শাহজাদা মুস্তাফা (শেষ পর্ব): হত্যার দায় রুস্তম পাশা নাকি সুলতান সুলেমানের?

অভিযানের লক্ষ্য কী ছিল, শাহজাদা মুস্তাফা নাকি সাফাভিরা?

১৫৫৩ সালে সুলতান সুলেমান তার সৈন্য নিয়ে যখন ইস্তাম্বুল ছাড়লেন, তখন তার অভিযানের লক্ষ্য কী ছিল? সাফাভিদের সাথে যুদ্ধ করা নাকি শাহজাদা মুস্তাফাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা?

এর প্রকৃত উত্তর হচ্ছে, সুলেমানের পূর্বদিকের অভিযানটি কখনোই সাফাভিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মানসিকতা নিয়ে ছিল না। কেননা এর আগে যখন রুস্তম পাশার নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল, তখন উদ্দেশ্য ছিল- সাফাভিদের সাথে যুদ্ধ না করে শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করা।

এরপর সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে যখন সৈন্যরা আবারো অভিযানে যায়, তখনও উদ্দেশ্য একই ছিল। তবে অভিযানে সবচেয়ে গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যা করা। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন, যদি জেনেসারিরা একবার শাহজাদাকে সুলতান হিসেবে বসানোর পরিকল্পনা গোপন থেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে, তাহলে তার সিংহাসন বালির বাঁধের মতো ভেঙে পড়বে।

সুলেমানের মনের আরো ভয় ছিল যে, জেনেসারিরা তাকে মুস্তাফার হাতে সিংহাসন তুলে দেওয়ার জন্যও বাধ্য করতে পারে, যা এর আগে তার বাবা সুলতান প্রথম সেলিমের হয়ে জেনেসারিরা করেছিল। তার মনে ভয় ছিল, একই ধরনের কাজ তার সাথেও হতে পারে। এ কারণে সুলতান সুলেমান শাহজাদা মুস্তাফাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

নাহচিভান অভিযানে সুলতান সুলেমান খান; Image Source: Ottoman Picture

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অটোমান সৈন্যরা কখনোই সাফাভিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। প্রত্যেক অভিযানই প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কঠিন হয়েছে। পাহাড়ি ভূমির কারণে অটোমানদের অনেক ক্ষতিও হয়েছে।

১৫১৪ সালের চালদিরানের যুদ্ধের পর অটোমানরা সাফাভিদের বড় কোনো ধাক্কা দিতে পারেননি। বরং অটোমানরা যা দখল করেছে, তা আবারো সাফাভিদের হাতে চলে গেছে। আর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অটোমান সেনারা সাফাভিদের চেয়ে হাঙ্গেরির সাথে যুদ্ধ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো।

এই কারণে সুলতান সুলেমান যুদ্ধের চেয়ে শান্তিচুক্তি করার জন্যই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। রুস্তম পাশার নেতৃত্বে যে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল, সেখান থেকে শাহ তামাস্পকে সেই বার্তাই দেওয়া হয়েছিল। ইরানের শাহ নিজেও শান্তিচুক্তি চেয়েছিলেন, যাতে দুই সাম্রাজ্যের একটি স্থায়ী সীমানা নির্ধারিত হয় এবং উভয়পক্ষ লাভবান হয়।

রুস্তম পাশা যখন অভিযানে বের হন, শাহ তামাস্প তখন বিগা মাহমুদ বে নামে এক অটোমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে তার হাতে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেন। এই চিঠিতে তিনি শান্তিচুক্তি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জবাবে সুলতান সুলেমান এবং উজিরে আযম রুস্তম পাশা তাদের যথাযথ প্রতিনিধি প্রেরণের কথা বলেন।

তখন শাহ তামাস্প তার দূত সাইয়্যেদ শামস আল-দীন দিলিজানিকে পাঠান। তিনি ১৫৫৩ সালের ১৯ আগস্ট ইস্তাম্বুল এসে পৌঁছান। সুলতান সুলেমান তখনও অভিযানে বের হননি। তবে অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া তখন শেষ। যদি সুলতান সুলেমানের অভিযানের একমাত্র উদ্দেশ্য হতো সাফাভিদের সাথে শান্তিচুক্তি করা, তাহলে তার আর অভিযানে বের হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

ইরানের শাহ তামাস্প; Image Source: Pixels

কেননা ইতোমধ্যে তামাস্পের দূত ইস্তাম্বুলে হাজির। তার আসার নয় দিন পর ২৮ আগস্ট সুলেমানের সৈন্য ইস্তাম্বুল ছাড়েন। দূতকে বলা হয় তিনি সুলতানের জবাব অভিযান চলাকালীন পেয়ে যাবেন।

পথে রুস্তম পাশা এবং শামস আল-দীনের মধ্যে শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। পরবর্তীতে দূতকে ছেড়ে তামাস্পের কাছে ফেরত পাঠানো শান্তিচুক্তির বিষয় সম্মতি জানিয়ে। তবে তা ছিল শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যার পর।

এখান থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, সুলতান সুলেমানে উদ্দেশ্য যদি সাফাভিদের বিরুদ্ধ শুধুমাত্র যুদ্ধ হতো, তাহলে তিনি প্রথমেই চিঠি এবং দূত উভয়ই প্রত্যাখ্যান করতেন। তাই এই অভিযানে সুলতান সুলেমানের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মুস্তাফাকে হত্যা করা। এরপরের উদ্দেশ্য ছিল তামাস্পের সাথে শান্তিচুক্তি করা। সেটি যদি না-ও হতো, সুলেমানের তা নিয়ে মাথাব্যথা থাকতো না।

সুলেমান তার মুখ্য উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য তামাস্পের দূতকে মুস্তাফাকে হত্যার পর ছেড়েছেন। কেননা যদি তাকে আগে ছাড়া হতো, তাহলে মুস্তাফার কাছে অবশ্যই খবর পৌঁছে যেত, তার বাবা তাকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই অভিযানে এসেছেন! তখন সুলেমান চিরতরে সেনাদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতেন।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, যদি অভিযানের উদ্দেশ্য মুস্তাফাকে হত্যা করাই হয়, তাহলে সুলেমান সেই সিদ্ধান্ত কখন নিয়েছিলেন? এ বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি।

অনেকের মতে সুলেমান এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য এবুসুদ এফেন্দির কাছে থেকে মতামত নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অটোমানদের বিচারিক প্রধান। তবে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

এবুসুদ এফেন্দি; Image Source: devletialiyyei.com

যদি সুলেমান অনেক আগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তা হলে তিনি তা একেবারেই গোপন রেখেছিলেন। আর দুই একজন যারা জানতেন, তারা সুলতানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যার ফলে শাহজাদার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। আবার অনেকে মনে করেন ঘটনার আগের দিন উজিরদের শাহজাদা মুস্তাফার সাথে দেখা করার মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।

এমনকি সুলেমানের সাথে দেখা করার পর শাহজাদাদের উপহার দেওয়া হতো। সেদিন মুস্তাফার জন্য উপহারও ঠিক করা ছিল। পরবর্তীতে সেই উপহার রাজকোষে জমা হয়। এতে বোঝা যায়, সুলতান সুলেমান শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যা করার জন্য খুব স্বাভাবিক একটি পরিস্থিতি বেছে নিয়েছিলেন; যেখানে জেনেসারিরা একবার আন্দাজও করতে পারেনি, তারা সেখানে থাকার পরও এমন কোনো কাজ হতে যাচ্ছে।

শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যার জন্য দায়ী কে, রুস্তম পাশা নাকি সুলতান সুলেমান?

শাহজাদা মুস্তাফার মৃত্যুদণ্ডের খবর জেনেসারিসহ সকল সৈন্যদের কাছে চরম এক শোক ছিল। যারা মুস্তাফাকে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের ভবিষ্যত সুলতান হিসেবে মনে করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে, তারা এই ঘটনা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। শাহজাদার প্রতি জেনেসারিদের ভালোবাসা সুলতান সুলেমানের চেয়েও বেশি ছিল। ফলে তাকে হত্যার পর দীর্ঘদিন সেনারা বিষণ্ণ ছিলেন।

হত্যার পরপরই জেনেসারি এবং আরো অনেক সেনা সুলতান সুলেমান এবং রুস্তম পাশার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। তবে সেনারা অপরাধী হিসেবে রুস্তমকে দায়ী করেছিল। যে কারণে তাকে হত্যা করার জন্য তার তাবুতে আক্রমণ চালানো হয়।

রুস্তম তখন রাতের আঁধারে সৈন্য শিবির ছেড়ে ইস্তাম্বুল পালিয়ে আসেন। কারণ তিনি যদি সেখানে থাকতেন তাহলে নির্ঘাত মৃত্যুবরণ করতে হতো।

উজিরের আযম রুস্তম পাশার চক্রান্তে হত্যার শিকার হন শাহজাদা মুস্তাফা; Image Source: Muhtesem Yuzyil

শাহজাদা মুস্তাফার মৃত্যু ঘিরে যে ক্ষোভ, তা প্রশমন করার জন্য তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়৷ এতে জেনেসারিরা কিছুটা শান্ত হলেও শীঘ্রই মুস্তাফাকে ঘিরে যে ভালোবাসা তা কাব্যে স্থান পায়। তাকে নিয়ে শোকগাথা রচনা করেন অনেক কবি। যেখানে সুলতান সুলেমান এবং রুস্তম পাশাকে সমালোচনা করা হয়।

শাহজাদা মুস্তাফাকে নিয়ে যে কয়েকজন কবি শোকগাথা লিখেছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন ইয়াহিয়া বে। যিনি ‘তাসলিজালি ইয়াহিয়া’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন জেনেসারি সদস্য। বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধের ময়দানে কাব্য রচনা করে সেনাদের মাঝে তা বিলি করতেন।

ইয়াহিয়া বে তার কবিতায় শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যার জন্য সরাসরি রুস্তম পাশাকে দায়ী করেন। তিনি রুস্তম পাশাকে ‘চক্রান্তের শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করেন। সেই সাথে শাহজাদা মুস্তাফার সিলমোহর দিয়ে তামাস্পের কাছে পাঠানো চিঠি যে রুস্তমেরই ষড়যন্ত্রের অংশও সেটা তুলে ধরেন।

ইয়াহিয়া বে, যিনি তাসলিজালি ইয়াহিয়া নামে অধিক পরিচিত; Image Source: Rallife

এসবের পর একটি প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যার জন্য দায়ী কে? এর উত্তর হচ্ছে সুলতান সুলেমান ও রুস্তম। হুররাম সুলতান কেন দায়ী নন, সে বিষয়ে পরবর্তীতে আসা হবে। আর রুস্তম নিজে সুলেমানের কাছে অনুরোধ করেছিলেন তাকে পদ থেকে সরিয়ে দিতে। তার জীবন রক্ষার্থে এই সিদ্ধান্ত খুবই জরুরী ছিল।

ধারণা করা হয়, তখন সুলেমান ও রুস্তমের মধ্যে কোনো চুক্তি হয়েছিল। যে চুক্তি অনুসারে তারা উভয় একে অপরকে সাহায্য করবে৷ কারণ শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যা করার পর সুলতান যে একেবারে নির্ভার ছিলেন তা কিন্তু নয়।

জেনেসারিদের তার উপর আক্রমণ করার ক্ষমতা ছিল। সৈন্যরা প্রকাশ্যে চিৎকার করে সুলতানকে ব্যাঙ্গ করতেন। তিনি নিজ কানে শুনলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখাননি।

বুরসায় শাহজাদা মুস্তাফার মাজার; Wikipedia Commons

এছাড়া সুলেমান তখন সাফাভিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বের হয়েছেন। সাফাভিদের চাপ দেওয়ার জন্য সৈন্যদের আনুগত্য প্রয়োজন ছিল। যে কারণে তিনি রুস্তমকে প্রাথমিকভাবে পদ থেকে সরিয়ে দেন।

তবে একসময় সুলতান সুলেমানকে রুস্তমের পাপাচার সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তখন তিনি সেনাদের কাছে শাহজাদা মুস্তাফার মৃত্যুদণ্ডের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন।

এদিকে রুস্তমকে উজিরের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও তার সম্মান ও ক্ষমতার কোনোটাই পরিবর্তিত হয়নি। ৩১ অক্টোবর ১৫৫৩, ইস্তাম্বুলে ফিরে রুস্তম আগের মতোই রাজকীয় জীবনযাপন কাটাতে থাকেন। আগের মতোই তিনি বিদেশি দূতদের সাথে আলোচনা করতেন। যদিও তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ ছিল না।

রুস্তম পাশার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন সুলতান সুলেমান; Image Source: Muhtesem Yuzyil

রুস্তম পাশার সাথে সুলতান সুলেমানের হাত মেলানোর আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ১৫৫৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, সুলতান সুলেমান অভিযান থেকে রাজধানীতে ফেরেন। রাজধানীতে ফেরার দিনই সুলেমান কারা আহমেদ পাশাকে সরিয়ে রুস্তম পাশাকে উজিরে আযমের পদে পুনর্বহাল করেন।

এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার সুলতান সুলেমান শাস্তি হিসেবে রুস্তম পাশাকে বরখাস্ত করেননি। বরং তিনি জেনেসারিদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য সাময়িক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নয়তো রুস্তম পাশার স্বপদে ফেরার সম্ভাবনা কোনোভাবেই ছিল না।

সুলতান সুলেমান রুস্তম পাশার মাধ্যমে প্ররোচিত হয়েছেন- তা ঠিক। কিন্তু তিনি নিজেও মুস্তাফাকে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেই হত্যা করেছেন। বলা যায়, রুস্তমদের ষড়যন্ত্রের চেয়ে জেনেসারিদের শাহজাদার প্রতি ভালোবাসাই সুলেমানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। নিজের সিংহাসন ধরে রাখার জন্য তিনি একজন যোগ্য এবং অনুগত শাহজাদাকে হত্যা করেছেন।

এবার আসা যাক, হুররাম সুলতানের বিষয়ে। হুররাম সুলতানকে কোনোভাবেই অপরাধী বলা যায় না। কারণ অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ম অনুসারে একজন শাহজাদা সিংহাসনে বসবেন। আর বাকিদের মৃত্যুবরণ করতে হবে। সেই হিসেবে মা হিসেবে হুররামের দায়িত্ব ছিল তার কোনো সন্তানকে সিংহাসনে বসানোর ব্যবস্থা করা। তাদের যোগ্য করে তোলা এবং তাদের সাহায্য করা।

সুলতান সুলেমানের সাথে হুররাম সুলতান; Image Source: Muslim Heritage

যদি তিনি বেঁচে থাকাকালীন কোনো সন্তান সিংহাসনে বসার সুযোগ পেতেন, তাহলে হুররাম অন্য সন্তানদের বাঁচানোর চেষ্টা করতেন বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু তার এই পরিকল্পনার পথে বাধা ছিলেন শাহজাদা মুস্তাফা৷ তাই নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে যে ষড়যন্ত্র করেছেন তা একদিক থেকে ঠিক৷ মা হিসেবে তার সন্তানদের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করা তার কর্তব্য ছিল।

কিন্তু সুলেমান ছিলেন মুস্তাফা এবং হুররামের চার সন্তানের বাবা। তার উচিত ছিল আরো বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া, সাম্রাজ্যের স্বার্থে সন্তানের সাথে আলোচনা করা।

মুস্তাফার বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা বিদ্রোহের কোনো নজির ছিল না। সুলেমানের প্রতি তার আনুগত্যেরও কমতি ছিল না। কিন্তু সুলেমান সেই আনুগত্য অনুধাবন না করে ষড়যন্ত্রে প্রলুব্ধ হয়ে এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য শাহজাদা মুস্তাফাকে হত্যা করেন।

অটোমান সাম্রাজ্যের উপর প্রভাব

শাহজাদা মুস্তাফা সিংহাসনে বসতে পারলে অটোমান সাম্রাজ্য আরো কতদূর এগিয়ে যেতে পারত- সেই প্রশ্নের জবাব এখন আর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তার দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে অনুমান করাই যায় যে, তিনি তার পিতার মতোই সফল হতেন, কিংবা তাকে ছাড়িয়েও যেতে পারতেন। কিন্তু সেসব সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

তবে তার মৃত্যুর পর অটোমান সাম্রাজ্যের অভাবনীয় এক ক্ষতি হয়ে যায়৷ তা হলো সুলতান সুলেমানের যোগ্য উত্তরসূরির অভাব৷ শেষ পর্যন্ত সিংহাসনের দাবিদার ছিলেন বায়েজিদ ও সেলিম। যোগ্যতার দিক থেকে বায়েজিদ এগিয়ে ছিলেন।

বায়েজিদের মুস্তাফার মতো পিতার প্রতি অগাধ আনুগত্য ছিল না৷ তিনি সুলেমানকে উৎখাত করে সিংহাসনে বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুস্তাফার প্রতি যেমন জেনেসারি এবং অভিজাতদের সমর্থন ছিল, বায়েজিদের প্রতি তেমন সমর্থন কারুর ছিল না৷

সুলতান সুলেমানের আদেশে বায়েজিদকে হত্যা করেন শাহজাদা সেলিম; Image Source: Revolvy

সুলতান সুলেমান শেষ দিকে এসে সিংহাসনে থেকেও সাম্রাজ্যের পরিচালনার দিক থেকে সরে আসেন। তিনি নিজের উপর চাপ কমিয়ে উজিরদের মাধ্যমে সাম্রাজ্য পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তখন উজিররা সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যারা উজিরে আযম হন, তাদের উদ্দেশ্য থাকে অযোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে পেছন থেকে রাজ্য পরিচালনা করা।

সুলতান সুলেমানের শেষ সময়ে এসে ঠিক তাই হয়েছিল। সর্বশেষ যোগ্য শাহজাদা বায়েজিদকে সুলেমানের পরোক্ষ আদেশে হত্যা করেন সেলিম। তখন আর সেলিমের কোনো বাধা ছিল না। তাই তার বাবাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করার প্রয়োজন হয়নি৷ সুলতান সুলেমানের মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন।

সুলতান সুলেমানের উত্তরসূরি সুলতান দ্বিতীয় সেলিম; Image Source: Wikipedia Commons

সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের সিংহাসনে বসার মধ্যে দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের বীজ বপন হয়। এর পরও প্রায় ৩০০ বছর অটোমান সাম্রাজ্য টিকে থাকলেও তাদের প্রবল প্রতাপ ক্রমশই হারিয়ে যেতে থাকে।

তবে সুলতান হিসেবে শাহজাদা মুস্তাফার নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে না। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে যদি মুকুটহীন সুলতান থেকে থাকেন, তবে তিনি মুস্তাফা! সুলতান না হয়েও সমপরিমাণ মর্যাদা নিয়ে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন শাহজাদা মুস্তাফা। 

This article is in Bangla language. It is about Shehzade Mustafa, Son of Ottoman Sultan Suleiman The Magnificent.

Featured Image Source: Magnificent Century (Muhteşem Yüzyıl)

References:  

1. ResearchGate  

2. The Ottoman Centuries by Lord Kinorss 

Related Articles

Exit mobile version