেই।
খান জাহান আলী তার দীর্ঘ শাসনামলে এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। প্রায় ২০/২৫টি গ্রাম নিয়ে তার রাজধানী খলিফাতাবাদ গড়ে উঠেছিল। এখানে তিনি থানা, কাচারি, বিভিন্ন সরকারী দফতর, বিচারালয়, সেনানিবাস ইত্যাদি নির্মাণ করেন। প্রশাসনিক সুবিধার্থে দক্ষিণবঙ্গকে তিনি ভাগ করেন কয়েকটি ভাগে, ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন সুশাসন। তার এই ছোটখাট রাজ্যে তিনি কায়েম করেন ইসলামী হুকুমত। খলিফাতাবাদ বা বাগেরহাট এলাকায় ইসলাম প্রচারের সময় স্থানীয় প্রভাবশালী হিন্দুদের বাধার সম্মুখীন হন খান জাহান আলী। তাদের বিরোধিতার কারণে ঐ এলাকার রণবিজয়পুর, ফতেহপুর, পিলঙ্গজ প্রভৃতি স্থানে হিন্দুদের সাথে যুদ্ধ হয় মুসলিমদের। খান জাহান আলী তাদের পর্যুদস্ত করে নিজের শাসনক্ষমতা কায়েম করতে সমর্থ হন।
প্রায় ৪০ বছর স্বাচ্ছন্দ্যে দক্ষিণবঙ্গে রাজত্ব করেন খান জাহান আলী। এই পুরো এলাকায় ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন এই মহান সাধক। তাঁর সুশাসন ও বিনয়ী স্বভাবে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে এই এলাকার মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। জীবনের শেষ দিনগুলো দরগায় বসে আল্লাহর ধ্যানে কাটিয়ে দিতেন তিনি। অনেক মূল্যবান বাণী তিনি দিয়ে যান নিজের প্রজ্ঞা ও সাধনালব্ধ জ্ঞান থেকে। এই মহান শাসক ও ধর্ম প্রচারক ৮৬৩ হিজরীর ২৬ জিলহজ্জ, ইংরেজি ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।
খান জাহান আলীর মাজার একটি পবিত্র স্থান। কিন্তু অন্যান্য মাজারের মতো একেও লোকজন সিজদার স্থান বানিয়ে ফেলেছে। কথিত মারেফতপন্থী সাধু-সন্নাসী ও ফকিরগণই মূলত এই সিজদা প্রথার প্রবর্তক। মাজার জুড়ে চলে একাধিক শিরকি কাজ-কারবার। মাজারের দিঘীতে থাকা কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড় নামক দুটি কুমীরের বংশধরেরা যুগ যুগ ধরে এখনও বাস করছে। লোকে মানত করার নামে এদের কাছে মুরগী-ছাগল ইত্যাদি খেতে দিয়ে যায়। এসব মানতের সামগ্রী নিয়ে মাজার সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু মানুষ করে চলেছে ব্যবসা।
চৈত্র মাসের পূর্ণিমায় এখানে খুব জাঁকজমকের সাথে মেলা বসে। এই মেলার উৎপত্তির কথা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেন না, তবে অনেকের মতে, পূর্ববর্তী একটি ঈসালে সওয়াব মাহফিল আজ এই মেলায় রূপান্তরিত। যে মানুষটি ইসলাম প্রচারের কাজে নিজের সারাটি জীবন ব্যয় করেছেন, এমনকি নিজের সংসার জীবন পরিত্যাগ করে যিনি ইসলামের সেবায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন, তার সমাধি ঘিরে বহু অশালীন ও ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের অন্যতম পথিকৃৎ হযরত খান জাহান আলী (র) এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হোক প্রতিটি সচেতন মুসলিম।
তথ্যসূত্র-
হযরত খান জাহান আলী: জীবন ও কর্ম- মোঃ মাসুম আলীম (প্রকাশকাল-২০০২, পৃষ্ঠা ৩৩-৫৬)