ইতিহাসের একটি বড় সময় অবধি দাসপ্রথা ছিল সামাজিক ও আইনীভাবে অনুমোদিত একটি সামাজিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় বাজারে মানুষের আনুষ্ঠানিক বেচাকেনা চলত এবং ক্রয়কৃত ব্যক্তি ক্রেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে কাজ করতে বাধ্য থাকত।
দাসপ্রথা সম্পর্কিত যেসব নথিপত্র পাওয়া যায়, তাতে প্রমাণ মেলে যে, বনেদি সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ও গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থার সাথে এ প্রথা সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিল। বাজারে মুক্ত শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর থাকায় সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি তাদের উৎপাদন ও প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণির লোকেদের দাসে রূপান্তর করত।
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বলছে, এখানে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল দীর্ঘদিনের। প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসনব্যবস্থাতেই তা ছিল। চাণক্যের অর্থশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্রে দাসপ্রথাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং এ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন বিধান করা হয়েছে।
প্রাচীনকাল হতে বাংলায়ও দাসপ্রথা প্রচলিত হয়ে আসছিল। মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেন যে, পাটালিপত্রের রাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব ক্রীতদাসীদের ওপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে দাসপ্রথা চালু থাকলেও বাংলায় কখনো স্থানীয় ব্যক্তিদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হতো না। ড.মোহাম্মদ মোহর আলি লিখেছেন:
বাংলায়, নিজের জন্মভুমির পুত্রকে দাসত্ব করে দেশের অন্য ব্যক্তির কাছে বিক্রি করার নজির কোথাও ছিল না ।
এ ধরনের ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, বাংলাতে শুধু বিদেশ থেকে ধরে আনা দাসদের বেচাকেনা হতো। স্থানীয় লোকজন কখনো দাস হিসেবে বিক্রি হতো না। তাদের এ অনুমানের বিপক্ষে রয়েছে জোরালো প্রমাণ!
দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত আইনজ্ঞ জীমূতবাহন দায়ভাগ-আইন লিপিবদ্ধ করেন। এ আইনে একাধিক মালিকের নিয়ন্ত্রণাধীন ক্রীতদাসীরা কীভাবে কাজ করবেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি লেখেন:
আমি দেখেছি অপূর্ব সুন্দরী সব দাসী বিক্রি হচ্ছে এক সোনার দিনারে, যা মরক্কোর মুদ্রামানে আড়াই দিনার। আমি নিজেও প্রায় সেই দামেই আশুরা নামের একজন দাসী কিনেছিলাম। সেও ছিল অপরূপা। আমার এক সঙ্গী দুই সোনার দিনারে লু লু নামে একজন অল্পবয়সী ক্রীতদাস কিনেছিলেন।
পর্তুগিজ ব্যবসায়ী বারবোসা বাংলায় দাসব্যবস্থা সম্বন্ধে নিম্নরূপ বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন:
মুসলিম বণিকরা দেশের (বাংলা) বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশীয় শিশু সন্তানদের (হিন্দু) তাদের পিতা-মাতা থেকে ক্রয় করতো, যাদেরকে তারা চুরি করে নিয়ে এসে নপুংসক করত। অনেকে এতে মারাও পড়ত। আর যারা বেঁচে থাকত, তাদের বিক্রি করা জন্য ভালোভাবে লালন-পালন করা হতো। এরপর একটা সময় তাদের বিক্রি করা হতো ২০-৩০ দিরহামে। পারস্যের অধিবাসীদের কাছে এদের আলাদা কদর ছিল। স্ত্রী এবং বাড়ির নিরাপত্তায় পারসিকেরা এই দাসেদের নিয়োগ দিত।
আবুল ফজল আইন-ই-আকবরীতে লিখেছেন যে, বাংলায় ঘোড়াঘাট এবং সিলেট সরকারে খোজাদের বেচাকেনা হতো। এ প্রসঙ্গে সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন :
হিন্দুস্তানে, বিশেষত সিলেট প্রদেশে, যা বাংলার একটি অংশ, লোকদের রীতি ছিল তাদের কিছু ছেলেকে নপুংসক বানানো এবং রাজস্বের পরিবর্তে রাজ্যপালকে দেওয়া। ডিক্রি দ্বারা এই প্রথা অন্যান্য প্রদেশে গৃহীত হয়েছে। এই অভ্যাসটি সাধারণ হয়ে উঠেছে। এই সময়ে, আমি একটি আদেশ জারি করেছি এই রীতিটি অনুসরণ করা উচিত নয় এবং তরুণ হিজড়াদের মূলত শাস্তি দেওয়া উচিত।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক দাবি করে থাকেন যে, বাংলায় দাসপ্রথা একটি প্রান্তিক সমস্যা ছিল। উপরন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীর খোজা করাকে নিষিদ্ধ করায় সমস্যা অত্যন্ত সীমিত হয়ে যায়। অনেকে ধারণা করেন যে, বাংলায় বেশির ভাগ দাস বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে।
পর্তুগিজদের মতো বিদেশি দস্যুরা কিছু বাঙালিকে ধরে নিয়ে দাস হিসেবে দেশের বাইরে বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালিদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হতো না- এমন অনুমান খুব বেশি ধোপে টেকে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশে দাস কেনাবেচার দলিল পাওয়া গেছে। দলিলগুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট, যেসব দাস বিক্রি করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিল স্থানীয় বাসিন্দা। এদের কাউকে বাইরে থেকে আনা হয়নি।
চন্দননগরে ফরাসিদের মহাফেজখানায়,সিলেট,হুগলি ও ত্রিপুরা জেলাতে দাস বিক্রয়ের দলিল পাওয়া গেছে। চার ধরনের ব্যক্তিকে বাংলায় দাস হিসেবে বিক্রি করা হতো :
- নিঃস্ব স্বাধীন ব্যক্তিসমূহ
- স্বাধীন ব্যক্তিদের উপর নির্ভরশীল শিশু (পুত্র ও কন্যা)
- যাদের দাস হিসেবে ক্রয় করা হয়েছে, তাদের পুনরায় বিক্রি করা
- দাসদের সন্তানসমূহ
ঐতিহাসিকদের মতে, বৃটিশদের শোষণমূলক কর-ব্যবস্থা ও খাদ্যশস্য রপ্তানির ফলে, ১৭৬৯-১৭৭৩ সালে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী দাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিরা স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে জমিদারদের কাছে বিক্রি করে দিত।
দাস মুখ্যত দু’ধরনের ছিল : গার্হস্থ্য ও কৃষিকার্যাধীন। কৃষিকার্যাধীন দাসের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। যেসব জেলায় বিশেষভাবে কৃষিনির্ভর দাস প্রথার প্রচলন ছিল, সেগুলি হচ্ছে সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা। আইন কমিশনের (১৮৩৯) প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব জেলায় প্রতি পাঁচ জনের একজনই ছিল দাস। বৃটিশ মিশনারি উইলিয়াম অ্যাডাম ১৮৩১ সালে লিখেছেন:
১৮০১ সালে ঢাকা জেলার মোট জনসংখ্যা গণনা করা হয়েছিল ৯৩৮৭১২ জন, এর অর্ধেক হিন্দু এবং অন্য অর্ধেক মুসলমান। এই জনসংখ্যার একটি অংশ দাসদের সমন্বয়ে গঠিত এবং দাসপ্রথায় ব্যক্তিদের বিক্রয় করা ছিল এই জেলা জুড়েই সাধারণ ঘটনা।
সাধারণ দাস বাজার থেকে ক্রয় না করে সরাসরি সামাজিক উৎস হতে কৃষিনির্ভর দাস সংগ্রহের রেওয়াজ ছিল। অভাব, দুর্ভিক্ষ, নদী ভাঙন, পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তির মৃত্যু প্রভৃতি কারণে বেঁচে থাকার তাগিদে দুর্যোগ-কবলিতদের দাসত্ব গ্রহণ করতে হতো। বাংলায় স্থানীয় লোকদের নিয়ে যে দাস ব্যবসা চলত, তার সমর্থন বাংলা সাহিত্যেও পাওয়া যায়। শ্রী শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত-তে লেখা হয়েছে:
নাহা লুহা লবণ বেচিবে ব্রাহ্মণে
কন্যা বেচিবেক যে সর্ব শাস্ত্র জানে।
মলুয়া কাব্যগ্রন্থে লেখা হয়েছে, “ফুলের ছেইল্যা বান্ধা দিয়া কিরষাণ খায় ভাত পানি”। অর্থাৎ, কৃষক তার ‘ফুলের মতো’ ছেলেকে বন্ধক দিয়ে ভাত-পানির ব্যবস্থা করে!
মানিক রাজার সঙ্গীতে বলা হয়েছে, “খাজনা তাপতে বেচায় দুধের ছাওয়াল”। অর্থাৎ, রাজস্বের দাবি পরিশোধের জন্য শিশু সন্তানদের বিক্রি করা হচ্ছে।
ওপরের দলিলসমূহ এবং সাহিত্যিক তথ্যসমূহ বিচার করলে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, বাংলায় স্থানীয় লোকেদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে। সিলেট জেলায় চাকরান ও নানকার ব্যবস্থা দাসব্যবস্থার স্মারক হিসেবে পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলায় জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন বিধিবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
আমাদের পাঠ্যবইয়ে বাংলার দাসপ্রথা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরা উচিত। বাংলার দাসপ্রথার ইতিহাস আমাদের ইতিহাসেরই অংশ।
আরো জানতে পড়তে পারেন এই বইটি- https://rb.gy/m0hmih